ভাড়াটে বউ

ভাড়াটে বউ —পর্ব –০৭

— চাউলের বস্তা বলেছে তো কী হয়েছে
তাই বলে তুমি ওর মাথায় কফি ঢেলে দিলে, সাহস
তো তোমার কম নয়।
শিলা বেগমের চোখে- মুখে প্রচন্ড রাগের ছায়া
দেখে মিথিলা ফিসফিস করে রাইসাকে বললো—
ভাবী বললাম না কথা বলোনা, এই ক্ষেপলো
বলে।
—- হুম, দাড়া ও দেখনা কী করি।
এই বলে রাইসা কাঁদতে লাগলো জোরে-
জোরে, রাইসার কান্না দেখে সবাই অবাক হয়ে ওর
পানে তাকিয়ে রইলো। শিলা বেগম আর রিয়ানের মা
শায়লা বেগম বিস্মিত কন্ঠে রাইসাকে জিজ্ঞাসা
করলো — এই তুমি কাঁদছো কেন?
প্রশ্নটি শুনে রাইসা কান্নাটা বন্ধ করে ফুঁপিয়ে –
ফুঁপিয়ে শিলা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলতে
লাগলো — আমি আপনার সম্মান বাচানোর জন্য এমন
করলাম আর আপনে আমাকে বকা দিচ্ছেন?
—– মানে? আমার সম্মান বাচানোর জন্য?
— ভাবী এবার কিন্তু তুমি কেস খাবে।
— চুপ,
— এই মেয়ে কী ফিসফিস করছো, কই
বললেনাতো আমার সম্মান বাচানোর জন্য মানে।
— আসলে কী সোনা মা, ওনি আমাকে চালের
বস্তা বলেছে, আমি তো একটা মেয়ে তার মানে
একটা মেয়েকে চালের বস্তা বলা মানে তো ও
পুরো মেয়ে জাতটাকেই চালের গুদাম, দূততরি
চালের বস্তা বলেছে।
রাইসার এমন কথা শুনা মাএই শিলা বেগম, মিথিলা, শায়লা
বেগম একসাথে রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে
প্রচন্ড ক্ষেপে উঠলো— এই কথা তো আগে
ভাবিনি, রিয়ান।
তিনটে মেয়ে মানুষের এভাবে অগ্নিময়
চোখের স্পর্শে রিয়ানের পুরো শরীর ভয়ে
আর রাইসার প্রতি রাগে ক্রমশ ঘামাতে লাগলো, রিয়ান
সোনা মায়ের দিকে তাকিয়ে আমতাআমতা করে
বলতে লাগলো— সোনা মা আমি কিন্তু এভাবে
ভেবে বলিনি, ও তোমাকে মিথ্যে বলছে।
এই বলে রিয়ান দ্রুত রাইসার সামনে গিয়ে ওকে
চেঁচিয়ে বলে উঠলো— এই মেয়ে তুমি কী
বলছো এসব?
রিয়ানের কথাটি শুনে রাইসা মুচকি হেসে রিয়ানকে
চোখ টিপ দিয়ে বলে উঠলো– কেমন দিলাম
আমার হট টেম্পারেচার জামাই?
— ও তার মানে এসব তুমি ইচ্ছে করে করছো,,
আমি, আমি তোমাকে দেখে নিবো।
হঠ্যাৎ রিয়ানের মনে হলো পিছন থেকে কেউ
একজন তার শার্টের কলার ধরে টানছে,
কৌতুহলবর্শে পিছনে তাকাতেই দেখে রাগান্বিত
ভাবে সোনা মা — এই তুই ওর সাথে কী বলছিস
আমার সাথে কথা বল। তুই মেয়েদের অপমান
করছিস?
— ইয়ে মা,মা, মানে না সোনা মা ও মিথ্যে বলছে
দেখ ও চোখ টিপ দিচ্ছে।
— চুপ।তুই আমার সাথে একদম আর কথা বলবিনা।
এই বলে শিলা বেগম দানবের মতো হাটতে-
হাটতে উপরে চলে গেলো।
রিয়ান কিছুসময় বক রাক্ষসের মতো রাইসার দিকে
তাকিয়ে থেকে তারপর কিছুনা না বলেই নিজের
ঘরের দিকে চলে গেলো।
রিয়ান চলে যাওয়ার পর শায়লা বেগম রাইসার কাছে
গিয়ে আলতো করে ওর মুখে হাতটা রেখে
স্নেহমাখা কন্ঠে বললো— এই সংসার আর আমার
ছেলেটাকে আগলে রেখো।
রাইসা তখন সম্মানজনক ভাবে শায়লা বেগমকে সালাম
করলো, শায়লা বেগম তখন হাসিমুখে রাইসাকে
বললো — তুমি এখানে বসো মা, আমি সবাইকে
ডেকে আনছি মা, আর হ্যা মিথিলা তুই ওর সাথে থাক।
— হুম বড় মা।

