মিছে মায়া !! Part- 04
দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। লোকটা কোথায় যেতে পারে আমার মা কে নিয়ে? মায়ের সাথে কিছু করলো নাকি? যদি মা কেও মেরে ফেলে নিরার মতো? আর তারপর পালিয়ে যায়? তাহলে আমি কি করব? না না এসব কি ভাবছি? এসব কিছুই হয়নি। আমি অযথাই চিন্তা করছি।
আশেপাশে আরেকটু খুঁজে দেখতে হবে। আজকের মধ্যেই মাকে নিয়ে ঢাকায় যেতে হবে। কেননা, নতুন জব তাই ছুটি নেই। আজ শুক্রবার দেখে আসলাম, রাতের মধ্যেই ফিরতে হবে। কাল আবার জবে জয়েন করতে হবে।
রাস্তায় বের হয়ে পরিচিত এক কাকার সাথে দেখা হলো। তার কাছে জিজ্ঞেস করে দেখি।
– আসসালামু আলাইকুম কাকা। ভালো আছেন?
– ওয়ালাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ বাবা। তুমি কেমন আছো?
– এই তো আলহামদুলিল্লাহ, চলছে। কাকা আপনি মায়ের ব্যপারে বলতে পারবেন? সকালেই আমি এসেছি মাকে নিতে। খবর নিয়ে জেনেছি তখন বাসায় ছিলো। কিন্তু এখন বাড়িতে এসে দেখি কেউ নেই। কোথায় গেছে কিছু জানেন আপনি?
– ওহ হ্যাঁ। তোমার বাবা তোমার মাকে নিয়ে ডক্টর দেখাতে গিয়েছে। জানোই তো তোমার মায়ের অবস্থা ভালো না। প্রতি সপ্তাহে তাকে নিয়ে ডক্টর এর কাছে যেতে হয়। আজ ও সকালে তোমার বাবা তোমার মাকে নিয়ে ডক্টর এর কাছে গেছে। তুমি অপেক্ষা করো। কিছুক্ষণ পরে চলে আসবে।
কাকার কথা শুনে মনে হলো নিষ্প্রাণ দেহে প্রাণ ফিরে পেয়েছি। এতক্ষণ কিসব ভাবছিলাম। যাক মাকে পেয়েছি তাতেই আমি খুশি। এখন মাকে নিয়ে শহরে চলে যাব।
বাসার সামনে এসে বসে রইলাম। তখন নিশু কল দিলো। ওর সাথে কথা বললাম। প্রায় দু’ঘন্টা বাদে দেখলাম মা আর বাবা আসছে। বাবা খুব সাবধানে মাকে রিকশা থেকে নামাচ্ছেন। মায়ের মুখে কোন ভাবান্তর নেই। আমি দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। মা তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকালো। মনে হচ্ছে আমাকে চিনেই না। তারপর আমাকে পাশ কাটিয়ে হনহন করে হেটে ঘরে চলে গেল।মায়ের এমন ব্যবহার দেখে আমার চোখে পানি ছলছল করছে। আমার মা আমাকে চিনতে পারছে না এর থেকে কষ্টের আর কি হতে পারে? নিচের দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলছি।
– তোমার মা নিরা ছাড়া কাউকে মনে রাখতে পারেনি। না তোমাকে, না আমাকে। আর সে এটাও ভাবে নিরা বেঁচে আছে।
– শান্তি হয়েছে তো আপনার? খুশি তো আপনি? এটাই তো চেয়েছিলেন আপনি। আমরা তো আপনার কাছে বোঝা ছিলাম।
বাবা চুপ করে আছেন। কোন কথা বললেন না। শুধু আমার দিকে তাকালেন। তার চোখে পানি। এই প্রথম বার এই লোকটাকে এতটা অসহায় মনে হচ্ছে। কিন্তু তাতে আমার বিন্দুমাত্র খারাপ লাগে নি। আবারো বলতে শুরু করলাম,
– আমার মা যখন সুস্থ্য ছিলেন তখন একটা দিনের জন্য তাকে ভালো রাখেননি। না তো আমাদের দুই ভাইবোন কে বাবার আদর দিয়েছেন। বরাবরই আমরা আপনার রাগ আর দুর্ব্যবহার এর সাথে পরিচিত ছিলাম। তাহলে আজ কেন আপনার চোখে জল? আপনার তো খুশিতে পার্টি দেয়া উচিত যে আপনার এক বোঝা চলে গিয়েছে, আরেকজন থেকেও নেই। আর আমি তো দূরেই। চিল করুন আপনি! পারলে আমার মা কেও মেরে ফেলুন নিরার মতো।
