সত্য ঘটনা অবলম্বনে গল্প: বহ্নিশিখা
মঞ্জুর চৌধুরী, ডালাস (যুক্তরাষ্ট্র) থেকে
(একটি গাছ কীভাবে বহু বছর পুরোনো খুনের মামলার প্রধান সাক্ষী হয়ে একটি হত্যা মামলায় ন্যায়বিচার পাইয়ে দিল, তা নিয়ে গত ১৬ ডিসেম্বর প্রথম আলোর দূর পরবাস বিভাগে ‘বৃক্ষের সাক্ষ্য’ গল্পের মাধ্যমে পাঠকদের পরিচয় করে দিয়েছিলাম ডিটেকটিভ আজিজ ভাইয়ের সঙ্গে। তাঁর কাছ থেকে শুনে লিখেছিলাম গল্পটি। সেটিও ছিল সত্য ঘটনার ওপর আধারিত। আজ আজিজ ভাইয়ের আরেকটি সত্য গল্প নিয়ে পাঠকদের কাছে হাজির হলাম।) সাদা ধবধবে শার্ট ও আকাশি রঙের ট্রাউজারে অবসরপ্রাপ্ত হোমিসাইড ডিটেকটিভ (শিকাগো পিডি, ডালাস পিডি ও পরবর্তী সময়ে প্রাইভেট) আজিজ ভাইকে বেশ হ্যান্ডসাম লাগছে। তিনি এমনিতেই সুপুরুষ। ছয় ফুটের কাছাকাছি লম্বা। সুঠাম দেহের অধিকারী এক বয়োজ্যেষ্ঠ। মাথার চুলে পাক ধরেছিল বহু যুগ আগে। এখন পুরো মাথায় ধূসর চুলের রাজত্ব। তবে এই বয়সেও তাঁর চুল বেশ ঘন। ব্যাকব্রাশ করে চুল আঁচড়ান। গালভর্তি চাপ দাড়ি। প্রতি সপ্তাহেই ট্রিম করেন। কোনো অবস্থাতেই আধা ইঞ্চির বেশি বাড়তে দেন না। দাড়িতে হয়তো তিনি রং মাখেন। কারণ তাঁর দাড়ি থাকে কুচকুচে কালো। ধূসর চুল এবং কালো দাড়িতে তাঁকে খুবই সুন্দর মানায়। বাংলাদেশের বিখ্যাত অভিনেতা ও বর্তমানে রাজনীতিক আসাদুজ্জামান নূরের সঙ্গে তাঁর চেহারার দারুণ মিল আছে। আজিজ ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় বহুদিনের। এক দশক হয়ে গেল। পরিচয়ের ঘটনাটাও ছিল বেশ নাটকীয়। সেটা পরে একদিন বলা যাবে। আপাতত ভিন্ন একটি গল্প বলা যাক। যে গল্পে খুন আছে। জখম আছে। রহস্য আছে। প্রথম পরিচয়ের গল্প সেই তুলনায় অনেক পানসে। কোনো পাঠকই পড়তে আগ্রহী হবেন না।
আমার অ্যাপার্টমেন্টে আজিজ ভাই একদিন বেড়াতে এলেন। তত দিনে আমার নতুন সংসার হয়েছে। বউ দেশ থেকে চলে এসেছে এক বছর হলো। সে ব্যাংকে চাকরি পেয়েছে। আমিও মোটামুটি জুতসই একটি চাকরি জোগাড় করে ফেলেছি।একটি একটি ইট গেঁথে আমরা সংসার গড়ছি। স্বপ্ন দেখছি নতুন বাড়ি কেনার। তার আগে নতুন গাড়ির। বর্তমান গাড়িটা বেশ পুরোনো হয়ে গেছে। কয়েক মাস পরপর নানা বাহানায় গ্যারেজে বেড়াতে যায়। বিস্তর খরচাপাতির ব্যাপার। পথেঘাটে কখনো থেমে গেলে তো কথাই নেই। তো ট্রাক ডাকতে হয়। তুলে নিয়ে গ্যারেজে নিতে হয়। অর্থের সঙ্গে সঙ্গে সময়ের অপব্যয়। এর চেয়ে নতুন গাড়ি কেনা সাশ্রয়ী।