মিসেস শায়লা বেগম ড্রইং রুম থেকে যেতেই
মিথিলা আর রাইসা একজন আরেক জনের দিকে
তাকিয়ে উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো।
— ভাবী তুমি তো ফাটিয়ে দিয়েছো।
— তা তো বুঝলাম, কিন্তু সোনা মা তো রিয়ানকে
অনেক ভালোবাসে তাহলে আমার এই সামান্য কথায়
ওর প্রতি এতো ক্ষেপে গেলো কেন?
— আরে ভাবী তোমার আন্দাজি ডিলটাই তো গিয়ে
গাছে লেগেছে।
— মানে?
— মানে মা পৃথিবীতে সবথেকে বেশি অপছন্দ
করে কেউ যদি মেয়েদের অসম্মান করে,
কোনোভাবে যদি কারো কাজে মেয়েদের
অসম্মানের ইংঙিত থাকে, ব্যস তার আর রক্ষে
নেই,
সেই হিসেবে তো ভাইয়াকে কিছুই বললোনা।
— তাই নাকি আগে বলবেনা তাহলে তো কাটা গায়ে
নুনেরছিটেটা একটু বেশিই দিতাম।
— ভাবী এবার কিন্তু আমি তোমার বিপক্ষে চলে
যাবো, আমার ভাইয়াকে কিন্তু অতো খারাপ নয় যে
এমন করতে হবে বুঝছো।
— কী বুঝবে দাদুভাই।
এতো সুন্দর করে ডাক আর স্নেহমাখা কন্ঠের
আওয়াজ পেয়ে রাইসা আর মিথিলা সামনে তাকাতেই
দেখে শায়লা বেগম একজন বৃদ্ধ মহিলাকে ধরে-
ধরে রাইসার কাছে নিয়ে আসছে। বৃদ্ধ মহিলাটিকে
দেখে মিথিলা মুখে একরাশ হাসি নিয়ে মহিলাটির কাছে
যেতে লাগলো আর বলতে লাগল— দিদুন, তুমি
এসো, এসো।
এই বলে মিথিলা আর শায়লা বেগম দিদুনকে ধরে-
ধরে রাইসা সামনে আনতেই রাইসা সম্মানোত্তর
ভাবে দিদুনকে সালাম করলো,
সালাম করে দাড়িয়ে দিদুনের দিকে তাকাতেই, দিদুন
জলচোখে শায়লাকে উদ্দেশ্য করে বলে
উঠলো— বড় বউ এতো দেখছি একেবারে রিয়ার
মতো লক্ষীমন্ত্র, বেচে থাক দাদু ভাই।
দিদুনের মুখ থেকে রাইসা রিয়া নামটি শুনা মাএই আবার ও
ওর মনে প্রশ্নরা বাসা বাধলো– কে এই রিয়া, এই
বাড়ির দেওয়াল, এই বাড়ির মানুষদের মুখে তাদের
মনে শুধু রিয়া কে ও?
রাইসাকে এমন চিন্তার জগতে থাকতে দেখে
মিসেস শায়লা বেগম বলে উঠলো — কী
ভাবছো মা?
শায়লা বেগমের গলার আওয়াজে রাইসা ভাবনার জগত
থেকে বাস্তবতা ফিরে আসলো তারপর অত্যন্ত
সেন্হমাখা কন্ঠে বললো— কিছু না মা।
— ও আচ্ছা, এস ও তোমার সাথে বসে দুদন্ড কথা
বলি।

