মেঘ বর্ষণের মায়া !! Part- 04
মেঘের মনটা আজ ভীষণ ভালো।কি করবে তা নিজেও জানে না।এদিকে খুব বৃষ্টি বর্ষণ হচ্ছে।আকাশের দম কালো মেঘে ঢেকে আছে পুরো পৃথিবীটা।যেদিকে তাকাচ্ছি শুধুই আবছা আলোয় অন্ধকার দেখতে পারছি।স্কুল ছুটি হয়ে গেছে।স্কুলের বারান্দায় দাড়িয়ে অপেক্ষা করছি আমি আর ঝিমি।ভাবছি কখন বৃষ্টি থামবে! এমন সময়ে খেয়াল করলাম দূর থেকে পরিচিত কেউ ছুটে আসছে আমাদের দিকে।যার এক হাতে একটা ছাতা আর অন্য হাতের ছাতাটা মাথার উপরে ধরে আছেন।মানুষটা সামনে এসে দাড়িয়ে ছাতা তুলে মুখ উঁচু করলেন।তখন দেখতে পেলাম উনার মুখটা।ঝিমির হাতে একটা ছাতা ধরিয়ে দিয়ে বললেন গাড়িতে গিয়ে বসতে।ব্যাস ঝিমিকে আর পাই কে? ছাতা খুলেই গাড়ির দিকে এগোতে লাগলো সে।পেছন থেকে যে ওকে ডাকবো আমি তারও কোনো উপায় নেই।উনি আমার মুখটা চেপে ধরে আছেন।খানিকটা দূরে ঝিমি চলে গেলে মুখটা ছাড়লেন আমার।আমি জোড়ে জোড়ে কয়েক সেকেন্ড শ্বাস নিয়ে নিলাম।তাকিয়ে দেখলাম অন্ধকারে মিলেয়ে গেছে ঝিমি।আবছা আলোয় নাক ফুলিয়ে তাকিয়ে আছি উনার মুখের দিকে আমি।
উনি এক হাতে ছাতা মেলে অন্য হাতে হুট করে আমার কোমড়টা চেপে ধরলেন।নিজের কোমড়ে আচমকা উনার হাত পরায় কেঁপে উঠলাম আমি। অহেতুক চেস্টা করলাম হাত ছাড়াবার।কিন্তু পারলাম না।উনি আমায় দিলেন এক ধমক।আমি কেঁপে উঠলে ছাতাটা ফেলে দিয়ে কোলে তুলে নিলেন আমায়।চোখ রাঙিয়ে বললেন,
—“ইচ্ছে তো করছে এভাবেই তোকে নিয়ে যায়। কিন্তু ভিজলে যে তুই অসুস্থ হয়ে পরবি।”
কথাটা শুনে উনার মুখের দিক থেকে অন্য দিকে মুখটা ঘুরিয়ে নিলাম আমি।বুঝতে চেস্টা করলাম হঠাৎ কি হয়েছে উনার।এরই মধ্যে উনি আমার কপালে ঠোঁটের আলতো পরস ছুঁইয়ে দিলেন।আমাকে কেঁপে উঠতে দেখে মুচকি হেসে নামালেন নিজের কোল থেকে।ছাতা উঠিয়ে আমাকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন,
—“চল এবার!”
আমি সরে আসলাম উনাকে ঠেলে কিছুটা দূরে।উনার মুখের দিকে না তাকিয়েই বললাম আমি,
—“এইভাবে যাওয়া যায় না।আপনি বরং আরেকটা ছাতা নিয়ে আসুন।”
উনি ভ্রু কুঁচকে তাকালেন আমার দিকে।নাক ফুলিয়ে বললেন,
—“আরেকটা ছাতার কি দরকার? তুই আসবি নাকি তোকে উঠিয়ে নিয়ে যাবো আমি?”
