00

মধুরেণ সমাপয়েৎ !! Part- 08

নিজাম সাহেবকে সবাই জমের মতো ভয় পায়। উনার এক হুংকার ই সব ঠান্ডা করার জন্য যথেষ্ট। উনাকে দেখে সাফওয়ান আর কথা বাড়ায় না কারণ সে জানে তার কোনো কথা তার বাবার পছন্দ নয়। তখন নিপা বেগম তার কাছে এসে সব বললে সে বলেন,
– তোমার বয়স তো কম হয় নি নিপা, যাও শাড়ি বদলে আসো। আর সেলিনা তোমার সময় জ্ঞান সে কমে গেছে সেটা আমার জানা ছিলো না। ৮ টা বাজতে পনেরো মিনিট বাকি, পনেরো মিনিটে অনুষ্ঠান শুরু হওয়া চাই আমার।
– ভাইজান আপনি
– যা বলার হলুদের অনুষ্ঠানের পর শুনবো।
নিজাম সাহেবের হুংকার যেনো ঔষধের মতো কাজ করেছে। নিপা বেগম ফোস ফোস করতে করতে ভেতরে চলে গেলেন। নিজাম সাহেবের চেহারাটাই পুরোনো দিনের দারোগা টাইপ। উনি আয়াতকে যখন দাঁড়াতে বলে এগিয়ে গিয়ে তার সামনে দাঁড়ালেন, আয়াত ভয়ে ঢোক গিলা শুরু করলো। আয়াতের ভয় সাফওয়ানের চোখ এড়ালো না। যে বাবার সাথে বিগত চার বছর কথা বলে নি আজ আয়াতের জন্য বাবার পুনরায় আয়াতের সামনে দাঁড়ালো সে। ধীর কন্ঠে বললো,
– আব্বা, ওর দোষ নেই। ইচ্ছে করে ফুপির গায়ে হলুদ ফেলে নি।
– তোমার থেকে আমার বয়স এবং অভিজ্ঞতা ত্রিশ বছর বেশি তাই তোমার কাছে শুনতে হবে না কি ভুল কি ঠিক। আর আমি ওর সাথে কথা বলতে চাচ্ছি। তোমার সাথে না
– কিন্তু……
– ইটস ওকে সাফওয়ান ভাই, জ্বী আংকেল বলুন( কাঁপা স্বরে আয়াত )
– তুমি কি সুহানা বান্ধবী?
– জ……জ্বী, কেনো?
– কিভাবে বন্ধুত্ব ওর সাথে?
– কলেজের মাধ্যমে, ওর সাথে এক কলেজে অনার্স করেছি।
– তাহলে তুমি আমার মেয়ের মতো, এখন যা ঘটেছে এটা এই বাড়ির হরহামেশার কাহিনী। নিপার কথায় কিছু মনে করো না। ওর মেজাজটা একটু খিটখিটে। এমনি মানুষ ভালো। তোমার সাথে আমার পরিচয় হয় নি, তোমার নাম জানে কি?
– আয়াত
– বাহ সুন্দর, বাবা কি করেন?
– বাবা রিটায়ার্ড মেজর জেনারেল।
– আর্মি নাকি? আমার বেশকিছু বন্ধু আছে আর্মিতে; তারাও রিটায়ার্ড করেছেন। কাল বিয়েতে আসবেন। যাক তোমার কোনো সমস্যা হলে সেলিনাকে জানিয়ো। আর নিপা র কথায় কিছু মনে করো না।
– জ্বী আংকেল আপনি টেনশন করবেন না।

