ভাড়াটে বউ

ভাড়াটে বউ — পর্ব-১০ (শেষ-অংশ)

চারপাশের বাড়িটা আজ আলোক সজ্জায় সাজানো,
হলুদ, নীল, আর লাল বাতির স্পর্শে পুরো বাড়িটা
আজ একটু বেশিই আলোকিত দেখাচ্ছে। বাড়ির
মানুষগুলো ও আজ অনেক ব্যস্ত, কিন্তু
কীসের এতো ব্যস্ততা।
কীসের এতো আয়োজন?
মিসেস শায়লা বেগম আর শিলা রান্না ঘর থেকে
যেনো আজ বের হতেই পারছেনা, সামছুল হক
বাড়ির কোথা ও কোনো ক্ষুদ আছে কিনা তা
ঘুরে- ঘুরে দেখছে,আর
মিথিলা একগাল হাসি মুখে রেখে উপরে
যেতে লাগলো, আর চেঁচিয়ে – চেঁচিয়ে
রিয়ানকে ডাকতে লাগলো— ভাইয়া, এই ভাইয়া।
অতঃপর
রিয়ানের দরজার সামনে গিয়ে নক করতে
লাগলো আর বলতে লাগলো — কীরে ভাইয়া
আজকের দিন ও কী তুই এতো বেলা অবদি
ঘুমোবি।
ওপাশ থেকে তখন উওর আসলো– একটু দাড়া
বোন আসছি।
গলার আওয়াজটি শুনতে পেয়ে মিথিলা শান্ত হয়ে
গেলো, কিছুসময় পর রিয়ান দরজা খুললো, রিয়ান
দরজা খুলতেই মিথিলা চমকে গেলো রিয়ানকে
দেখে, পরনে নীল, গোল্ডেন
শেরোয়ানি,
— বেশ লাগছে ভাইয়া তোকে।
— ধন্যবাদ মাই ডিয়ার সিস্টার।
— বাট ভাইয়া তুই আজ ও এতো বেলা অবদি
ঘুমোলি।
—- আরে না, রুম সাজাচ্ছিলাম।
— রুম সাজাচ্ছিলি কিন্তু কার জন্য।
— বাহ! রে তুই জানিস না বুঝি কার জন্য?
মিথিলা রিয়ানের মুখ থেকে বাক্যটি শুনা মাএই নিশ্চুপ
হয়ে রইলো, কিছুসময় পর রিয়ানকে শান্ত কন্ঠে
বলতে লাগলো—আর কতকাল অপেক্ষা করবি
ভাইয়া, কতদিন আর এভাবে ঘর সাজাবি, কত দিন আর
মিথ্যে আশা নিয়ে মরা লাশটির কাছে যাবি।
— চুপ, চুপ মিথিলা এসব বলতে নেই, আর কে মরা
লাশ, ও আমার সাথে অভিমান করেছে তাই হয়তো
এভাবে আছে।
তুই দেখিস ও আজ আমার সাথে আসবে,আমার
সাথে কথা বলবে।
—; প্রতিদিনেই তো তুই এই কথাটি বলিস।
— এই আশাটিয়েই তো আমার সব মিথি। যাইহোক
আমি তাহলে এখন বের হই।
— মানে কী, তুই এখনেই হসপিটালে যাবি।
— হুম,
— খেয়ে যাবিনা।
— এসে খাবো
এই বলে রিয়ান ঘর থেকে বেরিয়ে
গেলো,নিচে নামতেই মিসেস শায়লা বেগম
রিয়ানকে দেখা মাএই ওর কাছে এসে ওর মাথায়
হাত দিয়ে বলে উঠলো — বাবা যার কাছে যাচ্ছিস,
সে যেনে আজ সুস্থ হয়ে যায় তোর
অপেক্ষার যেনো অবসান ঘটে।।
— দোয়া করো মা।
— প্রতিদিনেই তো এই দোয়াটি করি আর প্রতিদিন
তুই আসার অপেক্ষায় থাকি এই ভেবে যে এই
বুঝি তুই হাসি মুখে ওর হাতটা ধরে এই ঘরে ফিরবি ।
রিয়ান মায়ের কথার কোনো উওর না দিয়ে
ছলছল চোখে বাড়িতে থেকে বের হয়ে
গেলো। মনের মাঝে নানা আশা আর স্বপ্ন
নিয়ে হসপিটালের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো,
তারপর ৩৪৫ নাম্বার কেবিনে গেলো, গিয়ে
দেখে সাঈফ বসে আছে সাঈফকে দেখা
মাএই রিয়ান বললো— মামা, চলে এসেছি।
— এই তোমার আসার সময়,
সেই অনেক্ষণ অবদি তোমার জন্য বসে আছি।
— স্যরি মামা আসলে জ্যামের কারনে আসতে
একটু দেরি হয়ে গেছে।
— ব্যাপার না, এবার তুমি তোমার ওয়াইফের সাথে
থাক, আমি চললাম।সাঈফ চলে যেতেই রিয়ান
ক্রমশ কেবিনের কাছে গেলো, তারপর রাইসার
মাথায় হাত দিয়ে ছলছল চোখে বলতে
লাগলো—আজকের দিন ও এভাবে নিশ্চুপ হয়ে
শুয়ে রইবে, উঠবেনা তুমি জানো আজকে
কী?
