শালুক ফুলের লাজ নাই

শালুক ফুলের লাজ নাই !! Part- 20

আশা বসে আছে নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে। আদনানের পেটের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়ে গিয়েছে।পেটে মোচড় দিয়ে উঠলো আশার কথা শুনে। আদনান কল্পনাও করে নি তীরে এসে আশা এভাবে তরী ডুবিয়ে দিবে।
সকালে আশাকে যেভাবে পশ্চাৎদেশে লাথি দিবে ভেবেছিলো এখন দেখতে পাচ্ছে সেই লাথি যেনো তার নিজের পশ্চাৎদেশে দিয়েছে আশা।
দাবার চক এভাবে বদলে যাবে আদনানের ভাবনাতেও আসে নি।
এখনো আদনানের অবিশ্বাস্য লাগছে। একটু আগেই তো আশা ছাদে আদনানের গালে চুমু খেলো। তখন ও তো মনে হয় নি আশা এরকম কিছু করবে!
তবে হঠাৎ করে এরকম করলো কেনো?
আদনান উঠে গিয়ে আশার হাত চেপে ধরে বললো, “এভাবে আমার লাইফ নিয়ে তুমি খেলা করতে পারো না আশা।এই মুহূর্তে এসে তুমি কিছুতেই এরকম সিদ্ধান্ত নিতে পারো না।”
আশা মুচকি হেসে আদনানের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, “লিসেন আদনান,আমাদের মধ্যে এরকম কোনো কমিটেমেন্ট ছিলো না যে আমরা বিয়ে করবোই।আমি তুমি দুজনেই এডাল্ট,দুজনের সম্মতিতে আমরা ঘনিষ্ঠ সময় কাটিয়েছি।তার মানে এই নয় যে আমার তোমাকে বিয়ে করতেই হবে।
আর যদি এরকম হয় যে বিয়ে করবো বলেছি বলে বিয়ে করাই লাগবে,তাহলে তো তোমার উচিত ছিলো তোমার কাজিন সিস্টার নয়না কে বিয়ে করা।আমি যতোদূর বুঝেছি তোমাদের মধ্যে লাভ রিলেশন ছিলো। আংকেল,আন্টির মৌন সম্মতি ও ছিলো তবে শেষ পর্যন্ত তুমি তাকে বিয়ে করো নি।সেখানে আমি কেনো তোমাকে বিয়ে করবো?
তুমি বয়ফ্রেন্ড হিসেবেই তো পারফেক্ট না।হাজব্যান্ড হলে তো অনেক রেসপনসেবলিটি,সেখানে তুমি জিরো আউট অব টেইন।”
আজাদ সাহেব উঠে আশার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,”এই সময়ে তুমি এরকম সিদ্ধান্ত নিলে আমাদের মান সম্মান আর থাকবে না মা।”
আশা ভ্রুকুটি করে নিজের বাবার দিকে তাকালো। আশার বাবা ভাঙা ভাঙা বাংলা,ইংরেজি মিলিয়ে যা বললেন তার মানে হলো, “আমার মেয়ের যেহেতু এই বিয়েতে মত নেই,সেখানে তাকে জোর দেয়ার কোনো মানে হয় না। এই বিয়ে হবে না।”
বিদায় নেয়ার সময় আশা সবার থেকে বিদায় নিলো। আদনানের কাছ থেকে ও হেসে বিদায় নিয়ে চলে গেলো বাবা মায়ের সাথে।
হতভম্ব হয়ে আদনান দাঁড়িয়ে আশার গমনপথ এর দিকে তাকিয়ে রইলো। যেমন করে সেদিন তাকিয়ে দেখেছে শালুকের চলে যাওয়া।
আদিবা বেগম ছেলের সামনে গিয়ে বললেন,”পাপ কখনো বাপকেও ছাড়ে না।আজ আমার অন্তরের জ্বালা কিছুটা হলেও জুড়িয়েছে।এবার বুঝতে পেরেছিস তো লজ্জা জিনিসটা কি?