আমি কিছু বললাম না।দাঁত দিয়ে হাতের নখ কামড়ে দাড়িয়ে রইলাম।কিছু একটা ভেবে ঝট করে বলে উঠলাম,
—“এমন বর্ষণে দু’জন একসাথে গেলে একটা ছাতায় আধ্যেক আধ্যেক ভিজে যাবো আমরা।জানেনই তো আমি একটু ভিজলেই সর্দি জ্বর হয়।তাই বলছিলাম আপনি গিয়ে গাড়ি থেকে ঝিমির ছাতাটা নিয়ে আসুন।নয়তো আমি গিয়ে ছাতাটা নিয়ে আসি।”
উনি কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে মুখটা মলিন করে বললেন,
—“ঠিক আছে।আমি যাচ্ছি।”
কথাটা বলেই এক ছুটে চলে গেলেন গাড়ির কাছে।উনার গাড়ির সামনে আরেকটা গাড়ি এসে দাড়ালো দেখতে পেলাম।দূর থেকে স্পষ্ট কিছু বুঝতেও পারছি না।গাড়ি থেকে নেমে ধীরে ধীরে কেউ আমার দিকে এগিয়ে আসছে বুঝা যাচ্ছে।কিন্তু কে সে? ছাতার জন্য মুখটা তো দেখতে পারছি না।যখন সে আমার সামনে এসে দাড়ালেন ছাতা সরিয়ে মুখ তুললে বুঝতে পারলাম এটা আবির।
আবির আমার দিকে তাকিয়ে আছেন এক অপলক দৃষ্টিতে। আমাকে ডেকে বললেন সে,
—“চলে এসো মায়া।আমি তোমাকে পৌঁছে দেবো বাড়িতে।”
আমি চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম আবিরের পেছনে উনি দাড়িয়ে আছেন।উনার হাতে আরেকটা ছাতা।আমি এক প্রকার ইচ্ছা না থাকা স্বত্তেও আবিরের ছাতার নিচে চলে আসলাম।আবিরের হাতে হাত রেখে ছাতাটা শক্ত করে ধরে বললাম,
—“চলুন।”
আবির মুচকি হেসে ঘুরলেন আর চোখের সামনে উনাকে দেখতে পেয়ে অবাক হলেন।কিছুক্ষণ চুপ থেকে মুখে হাসি টেনে বললেন,
—“একি মেঘ তুমি মায়াকে নিতে এসেছো? অফিসে তো কোমড়ে ব্যাথার কথা বলে ছুটি নিয়ে আসলে। তা তোমার কোমড়ের ব্যাথাটা কি এখন কমেছে?”
উনি মনে হয় কথাটার উত্তর দিতে সংকোচ বোধ করলেন।উল্টো আবিরের উপরে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,
—“আপনি এখানে কি করছেন স্যার?”
আবির কিছু না ভেবেই আমার কাঁধে হাত রাখলেন।হেসে উঠে বললেন,
—“মায়াকে নিতে এসেছি আমি।কিছুদিন পরেই তো আমাদের বিয়ে।ওর পছন্দ অপছন্দ সবকিছু জানতে হবে তো আমার তাই না? ভাবছি প্রতিদিন ওকে নিতে আসবো।সেই সুযোগে ওর সাথে একটু সময়ও কাটানো যাবে।”
আবির কথা বলছে আর উনার চোখদুটো লাল হয়ে আছে।উনি কিছু বলতে যাবেন আবিরকে।তার আগেই আমি আবিরের হাত টেনে ধরে বললাম,
—“ভিজে যাচ্ছি চলুন।”
ঘন্টা দুই পরে বাড়িতে ফিরলাম আমি।আবিরের সাথে না চাইতেও কিছুটা সময় কাটিয়েছি।আমার পছন্দ অপছন্দ সব আবিরকে বলেছি।আবিরের থেকেও শুনেছি।যদিও দূরে কোথাও যাওয়া হয় নি আমাদের।তবে গাড়িতে বসেই কোনো এক পছন্দের জায়গায় দুজন দুজনের ভালো লাগা খারাপ লাগার খরব নিয়েছি।জানি আবিরকে ভালোবাসতে পারবো না।তবুও বিয়ে যে ওকেই করতে হবে আমার।ভালোবাসলে যে তার সাথে থাকতে হবে তা তো নয়।তবে চেস্টা করতে হবে সবটা মানিয়ে নেওয়ার।
বাড়িতে ফিরে যখন আমি রুমে ঢুকতে গেলাম কাকিমার চিৎকার চেচামেচির আওয়াজ এলো আমার কানে।কাকিমা চিৎকার করতে করতে বললেন,
—“আবিরের সাথে মায়ার বিয়ে হবে না।কিছুতেই হতে দেবো না আমি।”
কন্ঠটা মেঘের রুমের থেকেই আসছে।আমি একটু এগিয়ে গিয়ে রুমের দরজার কাছে দাড়িয়ে দেখতে পেলাম উনি ফ্লোরে বসে আছেন কাকিমার দিকে তাকিয়ে। কাকিমা আর কিছু বলার আগেই উনি উঠে দাড়ালেন।কাকিমাকে ধরে ঝাকিয়ে বললেন,
—“মিথ্যা কেন বলেছিলে আমাকে মা?”