এরই মধ্যে বউ প্রেগন্যান্ট হয়ে গেছে। আমেরিকান বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীরা বলছিলেন, সংসার ঠিকঠাক মতো গুছিয়ে তবেই বাচ্চা নেওয়া উচিত। এদিকে আমার মতে, সংসার কখনোই গোছানো হয় না। আজীবন আমরা গোছাতে থাকি। চাকরিতে একটা প্রমোশন হলেই আমি মোটামুটি সেট হয়ে যাব! প্রমোশন হলে পরে, একটা বাড়ি কিনে ফেললেই আমি সেট হয়ে যাব। বাড়ি কেনা শেষ হলে, একটা ভালো গাড়ি না কিনলে এইবার চলছেই না। নতুন গাড়ি কেনা শেষে আরেকটু বড় বাড়ি কেনার দিকে মনোযোগ যায়। সেটার জন্য চাকরিতে আরেকটা প্রমোশনের আশা। যেহেতু একটা নির্দিষ্ট সামাজিক অবস্থানে পৌঁছে গেছি, সেটা জানান দিতেই আরও একটা দামি গাড়ি লাগবেই। এবং এভাবেই একটা পর্যায়ে গোছাতে না পারার আফসোস নিয়েই পৃথিবী ত্যাগ করি। কাজেই সময় থাকতে যা করার করে ফেলা ভালো।
বিদেশিদের অবশ্য পয়েন্ট অব ভিউ ভিন্ন। তাঁরা দীর্ঘদিন সংসার করার পরও একে অপরকে ঠিক ভরসা করতে পারে না। যেকোনো মুহূর্তেই তাঁদের বিয়ে ভেঙে যেতে পারে। দেখা যায় কয়েক যুগের সংসার অতি তুচ্ছ কোনো মতবিরোধে গুঁড়িয়ে গেল। সেই সময়ে বাচ্চাকাচ্চা থাকলে উল্টো ঝামেলার সৃষ্টি হয়। কাস্টডি, অ্যালামনাই ইত্যাদি নিয়ে বিস্তর দৌড়াদৌড়ি করতে হয়।
যাহোক, প্রেগনেন্সির তখনো আর্লি স্টেজ চলছে। বাচ্চার লিঙ্গ এখনো জানা সম্ভব হয়নি। আমরা প্রতিটা ক্ষণ চরম উত্তেজনায় কাটাই। বাচ্চার রুম গোছানো, ফিডার, বিছানা, ডায়পার ইত্যাদি কেনা থেকে শুরু করে কত কিছু নিয়ে যে পরিকল্পনা করি!
ছেলে হলে নাম হবে রিসালাত। আমার সাফ কথা, ক্লাস থ্রিতে থাকতে আমি ঠিক করে রেখেছিলাম আমার যদি কখনো ছেলে হয়, তবে তাঁর নাম হবে রিসালাত।
বউ চোখ কপালে তুলে বলে, তুমি ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময়ে বাচ্চাকাচ্চার নাম নিয়ে চিন্তা করতা? আমি তো সে সময়ে বিয়ে কী সেটাই বুঝতাম না।
আমি মুখ বেকিয়ে বলি, সেটা তোমার সমস্যা। আমি অ্যাডভান্স চিন্তা করি, এইটা আমার গুণ!
তাই বলে এত অ্যাডভান্স? ক্লাস থ্রি?