আজ আমাদের First Anniversary, এ দিনেই তো
তুমি এই ইডিয়েট ছেলেটাকে ঠিক করার জন্য
ওর হাতটা ধরেছো।
আর এ দিন ও তুমি আমার সাথে কথা বলবেনা, একটা
লাশের মতো শুয়ে থাকবে, তুমি জানো আজ
আমি তোমার জন্য পুরো বাড়িটা সাজিয়েছি, মাকে
বলে এসেছি আজ তোমাকে আমি আমার সাথে
নিয়ে যাবো। অবশ্য প্রতিদিনেই মাকে এই
আশ্বাসটা দিয়ে আসি তবে আজকে অন্তরের
অন্তস্থল থেকে কথাটা বলে এসেছি।
উঠোনা, আমার সাথে কথা বলোনা।
হঠ্যাৎ রিয়ান নিশ্চুপ হয়ে গেলো, তারপর কিছুক্ষণ
চুপ থেকে বলে উঠলো– এতো অভিমান
তোমার যে একটা বছর পেরিয়ে গেলো,
অথচ তুমি এখন সেই পুতুলের মতো নিশ্চুপ
হয়ে শুয়ে আছ ও।
তুমি জানো? প্রতিদিন বাবা ভাবে এই বুঝি তুমি সুস্থ
হয়ে বাবাকে বলবে — আপনে কোনো চিন্তা
করবেননা বাবা, আপনার ছেলে আবার আগের
মতো ঠিক হয়ে যাবে। মিথি প্রত্যহ ভাবে এই
বুঝি তুমি ওকে গিয়ে জড়িয়ে ধরবে। আর আমি
তোমার সুস্থ হওয়ার অপেক্ষায় প্রত্যহ
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলি। কিন্তু তুমি?
আমাদের অপেক্ষাটার অবসানেই ঘটাচ্ছনা, আচ্ছা
তোমার এতো অভিমান, এতো আমার উপর রাগ
যে সেদিন সেই যে বললাম — চলে
যেতে তাই আজ ও নিশ্চুপ হয়ে রয়েছে।
গত এক বছর ধরে প্রতিদিন তোমার কাছে এসে
তোমার সাথে আমি নিজেই শুধু কথা বলি কিন্তু তুমি
একবার ও আমার সাথে কথা বলোনা, তুমি বুঝো না
রাইসা এতে আমার খুব কষ্ট হয়।
আচ্ছা রাইসা তোমার এভাবে শুয়ে থাকতে কষ্ট
হয়না, প্লিজ রেসপন্স কর, প্লিজ।
রিয়ানের কথাগুলো শুনে রাইসার চোখ জলে
টলটল করতে লাগলো, রিয়ান তা দেখে
অভিমানী কন্ঠে বললো— এতই যখন আমার
কষ্ট দেখে তোমার কষ্ট হয় তাহলে কেন
উঠছো না, কেন আমার হাতটা আকড়ে ধরছো না,
রাস্তায় হাটতে গিয়ে যখন হোচট খেলাম তখন
তুমি আমার হাতটা আকড়ে ধরে আমাকে পথ
দেখিয়েছো আর এখন মাঝপথে ছেড়ে
দিয়েছো, তাহলে তোমার আর রিয়ার মধ্যো
কী পার্থক্য রইলো।
রাইসার অশ্রু তখন গড়িয়ে রিয়ানের হাতে
পড়লো, রিয়ান তখন বললো– না তুমি ভেবোনা
আমাকে নিয়ে রাইসা, সেদিন যখন ডক্টর
বলছিলো তুমি কোমায় চলে গেছো, তুমি
কখনো আর রেসপন্স করবে কীনা সন্দেহ
আছে, কথাটি শুনে সেদিন হয়তো আমি
ক্ষণিকের জন্য ভেঙ্গে পড়েছিলাম, কিন্তু
পরক্ষণে আমি নিজেকে বুঝিয়েছি এই বলে
যে— যারা অন্যদের বাচার অনুপ্রেরণা দেয় তার
কখনোই এতো সহজে মরে যায় না। আর এই
বিশ্বাসে, দেখতে- দেখতে একটা বছর পার
করে দিলাম।
তুমি তো জানো রাইসা আমি এখন আর সিগারেট
খাইনা,এখন আর মদ খাইনা এখন আর রাত ও জাগিনা, আর
ওই তিন রাস্তার মোড়ে ও বসে থাকিনা। কেন
জানো?