কাকিমা এক ঝাটকায় উনার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,
—“কোনো মিথ্যা বলি নি।মায়ার সাথে আমি তোরই বিয়ে দেবো দেখিস।একটা কথা বল তুই কি মায়াকে বিয়ে করতে চাস না? এতো এতো সম্পত্তি বুঝতে পারছিস? সব হাতছাড়া হয়ে যাবে অন্য কোথাও বিয়ে হলে।”
—“ওহহ শুধু সম্পত্তির জন্য তুমি মায়াকে আমার সাথে বিয়ে দিতে চাও?”
—“হ্যাঁ তো? তুই তো আর কাউকে ভালোবাসিস না তাহলে এতো অসুবিধা কিসের মায়াকে বিয়ে করতে?”
উনি হেসে উঠলেন।হাসতে হাসতে থেমে গিয়ে বললেন,
—“বাসি মা।একজনকে বাসি।”
আড় চোখে আমাকে দরজার কাছে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ডাকলেন উনি।আমি ভেতরে আসতেই আমার মাথায় হাত রেখে বলে উঠলেন,
—“আমি একজনকে ভালোবাসি আর তার নাম মলি।আমার অফিসেই একসাথে কাজ করি আমরা।বিয়ে করলে আমি আমার ভালোবাসাকেই করবো।ঠিক যেমন মায়া তার ভালোবাসা আবিরকে বিয়ে করবে।একটা কাজ করি মায়ার আগে আমি বিয়েটা সেরে নিই।ওর বিয়েতে অনেক মজা হবে।কি বলিস মায়া?”
আমি মুখটা তুলে তাকালাম উনার দিকে। উনার মুখে মলি নামটা শুনেই ইচ্ছে করছে গলাটা টিপে ধরতে।প্রচন্ড রাগ হচ্ছে আমার।এই মলি নামের মেয়েটার সাথেই তো উনি মাঝ রাতে রোজ কথা বলেন।মাঝ রাতে উনার রুমের সামনে আসলে এই নামটাই তো উনার কন্ঠস্বরে শুনতে পাই।উনার ফোনটাও ভেঙে ফেলেছি এই মেয়েটার সাথে যেন আর কোনো কথা না বলতে পারে তার জন্য।সেই মেয়েকে বিয়ে করবেন উনি? সেই মেয়েকে?
আমার হাত ঝাকিয়ে বলে উঠলেন উনি,
—“কি হলো চুপ হয়ে আছিস কেন?”
