মিশে আছো আমার অস্তিত্বে !! Part-04
অন্যান্য দিনের তুলনায় আজকে ব্রেকফাস্টের মেনু দেখে আকাশ কিছুটা অবাক হলো।অন্যান্য দিন নরমাল ব্রেকফাস্ট থাকলেও আজকে তার জায়গায় রয়েছে আলুর পরোটা,, সবজি,,মাটন,,লাচ্ছি আর পায়েস।এতকিছু একসাথে দেখে আকাশ তার মাকে জিজ্ঞাসা করল-;
-:আজকে এতকিছু বানাতে গেলে কেন??মা তোমাকে আমি কতোবার বলেছি এত রান্না করবেনা। এমনিতেই তোমার শরীর অসুস্থ,, তুমি আমার কোনো বারণই শোনো না।আর এই যে তুমি!!(তৃষাকে উদ্দেশ্যে করে)মা যখন এতকিছু রান্না করছিল তখন তুমি কোথায় ছিলে??মাকে বারণ করতে পারোনি!! অবশ্যই বারণ করবেই বা কেন ভালোমতো খাবার খাওয়ার জন্য তো চুপচাপ ছিলে।তুমি জানো না আমার মা অসুস্থ।
আকাশ বেশ রেগে কথাগুলো বলল।আকাশের কথা শুনে তৃষা ফুরফুরে মন হঠাৎ করেই কালো মেঘে ঢেকে গেল,,চোখে তার পানিতে টলমল করে উঠলো।আকাশের মা এতক্ষন চুপ করে থাকলেও এবার আর চুপ করে থাকতে পারলো না,,বেশ জোরেই বলে উঠলো-;
-:আকাশ আমি কিছু বলছি না বলে,,এই নয় যে তুমি বলতেই থাকবে।তুমি কী জানো যে আজ ব্রেকফাস্টটা কে তৈরি করেছে??শোনো আকাশ কোন কিছু না জেনে,,না যাচাই করে বিচার করাটা একজন শিক্ষিত মানুষের কাজ নয়।আর আজকের সমস্ত ব্রেকফাস্ট তৃষা নিজের হাতে বানিয়েছে।তুমি এইভাবে মেয়েটাকে কথা শুনতে পারো না আকাশ,,মেয়েটা আমার কথা ভেবে আজকের সমস্ত কিছু নিজের হাতে করেছে।আর হাজার হোক মেয়েটা তোমারই স্ত্রী।এখন চুপচাপ বসে ব্রেকফাস্ট করে নাও আর তৃষা মা তুমি আমার পাশে এসে বসো।
মায়ের কাছ থেকে এমন উত্তর শুনে আকাশের নিজেরও কিছুটা খারাপ লাগলো সত্যিই সে না জেনে তৃষার উপর সমস্ত দোষ চাপিয়ে দিলো।আকাশ আর কিছু না বলে চুপচাপ বসে বলল তৃষা ও নিজের চোখের জলটা আড়াল করে মায়ের পাশে বসে পড়লো। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজকের আকাশ ব্রেকফাস্ট একটু বেশি করে ফেলল,, কারণ রান্না গুলো সত্যিই খুব সুন্দর হয়েছিলো। ব্রেকফাস্ট করে নিজের অফিসের উদ্দেশ্যে আকাশ বেরিয়ে পড়লো।
এদিকে তৃষাও সমস্ত কাজ সেড়ে,,শাশুড়ি মায়ের সাথে গল্প করতে চলে গেল।ঘরে গিয়ে দেখলো তিনি চুলে তেল দেওয়ার জন্য বসেছে।তৃষাও শাশুড়ি মায়ের পাশে বসে বলে উঠলো-;
-:মা তেলটা দাও আমি তোমার চুলে আজ তেল দিয়ে দিচ্ছি।
তৃষার কথা শুনে তিনি মুচকি হেসে বলে উঠলেন-;
-:তুই দিবি।তাহলে এই নে ধর।
তৃষা সুন্দর করে শাশুড়ি মার চুলে তেল দিয়ে ম্যাসাজ করে দিচ্ছে,,,কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি বলে উঠলেন-;
-:আজকের আমি তোকে কিছু কথা বলব সেগুলো মন দিয়ে শুনবি।আমি হয়তো বেশি দিন আর তোদের সাথে থাকতে না।আমার চলে যাবার পর তোকেই কিন্তু এই সংসারের হাল ধরতে হবে আর তার সাথে আমার ছেলেটাকেও সামলে রাখতে হবে।
তৃষা তার শাশুড়ি মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে,, কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলো-;
-: এইভাবে বলোনা মা। নিজের বাবা-মা তো আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।এখন যদি তুমিও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে বলো তাহলে আমার কী হবে??
