সাঁঝের প্রেম

সাঁঝের প্রেম !! Part- 04

নিশি নিজেকে সামলাতে না পেরে মাহবুবকে কল করে ফেলল। নিশি আশা করেনি যে ফোন রিং হবে। ফোন রিং হওয়ার শব্দ শুনে নিশির বুক কাঁপছে। চারবার রিং হওয়ার পর ফোন রিসিভ হলো। নিশি তখন ফ্লোরে বসে পরলো ফোনটা কানে নিয়ে।

-হ্যালো! কে বলছেন? (মাহবুব)
-নিশি চুপ করে ফোঁপাচ্ছে।
-তিনটা বছর পর কি মনে করে? (দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহবুব)
-নিশি চমকে গেলো মাহবুবের কথা শুনে।
-চমকানোর কিছু নেই মিস নিশি। হয়ত ফোন নাম্বারটা পাল্টেছেন বাট নিঃশ্বাসের শব্দ কি পাল্টাতে পেরেছেন? আপনাকে চেনার জন্য আমার ওইটুকুই যথেষ্ট! (সোফায় বসে মাহবুব)
-কেমন আছো? (কেঁদে কেঁদে নিশি)
-হ্যা খুব ভালো। যতটা ভালো থাকা উচিৎ ছিল না ঠিক ততটাই ভালো আছি। আপনি কেনো ফোন দিয়েছেন জানতে পারি? (মুখের ঘাম মুছে মাহবুব)
-কোথায় তুমি?
-আহহহ! আমার কোনো নিউজ আপনাকে জানাতে আমি বাধ্য না মিস নিশি, বাধ্য না। (দেয়ালে আঘাত করে মাহবুব)
-বিয়ে করে ফেলেছো?
-কেন? সেকেন্ড বউ হয়ে আসার ইচ্ছা আছে নাকি?
-ও! তার মানে বিয়ে করে ফেলেছো! (উঠে দাঁড়িয়ে নিশি)
-পারবর্তী ছেড়ে চলে গেছে বলে তো দেবদাস হয়ে থাকা যাবেনা তাইনা?
-কথার স্টাইল আজো পালটায় নি তাইনা?
-পাল্টাবেনা তো। যাইহোক মাই ওয়াইফ ইজ ওয়েটিং ফর মি! আই হ্যাভ টু গো নাও। (চোখের পানি মুছে মাহবুব)
-ওহ শিউর!

কথাটা বলেই নিশি ফোন কেটে দিয়ে দেয়ালের সাথে হ্যালান দিয়ে কাঁদতে শুরু করে। মাহবুব ও ফোন টা আছাড় মেরে ভেঙ্গে টাইটা ঢিলে করে মাথায় হাত দিয়ে সোফার উপর বসে। এইদিকে নিশি কাঁদছে আর ওইদিকে মাহবুব। নিশি কান্নার এক পর্যায়ে বলে,

-ও তো এখন সুখে আছে। আমি আর কাঁদবো না ওর জন্য। আর কখনো ভাববো না ওর কথা। আজ থেকে মাহবুব শেষ আমার জীবন থেকে।

নিশি উঠে ডায়েরিটা ছিঁড়তে গেলো কিন্তু পারলো না। মাহবুবের ছবিটা হাতে নিয়ে নিশি আবারো কান্না জুড়ে দেয়। সারারাত দুজনেরই কাঁদতে কাঁদতে শেষ হলো। পরেরদিন নিশি ফ্ল্যাটটা সুন্দর করে গোছালো আর নিজের কিছু জামাকাপড় ধুয়ে ইস্ত্রি করলো। মাহবুব বিয়ে করেছে শোনার পর থেকে নিশির বুকটা খা খা করছে কিন্তু বাস্তব মানতে হবে। নিশি এইটা মেনেই নিজেকে শক্ত করে নিয়েছে। সুখে থাকুক মাহবুব, ভালো থাকুক। নিশি সেদিন একবেলা খেয়েছে মাত্র তাও নুড়ির জোরাজুরিতে। পরেরদিন সকাল আটটায় নিশির অফিস। অফিসের গাড়ি এসে নিশিকে বাসার সামনে থেকে নিয়ে যাবে। নিশি নুড়ির দায়িত্বে সব রেখে সকালে বেরিয়ে যায়। যেতে যেতে অনেক কথাই ভাবে কিন্তু সেসব ভাবনা এখন অর্থহীন। অফিসের প্রথম দিন থাকায় নিশিকে সবাই ওয়েলকাম জানায়। নিশির কেবিনে গিয়ে নিশি বসে প্রথমে ফাইল চেক করে। নিজেকে সম্পূর্ণ কাজের মধ্যে ডুবিয়ে দেয় নিশি। তাও যে মাথা থেকে বের হচ্ছেনা মাহবুবের স্মৃতি। রাতের বেলা পাহাড়ি এলাকা ঘুরে নিশিকে বাসায় দিয়ে যায় অফিসের গাড়ি৷ নিশি বাসায় ঢুকে নুড়িকে দিয়ে কফি বানিয়ে নুড়িকে চলে যেতে বলে। এরপর নিশি একটু রেস্ট নিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে ডিনার করে তুর্না আর মায়ের সাথে কথা বলে। এইভাবে নিশির দিন কেটে গেলো নয়দিন। দশদিনের দিন কেনো যেনো নিশি অফিসে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে। আটটা বাজার দশ মিনিট আগেই বাইরে এসে দাঁড়ায়। চারদিকে পাহাড় আর মাঝখানে নিশির ফ্ল্যাট। জায়গাটা অদ্ভূত সুন্দর আজ নিশি সেইটা খেয়াল করলো। গাড়ি আসার পর নিশি হাসিমুখে না গেলেও মন প্রফুল্ল রেখে অফিসে ঢুকলো। কলিগদের সাথে টুকটাক কথা বলে নিশি নিজের ডেস্কে বসলো। তখন ম্যানেজার এসে বলল,