নিজাম সাহেব কথা বলে চলে যাবার পর যেনো সাফওয়ান আর আয়াত হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ভেবেছিলো নিজাম সাহেবের হাতে এই বুঝি ধরা খেলো। নিজাম সাহেব এতো ভালো ব্যবহার করবেন এটা যেনো কল্পনার বাহিরে। সাফওয়ান যেই না আয়াতকে কিছু বলতে যাবে অমনি ভেঞ্চি কেটে হাটা দিলো সে।
– যা বাবা, আমি কি করলাম?
হতবাক দৃষ্টিতে আয়াতের যাবার পথে তাকিয়ে থাকলো সাফওয়ান। এই মেয়ের কখন কিসের মুড হয় সেটা হয়তো সে নিজেও জানে না।
রাত ৩টা,
অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত বারোটার উপর বেজে গিয়েছিলো। তারপর সব গুছাতে গুছেতে দেড়টা বেজে গেছে। তাই যে যেখানে জায়গা পেয়েছে ঘু্মিয়ে পড়েছে। খুব ক্লান্ত লাগছে আয়াতের, মেজাজটাও ভীষন খারাপ, অন্না মেয়েটা সাফওয়ানের পিছন ই ছাড়ে নি। সারাক্ষন চুইংগামের মতো লেগে ছিলো। সাফওয়ানের ও দোষ ছিলো এতো সাজের ঘটার কি ছিলো। ধূর, এখন ঘুমানো দরকার, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ঘুমাবে কোথায়? সোহাগ আপু বললো সুহানার রুমে যেতে কিন্তু সুহানার রুমে শ্বাস ফেলবার জায়গাটুকু নেই। এখন? আচ্ছা ছাদের গেলে তো মন্দ হয় না। ধীর পায়ে বালিশ হাতে রওনা দিলো আয়াত, গন্তব্য ছাদ। সাফওয়ানদের ছাঁদটি বেশ বড়। মাজা অবধি রেলিং, একপাশে ফুলের টবের সারি। গোলাপের গন্ধে ম ম করছে ছাদটি। অন্যপাশে বিশাল দোলনা। দোলনায় বালিশটা রেখে রেলিং এর দিকে চলে যায় সে। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে ইচ্ছে হছে তার। গাড়ি ঘোড়ার কৃত্তিম শহরে পাওয়া গেলেও এই মুক্ত বাতাসটা পাওয়া যায় না। নীরবতার আকাশটা আজ জোৎস্নায় আলোকিত।
– তুমি এখানে কি করছো?
হুট করে কারোর কথা শুনে আৎকে উঠলো আয়াত। বাড়ির প্রতিটা জীব ঘুমন্ত। এই মাঝ রাতে কারোর ছাদের আসার কথা না। পেছনে ফিরে যেন বুকে ডেউ খেলে যায় আয়াতের। চাঁদের আলোতে তুলি হাতে পুরুষটিকে ঠিক যেন গ্রিক দেবতা জিউসের ন্যায় লাগছে। এতো সুন্দর পুরুষ হয় বুঝি! সাদা পাঞ্জাবি, তাতে রঙের লেগে আছে। চুলগুলো বাতাসের উম্মাদনায় দোলা খাচ্ছে, সামনে দাঁড়ানো পুরুষটি যে আর কেউ নয়, সে যে সাফওয়ান। লোকটার প্রতিটা কাজ আজকাল উম্মাদনার পরশ দিচ্ছে আয়াতকে। আয়াতকে হাবলার মতো হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে অনেকটা অস্বস্তির মাঝে পড়ে যায় সাফওয়ান। তুরি দিয়ে তাকে পুনরায় জিজ্ঞেস করে,
– এতো রাতে এখানে কি করছো?
– হ্যা?
– কি হ্যা? ঘুমাও নি কেনো?
– ও

এবার কাছে যেয়ে ঝাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
– এই মেয়ে নেশা করছো নাকি? হ্যা, ওহ কি হইয়েছে? এভাবে কি দেখে যাচ্ছো?
– আপনাকে দেখছি

মুখ ফসকে বলে নিয়ে জিব কেটে বসে। তারপর সামলে নিয়ে বলে,
– না মানে, আপনাদের ছাদ দেখছি
– এতোরাতে?
– তো কি করবো?আপনার বউ অন্না বারবার গায়ে পা তুলে আমার ঘুম ভেঙে দিয়েছে। তাই ছাদের এসেছি। আপনি কি করছেন শুনি?
– আমার রুমে সব মামারা ঘুমোচ্ছে, তাই ছাদে এসেছি কাজ করতে।
– ছবি আঁকছিলেন বুঝি?
– না তুলি হাতে মাটি খুড়ছিলাম
– এভাবে বলেন কেনো? সোজা প্রশ্নের সোজা উত্তর দিলে কি হয় আপনার?
– সকালে উঠে যদি তোমাকে আর আমাকে একসাথে এখানে দেখে বুঝতেছো কি হবে?
– আমি ভোরে চলে যাবো
– আহারে কি ভোরে উঠা মানুষ আমার!
– তাহলে আপনি চলে যাবেন
– কি বুদ্ধি!
– আই নো। আচ্ছা কি আঁকছিলেন?
– দেখানো যাবে ন, সিক্রেট
– আহ, সাফওয়ান ভাই দেখান না।
– উফফ জিদ করো না, এখনো কমপ্লিট হয় নি। কমপ্লিট হলে তোমাকে প্রথম দেখাবো।
– সত্যি তো? প্রমিস?
– প্রমিস।

বলে আয়াতকে কোনোমতে সামাল দিলো সাফওয়ান। আয়াত ও আর জিদ না করে যেয়ে দোলনায় গিয়ে বসলো। পেন্টিংটা ঢালা দিয়ে, হাত ধুয়ে আয়াতের পাশে গিয়ে বসে সে।
– সাফওয়ান ভাই, ভালোবাসায় বিশ্বাস ভাংগার কষ্টটা খুব দুঃসহনীয়। আচ্ছা আপনি কোনোদিন কাউকে ভালোবাসেন নি?

উদাশ চিত্তে শান্ত গলায় প্রশ্ন ছুড়ে দেয় আয়াত।
– হঠাৎ আজ এই প্রশ্ন
– এমনি, শুনেছি কষ্ট না পেলে শিল্পী হওয়া যায় না; কথাটার যথার্থতা পরীক্ষার বৃথা চেষ্টা বলতে পারেন
– আমি ভালো শিল্পী নই। এবার বুঝে নাও
– আমি বাড়ি ফিরে যাবো সা্ফওয়ান ভাই।
– হঠাৎ?
– ইফাদ কথা রাখে নি, তাই বলে দেউলিয়ার ঘুরার মানে হয় না। বাবা মারবেন, বকবেন মেনে নিবো। বাবা হয়তো এখন রেগে আছেন, হয়তো থাকবেন। কিন্তু দোষ তো আমার তাই না? আমি যদি নিজের দোষ মেনে ক্ষমা চেয়ে নেই আমার মনে হয় উনি ক্ষমা করে দিবেন।
– যাক ঘটে সুবুদ্ধির উদয় হয়েছে। বেশ আর তো তিনদিন এরপর তোমাকে বাসায় দিয়ে আসবো তাহলে।
– থ্যাংক উ, আপনার কাছে সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। এই ছয়দিন আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ ছয় দিন। এই ছয়টা দিন না থাকলে আপনাকে হয়তো সারাজীবন অসহ্যের কাতারেই রাখতাম।
– তাই বুঝি? আমাকে এতো অসহ্য লাগতো তোমার?
– তাই নয় কি? আপনি বলেন এই চার বছর আপনার সাথে আমার পরিচয় একবার ভালো ব্যবহার করেছেন? অন্নার সাথে এর চেয়ে মিষ্টি করে কথা বলেন আপনি?
– হিংসা হচ্ছে বুঝি?
– বয়েই গেছে।

খুনসুটিতে কখন যে সকাল হয়ে গেছে টের পায় নি তারা, ভোরের প্রথম কিরনে মুগ্ধ নয়নে আয়াতের দিকে তাকিয়ে আছে সাফওয়ান। এতোটা স্নিগ্ধ মেয়েটাকে সারাজীবন নিজের কাছে রেখে দিতে ইচ্ছে করছে। আয়াত উঠে নিচের দিকে চলে যাবার সময় পিছু ডাকে সাফওয়ান। শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে,
– তুমি কি এখনো ইফাদের জন্য অপেক্ষায় আছো?
– জানি না, আজকাল তার আনাগোনা আমার হৃদয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। তাকে নিয়ে কোনো স্বপ্ন বুনে না ভাবনারা। হয়তো অপেক্ষার প্রহর আর গুনতে চায় না বেহায়া মনটা।
– যদি কেউ নতুন করে বন্ধ হৃদয়ের দরজায় কড়া নাড়ে তবে?
– এবার আর অন্ধ হয়ে দরজা খুলবো না। কাঠ খড় পুড়াতে হবে কিন্তু।
– তাহলে কড়া নাড়ার সুযোগ দিচ্ছো?
– বাবার হৃদয়ের দরজায় কড়াটা আগে নাড়তে হবে। বাবা দরজা খুলে আমন্ত্রণ জানালে আমার কোনো সে নেই।
– যাহহ যা একটু বন্ধুরা চান্স নিতো তাও হবে না।
– হাহাহা, থাকেন আমি যাই

বলেই রুমের দিকে হাটা দিলো আয়াত। আর তার যাওয়ার পানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাফওয়ান।

দুই দিন পর,
আজ সুহানার বিয়ে, কমিউনিটি সেন্টারে বিয়েটা হবে। সাফওয়ানের অন্যান্য কাজিনদের সাথে আয়াত ও লাইনে দাঁড়িয়েছে বরের গেট ধরতে। নিজাম সাহেব প্রচুর নামীদামী লোকদের একজন বিধায় আত্নীয়ের এবং গেস্টের অভাব নেই। সবাইকে গোলাপ জলের ছিটা দিয়ে বরণ করছে আয়াতরা। হুট করে একজন গেস্টের দিকে গোলাপ জল ছিটাতেই হাত আটকে গেলো তার। গেস্টটিও আয়াতকে নিপুন সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষন করে যাচ্ছে। আয়াতের চোখে পানি ছলছল করছে, এভাবে তার সাথে দেখা হবে এ যেনো মানতে পারে নি সে। মনের অজান্তেই মুখ ফসকে বেড়িয়ে গেলো আয়াতের,
– বাবা…………

চলবে