ঠোঁটের কোণে জোড় করে হাসি টেনে বললাম আমি,
—“করে ফেলুন বিয়ে।”
কথাটা বলার পর উনার মুখে খুশির ঝলক দেখতে পেলাম।কিন্তু কাকিমার চোখে চিন্তার ছাপ।কাকিমার দিকে তাকিয়ে বললেন উনি,
—“আরে মা আবিরের বোন মলি।অফিসে মলি আমার সিনিয়র। আর আমি ওর এসিস্টেন্ট।কাজের শুরু শুরুতে মলি আমায় প্রপোজ করেছিলো।কিন্তু আমি পাত্তা দিতাম না মলিকে।মেয়েটা অনেক ভালোবাসে আমায়।এখন বুঝতে পারলাম ওর ভালোবাসাটা।অনেক কস্ট দিয়েছি ওকে।এবার নিজের ভুল শুধরে নেবো।ওকে বিয়ে করে আমার ভালোবাসাটাও দেখাবো।”
কাকিমা মুহূর্তে খুশি হয়ে গেলেন।গদগদ স্বর টেনে বললেন,
—“সত্যি বলছিস বাবা মলি আবিরের বোন? কই আগে কখনো তো শুনি নি আবিরের বোন আছে। আর আবিরের বোন মানে তো ওদের অনেক অনেক সম্পত্তি।মন ভরে গেলো তোর কথা শুনে।আচ্ছা তুই মলিকেই বিয়ে কর।আমি গিয়ে ঝিমিকে জানিয়ে আসি সু-খবরটা।”
কাকিমা খুশিতে নাচতে নাচতে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন। আমি উনার দিকে তাকালাম। উনি হাসছেন।আমি নিজের ভেতরের রাগটা আর ধরে রাখতে পারলাম না।উনার শার্টের কলারটা চেপে ধরলাম।উনাকে ঠেলে বিছানায় ফেলে দিয়ে বুকে ইচ্ছা মতো কিল বসাতে লাগলাম।উনি চুপ হয়ে আছেন আমার হাত ধরে থামাচ্ছেনও না।যখন আমার থেকে নিজের মুখটা ঘুরিয়ে নিলেন তখন উনাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে বসলাম আমি।কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমিই প্রথম জিজ্ঞাসা করলাম,
—“সত্যি কি আপনি মলিকে বিয়ে করবেন?”
উনি শুয়ে থেকে চোখ বন্ধ করে উত্তর দিলেন,
—“হ্যাঁ মলিকেই করবো।আমার ভালোবাসা মলিকেই বিয়ে করবো আমি!”
আমি আড়চোখে উনার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
—“সত্যি কি মলি আপনার ভালোবাসা?”
—“হ্যাঁ বোন।”
—“বোন? এখন আমি আপনার বোন হয়ে গেলাম?”
—“হ্যাঁ কাকাতো বোন।”
আমি কিছুক্ষণ চোখটা বন্ধ করে রইলাম।হুট করে উনার মুখে মলি নামটা শুনে চোখ খুললাম।তাকিয়ে দেখলাম আমি উনি ফোনে কথা বলছে মলির সাথে।
—“ফোন কিনে নিয়েছেন?”
কোনো উত্তর দিলেন না।টানা এক ঘন্টা প্রেম আলাপ করলেন আমার পাশে বসে উনি মলির সাথে। কথা শেষ হলে উঠে গিয়ে একটা ফোন এনে আমার সামনে রেখে বললেন,
—“তোর ফোন ভেঙেছিলাম না? এটা তোর জন্য। আবিরের সাথে কথা বলিস।”
আমি ফোনটা দূরে ঠেলে দিয়ে বললাম,
—“লাগবে না আমার।আমি আপনার ফোন ভেঙেছি আপনি আমারটা ভেঙেছেন শোধবোধ।”
উনি হেসে উঠলেন। আমি উঠে চলে আসার জন্য পা বাড়ালাম।অমনি পিছন থেকে আমার হাতটা টেনে ধরলেন উনি।আমি হাত ছাড়ানোর চেস্টা করলে আমাকে টেনে বিছানায় ফেলে আমার হাতদুটো বিছানার সাথে চেপে ধরে মুখের সামনে মুখটা এনে বললেন,
—“তুই আবিরকে বিয়ে করছিস আর আমি ওর বোন মলিকে শোধবোধ।”
কথাটা শুনে আমি ডুকরে কেঁদে উঠলাম।কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
—“আমি আবিরকেই বিয়ে করবো।”
উনি আমার নাকে নাক ঘেঁষে বললেন,
—“আর আমি মলিকে।”
আমি উনাকে জোড়ে এক ধাক্কায় দূরে ঠেলে দিয়ে রুম থেকে ছুটে বেড়িয়ে আসলাম।
চলবে,,,,