-নিশি ইউনাইটেড ব্যাংক থেকে আজকে রিপ্রেজেনটেটিভ আসবে। আমি তো থাকব না দুপুরে। তাই আমি দায়িত্ব টা তোমার উপর দিয়ে গেলাম। তুমি ওনাদের সাথে কথা বলো আর সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিও। উনারা আমাদের নতুন ক্লায়েন্ট।
-ওকেহ স্যার। আমাকে ডিটেইলস গুলো দিয়ে যাবেন।
-আচ্ছা আমি তোমায় ফাইল পাঠিয়ে দিচ্ছি।
-ওকে স্যার আই উইল ম্যানেজ।

নিশি ফাইলগুলো দেখে দুপুরের জন্য প্রিপারেশন নেয়। লাঞ্চের পর ইউনাইটেড ব্যাংক থেকে ব্যাংকার রা আসার পর এমডি নিশিকে ডেকে পাঠায়। নিশি এমডির কেবিনে পার্মিশন নিয়ে ঢুকে। নিশির গলায় “May I come in Sir” শোনার পর একজন রিপ্রেজেনটেটিভ সাথে সাথে পেছনে ঘুরে তাঁকায়। নিশি আর ওই লোকটা দুজনেই থ হয়ে যায়। সে আর কেউ না মাহবুব ছিল! মাহবুব সামনে ঘুরে বসে। নিশি আস্তে আস্তে হেঁটে এমডির সামনে এসে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,

-স্যার ডেকেছেন? (নিশি কাঁপছে)
-হ্যা। ম্যানেজার তো নেই তাই দায়িত্ব টা আপনার। ওনারা তিনজন ইউনাইটেড ব্যাংকের রেপুটেড ব্যাংকার। আমাদের নতুন ক্লায়েন্ট ইউনাইটেড ব্যাংক। উনি মিস্টার আশরাফ, উনি আয়ুশ আর উনি মিস্টার মাহবুব।
-হ্যালো! (নিশি তড়তড় করে ঘামছে)
-হাই! (আয়ুশ এবং আশরাফ)
-মিস্টার মাহবুব আপনারা নিশির সাথে যে কোনো বিষয় নিয়ে আলাপ করতে পারেন। নিশি তোমার কেবিনে নিয়ে যাও ওনাদের।
-প্লিজ কাম। (নিশি)

মাহবুব একবারের জন্য ও আর নিশির দিকে তাঁকায় নি। নিশির কেবিনে গিয়ে মাহবুব বসলো আর বিপরীত পাশে নিশি। নিশি পানি খাচ্ছে আর মাহবুব নিচের দিকে তাঁকিয়ে আছে।

-মিস্টার আশরাফ কি জানতে চান বলুন। (নিশি কাঁপা গলায়)
-মিস নিশি আপনার অফিসের ডেকোরেশন টা আপনার মতই সুন্দর। পছন্দ হয়েছে আমাদের। (আশরাফ)
-আশরাফের কথা শুনে রাগী লুক নিয়ে তাঁকায় মাহবুব আশরাফের দিকে।
– স্যার এনি প্রবলেম? (আয়ুশ)
-আশরাফ ইউ জাস্ট ক্রস ইউর লিমিট। কাজের কথা বলো। (ধমক দিয়ে মাহবুব)
-স্যরি স্যার।