আমাকে যাতে কেউ ইঁচড়ে পাকা না ভাবেন তাই ঘটনা একটু বিস্তারিত বলা যাক।
আমার স্কুলে এক হারামজাদা কিসিমের ছেলে ছিল। যে আমাকে বুলি করত। কীভাবে বুলি করত সেটা না হয় না–ই বা বললাম। কিন্তু ছেলেটাকে আমি দেখতে পারতাম না। কিন্তু মানব মস্তিষ্কের অদ্ভুত খেয়ালে ওই বদমাশটার নামটাই আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল। তার নাম ছিল রিসালাত। এমন আনকমন নাম আমি আমার সেই ক্ষুদ্র জীবনে কোথাও শুনিনি। আশপাশের বন্ধুদের নামগুলো তখন খুবই কমন। জাকির হোসেন, মুহিবুর রহমান, আসিফুল হক ইত্যাদি। রিসালাত নামের মধ্যে একটা ঝংকার ছিল বলে মনে হতো।
ছেলের জন্য রিসালাত নামটা তখনই ঠিক করেছিলাম।
আর মেয়ে হলে?
বউয়ের ভ্রু কুঁচকানো প্রশ্ন।
বহ্নিশিখা।
যখন থেকে সুনীলের পূর্ব পশ্চিম বইটা পড়েছি তখন থেকেই এই নামটি আমার প্রিয়।
বউ বলল, খবরদার, তুমি আমার বাচ্চার নাম রাখতে পারবে না।
আমি বললাম, বহ্নিশিখা নামটিতে সমস্যা কী?
বউ একই স্বরে বলল, আমেরিকান কেউ এই কঠিন নাম উচ্চারণ করতে পারবে? রিসালাত হয়ে যাবে রিজ আর বহ্নিশিখা যে কী হবে সেটা আল্লাহ মালুম।
গুড পয়েন্ট। আমাকে যেমন আমার কিছু বন্ধুবান্ধব ম্যানি ডাকত। বউয়ের নাম নুসরাত, অফিসে লোকেরা তাঁকে নাজরাট, নুজ্রেট, নাসর্যাট ইত্যাদি নামে ডাকে। একজন তো আরও শর্টকাটে ডাকে নু। আল্লাহর মেহেরবানি! আমার শ্বশুর সাহেব তাঁর ছোট কন্যার নাম গুলশানা রাখেননি, তাহলে এরা নামটি ছোট করে কেলেঙ্কারি বাধিয়ে দিত।
সে যাক, আমাদের এই কথোপকথন চলছিল যখন আজিজ ভাই আমাদের বাড়িতে ছিলেন। স্টুডেন্ট ও ব্যাচেলর অবস্থায় বহুদিন তাঁর বাড়িতে গিয়ে খাওয়াদাওয়া করেছি। এখন তাঁকে মাঝেমধ্যে আমার বাড়িতে এনে খাওয়াই। সত্তর-ঊর্ধ্ব এই বয়স্ক ব্যক্তিটিকে আমি তো খুব পছন্দ করিই, আমার স্ত্রীও তাঁকে খুব সম্মান করে। তাঁর মুখে তাঁর চল্লিশ বছরের হোমিসাইড ডিটেকটিভ ক্যারিয়ারের সত্য গল্পগুলো সে–ও মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে।
মেয়ের নাম বহ্নিশিখা রাখব বলে তিনি নিজে থেকেই বললেন, নামটি চমৎকার। কিন্তু আসলেই আমেরিকানরা এই নামটির বারোটা বাজিয়ে দেবে। তুমি একই অর্থের অন্য কোনো সহজ নাম রাখো।
আমি বললাম, আগুনের প্রতিশব্দগুলো তো আরও খটমট। অনল, পাবক, দহন, সর্বভুক, শিখা, হুতাশন, বৈশ্বানর, কৃশানু, বিভাবসু, সর্বশুচি, হোমাগ্নি বীতিত্রোর, জ্বলন, শিখাবৎ, শিখিনু, বায়ুসখা…ইত্যাদি।
তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, বাপরে! তুমি দেখি পুরো ডিকশনারি নামিয়ে ফেলেছ। এতগুলো প্রতিশব্দ মুখস্থ করলে কীভাবে?