অবশ্য তুই বুঝবি না।তোকে আমি মানুষ বানাতে পারি নি।লজ্জা আমার হওয়া উচিত তোর মতো ছেলের মা হয়েছি বলে। ”
আদনান ধীর পায়ে নিজের রুমে চলে গেলো। একূল ওকূল দুই কূল হারিয়ে আদনানের নিজেকে রিক্ত শূন্য মনে হচ্ছে।
আশা যদি বিয়ে করবে না বলেই ভেবে রেখেছিলো কেনো আগে জানালো না তাকে?তাহলে তো আদনান শালুককে হাতছাড়া করতো না কিছুতেই।
নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছে আদনানের।বিচিত্র এই জীবনের কতোটুকুই বা মানুষ জানে!
বুকের ভেতর একটা হাহাকার আজ আদনানকে ব্যথিত করছে।
শালুকের স্কুলে প্রিটেস্ট এক্সাম শুরু হবে আগামীকাল থেকে। ধ্রুবর নতুন চাকরি,নতুন টিউশনি। এই মুহূর্তে শালুককে নিয়ে ধ্রুব কিছুতেই গ্রামে যেতে পারছে না।
রাতে বাসায় ফিরে ধ্রুব স্কুলে কল দিলো। নিজেদের সব সমস্যার কথা স্কুলে খুলে বললো। তারপর জানালো শালুকের পক্ষে পরীক্ষায় হাজির হওয়া এই মুহুর্তে অসম্ভব।
স্যারকে অনেক রিকুয়েস্ট করে ধ্রুব শালুকের এক্সাম দেওয়া বাদ দেওয়ালো।তবে স্যারকে অনুরোধ করলো যাতে করে প্রতিদিনের এক্সামের প্রশ্নটা ধ্রুবকে মেসেঞ্জারে পাঠিয়ে দেয়।
ভয়ে আধমরা হয়ে রইলো শালুক বাসায় ধ্রুবর সামনে বসে পরীক্ষা দিতে হবে শুনে।
পিঠ বেয়ে ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো তার।পরের কয়েকদিন গেলো শালুকের অগ্নি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে।
প্রতিদিন রাতে ধ্রুব বাসায় এসে শালুকের এক্সাম নেয়।এই প্রথম শালুক অনুভব করলো আশেপাশে সাহায্য করার মতো যখন কেউ না থাকে তখন নিজের চরকায় নিজের তেল দেওয়া লাগে।
এই যেমন এখন,শালুকের কোনো উপায় নেই কারো থেকে হেল্প নেওয়ার।
মূর্তিমান বিপদের ন্যায় ধ্রুব শালুকের সামনে বসে রইলো,উপরন্তু পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত সময়ের চাইতে ২০ মিনিট সময় শালুককে কম দিলো।
শালুক প্রশ্ন করায় ধ্রুব জবাব দিলো, মনে কর এটা তোর ফাইনাল এক্সাম।তখন খাতায় মার্জিন দিতে,রোল নাম্বার, রেজিস্ট্রেশন নাম্বার এসব পূরণ করতে,সিগনেচার শিটে নিজের সিগনেচার দিতে,স্যারেরা খাতায় সিগনেচার দিতে,এক্সট্রা পেইজ আনতে আসা যাওয়া করতে,খাতায় পিন মারতে,প্রশ্ন ভালো করে পড়তে।এসব কাজে তোর মিনিমাম ২০ মিনিট নষ্ট হবে।
তাই তোকে মূল সময়ের চাইতে ২০ মিনিট সময় কম ধরেই পরীক্ষার জন্য মাইন্ড সেটআপ করতে হবে।এই সময়ের মধ্যেই ফুল মার্কস উত্তর দিতে হবে।
শালুকের বুক ফেটে কান্না এলো। কেনো এরকম শত্রুতা করছে ধ্রুব তার সাথে!
এই বুঝি তার ভালোবাসা শালুকের প্রতি?ভালোবাসা হলে তো আরো ২০ মিনিট বেশি সময় দিতো সে শালুককে।
বুক ভরা ব্যথা নিয়ে শালুক এক্সাম দিলো।পুরোটা সময় ধ্রুব শালুকের সামনে বসে রইলো।যেদিন যেই সবজেক্ট এক্সাম সেদিন এক্সামের সময় সব বই খাতা রান্নাঘরে রেখে আসতো ধ্রুব।
এরকম অথৈ জলে শালুক আগে কখনো পড়ে নি।প্রথম দিন পরীক্ষা দিয়েই শালুক বুঝতে পারলো শিক্ষক হিসেবে ধ্রুব ভীষণ কড়া।
এরপর থেকে নিজ দায়িত্বে সারাদিন ধরে মনোযোগ দিয়ে পড়েছে শালুক।
সেই সাথে ধ্রুবকে সমানে বকাবকি করে গেলো এক্সাম দিতে বসে।
এক্সাম শেষ হলে ধ্রুব শালুকের খাতা দেখলো।শালুক নিজ প্রচেষ্টায় পরীক্ষায় ৪.১৪ পেলো।
ধ্রুব যখন শালুককে তার রেজাল্টের কথা জানালো শালুকের মনে হলো পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের কথা শুনছে সে।৪.১৪ তার পয়েন্ট!
এ তো অসম্ভব ব্যাপার। তাও সে একা এক্সাম দিয়ে এই পয়েন্ট পেয়েছে!
যেকজানে সে দেখাদেখি করে এক্সাম দিয়ে ও ৩.৫০ এর উপর উঠতে পারে না।
শালুকের বিশ্বাস হলো না। ধ্রুবর হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “সত্যি বলছেন আপনি? আমি সত্যি এতো ভালো রেজাল্ট করেছি?”
ধ্রুব হাসলো। তারপর হঠাৎ করেই শালুককে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, “আমার বোকা ফুল না তুই,আমি তোকে নিজ হাতে গড়ে নিবো শালুক।কেউ যেনো তোকে কখনো কথা শুনানোর সাহস না পায়।তুই আরো ভালো রেজাল্ট করবি শালুক।তুই শুধু একটু চেষ্টা করে যা।আমি তো আছি তোর পাশে।”
তারপর লজ্জা পেয়ে শালুককে ছেড়ে দিয়ে বিড়বিড় করে বললো, রান্না বসাতে হবে আমি রান্নাঘরে যাই।
শালুকের কি যে ভালো লাগলো হঠাৎ করেই। এই যে হুট করে ধ্রুব তাকে জড়িয়ে ধরলো তাতেই শালুকের হৃদয় শান্ত হয়ে গেলো। আবার অপ্রস্তুত হয়ে যে ধ্রুব পালিয়ে গেলো শালুকের সামনে থেকে তাও শালুকের ভীষণ ভালো লাগলো।
এতো ভালো লাগছে কেনো শালুকের! ভেবে পেলো না শালুক।
রাতে খেতে বসে ধ্রুব শালুককে বললো, “আগামীকাল থেকে আমার আসতে আরেকটু দেরি হবে শালুক।নতুন আরেকটা টিউশনি পেয়েছি।”
শালুকের মন খারাপ হয়ে গেলো শুনে।সারাদিন সে চাতক পাখির মতো ধ্রুবর জন্য অপেক্ষা করে থাকে।এখন কি-না আরো দেরি করে আসবে ধ্রুব!
আস্তে করে শালুক বললো, “আমার জন্য আপনার অনেক কষ্ট করতে হয় তাই না ধ্রুব ভাই?আমি না থাকলে তো এতো ঝামেলা হতো না আপনার। একা থাকতেন।হলে থাকতেন,এতো চাপ থাকতো না আর।”
ধ্রুব হেসে বললো, “দুদিন আগে আর পরে,তোকে যখন ভালোবেসেছি, বিয়ে তো তোকেই করতাম।তোর দায়িত্ব তো আমি নিজেই নিতাম শালুক।হয়তো দু’দিন পরে নিতাম।এখন আগে নিচ্ছি,তাতে অসুবিধা কি?এই যে তুই আমার সাথে আছিস,আমার পাশে থাকিস,বাসায় ফিরলে তোর উদ্বিগ্ন মুখ দেখি এই পাওয়া কি কম পাওয়া তুই বল?এর চাইতে বেশি সুখ আমি কোথায় পেতাম?আমার সারাদিনের সব খাটুনি ভুলে যাই যখন বাসায় ফিরলে দেখি তুই আমার অপেক্ষায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছিস।”
শালুক কিছু বলতে পারলো না। তার কেমন অবিশ্বাস্য লাগছে।তাকেও কেউ এরকম পাগলের মতো ভালোবাসতে পারে তা কি কখনো শালুক ভেবেছিলো!
নিজের সৌভাগ্য দেখে শালুক নিজেই অবাক হয়।
চলবে….
রাজিয়া রহমান