-:আরে পাগলি মানুষ কি আর সারা জীবন বেঁচে থাকে একদিন না একদিন তাকে চলে যেতেই হয়। আর তাছাড়াও আমি যা রোগ বাধিয়েছি,, তাতে হয়তো আমি আর এই পৃথিবীতে কয়েক মাসের অতিথি।
-: না তোমার কিচ্ছু হবে না।কিছুই হতে দেবো না আমি তোমাকে।
-:আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে সে নয় পরে দেখা যাবে ক্ষন।এখন আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোন।আকাশ এমন ছিলো না ও আমার আর ওর বাবার অনেক বাধ্য ছেলে ছিল।পড়াশোনায় ভালো রেজাল্ট করায় ওর বাবা সিদ্ধান্ত নিল ছেলেকে বিদেশে পড়াবে,, ওখানে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হবে।সেই জন্য ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে দিল,, প্রতিদিন খোঁজখবর নিতে না পারলেও কিছু দিন অন্তর অন্তর আমাদেরকে ফোন করে খোঁজখবর নিত। বিদেশে বেশ ভালই পড়াশোনা চলছিল কিন্তু হঠাৎ করে এক বছরের মাথায় আকাশ চেঞ্জ হতে লাগল,, আগে দুই দিন অন্তর অন্তর ফোন দিত কিন্তু তখন সে আমাদের মাসে একবার ফোন দিত তাও আবার মাঝে মাঝে ভুলেও যেতে।এতদুর থেকে ছেলের খোঁজখবর নিতে আমাদের অসুবিধা হতো তাই আকাশের বাবা ঠিক করলেন যে ছেলেকে আবার দেশে ফিরিয়ে আনবে কিন্তু যখন আকাশকে আমরা প্রস্তাবটা দিলাম সে বলে দিল নিজের পড়াশোনা কমপ্লিট না করে দেশে সে ফিরবে না।
এদিকে ছেলে আমাদের কাছ থেকে দূরে যেতে লাগলো পরে জানতে পারলাম সে একটা মেয়ের পাল্লায় পড়েছে।মেয়েটা নাকি এদেশীয়,, আমাদেরও কোন প্রবলেম হতো না আমরা তাকে হাসিমুখে মেনে নিতাম কিন্তু আকাশের বাবা খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারলেন যে মেয়ের বাবা ভালো নয় নিজের দাদাকে ফাঁসিয়ে তার সমস্ত কিছু নিজের নামে করে নিয়েছে।আর ওই মেয়েটার ও নাকি আকাশ ছাড়াও অনেক ছেলের সাথে সম্পর্ক।জেনেশুনে নিজের ছেলেকে তো আর আমরা মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারিনা।
কিন্তু ছেলেকে বোঝাবো কি করে?? এইসব চিন্তায় আকাশের বাবা দিন দিন ভেঙে পড়ছিল,,একদিন রাতে হুট করে বলল তার শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছে,,,ড্রাইভারকে বলে সঙ্গে সঙ্গে হসপিটালে নিয়ে গেলাম কিন্তু মাঝ পথেই তিনি এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন।তার আমার কাছে বলা শেষ কথা ছিল আকাশকে ওই মেয়েটার কাছ থেকে দূরে রাখতে।
আকাশের বাবা মারা যাবার পর আকাশ দেশে ফিরলো।বলতে পারো আমার জেদের কাছে হার মেনেই এখানে পুরোপুরি ভাবে চলে এলো,,,আর তাছাড়া ওর পড়াশোনা ও প্রায় কমপ্লিট হয়ে গিয়েছিল আর নিজের বাবার বিজনেসটাকেও সামলাতে হতো,,তাই সে আর বিদেশে যাবার সিদ্ধান্ত নিল না।কিন্তু আকাশ এটা কোনোদিন জানতে পারলো না যে ওর বাবার মৃত্যু ব্রেন স্ট্রোকের জন্যই হয়েছিল ঠিকই কিন্তু পরক্ষ ভাবে ও নিজেই দায়ী ছিল ওর বাবার মৃত্যুর জন্য।
পরে সে ওই মেয়েটাকে বিয়ে করতে চাই এই প্রস্তাব নিয়ে আমার কাছে এসেছিল কিন্তু আমি তাকে স্পস্ট না করে দিই,, প্রথমে কিছুতেই মানছিল না পরে আমি অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় সে আর এই বিষয়ে কোন কথা বলেনি।এর কয়েক বছর পর সে আবার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতে চেয়েছিল কিন্তু আমার ক্যান্সার ধরা পড়ায় সে আমাকে আর এই বিষয়ে কিছু বলে নি।