হেসে বললাম, আমার মাঝে মাঝে অতি ফালতু বিষয় মাথায় জমে থাকে। স্কুলে থাকতে বাংলা দ্বিতীয় পত্রের জন্য মুখস্থ করেছিলাম, মাথা থেকে বেরোচ্ছে না।
তারপর গলার স্বর পাল্টে বললাম, তবে আমার মূল পয়েন্ট নামের অর্থ না, নামটাই আমার পছন্দের ছিল। না হলে আগুন মোটেও রোমান্টিক বিষয় না যে বেহেশতের ফুলের নাম আমি নরকের উপাদানের নামে রাখব।
তিনি মাথা নাড়িয়ে বললেন, ভ্যালিড পয়েন্ট।
আমি চোখ বড় বড় করে বললাম, আমি আগুন খুবই ভয় পাই। দেখেন না, আমি বাড়িতে ইলেকট্রিক চুলা ব্যবহার করি। গ্যাসের চুলায় আমার ভীতি আছে। ছোটবেলায় বিটিভির খবরে প্রায়ই গ্যাসের সিলিন্ডার বার্স্ট করে বাড়িতে আগুন লাগার খবর দেখাত।
আজিজ ভাই হেসে বললেন, আরে না। গ্যাস থেকেও যেমন আগুন লাগতে পারে, ইলেকট্রিসিটি থেকেও তেমনি বাড়িতে আগুন লাগতে পারে। সব ক্ষেত্রেই সাবধানতাটা জরুরি।
তারপর হঠাৎ কিছু মনে পড়ে গেছে এমনভাবে তিনি বললেন, আচ্ছা, আগুন রিলেটেড একটি ইন্টারেস্টিং কেসের গল্প তোমাকে কী আমি কখনো শুনিয়েছি?
তাঁর বলা যেকোনো গল্পই আমার কাছে ইন্টারেস্টিং লাগে। যখন ব্যাচেলর ছিলাম। তাঁর বাড়িতে সপ্তাহে এক দিন হলেও যেতাম কেবল গল্প শোনার আশায়।
তিনি বললেন, ওই যে এক নারীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল, তাঁর সন্তানদের পুড়িয়ে মারার অভিযোগে…বলেছিলাম সে গল্প?
তাঁর কাছে কমসে কম পঞ্চাশটির বেশি গল্প আমি শুনেছি। তবে এমন কোনো গল্প মনে করতে পারলাম না।
তিনি বললেন, তাহলে শোনো, এটা খুবই ইন্টারেস্টিং একটি কেস। যদিও এই কেসে আমি বিন্দুমাত্র ইনভলভড ছিলাম না। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু জড়িত ছিলেন। তাঁর কাছ থেকেই শোনা। তবে এ কেস থেকে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জন্য অনেক কিছুই শিক্ষণীয় ছিল। জীবনে খুব কম এমন কেসের অভিজ্ঞতা হয়।
আমি ও আমার বউ আজিজ ভাইয়ের সামনের সোফায় গা এলিয়ে বসলাম। তাঁর গল্প বলার ভঙ্গি আমাদের ভালো লাগে। তিনি চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে গল্প শুরু করলেন। বরাবরের মতোই, আমি তাঁর ভাষাতেই পুরোটা লিখছি।
ঘটনার সূত্রপাত অনেক ভোরে। ঘড়িতে তখন ধর চারটা সাড়ে চারটা বাজে। নাইন ওয়ান ওয়ান ডিস্প্যাচার একটি কল পেল যে এক নারী জানাচ্ছেন তাঁর বাড়িতে আগুন লেগেছে। ওপরের ঘরে আগুন ছড়িয়েছে। তাঁর বাচ্চারা আটকা পড়েছে। এখুনি যেন তাঁকে সাহায্য করা হয়।
দুই মিনিটের মধ্যেই পুলিশ হাজির হলো। কিন্তু অবস্থা খুব খারাপ। সিঁড়ি ছাড়া ওপরে ওঠার আর কোনো পথ নেই। ফায়ার রেসকিউর লোকজন ছাড়া কারও পক্ষে যাওয়াও সম্ভব না। ওই নারী পাগলিনীর বেশে ড্রয়িংরুমে ছোটাছুটি করছেন। বারে বারে সিঁড়ির দিকে দৌড়ে যাচ্ছেন। পুলিশ অফিসার তাঁকে জোর করে আটকে রাখলেন।
ফায়ার সার্ভিস আসতে আরও এক মিনিটের মতো সময় নিল। দৌড়ে আগুনে ঢুকে গেল এবং দুই বাচ্চাকে উদ্ধার করে এনে দ্রুত হাসপাতালে পাঠাল। নারীকেও হাসপাতালে পাঠানো হলো। ফায়ার সার্ভিস অনেক পরিশ্রম করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হলো। কিন্তু আফসোস, বড় মেয়েটি বাঁচলেও সতেরো মাস বয়সী ছেলেটিকে কেউ বাঁচাতে পারল না।
তিন্নি (আমার স্ত্রীর ডাকনাম) চাপা আর্তনাদ করে উঠল। এমনিতেই সে অনেক বেশি আবেগপ্রবণ। প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর তার পরিমাণ আরও বেড়েছে। যেকোনো শিশুর মধ্যেই এখন সে নিজের অনাগত সন্তানকে দেখে।
আজিজ ভাই গল্প চালিয়ে গেলেন, ‘এ ধরনের ঘটনায় আমরা রুটিন ইনভেস্টিগেশন করি। এইটা নিয়ম। স্টেট আর্সন (অগ্নিসংযোগ) ইনভেস্টিগেটররা এসে খুঁটিনাটি পরীক্ষা করলেন। ফেডারেল আর্সন ইনভেস্টিগেটররাও এলেন। আগুনের ব্যাপারে কিছু তথ্য তোমাদের দিই। তাহলে তোমাদের বুঝতে সুবিধা হবে। আগুন সব সময় উৎপত্তি স্থানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। ক্ষতির পরিমাণ দেখেই ইনভেস্টিগেটররা বুঝতে পারেন আগুন কোথা থেকে শুরু হয়েছে। তাঁরা আবিষ্কার করলেন নিহত শিশু…, কী যেন নাম ছিল ভুলে গেছি। ধরো যশোহা। যশোহার রুমের ক্লজেট সবচেয়ে বেশি পুড়েছে। মেঝে থেকে ‘ঠ’ শেপের পোড়া দাগ ছাদ স্পর্শ করেছে। ছাদ পুড়ে ছাই হয়ে ধসেছে। তাঁরা রিপোর্ট করলেন আগুন মেঝে থেকে ওপরের দিকে গেছে।
অ্যাটিকে (চিলেকোঠার মতো ফাঁকা অংশ) একটি পোড়া ঝুলন্ত ইলেকট্রিক তার পাওয়া গেছে। তাঁরা নিশ্চিত করেছেন ওটা আগুন লাগার পরে পুড়েছে। ইলেকট্রিক্যাল আউটলেটও পরীক্ষা করা হয়েছে। সেগুলো থেকেও আগুন লাগেনি নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেছে। যেহেতু আগুন লাগার কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ তাঁরা খুঁজে পাননি, তাই তাঁরা রিপোর্ট দিলেন, নিশ্চিত এটি কেউ অগ্নিসংযোগ করেছে।
এখন একটু জরুরি তথ্য দিয়ে রাখি। ঘটনার রাতে ভদ্রমহিলা নিচে ড্রয়িংরুমে সোফায় ঘুমাচ্ছিলেন। বাচ্চারা ওপরে বেডরুমে ঘুমাচ্ছিল। শীত আগমনী রাত ছিল। প্রথমবারের মতো স্পেস (মোবাইল) হিটার চালু করে ওই নারী ঘুমাচ্ছিলেন। যখন ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা তাঁর বাচ্চাদের উদ্ধারে এলেন, তিনি নিজ হাতে স্পেস হিটার সরিয়ে তাঁদের জায়গা করে দিয়েছিলেন।
ওই নারী সম্পর্কেও কিছু তথ্য দিয়ে দিই। ভদ্রমহিলার বয়স তিরিশের ঘরে। ককেশিয়ান। সিঙ্গেল মাদার। স্বামীর সঙ্গে তালাক হয়েছে এক বছরও হয়নি। এক মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে তাঁর সংসার। সদ্যই এক লোকের সঙ্গে প্রণয়ের সম্পর্ক হয়েছে। যদিও ভদ্রলোক তাঁর সঙ্গে একই বাড়িতে থাকা শুরু করেননি।
যাহোক, এসব ক্ষেত্রে বাড়িতে উপস্থিত লোকজনকেই সন্দেহ করা হয়।
প্রথমেই সন্দেহ গেল বড় বোন ব্রিটনির (নাম মনে করতে না পারায় এটিও কাল্পনিক নাম) ওপর। যার বয়স তখন ছয় বছর। সে কি ম্যাচ কাঠি বা লাইটার নিয়ে খেলছিল কি না। তবে পুলিশি সন্দেহ সবচেয়ে বেশি গিয়ে পড়ল তাদের মা টেরির (এই নামটা সঠিক) ওপর, যখন তাঁরা তিন বছর আগের একটি ঘটনার কথা জানতে পারলেন।’
এই পর্যন্ত বলে আজিজ ভাই বললেন, ‘আমাকে একটু রেস্টরুমে যেতে হবে, যদি কিছু মনে না করো।’
গল্পের অতি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এসে বিরতি কার বা ভালো লাগে? তবু তাঁকে বললাম, জি, অবশ্যই।
তাঁকে গেস্ট টয়লেট দেখিয়ে দিলাম। যদিও তিনি ভালোভাবেই জানেন কোথায় সেটি। এর আগেও বহুবার তিনি আমাদের ফ্ল্যাটে এসেছেন।
তিনি বাথরুমে গেলে আমি চোখের ইশারায় তিন্নিকে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন লাগছে?
সে নিশ্বাস ফেলে বলল, ইন্টারেস্টিং।
হেসে বললাম, সেটা তো সব সময়েই। তাঁর গল্প বোরিং হতেই পারে না।
সে বলল, তুমি এমনভাবে বলছ, যেন এতে তোমার ক্রেডিট!
তাঁর বলার ভঙ্গিটা আমার ভালো লাগল না। আমি অবাক হয়ে বললাম, আরে, আমি ক্রেডিট নিতে গেলাম কই? মহিলা মানুষের সঙ্গে দেখি কথা বলাটাও একটা যন্ত্রণা। সবকিছুতেই প্যাঁচ!
সে বলল, এত অভিযোগ থাকলে কোনো পুরুষকেই বিয়ে করতে। থাকতে আমেরিকায়, ইচ্ছা করলেই সম্ভব ছিল।
আমি গলা চড়িয়ে বললাম, ফালতু বাত মাত করো!
সে উল্টো ধমক দিয়ে বলল, আস্তে কথা বল। মেহমানের সামনে সিনক্রিয়েট কোরো না।
এই সময় বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলেন। তারপর বললেন, ‘তোমার সোপ ডিস্পেন্সারটা আমার খুব ভালো লেগেছে। নাইস ওয়ান!’
আমি বললাম, থ্যাংক ইউ ভাই। তারপর কী হলো?
‘কতটুকু যেন বলেছিলাম?’