প্রায় দুই ঘণ্টা কথা বলার পরও নিশির সাথে একটাও কথা বলেনি মাহবুব। নিশি যে কতটা শান্তি পাচ্ছে মাহবুবকে দেখে। অনেক পালটে গেছে ও! রোগা হয়ে গেছে প্রায়। তবে স্মার্ট আছে আগের মতই। চোখের ভাষা পালটে গেছে। সবাইকে বাই জানিয়ে মিটিং শেষ করে নিশি। মাহবুব চেয়ার থেকে উঠতেই পারছিলো না। কেনো যেন শরীর টা অসার হয়ে আসছে। নিশি মাহবুবের দিকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দেয়। মাহবুব ঢকঢক করে পানিটা খেলো এরপর নিশির চোখের দিকে একবার তাঁকিয়ে উঠে আসলো সেখান থেকে। নিশি টেবিলে মাথা নিচু করে শুয়ে পরলো। হয়ত হার্ট এটাক করে এখনি মারা যাবে নিশি। কিন্তু ওকেও তো মাহবুবের মতো ভালো থাকতে হবে, নিজেকে সামলাতে হবে এখন। মাহবুব চলে যাওয়ার পর পেপারস গুলোতে মাহবুবের সাইন গুলো বারবার দেখছে নিশি। মাহবুব কে দেখে ওর মনটা যতটা আনন্দে ভরে গেছে তার চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে। এত কাছে পেয়েও ওকে একটাবার ছুঁতে না পারার কষ্ট যে কি!

মাহবুব ও ভাবেনি নিশি চিটাগং আছে। সব ছেড়ে মাহবুব চিটাগং চলে এসেছিলো। এখানেও নিশি থাকলে ওর স্মৃতি ভুলবে কিভাবে? মাহবুব সেদিন বাসায় এসে সব ভাঙচুর করে। শুধু নিশি নিজেকে সামলে রেখেছে। মাহবুবের পরিবর্তন গুলো শুধু ভাবছে নিশি। একটা মানুষ কতটা পালটে যায় তাইনা? মাহবুব আর কখনো নিশির অফিসে যায়নি। খুব প্রয়োজনে গেলেও নিশির সাথে কথা বলেনি।

এক শুক্রবার,

নিশির অফিস ছুটি। তাই নিশি ভেবেছে আজকে একটু বের হবে। পাহাড়ে গিয়ে একটু মনটা রিফ্রেশ করবে। তাই নিশি লাঞ্চ করেই বেরিয়ে যায়। পরনে থ্রি পিস আর স্লিপার আর চুলগুলো তুলি দিয়ে ঝুটি করা। মুখে হালকা মেকাপ আছে। হেলতে দুলতে নিশি ছোট্ট একটা টিলার উপর উঠে। সেখান থেকে প্রকৃতিটা দেখে আবার নিচে এসে ঢালু জায়গা বেয়ে হাঁটতে শুরু করে নিশি। এই চিটাগং এ কত স্মৃতি মাহবুব আর নিশির। শুরুটা পূর্ণতা পায় এখান থেকে আর শেষের পূর্নতাও হয়ত এখানেই পাবে। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে নিশি হঠাৎ করে খাঁদে পা দিয়ে ফেলে। পরে যাওয়ার আগেই নিশির হাত ধরে মাহবুব। মাহবুবকে দেখে ভূত দেখার মতই চমকে যায় নিশি।

-ঠিকমতো চলতে পারলে চলবেন নচেৎ বের হওয়ার দরকার নেই। (নিশির হাত ছেড়ে মাহবুব)
-তুমি এখানে? (অবাক হয়ে নিশি)
-আমারো একই প্রশ্ন আমার বাড়ির সামনে আপনি কেনো?
-কোনটা তোমার বাড়ি?
-এইটাই আমার বাড়ি। (আঙুল দিয়ে দেখিয়ে মাহবুব)
-তুমি বানিয়েছো?
-হ্যা আমার বউয়ের পছন্দে।
-বাহ! তোমার বউয়ের পছন্দ আমার পছন্দের সাথে অনেক মিল।
-হতে পারে।

ওইটুকু বলে মাহবুব চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় তখন নিশি পেছন থেকে বলে,

-একবার কি সেই ভাগ্যবতীকে দেখাবেনা যে তোমার মত স্বামী পেয়েছে?
-কাউকে দেখানোর বস্তু ও নয়।

মাহবুব চলে যায় ওর বাড়িতে। নিশি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সেখান থেকে চলে আসে। মাহবুবের বাড়ি আর নিশির বাড়ি বেশি দূরে না। হেঁটে গেলে আধা ঘণ্টার দূরত্বে দুজনের বাসা। নিশি সেইদিন সন্ধায় ওর হাতটা ধোয় নি পর্যন্ত কারণ এতে মাহবুবের ছোয়া আছে। বারবার নিশি হাতটা বুলিয়েছে। কতটা ভালো লাগা কাজ করছিলো তখন যখন মাহবুব ওকে ছুঁয়েছিলো। এখন যে ওর ছোঁয়া অন্যকেউ পায়, ওর আদরের ভাগীদার যে এখন অন্য কেউ।

চলবে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *