® মায়াবিনী—– পর্ব- ৫
লেখাঃ নিলয় রসূল
প্রচন্ড জোরে একটা বিকট আওয়াজ হলো। অয়নীর দিকে তীব্রভাবে এগিয়ে আসা গাড়িটি দ্রুতই থামনোর চেষ্টা করছিলো। শেষমেশ থামাতে সম্ভবপর হয়েছিলো।
দ্রুতো গাড়ি থেকে একটা ছেলে নেমে দাড়ালো। ঘটনার আকস্মিকতায় অয়নী মাথা ঘুরে রাস্তায় পড়ে গেছে এবং অজ্ঞান হয়ে গেছে। একটা আগে দূর্বল মেয়ের দিকে হায়েনার মতে তেড়ে আসা লোকগুলো থমকে দাড়িয়ে গেলো…! বুঝতে পারছেনা ছেলেটা কে..?
ছেলেটা মেয়েটি মানে অয়নীর দিকে তাকিয়ে দেখলো রাস্তায় উপুড় হয়ে মেয়েটি পড়ে রয়েছে। আর মাথা ফেটে অনর্গল রক্ত পড়ছে…!
সেদিকে একবার তাকিয়ে ছেলেটি হায়েনার মতো সদ্য পিশাচরুপি মানুষগুলোর দিকে কড়া চোখে তাকালো।
নেশাগ্রস্ত মাতাল,, পিশাচ গুলো ছেলেটিকে দেখে ভয় পেয়ে গেছে ভাবছে ছেলেটি হয়তো প্রশাসনের কেও একজন হবে। তাই আর সাহস করলনা তারা এগিয়ে আসতে। পিছনের কয়েকজন আগেই পালিয়েছে। সামনে যে দুএকজন ছিলো তারা একবার সামনে একটু এগিয়ে এসে কি ভেবে পিছনদিকে দৌড় দিলো….!
ছেলেটি দ্রুতো মেয়েটির কাছে আসলো। এসে দেখে কালো পিচ ঢালা রাস্তা রক্তিমাকার ধারণ করেছে। আর পাশেই একটা বাচ্চা কাঁদছে..!কয়েকবছর হবে বয়স। ছেলেটির অয়নী আর সুপ্তর জন্য খুব মায়া লাগছে। মেয়েটির মুখ তুলতেই চেহারা দেখে ছেলেটি চমকে উঠলো। ছেলেটি মনে মনে বলছে,
” কি ব্যাপার উনাকে যে খুব চেনা চেনা লাগছে কোথায় যেনো দেখেছি….! ইশ মনে করতে পারছিনা।।আরে খুব পরিচিত মুখ…। কেথায় দেখেছি…? ধুর ভালো লাগছেনা..! আর বাচ্চাটিই বা কার। মেয়েটির সাথে আছে তাহলে নিশ্চয় মেয়েটিরই হবে তবে বাচ্চার বাবা কোথায়….? আর লোকগুলোই বা কে আর মেয়েটিই বা এতো রাতে এই রকম খালি জনশুন্য রাস্তায় কি করছে একা একা সরি, বাচ্চা সহ….!
লোকগুলো যে বাজে সেটা তো বুঝলাম কিন্তু ইনি কে…? মেয়েটির বাসা কি আশেপাশেই…!
নাকি মেয়েটি আবার বাচ্চা পাচারকারীদের সাথে জড়িত।
কারের বাচ্চা নিয়ে পালাচ্ছিলোনা তো….!সবাইকে কি ডাকবো,,না পুলিশকে ফোন দিবো।
সবাইকে ডেকে কোনো লাভ নেই শালার সব কাপুরুষ একেকটা। মেয়েদের যদিও সাহস থাকে এদের তাও নেই….!
তার থেকে পুলিশকে জানায়। কিন্তু তাই যদি হবে তাহলে বাচ্চাটা মেয়েটির দিকে হাত বাড়িয়ে কাঁদছে কেনো। নাহ্ থাক পুলিশকে জানালে উল্টে আমাকেই বলবে আমি মেয়ে ভাগিয়ে পালাচ্ছিলাম। এখন টাকা দে….! বেকার ঝামেলা ডেকে লাভ নেই।
আর মেয়েটির অবস্থাও খুব খারাপ মনে হচ্ছে। তারথেকে বেস্ট আইডিয়া হচ্ছে আমি মেয়েটিকে নিয়ে হাসপাতালে যায়। ওখানে বন্ধুকে ফোন দিয়ে ডেকে নিবো। ও সব ব্যাবস্থা করবে।
আরে ধুর আমি যদি এখানে বসে এতো চিন্তা করতে থাকি তাহলে মেয়েটিকে বাঁচানো সম্ভব হবেনা। যদিও এখনো সম্ভব কিনা তা জানিনা….!
এজন্যাই বন্ধু আমাকে বলে মাথামোটা, কাজের থেকে ভাবি বেশি। আর ফজরের আজানও দিয়ে দিয়েছে তাই এখানে বসে থাকলে রাতের বেলায় নিষ্কৃয় দামাল ছেলেরা এখন সক্রিয় হয়ে উঠবে আর গায়ের জোর দেখাতে আসবে। তার থেকে হাসপাতালে যাওয়াটাই বেস্ট।”
এতক্ষণ ছেলেটি সুপ্তকে কোলে নিয়ে এতকিছু ভাবছিলো..!
এবার দ্রুতো গাড়িতে গিয়ে একটা রুমাল দিয়ে নেয়েটির মাথা যতসম্ভব বেধে দিলো। তারপর গাড়ির পিছনে শুইয়ে দিলো। আর সুপ্তকে আস্তে করে সামনে বসিয়ে দিলো। আর ছুটে চললো হাসপাতালের পথে….!
এদিকে টিনাদের বাড়িতে সবাই জেনে গেছে অয়নী চলে গেছে আর যাওয়ার সময় চিঠিতে বলে গেছে আর সে ফিরবেনা। সবাই যেনো ভালো থাকে। টিনার মা টিনার বড় ভাবি আয়েশাকে বলছে,
টিনার মা: অপয়াটা বিদেয় হয়েছে….ভালো হয়েছে
আয়েশা: যা বলেছেন মা
টিনার মা: ফকিন্নিটা বাড়িটাকে দোযখ এ পরিণত করেছিলো
আয়েশা: জ্বী মা.. (ভেংচি কেটে) আবার বলছে ভালো থাকতে হুহ্..
টিনার মা: মেয়েটা বোঝেনা ওকে ছাড়াই আমরা সুখে থাকুম
আয়েশা: মা তবে আমার অন্য কথা মনে হচ্ছে…! কি বলুন তো
টিনার মা: কি গো বউমা…!
আয়েশা: আমার মনে হয় ওর সাথে অন্য ছেলের অবৈধ সম্পর্ক আছে….!
টিনার মা: তা আবার বলতে….!
আয়েশা: নষ্ট মেয়েছেলে একটা….!
টিনার মা: সে তো আমি কখনই বুঝেছি….
রাজীব ডাইনিং রুমে আসছে দেখে ওর মা বললো
টিনার মা: এ রাজীব….!
রাজীব: কি মা
টিনার মা: তের জন্য সুসংবাদ আছে রে
রাজীব: হাহ্ আমার আবার সুসংবাদ। ওই অপয়াকে না তাড়লে আমার শান্তি নেই…
টিনার মা: আর তাড়তে হবে না।
রাজীব: কি বলছো মা। ওকে তাড়বনা। সরি তোমার কথা রাখতে পারবনা। ওকে আমি তাড়িয়েই ছাড়বো সে যে ভাবেই হোক..
টিনার মা: তার আর দরকার নেই বললাম তো,,
রাজীব: কিন্তু কেনো। না মা আমি…
টিনার মা: আগে শুনবি তে আমার কথা…
রাজীব : কি বলো?