ওই যে, মহিলাকে আপনারা সন্দেহ করলেন।
আজিজ ভাই বললেন, ‘ও হ্যাঁ, মহিলার ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করতে গিয়ে আমাদের পুরো সন্দেহ গিয়ে পড়ল তাঁর ওপর। বাই দ্য ওয়ে, আমি আমরা বলতে পুলিশ ডিপার্টমেন্ট বোঝাচ্ছি, আমি সেই কেসে ইনভলভড ছিলাম না। আমার ডিপার্টমেন্টও না। অন্য শহরের কেস হিস্ট্রি বলছি। শহরের নাম বা অন্য ডিটেইল শেয়ার করতে চাচ্ছি না।’
মূল ঘটনা হচ্ছে, গত কয়েক দিনের বৃষ্টির পানি যখন অ্যাটিকে পুরোনো নগ্ন তার ভিজিয়ে দিচ্ছিল, তখন সেই ইলেকট্রিক্যাল তার স্পার্ক (স্ফুলিঙ্গ) তৈরি করছিল। এতে কাঠের ওপর কার্বন ছাড়তে শুরু করে। কাঠ বিদ্যুৎ কুপরিবাহী হলেও কার্বন তড়িৎ পরিবাহী।
ঘটনার রাতে ব্যক্তিগত কিছু কাজ করতে হবে বলে বাচ্চাদের ওপরে ঘুমাতে পাঠিয়ে মহিলা নিচে শুয়ে পড়েন। ঠান্ডা লাগছিল বলে স্পেস হিটার চালান। যে আউটলেট ব্যবহার করেন, সেটা কম ওয়াটের যন্ত্রপাতির জন্য ডিজাইন করা ছিল। তাই ১৫০০ ওয়াটের হিটার অন করায় তার গরম হয়ে যায়। কাঠে জমা কার্বনের কারণে আগুন ধরে এবং বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়া কেমিক্যালবিহীন ইন্সুলেটরে আগুন ধরে যায়। সিরিজ অব ইভেন্ট বলে এটাকে। একটার সঙ্গে আরেকটা জড়িত।
আগুন ছড়াতে বেশি সময় লাগে না। যশোহার রুমের ক্লজেটের ছাদের ওপরই ঘটনাটি ঘটে। আগুনে পুড়ে ছাদ ধসে নিচে পড়ে এবং তারপরই আগুন নিচ থেকে ওপরের দিকে উঠে ‘ঠ’ আকৃতি তৈরি করে। ইনভেস্টিগেটররা যার পুরো উল্টো রিপোর্ট দিয়েছিলেন।
দীর্ঘ গল্প শুনিয়ে আজিজ ভাই দম নিলেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, তারপর?
তিনি বললেন, ‘তারপর ওই মহিলা মিথ্যা অভিযোগ থেকে মুক্তি পেল। আদালতে পুরো ঘটনার ডেমো দেওয়া হয়েছিল। জুরিদের মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। তবে বেচারির জন্য আমার খুব খারাপ লাগে। দরিদ্র ছিল বলে নিজের এক বাচ্চাকে সে অ্যাডপশনে দিয়েছিল। তারপর চাকরি করে কিছুটা ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল, এমন সময়ে তাঁর বাচ্চা, বাড়ি সবই এক রাতে হারিয়ে গেল। আবার সম্মানে স্যালুটও দিই, একজন স্বল্প শিক্ষিতা, সাধারণ কিন্তু অসম্ভব বুদ্ধিমতী রমণী যা করে দেখাল, আমরা অনেক সাহসী মানুষও এমন পরিস্থিতিতে হাল ছেড়ে দিতাম।’
আমি কিছু না বলে আমার বউয়ের দিকে তাকালাম। বউয়ের হাত তাঁর পেটে। আমাদের অনাগত সন্তান আছে সেখানে। এখনই মা তার মায়ায়, ভালোবাসায় পৃথিবীর যাবতীয় অনিষ্ঠতা থেকে তাকে ঢেকে রাখতে চাইছে। নশ্বর পৃথিবীতে কোনো কিছুই গ্রান্টেড হিসেবে নেওয়ার উপায় নেই।
পুনশ্চ: সত্য ঘটনার ওপর আধারিত গল্প। মূল ঘটনায় সামান্য পরিবর্তন টেনে পাত্রপাত্রীর নাম গোপন রেখে লেখা হয়েছে। কেউ যদি আমেরিকান এই কেসটি সম্পর্কে কোথাও কিছু পড়ে থাকেন অথবা টিভিতে দেখে থাকেন, তাহলে বুঝে নেবেন সেই কেসটি নিয়েই লেখা।