ভালোবাসার ছোট গল্প

বি‌বাহ শঙ্কা —>পর্বঃ-৩(শেষ)

লেখাঃ শার‌মিন আক্তার
—–‌বেশ অনেকক্ষন পর লা‌বিবার ফোনে কল ডুক‌লো।
লা‌বিবাঃ হ্যা ব‌লো?
‌সোহানঃ আমি তোমার বাসার নি‌চে দা‌ড়ি‌য়ে আছি! তারাতা‌রি নি‌চে আসো!
লা‌বিবাঃ হোয়াট? এসময় রাত দশটা বা‌জে এখন! এখন আমি কি ব‌লে বা‌ড়ির বাই‌রে যা‌বো?
‌সোহানঃ অত কিছু জা‌নিনা আমি, তু‌মি বাই‌রে আস‌বে নাকি আমি ভিত‌রে গি‌য়ে সিন‌ক্রি‌য়েট কর‌বো?
লা‌বিবাঃ না না তার দরকার নাই। আমি আস‌ছি, দশ মি‌নিট ওয়েট ক‌রো।
লা‌বিবা নি‌চে এসে দে‌খে সোহান মাথা নিচু ক‌রে চুপচাপ দা‌ড়ি‌য়ে আছে।
লা‌বিবাঃ ব‌লো কি বল‌বে?
‌সোহানঃ লাবু তু‌মি তোমার বি‌য়েটা ভে‌ঙে দাও। তোমার রাফসান‌কে বি‌য়ে কর‌তে হ‌বে না!
লা‌বিবাঃ তাহ‌লে কা‌কে বি‌য়ে কর‌বো? তু‌মি‌ তো আর বি‌য়ে কর‌বে না! বিবাহ নি‌য়ে‌ তো তোমার ম‌নে অনেক শঙ্কা তাই না!
‌সোহানঃ হ্যা বিবাহ নি‌য়ে আমি সবসময় ভ‌য়ে থা‌কি। কিন্তু তোমার বি‌য়ের কার্ড পাবার পর থে‌কে এ পর্যন্ত তোমা‌কে হারা‌নোর শঙ্কা বা ভয়টা‌ আমা‌কে এক মুহূ‌র্তের জন্যও শা‌ন্তি‌তে থাক‌তে দি‌চ্ছে না। প্লিজ লাবু তু‌মি রাফসান‌কে বি‌য়ে ক‌রো না!
লা‌বিবাঃ তাহ‌লে কা‌কে বি‌য়ে কর‌বো?
‌সোহানঃ ও—— আস‌লে——আ——– তু‌মি আমা‌কে বি‌য়ে কর‌বে! আমি তোমা‌কে ছাড়া বাঁচ‌তে পার‌বো না ব্যাস।
লা‌বিবাঃ (কিছুক্ষন চুপ থে‌কে) এ কথাটা বল‌তে এত সময় নি‌লে সোহান! এখন আমি বাবা মা‌কে কি বল‌বো?
‌সোহানঃ তা‌দের সা‌থে যা বলার আমি বল‌বো! এত সময় নিতাম না লাবু য‌দি আমার ছোট বেলাটা স্বাভা‌বিক হ‌তো। স‌ত্যি বল‌তে আমি এখ‌নো বি‌য়ে নিয়ে ভ‌য়ে আছি কিন্তু তার থে‌কে বে‌শি ভ‌য়ে আছি তোমা‌কে হারা‌নোর। আর তু‌মিই এক‌দিন ব‌লে‌ছি‌লে জীব‌নে বেঁ‌চে থাক‌তে হ‌লে নি‌জের ভিত‌রের ভয়টা‌কে জয় কর‌তে হয়। আমি জা‌নি না ভয়টা‌কে জয় কর‌তে পে‌রে‌ছি কিনা? কিন্তু তু‌মি পা‌শে থাক‌লে অসাধ্যও সাধন কর‌তে পার‌বো। থাক‌বে আমার পা‌শে?
লা‌বিবাঃ এক শ‌র্তে? আগে ব‌লো তোমার বি‌য়ে নি‌য়ে এত শঙ্কা কেন?
‌সোহানঃ আজ তোমার কা‌ছে কিছু লুকা‌বো না লাবু। আস‌লে তু‌মি তো জা‌নোই নেহা আমার আপন বোন না বা ওর মা আমার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী!
লা‌বিবাঃ হ্যা জা‌নি! কিন্তু তু‌মি কি এ কারনে ‌বি‌য়ে পছন্দ ক‌রো না কারন তোমার বাবা দ্বিতীয় বি‌য়ে ক‌রে‌ছেন। দে‌খো সোহান আমি যতদূর জা‌নি তোমার মা যখন মারা গে‌ছেন তখন তোমার বয়স সাত কি আট বছ‌রের মত। তখন তোমা‌কে, তোমার বাবা‌কে , আর তোমা‌দের সংসার সামলা‌তে একজন ম‌হিলার খুব প্র‌য়োজন ছি‌লো যার কার‌নে দা‌দির কথামত বাবা বি‌য়ে ক‌রেন। কিন্তু সোহান তার দিকটা একবার ভা‌বো, তি‌নি যা ক‌রে‌ছেন তোমার ভা‌লোর জন্য ক‌রে‌ছেন আর তাছাড়া তাইফা আন্টি‌তো অনেক ভা‌লোমানুষ। তি‌নি আর নেহা তোমা‌কে প্রচন্ড ভা‌লোবা‌সে। দে‌খো সোহান তু‌মি তো প্রথ‌মে নেহা‌কে চো‌খেই দেখ‌তে পার‌তে না কিন্তু এই এক বছর ধ‌রে তোমা‌দের সম্পর্ক আর পাঁচটা ভাই‌বো‌নের মত হ‌য়ে‌ছে। তাও কিন্তু এম‌নি এম‌নি হয়‌নি আমা‌কে অনেক কষ্ট ক‌রে কর‌তে হ‌য়ে‌ছে। কারন আমি মা‌নি ভাই বোন মা‌নে শুধু ভাই‌ বোন। সেখা‌নে সৎ, চাচা‌তো, মামা‌তে‌া, ফু্ফাতো বল‌তে কিছু নাই। তাই কষ্ট হ‌লেও এক রকম অসাধ্য কাজ‌কে সাধন ক‌রে‌ছিলাম।
এটা কিন্তু আমার একার প্র‌চেষ্টায় হয়‌নি তোমার মনও সবসময় নেহা‌কে বোন হিসা‌বে মান‌তো কিন্তু তু‌মি মু‌খে স্বীকার কর‌তে না। আমি শুধু তোমার ম‌নের কথাটা মন থে‌কে মু‌খে এনে‌ছি। তোমা‌কে বি‌ভিন্ন ভা‌বে ইমোশনাল ব্ল্যাক‌মেইল ক‌রে । তারপর থে‌কেই তোমা‌দের ভাই‌বো‌নের সম্পর্কটা আল্লাহর রহম‌তে ঠিক হ‌য়ে‌ছে। কিন্তু তোমার সা‌থে তোমার বাবা মা‌য়ের সম্পর্ক এখ‌নো ঠিক হয়‌নি। আমি তো তোমার বাবার কোন ভুল দেখ‌ছি না।
‌সোহানঃ লা‌বু তু‌মি যা বল‌ছো সব ঠিক বল‌ছো। আমি বাবার দ্বিতীয় বি‌য়ের কার‌নে বি‌য়ে‌কে ঘৃনা ক‌রি না বা বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী‌কেও ঘৃনা ক‌রি না। আমি বি‌য়ে নামক সম্পর্কটা‌কে ঘৃনা ক‌রি। কোন সম্প‌র্কে বাঁধা পড়াটা আমার ভা‌লো লা‌গে না।
লা‌বিবাঃ কি? কিন্তু কেন?
‌সোহানঃ লাবু সবাই জা‌নে আমার নি‌জের মা মারা গে‌ছে এটা সম্পূর্ন ভূল আস‌লে আমার মা এখ‌নো বেঁ‌চে আছে । আমার যখন সাত বছর বয়স তখন তা‌দের ডি‌ভোর্স হয়। জা‌নো লাবু ছোট বেলার যতটুকু স্মৃ‌তি ম‌নে আছে সেখা‌নে শুধু বাবা মা‌য়ের ঝগরা ছাড়া কিছু দেখতে পাই না। আমার বাবা মা দিন রাত ঝগরা কর‌তো, তা‌দের কখ‌নো দে‌খি‌নি দু‌মিনিট শা‌ন্তি‌তে কথা বল‌তে, ঝগরা একে অপরকে গালাগাল করা আরো অনেক কিছু আর শেষ মেষ ডি‌ভোর্স। তারা নি‌জে‌দের ঝগরা নি‌য়ে এতটাই ব্যাস্ত থাক‌তো যে ভু‌লে যে‌তো আমি তা‌দের ছে‌লে। কখ‌নো তারা আমার কথা ভাব‌তো না। এটা ভাব‌তো না তা‌দের ঝগরার প্রভাব আমার উপর কিভা‌বে প‌রে। সবসময় নি‌জে‌দের নি‌য়ে ভাব‌তো তারা। দাদু সবসময় আমা‌কে নি‌জের কা‌ছে আগ‌লে রাখ‌তো। নয়‌তো মা‌য়ের তো আমার জন্য সময়ই হতো না । ডি‌ভো‌র্সে পর আমার মা মাতৃ‌ত্বের খা‌তি‌রেও একবারও আমায় দেখ‌তে আসে‌নি। একদিন অনেক কান্না ক‌রে নানা বা‌ড়ি মা‌য়ের সাথে দেখা কর‌তে গি‌য়ে‌ছিলাম নানা না‌নি, মামারা খুব খু‌শি হ‌য়ে‌ছি‌লো কিন্তু আমার মা হয়‌নি।
মা তখন আমায় যে কথাগু‌লো ব‌লে‌ছি‌লো তা আজও আমা কা‌নে বাজে। মা ব‌লে‌ছি‌লো কেন এসেছিস এখা‌নে? আমি এখন তোর আর তোর বা‌পের থে‌কে মুক্ত, তুই না থাক‌লে ক‌বেই আমি মুক্ত পা‌খির মত উড়ে যেতাম, আমার সর্বনা‌শের আর পরা‌ধিনতার নষ্ট তালা তুই। তখন আমার ছোট মাথায় এত ভারী ভারী কথা ডু‌কে‌নি। ত‌বে এটা বুঝ‌তে পে‌রে‌ছিলাম মা খুব রে‌গে আছে। মা‌কে জ‌ড়ি‌য়ে কান্না ক‌রে ব‌লে‌ছিলাম মা ফি‌রে চ‌লো বা‌ড়ি। তখন মাও আমায় জ‌ড়ি‌য়ে কান্না ক‌রে ব‌লে‌ছি‌লো না‌রে বাবা সেটা সম্ভব না, সব ‌শেষ তুই বরং নি‌জের খেয়াল রা‌খিস তারপর দা‌দির সা‌থে আমায় রুম থে‌কে বের ক‌রে দি‌য়ে দড়জা বন্ধ ক‌রে ফে‌লে‌ছি‌লো। সে‌দিন নানা না‌নি কান্না কর‌তে কর‌তে বল‌ছি‌লো আহা‌রে সোনার টুক‌রো ছে‌লেটার কথাও একবার ভাব‌লো না ওরা। নি‌জে‌দের নি‌য়ে ভাব‌তে গি‌য়ে দু‌টো পরিবার‌কে ভে‌ঙে দি‌লো। তারপর প্রায় ছয় মা‌সের মাথায় বাবা নতুন মা‌কে বি‌য়ে ক‌রে।
তখন পাশের বাসার আন্টিরা আমায় বল‌তো ওনি আমার সৎ মা। ওনি কখ‌নো না‌কি আমায় ভা‌লোবাস‌বেন না, আমার বন্ধুরাও একই কথা বল‌তো। বাবা নতুন মা‌য়ের সা‌থেও ঝগরা কর‌তো মা‌ঝে মা‌ঝে কিন্তু তা খুব কম। কারন বাবা কিছু বল‌লেও নতুন মা তা‌কে কিছু বল‌তো না চুপচাপ শুন‌তো তারপর তাদের মা‌ঝে ঝগরা ধীরে ধীরে কম‌তে থা‌কে। কিন্তু আমার ম‌নে কেন যে‌নো বি‌য়ে নি‌য়ে ভয় তৈরী হ‌য়ে গি‌য়ে‌ছি‌লো। যখন বড় হ‌য়ে বি‌য়ে মা‌নে বুঝতাম তখন ভাবতাম আমি বি‌য়ে কর‌লে আমারও বাচ্চা হ‌বে, আর আমার স্ত্রীর সা‌থে আমার ঝগরা দে‌খে আমার বাচ্চাটাও আমার মত মান‌ু‌ষিক ভারসাম্য হা‌রি‌য়ে ফেল‌বে।
কথাগু‌লো বল‌তে বল‌তে সোহানের গলা আট‌কে আসছি‌লো, নিঃশ্বাসটা অনেক ভারী হ‌য়ে গে‌ছে। লা‌বিবা ঠিক কি ব‌লে সোহান‌কে শান্তনা দি‌বে তা ভে‌বে পা‌চ্ছি‌লো না। তাই সোহা‌নের হাত দু‌টো চে‌ঁপে ধ‌রে বল‌লো
লা‌বিবাঃ প্লিজ সোহান শান্ত হও। কান্না ক‌রো না।
‌সোহানঃ না ল‌াবু আজ একটু কাঁদ‌তে দাও। কত বছর ধ‌রে কান্নাগু‌লো জ‌মি‌য়ে‌ রে‌খে‌ছি। এতক্ষন কথাগু‌লো রাস্তায় দা‌ড়ি‌য়ে বল‌ছি‌লো। কিন্তু এত রা‌তে রাস্তায় দা‌ড়ি‌য়ে কান্না করাটা কেমন যে‌নো লা‌গে লা‌বিবা সোহান‌কে নি‌জের বা‌ড়ির ভিতর নিয়ে যায়। বা‌ড়ির সাম‌নে বেশ খা‌নিকটা জায়গা মা‌নে উঠোন আছে, উ‌ঠো‌নের এক পা‌শে চেয়ার আর টে‌বিল পাতা মা‌ঝে মা‌ঝে এখা‌নে চা‌য়ের আড্ডা‌ হয়। লা‌বিবা সোহান‌কে নি‌য়ে সেখা‌নে বসায়। সোহান ব‌সা অবস্থায় লা‌বিবা‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে কান্না কর‌তে থা‌কে। লা‌বিবা সোহা‌নের চু‌লে বি‌লে কাট‌ছে। আজ লা‌বিবার মনটা খুব খারাপ লাগ‌ছে, কারন যা‌কে এত দিন ধ‌রে চে‌নে যানে ভা‌লোবা‌সে, সে তার ম‌নে এতবড় ক‌ষ্টের পাথর নি‌য়ে রে‌খে‌ছি‌লো অথচ লা‌বিবা এত কা‌ছের হ‌য়েও সেটা বুঝ‌তে পা‌রে‌নি। কি ক‌রেই বা বুঝ‌বে যখনই লা‌বিবা জান‌তে চে‌য়ে‌ছে সোহান কথা ঘু‌রি‌য়ে দি‌য়ে‌ছে।
কিছুক্ষন কান্না করার পর সোহান যখন কিছুটা স্বাভা‌বিক হ‌লো তখন লা‌বিবা বল‌লো
লা‌বিবাঃ সোহান একটা খাবা‌রে বিষ ছি‌লো ব‌লে কি তু‌মি খাবার খাওয়া ছে‌ড়ে দি‌বে ? ঠিক তেম‌নি একটা বি‌য়ে সাক‌সেসফুল হয়‌নি ব‌লে তু‌মি বি‌য়ে‌কে ঘৃনা কর‌বে! এটা ঠিক না। জীবন কা‌রো জন্য বা কোন ঘটনার কার‌নে থে‌মে থা‌কে না। জীবন জীব‌নের মত চ‌লতে থা‌কে। আজ একটা জি‌নিস চাই‌বো দি‌বে?
‌সোহানঃ হুমমম ব‌লো?
লা‌বিবাঃ তু‌মি কি জা‌নো তোমার মা কোথায় থা‌কে এখন?
‌সোহানঃ হুমমম। গতবার আমার বড় মামা দেখ‌তে এসে‌ছিলো তখন শু‌নে‌ছিলাম আমা‌দের পা‌শের শহ‌রে থা‌কে তারও বি‌য়ে হ‌য়ে‌ছে বাবার সা‌থে ডি‌ভো‌র্সের তিন বছর পর।
লা‌বিবাঃ চ‌লো না তার সা‌থে একবার দেখা ক‌রে আসি প্লিজ না ব‌লো না!
‌সোহানঃ হুমম ঠিক আছে তার আগে তোমার ঘ‌রের লো‌কের সা‌থে কথা ব‌লে তোমার বি‌য়েটা বন্ধ ক‌রে আসি!
লা‌বিবাঃ সেটা আমি ক‌রে নি‌বো।
সোহানঃ না ভুল যে‌হেতু আমি ক‌রে‌ছি ক্ষমাও আমি চাই‌বো।
এই ব‌লে সোহান লা‌বিবার বাঁধা স‌ত্তেও ভিত‌রে চ‌লে গে‌লো আর গি‌য়েই লা‌বিবার বাবা‌কে বল‌লো
‌সোহানঃ আঙ্কেল লা‌বিবার এ বি‌য়ে হ‌বে না।
লা‌বিবার বাবা সহ সবাই এত রা‌তে সোহান‌কে দে‌খে অনেক অবাক হ‌লো।
লা‌বিবার বাবাঃ কি! কেন? তোমা‌দের ভিতর কি কোন ঝগরা হই‌ছে? নাহ‌লে তোমা‌দের বি‌য়ের মাত্র চার‌দিন বা‌কি আর এখন বল‌ছো তু‌মি লা‌বিবা‌কে বি‌য়ে কর‌বে না! কেন?
‌সোহানঃ আমা‌দের বি‌য়ের চার‌দিন বা‌কি মা‌নে?
লা‌বিবাঃ সোহান তু‌মি চ‌ুপ ক‌রো! বাবা ও আমার ওপর রাগ ক‌রে এসব বল‌ছে আমি ওকে বু‌ঝি‌য়ে বল‌ছি। সোহান চ‌লো আমার সা‌থে চ‌লো কথা আছে। লা‌বিবা সোহান‌কে টে‌নে নি‌য়ে অন্য রু‌মে এসে ব‌লে
মাথা ঠিক আছে? কতক্ষন ধ‌রে থামা‌নোর চেষ্টা কর‌ছি বোকার মত কথা ব‌লেই যা‌চ্ছো! গাঁধা চার‌দিন পর তোমার আর আমার বি‌য়ে। বড়রা মি‌লে ঠিক কর‌ছে।
‌সোহানঃ কি? (অনেক অবাক হ‌য়ে) তাহ‌লে রাফসান কে? আর বি‌য়ের কা‌র্ড?
লা‌বিবাঃ তোমা‌কে যে বি‌য়ের কার্ড দি‌য়ে‌ছি সেটা নকল ছি‌লো। আর রাফসান ভাইয়া আমার মে‌জো কাকার ছে‌লে। অনেক‌দিন প্রবা‌শে ছি‌লো ক‌দিন আগে আস‌ছে ওই আমা‌দের সম্প‌র্কে সব শু‌নে তোমা‌কে জ্বালা‌নোর এই আই‌ডিয়া দি‌য়ে‌ছে। এতদিন রাফসা‌ন ভাইয়ার সা‌থে যা ছি‌লো সব নাটক ছি‌লো তোমা‌কে জ্বালা‌নোর জন্য। কিন্তু তার জন্য তু‌মি আমায় দু দু‌টো চড় মে‌রেছো গালদু‌টো খুব ব্যাথা কর‌ছে এখ‌নো।
‌সোহানঃ খুব ভা‌লো ক‌রে‌ছি চড় মে‌রে আমা‌কে বোকা বানা‌নো তাই না। পা‌জি মে‌য়ে!
লা‌বিবাঃ তোমার মত মাথা মোটা না যে বিয়ে‌তে ভয় পা‌বো। এখ‌নো বি‌য়ে‌তে ভয় পাও?
‌সোহানঃ জা‌নিনা ত‌বে স্য‌রি চড় মারার জন্য।
লা‌বিবাঃ ইট’স ওকে ঐ চ‌ড়ের ভিতর তোমার ভা‌লোবাসা ছি‌লো তাই।
‌আরো‌ কিছুক্ষন সোহান লা‌বিবার সা‌থে কথা ব‌লে বা‌ড়ি চ‌লে যায়। ওর নানা বা‌ড়ি ফোন ক‌রে মা‌য়ের ঠিকানাটা যোগার ক‌রে। প‌রের দিন সকা‌ল আটটার দি‌কে লা‌বিবা আর সোহান রওনা দেয় পা‌শের শহ‌রে সোহা‌নের মা‌য়ের সা‌থে দেখা করার উদ্দেশ্যে।
‌সোহা‌নের মা‌য়ের বা‌ড়ি পৌছা‌তে পৌছা‌তে এগা‌রোটা বে‌শি বে‌জে গে‌লো। দড়জায় গি‌য়ে ক‌লিং‌বেল টেপার কিছুসময় পর একজন স‌ুন্দর ম‌হিলা দড়জা খুল‌লেন সোহা‌নের চেহারার সা‌থে তার চেহারার হুবহু মিল। বোঝাই যায় ইনি সোহা‌নের মা আর সোহান ওর মা‌য়ের চেহারা পে‌য়ে‌ছে। সোহান তা‌কে দে‌খে চিন‌তে পার‌লেও কি ব‌লে ডাক‌বে ভে‌বে পা‌চ্ছে না। কারন এত বছ‌রে যে একবারও সোহান‌কে দেখ‌তে যায়‌নি, সোহা‌ে‌নের খোঁজ ক‌রে‌নি সোহা‌নের তা‌কে সোহান ঠিক কি ব‌লে ডাক‌বে ভে‌বে পা‌চ্ছে না? লা‌বিবা ব্যাপারটা বুঝ‌তে পে‌রে বল‌লো
লা‌বিবাঃ আসসালামু আলাইকুম আন্টি। আপনার নাম কি শা‌হিনুর বেগম!
শা‌হিনুর বেগমঃ হ্যা কিন্তু তোমরা কে মা?
লা‌বিবাঃ ও সোহান আপনার ছে‌লে।
শাহিনুর বেগম লা‌বিবার কথা শু‌নে ছল ছল চো‌খে তাকা‌লেন সোহা‌নের দি‌কে। সোহা‌নের গা‌লে হাত দি‌য়ে কপা‌লে চু‌মো খে‌য়ে সোহান‌কে জড়ি‌য়ে ধ‌রে কান্না ক‌রতে কর‌তে বল‌লেন আমা‌কে মাফ ক‌রে দে বাবা! মাফ ক‌রে দে! আমি মা হ‌য়েও ম‌া‌য়ের দা‌য়িত্ব পালন কর‌তে পা‌রি‌নি। সোহান কিছু বল‌ছে না চুপ ক‌রে চো‌খের জল ফেল‌ছে। ওনার শরীর থে‌কে মা মা ঘন্ধ ঠিকই আস‌ছে কিন্তু সোহান ভাব‌ছে যে‌দিন প্রথমবার নতুন মা‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে কান্না ক‌রে‌ছিলাম সে‌দিনের অনুভু‌তিগু‌লো কেমন যে‌নো স্বর্গীয় ছি‌লো, যেটা আজ পা‌চ্ছি না। মা ছে‌লের এমন সাক্ষাৎ দেখে লা‌বিবারও চোখ ভ‌রে এলো। কিছুক্ষন পর তারা স্থির হ‌য়ে বস‌লো। তারপর শা‌হিনুর বেগম লা‌বিবা‌কে উদ্দেশ্য ক‌রে বল‌লো তু‌মি কে মা?
লা‌বিবাঃ আমি আস‌লে (লজ্জা পে‌য়ে) আস‌লে তিন দিন পর আমার আর সোহা‌নের বি‌য়ে তাই আপনা‌কে দাওয়াত কর‌তে এসে‌ছি।
শা‌হিনুর বেগমঃ মাশাল্লাহ্ আল্লাহ্ তো আমার ছে‌লের কপা‌লে রাজকন্যা মি‌লি‌য়ে দি‌য়ে‌ছে। বেঁচে থা‌কো মা।
‌সোহানঃ আপনার আর বাবার ডি‌ভোর্স কেন হ‌য়ে‌ছি‌লো?