বাবা আমার গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় মেরে ঘরে চলে গেলেন। আমি গাল হাত দিয়ে ওখানে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। আজ উনি যদি আমাদের সাথে এরকম না করতেন তবে হয়তো এই দিনটা আমাদের দেখতে হতো না। সুখের একটা পরিবার থাকতো আমাদের যেখানে মায়ের শাসন, বাবার ভালোবাসা আর ভাইবোনের খুনশুটি দিয়ে পূর্ণ থাকতো। শুধুমাত্র তার কারণে আমাদের সুখ, শান্তি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তার সাথে অভিমান করে আমার ছোট্টবোন টা কত দূরে চলে গেছে। আমি চাইলেও তাকে আর পেত্নী বলেডাকতে পারব না, তার চুল টেনে জ্বালাতে পারব না। আমার পকেট ভরা চকলেট গুলো কেউ দৌড়ে এসে নিয়ে যাবেনা।
আস্তে আস্তে হেটে নিরার কবরের কাছে গেলাম। হাটুগেড়ে বসে পড়লাম। পকেট থেকে চকলেট বের করে কবরের ওপর রেখে দিলাম। চোখের পানি বাধা মানছে না। এই অবেলায় কেন গেলি বোন? এত অভিমান কেন তোর? আয় না, একবার ফিরে আয় প্লিজ। আই প্রমিস আমি তোর কোন কথা ফেলব না। আমি পুরো পৃথিবী এনে দিব তোকে। প্লিজ ফিরে আয়।
কাঁধের ওপর কারো হাতের ছোঁয়া পেয়ে পেছন ফিরে তাকালাম। নিশু দাঁড়িয়ে আছে। দুহাত দিয়ে আমার চোখ মুছে দিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরলো। ওকে দেখে আরো বেশি কান্না পাচ্ছে। নিশুও কাঁদছে। আমার হাত ধরে কিছুটা দূরে একটা বেঞ্চ আছে সেখানে নিয়ে বসালো। পাশে নিশুও বসে পড়লো।
– তোমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি। খাবে চলো।
– আমি কিছু খাবো না। আমি মাকে নিয়ে চলে যাব।
– এখন তো বিকেল। তোমার গাড়ি তো সন্ধ্যা ৭ টায়। আর তাছাড়া সারাদিন কিছু খাও নি। আমি নিজ হাতে রান্না করে নিয়ে এসেছি তোমার জন্য।
– নিশু প্লিজ আমি খাবো না এখন। খেতে ইচ্ছে করছে না।তুমি বরং সন্ধ্যা পর্যন্ত আমার পাশে বসে থাকো।
– আচ্ছা তাহলে খাবার রেখে দিচ্ছি। দুপুরে আমিও খাইনি। কি আর করার!
নিশু ভেংচি কেটে অন্যদিকে তাকালো। আমি হেসে ফেললাম ওকে দেখে৷ আড়চোখে একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার ও ভেংচি কাটলো।
– আচ্ছা খাইয়ে দাও তাহলে। আর তুমিও খাও।
এইবার নিশুও হেসে ফেললো। ওর হাসি দেখলে কেন যেন প্রশান্তি আসে। দুজনে কথা বলতে বলতে খাওয়া শেষ করলাম। নিশু আমাকে খাইয়ে দিলো। কতদিন পরে নিশুর হাতে খেলাম। দুজনে কিছুক্ষণ গল্প করলাম বাড়ির পেছনে বসে। সন্ধ্যার কিছু আগে নিশু বাসায় চলে গেল। ওর বাসাটা শহরের দিকে। আমাদের বাসা থেকে এক ঘন্টা সময় লাগে। যেহেতু শহরের মেয়ে তাই ওর চলাফেরা নিয়ে তেমন একটা সমস্যা হয়না। বাসা থেকে তেমন চাপ নেই।
নিশু চলে যাওয়ার পরে আমিও ধীরে ধীরে বাসায় গেলাম। প্রায় ৬টা বাজে। একটু পরেই মাকে নিয়ে বের হতে হবে। মায়ের ঘরে গেলাম। মা ঘুমিয়ে আছে। পাশে বাবা বসে আছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।
– ভেতরে আসব?