তারপর,
রাইসা, দিদুন, মিথিলা আর মিসেস শায়লা বেগম একসাথে
বসে জমিয়ে গল্প করতে লাগলো, ঠিক এমন সময়
শামছুল হক দুই ব্যাগ বাজার নিয়ে বাড়িতে ঢুকতে-
ঢুকতে বলতে লাগলো— কই আমার নতুন বউ মা
কই।
শামছুল হকের গলার আওয়াজে সবাই দাড়িয়ে
গেলো, রাইসা চোখে – মুখে একরাশ খুশী
নিয়ে দরজার সামনে যেতে অগ্রসর হলেই
মিসেস শায়লা বেগম তখন রাইসাকে বলে উঠলো–
তোমার যাওয়া লাগবেনা মা, আমি যাচ্ছি ।
— না মা আমিই যাবো।
— হ্যা আমার বউ মা কে এই দিকে আসতে দেও
দেখি।
রাইসা দরজার কাছে গিয়ে হাত থেকে বাজারের
ব্যাগগুলো নিতে-লাগলো আর গম্ভীর কন্ঠে
শামছুল হককে বললো — বাবা আপনার এই শরীর
নিয়ে কিন্তু বাজারে যাওয়া একদম উচিত হয়নি।
–+ আরে শরীরের কথা বাদ দেও তো মা কতদিন
পর এই হক বাড়িতে আবার খুশীর বর্না বইছে।
এই বলে শামছুল হক রাইসার হাত দুটো আলতো
করে ধরে বললো— মারে আজ থেকে এই
সংসার তোর তুই আবার রিয়ার মতো চলে যাস না।
বারবার এদের এসব কথায় রাইসার মনটা মায়ার বাধনে
নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে কিন্তু এটা কখনো
সম্ভব নয়, না আমাকে চলে যেতেই হবে আমার
সময় শেষ হলে।
— কীরে কী ভাবছিস মা,
— না কিছুনা আসুন বাবা।
— হুম।
ঘরে ঢুকতেই শামছুল হকের উপরের দিকে
চোখ পড়তেই দেখলো রিয়ান উপর থেকে
নিচে নামছে।
রিয়ানকে দেখা মাএই শামছুল হক অট্টহাসি হেসে
রিয়ানকে বললো– আরে মাই সন, আয় নিচে আয়
আমার সাথে একটু বস, তোর সাথে আজ আমি গল্প
করবো, দেখ আজ আমি নিজে বাজার করেছি শুধু
তোর জন্য।
রিয়ান সামছুল হকের কথাগুলোকে না শুনেই উল্টে
শামছুল হকের মুখের উপর বলে দিলো– বাবা আমি
বের হচ্ছি।
রিয়ানের এমন কথায় সবার মুখের হাসিটা মেঘের ছায়ায়
ঢেকে গেলো, বিশেষ করে রাইসার চোখে
আপছা- আপছা জল ও চলে আসলো। আজকে
বিয়ের পরের দিন, একটু পরেই অনেক লোকজন
আসবে অথচ ও ই থাকবেনা, তা কী হয়। মানুষ যদি
জিজ্ঞাসা করে তখন কী বলবো, অন্তত নিজের
বাবা- মায়ের খুশীর জন্য ও তো আজকের দিনটায়
ও একটু অভিনয় করে না হয় কাটিয়ে দিতে পারতো।
— বের হবি মানে কোথায় যাবি?
শামছুল হকের প্রশ্নটা শুনে রিয়ান একটু অস্বস্তিকর
ভাবে বললো— কেন বাবা তুমি জাননা আমি কোথায়
যাবো?
— ভাইয়া আজকের দিন ও তুই এভাবে চলে যাবি।
— কেন আজকের দিন কী, একটা কথা সবাই মাথায়
ঢুকিয়ে রেখ ও আমি জাস্ট তোমাদের জন্য
বিয়েটা করেছি তাছাড়া আর কিছুই নয় ।
এই বলে রিয়ান চলে যায়।রাইসা অবাক দৃষ্টিটে
রিয়ানের চলে যাওয়াটার দিকে তাকিয়ে রইলো —
মানুষ বুঝি কষ্টের স্পর্শে ধীরে- ধীরে নিষ্ঠুর
হয়ে যায়।
রিয়ানের এভাবে চলে যাওয়ায় শামছুল হক প্রচন্ড
ভাবে ভেঙে পড়ে, রাইসার দিকে তাকিয়ে কান্নামাখা
কন্ঠে বললো— আমি ভেবেছিলাম ও বদলে
গেছো মা কিন্তু না ও শুধু আমার জোরে বাধ্য
হয়ে তোকে বিয়ে করলো, তার মানে ও
কোনো দিন ও বদলাবে না, এই জিবন থেকে
বেরিয়ে আসবেনা।
রাইসা বুঝতে পারলো না ও কী বলবে কিন্তু ওর
মুখের সামনে অসহায়ত্ব আর এক বুক ভালোবাসা
নিয়ে এমন কিছু মানুষ দাড়িয়ে রয়েছে যাদের
মধ্যে কেউ তার হারানো সন্তানকে ফিরে
পেতে চায়, এক বৃদ্ধ অসহায় তার নাতিনকে চায়
ফিরে পেতে, আর এক বোন তার ভাইয়াকে ব্যস
রাইসা আর কোনোকিছু না ভেবেই মুখগুলোর
দিকে কিছুসময় তাকিয়ে বলে উঠলো– ধৈর্য
হারাবেননা বাবা আপনার ছেলেকে আমি আবার তার
আগের জিবন ফিরিয়ে আনবোই।
রাইসার এমন কথায় সবার মুখে একরাশ হাসি আর
চোখে রাইসার প্রতি অগাধ বিশ্বাসের ছায়া দেখা
গেলো।

সারাদিন নানা লোকজন প্রতিবেশী রাইসাকে
দেখতে আসলো, তাদের সামনে মেকাআপের
আবরনে নিজের কষ্টটাকে লুকিয়ে মুখে দিব্যি হাসি
রেখে দিনটা পার করে দিলো, অনেক গেস্ট
শামছুল হককে যতবারেই রিয়ানের কথা বলেছে
ততবারেই তিনি কোনো একভাবে এড়িয়ে চলে
যায়।

রিয়ান সারাদিন একবার ও বাড়িতে না আসায় রাইসার চেহারায়
ক্রমশ চিন্তা ছায়া চলে আসতে লাগলো।
মিথিলাকে বারবার জিজ্ঞাসা করতে লাগলো– তোমার
ভাইয়া কোথায়?
— ভাইয়া প্রতিদিন যেখানে যায়, সেখানেই গেছে।
— মানে?
— সময়ের সাথে- সাথে সব বুঝে ফেলবে,
যাইহোক টেনশন করোনা দেখবে চলে
আসবে।

রাত ১২ টায় রিয়ান বাড়ি ফিরলো, রিয়ানকে রুমে
ঢুকতে দেখেই রাইসা তার সামনে গিয়ে শান্ত
কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো — এই যে মিষ্টার সারাদিন
কোথায় ছিলেন?
(চলবে)