কারন তোমার শেষ কথাটি ছিলো — ভালো
থাকবেন।
আর সেই কথাটিই আমাকে নতুন করে জিবন শুরু
করতে বাধ্য করেছে,
আর ভালো থাকার ও চেষ্টা করছি,এবং নিজের
কাছের মানুষগুলোকে ও ভালো রাখার চেষ্টা
করছি। জানো রাইসা এখন আমি অনেক কিছু বুঝে
গিয়েছি সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিয়ে চলতে
শিখে গেছি।
যখনি এখন আবেগের বর্শে আবার জিবনকে
থামিয়ে দিতে চায় মন,
তখনি তোমার কাছে চলে আসি তোমার এই
নিস্পাপ চেহারা দেখে আমি আবার বাচার
অনুপ্রেরণা পাই। সেদিন হয়তো রাইসা আমি
তোমার কথাগুলোর মূল্য বুঝতে পারিনি কিন্তু
এখন বুঝতে পেরেছি।
আসলে আমরা সত্যিকারের যখন কেউকে
ভালোবাসি তখন ভালোবাসার মানুষটিকেই ভুল
নির্বাচন করি। আর যখন কেউ আমাদের
সত্যিকারের ভালোবাসে তখন আমরা না তার
ভালোবাসাটা বুঝিনা, , বুঝতে পারি তখনি যখন সে
আমাদের ছেড়ে দূরে চলে যায়। যেমন এখন
আমি বুঝতে পেরেছি তোমার নিরবতার কারনে
আর রিয়া ও হয়তো বুঝতে পেরেছে
তাইতো কয়েকদিন আগে আমাকে ফোন
দিয়ে কাঁদতে – কাঁদতে বললো– ও আমার
কাছে ফিরে আসতে চায়। কিন্তু এ কথাটি শুনে না
সেদিন আমি ও একটু ও খুশী হয়নি, তিনটা বছর যার
জন্য মরা লাশের মতো ছিলাম সে আমাকে
ফোন দিয়েছে, সেই অনুভূতিটা আমার ভিতর কাজ
করেনি কেন জানো বিকজ আমার সব অনুভূতি আর
আবেগ, ভালোবাসা শুধু তোমায় ঘিরে। আসলে
আমাদের জিবনে সুখকর অনুভূতির ঘাটতি থাকে
বিধায় আমরা জিবন পথ চলতে গিয়ে বারবার
ভালোবাসাটাকে খুজি, আর ভালোবাসা প্রথম,
দ্বিতীয়, তৃতীয় বলতে কিছু নেই, যেই
ভালোবাসায় হাজার কষ্টের মাঝে ও আমরা সুখকর
অনূভুতি খুজে পাই সেটাই প্রথম এবং শেষ
ভালোবাসা, আর বাকি সবকিছু আবেগ কিংবা একটু
ভালোলাগা ছাড়া আর কিছুই নয়।
আজ মনে হচ্ছে সেদিন রিয়া আমাকে ছেড়ে
চলে গিয়ে অনেক ভালো করেছে, কেননা
এই পৃথিবীতে এমন অনেক স্বামী- স্ত্রী
আছে যাদের ভিতর ভালোবাসা শব্দটি নেই কিন্তু
সমাজ, বাস্তবতার কারনে একজন আরেকজনের
সাথে মিথ্যে অভিনয় করে জিবনটা পার করে
দিচ্ছে। কিন্তু রিয়া আমার সাথে সে নাটকটা
করলোনা, যদি করতো তাহলে কখনোই
জানতেই পারতাম না যে ও আমাকে কখনোই
ভালোবাসেনি, আমি শুধু মাএ ওর আবেগ ছিলাম যার
মেয়াদ ছিলো তিন বছর। আর ভালোবাসা জিনিসটা
কখনো সময়ে সাথে- সাথে কমেনা বরং একটু
একটু করে বাড়ে।
যা মানুষকে আর দীর্ঘ দিন বাচার অনুপ্রেরণা
দেয়। আর সেই অনুপ্রেরণা নিয়েই তো দুজন
একসাথে হাতে – হাত রেখে জিবনের সমস্ত
জরা- জীর্ণতা আর বাধা অতিক্রম করে।
— আর কত ওই পুতুলের সাথে কথা বলবে রিয়ান?
সাঈফের গলার আওয়াজটি পেতেই রিয়ান নিশ্চুপ
হয়ে গেলো,কিছুসময় রাইসার দিকে তাকিয়ে
থেকে বলে উঠলো— যতদিন ও রেসপন্স না
দেয়।
— ওর আর রেসপন্স, এই আশা নিয়ে তো এক
বছর পার করেই দিয়েছো। যাও বাড়ি যাও।
এই বলে সাঈফ চলে গেলো।
রিয়ান তখন রাইসার চোখের জলগুলো মুছতে
লাগলো, আর নিলিপ্ত স্বরে বলতে লাগলো—
আজকে ও খালি হাতে ফেরাবে।
তারপর রিয়ান রাইসার কপালে হাত বুলিয়ে বলে
উঠলো— আসি।
কথাটি বলে রিয়ান দাড়িয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা
দিতেই মনে হলো কেউ ওর হাতটাকে শক্ত
করে ধরে রেখেছে।
নিছক কল্পনা কিংবা স্বপ্ন মনে করে রিয়ান আবারো
চলে যেতে গেলেই সেই অনুভূতিটটা
আবারো ফিল হলো।
রিয়ানের চোখ- মুখে সুখের আমেজ
নেমে আসলো, পিছন ফিরে তাকালো,
তাকাতেই দেখে রাইসা হাতটা আকড়ে
ধরেছে,
রিয়ান ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারলোনা, তাই রাইসার
মাথার পাশে গিয়ে বসে, চোখ দুটো বন্ধ
করলো নিছক স্বপ্ন ভেবে, হঠ্যাৎ মনে
হলো কেউ তাকে বলছে— নিয়ে যাবেনা
আমায় তোমার সাথে।
কৌতুহল বর্শে চোখ খুলতেই রিয়ান দেখলো,
রাইসা ওকে কথাটি বলছে।
ব্যাপারটা দেখে রিয়ান জোরে,জোরে শ্বাস
ছাড়লো, আর সেই এক একটা শ্বাস যেনো
রিয়ানের এক বছরের অপেক্ষার প্রহর গুনার
প্রমান।
রিয়ান রাইসার কপালে আলতো করে একটা চুমু
দিয়ে বললো—
একটা বছর পর আমার অপেক্ষার সমাপ্তি হলো,
রাইসা আমি কী কোনো স্বপ্ন দেখছি।
রাইসা তখন আস্তে- আস্তে বললো— আমি রিয়া
নয় যে হোচট খেয়েছো বলো মাঝপথে
তোমায় ছেড়ে চলে যাবো। তাইতো
মরতে- মরতে ও বেচে গেলাম।
রিয়ান এতোক্ষণ পর বুঝতে পারলো যে এখন
যা ও দেখছে বা ওর সাথে হচ্ছে সব সত্য, রিয়ান
কিছুসময় চুপ থেকে অতঃপর জোরে চিৎকার
দিয়ে ডক্টরকে ডাকতে লাগলো— ডক্টর ও
রেসপন্স করেছে,ও রেসপন্স করেছে।
তারপর উচ্চস্বরে হেসে বলতে লাগলো–
এই ভাড়াটে বউ তুই আমার সাথে বাড়ি যাবিনা?
— না,
— কিন্তু কেন?
— কারন এই যে তুই বললি আমি তোর ভাড়াটে বউ,
যার ২ মাস ফুরিয়ে গেছে।
— রিয়ান তখন হাসতে – হাসতে বললো, হ্যা
তো তুই আমার ভাড়াটে বউ তো, তবে ২
মাসের জন্য নয় সারাজিবনের।
এই বলে রাইসার হাতটা আর ও শক্ত করে আকড়ে
ধরলো আর যাতে হারিয়ে না যায়।
তারপর রিয়ান কাঁদতে লাগলো, রিয়ানের কান্না
দেখে রাইসা বলে উঠলো– এ মা রিয়ান হক
কাঁদছে।
— কী করবো বল, তুই য়ে তো কাঁদতে
শিখিয়ে দিলি, আমায় ছেড়ে চলে যাস না প্লিজ।
— কখনো না, এই যে হাতটা ধরলাম মৃত্যু অবদি
শক্ত করে ধরে রাখবো।
( সমাপ্ত).
( এই যে আপনাদের বলছি যারা রিয়ানের মতো
এমন কেউকে ভালোবেসে জিবনটাকে
থামিয়ে দিতে চাইছেন তাদের বলছি, থমকে
যাবেননা, সমস্ত কষ্টকে উপেক্ষা করে
সামনে হাটতে থাকুন দেখবেন এমন কারো
দেখা পাবেন যে আপনে মাঝ পথে হোচট
খেয়ে পড়ে গেলে ও ছেড়ে চলে
যাবেনা
যাইহোক,
ধন্যবাদ গল্পটি পড়ার জন্য সবাইকে,ভুল- হলে
ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।