টিনার মা: অপয়া পালিয়ে গেছে,,
রাজীব: সত্যি….!
টিনার মা: তবে কি আমি মিথ্যা বলছি রে
রাজীব: আর সুপ্ত….!
টিনার মা: ওটাকেও নিয়ে ভেগেছে
রাজীব: যাক ওর কোনো স্মৃতিচিহ্ন থাকলনা বাঁচা গেছে…
সবাই উচ্চে স্বরে হেসে উঠলো। পাশের ঘরে বসেই টিনা সব শুনতে পাচ্ছে আর কাঁদছে আর রাগে ফুলে উঠছে….!
আর সহ্য করতে না পেরে টিনা যখন ঘর থেকে বেরিয়ে ডাইনিং এর দিকে যাবে তখনই টিনার ফোন বেজে উঠলো। টিনা বিরক্তের সঙ্গে তাকিয়ে দেখলো তার মেডিকেল কলেজের এক স্যার ফোন দিয়েছে। টিনা ভাবছে,
“কি হলো বিষয়টা স্যার তো জীবনেও কারণ ছাড়া একটিবারও ফোন দেননা। তাহলে আজ হঠাৎ কেনো ফোন দিলো। কোনো সমস্যা হলো না তো। নাহ্ আমি তে পরীক্ষা ভালোই দিয়েছি..! তাহলে….অন্য কোনো বিপদ নয়তো। নাকি ভূলে ফোন দিয়েছেন। ”
এর মধ্যে ফোনটা কেটে গেলো।
” কি করবে ফোন কি ব্যাক করবো….!”
আবারও ফোন বেজে উঠলো। টিনা আর কিছু না ভেবেই ফোন ধরলো।
: হ্যালো স্যার…
: হ্যা…হ্যালো টিনা
: জ্বী স্যার বলুন
: টিনা তুমি কি দ্রুতে একবার হাসপাতালে আসতে পারবে…প্লিজ…!
: এখোন….! হাসপাতালে…..!
: কোনো সমস্যা আছে নাকি….!
: না মানে স্যার,,
: সমস্যা থাকলে থাক..
: না,,না,, স্যার সমস্যা থাকবে কেনো…
: ওহ্
: স্যার আপনার কিছু হয়নি তো…!
: আসলে একটা মারাত্মকভাবে এক্সিডেন্ট করা পেশেন্ট এসেছে….চরম ক্ষত হয়েছে….
: ওওও
: হু..এখনই অপারেশন না করলে মারা যাওয়ার সম্ভবনা আছে..! হেল্পিং হ্যান্ড দরকার একজন। হাসপাতালে সেরকম কেও নেই…
: কিহ্
: আর পেশেন্ট আমার পূর্বপরিচিত…!
: ঠিক আছে স্যার আমি এখনি আসছি…!
টিনার মন খারাপ তারপরও চলে গেলো। পেশেন্ট এর বাঁচা মরা নিয়ে প্রশ্ন যেহেতু।
হাসপাতলে ঢুকেই অপারেশন এর জন্য পোশাক পরিধান করে সোজা অপারেশন থিয়েটরে।
অয়নী প্রচন্ডভাবে আঘাত পাওয়ায় মাথায় ছোটো খাটো একটা অপারেশন হলো।মন খারাপ থাকায় পেশেন্ট এর মুখের দিকে একবারও তাকায়নি টিনা।
অপারেশন শেষে বের হয়ে বারান্দায় দাড়িয়ে আছে অবচেতন মনে।
মনে হাজারো কষ্ট তাকলে প্রকৃতির কাছে আসলে সব কেমন যেনো হয়ে যায়।
মনটা হালকা হয়।
টিনা সুপ্তকে খুব ভালোবাসতো। সুপ্ত সবমসময় টিনার ওড়না জড়িয়ে ধরে বসে তাকতো কিন্তু আজ…! টিনার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। বুকের মধ্যে হু হু করে উঠছে…!
এমন সময় মনে হলো কে যেনো ওর চুল ধরে টানছে। টিনা পিছন ঘুরে তাকাতেই দেখে একটা ছোট্ট বাচ্চা একা গাল ফোকলা দাতের বিশ্বজয় করা হাসি দিয়ে টিনার দিকে তাকিয়ে আছে….!
টিনা খেয়াল করলো বাচ্চাটার মাথায় আর বাম হাত ব্যান্ডেজ করা।
বাচ্চাটা কোলে ওঠার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছে…! টিনা এমনিতেই ছোটো বাচ্চাদের প্রতি দূর্বল। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে নার্সকে জিজ্ঞেস করলো
: একে কোথায় পেলে??
: আপা আজ সকালে যে আপা এক্সিডেন্ট করেছে সে।
: কখন বলোতো।
: জানিনা।
: ও
: তবে স্যারের কোন এক ফ্রেন্ডের গাড়ির সামনে এক্সিডেন্ট করেছে ভোর রাতের দিকে।
বাচ্চাটা টিনার কোলে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে আছে। টিনার সন্দেহটা আরে প্রকট হলো। সে জিজ্ঞেস করলো
: পেশেন্টকে কি আই সি ইউ তে দেয়া হয়েছে..!
: জ্বী
: এখনি চলো সেখানে
: কিন্তু আপা স্যার জানলে বকা দেবে আমাকে,,
: আমি আছি না। সমস্যা নায় চলো..
:আচ্ছা ঠিক আছে আপা।
টিনা দ্রুতো হাটছে বর বুক ধরপর করছে কি হবে সেটা ভেবেই,
আই সি ইউ তে ঢুকেই টিনা মুখ দেখে থমকে গেলো। সেটা আর কেউ নয় তার ভাবি অয়নী আর বাচ্চাটা তার, মানে সুপ্ত। টিনা আরো জোরে সুপ্তকে জড়িয়ে ধরলো।
সুপ্তও একবা “তিনা” বলে টিনার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেলো।
টিনা বাইরে এসে ভাবছে,” যাক শেষমেশ ভাবি আর সুপ্ত সোনাকে খুঁজে পেলাম। কিন্তু স্যার যে বললো স্যার ভাবিকে চেনে..! কিন্তু ভাবির মুখে তো কোনেদিন স্যারের নাম শুনিনি। এমনকি যেদিন এই মেডিকেলে চান্স পেলাম সেদিনও ভাবি কিছু বললনা। কিন্তু স্যার আবার বলছে স্যারের পূর্বপরিচিত…! এতে ঘন রহস্য কেনো সবজায়গায়…! তবে আমাকে জানতেই হবে। স্যারকে এখন বলবনা যে আমি এদের চিনি। তারপর দেখি কি হয়…!”
কিছুক্ষণ পর অয়নীর জন্য ঔষধ কিনে টিনার স্যার ফিরে আসলো,
: ওহ্ টিনা থ্যাংকস্
: কেনো স্যার
: এই বাচ্চাটা কাঁদছিলো আর তুমি ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছো। মনে হচ্ছে কতদিনের চেনাপরিচয়।
: স্যার আপনি কি পেশেন্ট কে চিনতেন…!
: হু
: আপনার রিলেটিভ..!
: নাহ্..
: তাহলে…! মানে আমাকে যদি বলা যায় তো বলবেন..!
: হু…তুমি আমার বোনের মতো তোমাকে বলবনা কেনো। তুমি তো সবকিছুই জানো আমার। তাহলে…
: তাহলে স্যার প্লিজ বলেননা।
: হুম। আসলে আমি ওকে…
এমন সময় টিনার স্যারের বোন ফোন দিলো।
: ইয়ে টিনা আমি তোমাকে একটু পর বলছি। বোন ফোন দিয়েছে…!
< << চলবে>>>