– হ্যাঁ এসো।
– আমি মাকে শহরে নিয়ে যেতে চাই। এখানে মায়ের দেখাশোনা করার জন্য কেউ নেই। আর তাছাড়া মায়ের সুস্থ্য হওয়ার জন্য শহরের ভালো ডক্টর দেখাতে হবে।
– তোমার মা এখানে বেশ আছে। আমি তার যথেষ্ট দেখাশোনা করতে পারি। তার জন্য আমি আমার জবটাও ছেড়ে দিয়েছি। আর আমি তার চিকিৎসায় কোন ত্রুটি রাখছি না।
– দেখুন আপনি যা-ই বলেন আমি আপনার কাছে আমার মাকে রেখে কিছুতেই নিশ্চিন্ত থাকতে পারব না। আপনাকে আমি একটুও ভরসা করতে পারিনা। সবসময় ওনাকে কষ্ট, অপমান আর খারাপ ব্যবহার ছাড়া কিছু দিতে দেখিনি তো তাই হঠাৎ করে যত্ন আর ভালোবাসা টা ঠিকভাবে নিতে পারছিনা।
– সেটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু তোমার মা এখান থেকে কোথাও যাবে না।
– দেখুন আমি কিন্তু জোর করে নিতে বাধ্য হবো। আমার মাকে আমার সাথে যেতে দিন।আর না জানি আপনি আবার কোন ফয়দা খুজতেছেন।এটা তো হতে দিবো না।
– আমার স্ত্রী কে তুমি আমার অনুমতি ছাড়া নিয়ে যেতে পারো না।
-এতো দিন কোথায় ছিলো আপনার এমন কথা বার্তা?দীর্ঘ সাতাশটা বছর ধরে তারউপরে অত্যাচার করে এসেছেন আর আজ দু দিনেই…
আমাদের কথার আওয়াজে মা জেগে উঠলেন। আমি মায়ের পাশে গিয়ে বসলাম।
– মা তোমাকে আমি শহরে নিয়ে যাব। তুমি যাবে না আমার সাথে?
মা একটু সরে গেলেন। তারপর বাবার দিকে তাকালেন। বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে বোঝালেন যাতে মা না বলে।
– না না আমি কোথাও যাবো না। এখানেই থাকব, কোথাও যাব না। কোথাও না। যাও তুমি, যাও। আমি যাব না। আমার নিরা এখানে একা আছে। ও, ও খুব ভয় পায়৷ ও আমাকে ডাকে। আমি যাব না। আর তুমি কে?
মায়ের প্রশ্নটা শুনে আমার মাথায় বাজ ভেঙে পরলো।
আমি মাথা নিচু করে ঠায় দাড়িয়ে রইলাম।
– না তোমার কোথাও যেতে হবেনা। তুমি এখানেই থাকবে। আমার কাছে থাকবে। এবার চুপ করে ঘুমাও। কেউ নিয়ে যাবে না তোমাকে।
বাবা বুঝিয়ে শুনিয়ে মাকে ঘুম পারিয়ে দিলেন। আমি কাছে যেতে গেলেই মা আরো ভয় পেয়ে দূরে সরে যায়।
– আপনি আমার মাকে আমার কাছ থেকে আলাদা করছেন। এটা ঠিক নয়।
– ঠিক ভুল আমি তোমার থেকে বেশি বুঝি। তুমি চাইলে এখানে থাকতে পারো। কিংবা চলেও যেতে পারো। তোমার সিদ্ধান্ত। কিন্তু তোমার মাকে নিয়ে যেতে পারো না। তাকে তুমি সামলাতে পারবে না। সে আমার কাছে ভালো থাকে।
– ঠিক আছে। আজ চলে যাচ্ছি। কিন্তু আমার মাকে আমি আপনার কাছ থেকে ঠিকই নিয়ে যাব একদিন।
বাবা একটা শুকনো হাসি দিলেন। তার হাসির মাঝে আমি ভয়ংকর কিছু দেখতে পাই।এই হাসির মানে অনেক কিছু। কিন্তু আমি এখন কিচ্ছু বুঝতে চাইনা। আমি তাকে প্রচন্ড ঘৃনা করি, প্রচন্ড!
[চলবে…..]