পরে আমি ভেবে করে দেখলাম আমার মৃত্যুর পর তো আমার ছেলে আবার ওই মেয়ের কাছে চলে যেতেই পারে।তাই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম তাকে একটা ভালো মেয়ের সাথে বিয়ে দেব।তাই তাকে বিয়ে করে জন্য একপ্রকার চাপ দিতে লাগলাম। তার কিছুদিন পর সে তোকে বিয়ে করে এ বাড়িতে আনলো। প্রথমে একটু সন্দেহ হয়েছিল ঠিকই কিন্তু পরে ভেবেছিলাম হয়তো তোকে পছন্দ হয়েছে তাই বিয়ে করে এনেছে।
কিন্তু আজকের খাবার টেবিলে ও তোর সাথে যে ব্যবহার করল তাতে আমি এইটুকুনি বুঝতে পেরেছি যে তোদের মধ্যে সম্পর্কটা আর পাঁচটা সম্পর্কের মতোন স্বাভাবিক নয়া।দেখ তুই যতই আমার কাছ থেকে লুকাস না কেন আমিতো মা তাই আমি বুঝি।আকাশ যখন তোকে বিয়ে করে এই বাড়িতে এনেছিল তখন আমার কিছুটা সন্দেহ হয়েছিল কিন্তু তোর মত একজন মেয়েকে হাতে পেয়ে কি করে হাতছাড়া করি বল।
এবার এখন তুই আমায় কথা দে যে তুই আমার ছেলেটাকে ওই বাজে মেয়ের কাছে কোনোদিন যেতে দিবি না,,,আমি মারা যাবার পর তোকেই কিন্তু আমার ছেলেটাকে ওই বদ মেয়ের ছায়া থেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।আমি হয়তো বেঁচে আছি বলে আকাশ ওই মেয়েটার কাছে যেতে পারছে না আর আমাকে খুশি রাখার জন্য তোকে বিয়ে করেছে। কিন্তু আমার মৃত্যুর পর হয়তো আবার ওই মেয়ের কাছে চলে যাবে,, তুই তুই আমার গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা কর যে তুই আমার কথা রাখবি।
তৃষা কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। একদিকে আকাশের সাথে হওয়া কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ আর অপরদিকে একজন মায়ের করা অনুরোধ যে সে যেন তার ছেলেকে রক্ষা করে।কী করবে তৃষা কিছুই বুঝতে পারছে না। সর্বশেষ তার মনে হলো বৃদ্ধার শেষ অনুরোধ টুকু রক্ষা করাই তার সর্বপ্রথম কর্তব্য,,কারণ মানুষ টা সত্যিই এ ক’দিনে তার মায়ের জায়গাটা প্রায় নিয়ে নিয়েছে।তাছাড়াও একজনের মুখে হাসি ফোটাতে যদি তাকে আরেকটু অপমান সহ্য করতে হয় তাহলে ক্ষতি কি!!
এমনিতেই তো সে তার জীবন অর্ধেক নষ্ট করেই ফেলেছে নিজের বাবাকে বাঁচাতে,,আরও একবার না হয় কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করেই ফেলুক নিজের মার বয়সি মানুষটিকে সাহায্য করতে।সারা জীবন ঘুরেও এই পৃথিবীর বৈচিত্র বোঝা বড়ই মুশকিল।কিছু কিছু অভিজ্ঞতা নিজের কাছে সঞ্চিত থাক ভালোই,,ভবিষ্যতে হয়তো কোনো কাজে লেগে গেল।
এর জন্য অবশ্যই তাকে আরও কিছুটা অপমান,,লাঞ্ছনা সহ্য করতে হবে কিন্তু কিই বা করার,,,,সেইতো তাকে বাকি জীবনটা একা চলতেই হবে কারণ তার বাবা-মা তো তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।আর এমনিতেই সে তো আর কনট্রাক ভাঙবে না একজনকে শুধু আলো আর অন্ধকারের তফাৎ টুকু বুঝিয়ে দিয়েই চলে যাবে। এতে যদি একজন মায়ের কলিজা শান্ত হয় তাহলে ক্ষতি কি??
তৃষা তার শাশুড়ি মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো-;
-: মা আমি তোমাকে কথা দিলাম তোমার ছেলেকে সঠিক পথটা দেখাতে সাহায্য করবো,,, নিজের সর্বস্ব ক্ষমতা দিয়ে।
তৃষার কথায় তিনি সন্তুষ্ট হয়ে তৃষাকে জড়িয়ে ধরলো হয়তো তিনি কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন!!
.
.
.
.
[বাকিটা নেক্সট পর্বে]