‌সোহা‌নের এসন কথায় লা‌বিবা আর শা‌হিনুর বেগম দুজ‌নেই থম‌কে যায়। অনেকক্ষন চুপ থে‌কে শা‌হিনুর বেগম বল‌লেন
শা‌হিনুরঃ দোষটা আমার বেশি ছি‌লো। আস‌লে আমি কখ‌নোই তোমার বাবা‌কে বি‌য়ে কর‌তে চাই‌নি, কারন সবসময় আমার ম‌নে ছি‌লো #বিবাহ্_শঙ্কা। কিন্তু বাবা মা জোড় ক‌রে বি‌য়ে দি‌য়ে দেয়। মা ব‌লে‌ছি‌লো স্বামী‌কে ভা‌লোবাসার চেষ্ট‌া কর, কিন্তু সে চেষ্টা কখ‌নোই আমি ক‌রি‌নি তোমার বাবা সবময়ই আমায় খুব ভা‌লোবাস‌তো কিন্তু আমি কখ‌নোই তার ভা‌লোবাসার মূল্যায়ন ক‌রি‌নি। সে ভাব‌ছি‌লো বাচ্চা হ‌লে ঠিক হ‌য়ে যা‌বে কিন্তু তোমার জ‌ন্মের পরও আমার তোমার বাবার উপর সামান্যতম অনুভু‌তি জন্মায়‌নি। আস‌লে চেষ্টা ক‌রেও কে‌নো যে‌নো তার সা‌থে আমি আমার ম‌নের মিলটা করা‌তে পা‌রি‌নি। আর স‌ত্যি বল‌তে আমি তা‌কে মন থে‌কে কখ‌নো মান‌তে চাই‌নি। কেন তা নি‌জেও জা‌নি না! তার ফলপ্রসূ রোজ রোজ ঝগরা , গালাগা‌লি। সব স্বামীই চায় তার স্ত্রী তা‌কে ভা‌লোবাসুক, যত্ন কর‌ুক, সংসার সাম‌লে রাখুক যেগু‌লো আমি কখ‌নোই করতাম না। শেষ ফলাফল বিবাহ বি‌চ্ছেদ। কিন্তু তোমার কথা ভে‌বে য‌দি আমি নি‌জের মা‌ঝে সহ্য ক্ষমতা বাড়াতাম, ‌তোমার বাবা‌কে, তার সংসার‌কে বোঝার চেষ্টা করতাম তাহ‌লে হয়‌তো আমা‌দের জীবনগু‌লো অন্য রকম হ‌তো। যখন ভুল বুঝ‌তে পারলাম তখন দে‌রি অনেক দে‌রি হ‌য়ে গে‌ছি‌লো ,তত‌দি‌নে সব হা‌রি‌য়ে ফেল‌ছিলাম আমি।
প‌রেরবার বি‌য়েটাও প‌রিবা‌রের ইচ্ছায় হয় কারন ডি‌ভো‌র্সি মে‌য়ে‌কে সারাজীবন ব‌সি‌য়ে খাওয়ার মত দানবীর পৃ‌থিবী‌তে কেউ নাই। এখা‌নে আমার ব‌রের আগের স্ত্রীর এর মে‌য়ে আছে। তা‌কে ভা‌লোবাসার চেষ্টা ক‌রে‌ছি এখন আল্লাহর রহম‌তে মোটামু‌টি সু‌খেই আছি। তারপর আরো অনেক কথা হয়।
‌বিকালবেলা সোহ‌ান লা‌বিবা ওর মা‌য়ের কাছ থে‌কে বিদায় নি‌য়ে চ‌লে আস‌লো। গা‌ড়ি তার আপন গ‌তি‌তে ছুট‌ছে। লা‌বিবা ক্লান্ত হ‌য়ে সোহা‌নের কাঁ‌ধে মাথা রে‌খে ঘুমা‌চ্ছে। সোহান ওর মা‌য়ের বলা কিছু কথা ভাব‌ছে
‌সোহান শোন সম্পর্ক এম‌নি এম‌নি তৈরী হয়না আর এম‌নি এম‌নি টে‌কেও না। সম্পর্ক‌কে ধ‌রে রাখতে হয় খুব সাবধা‌নে। সম্পর্ক ধ‌রে রাখ‌তে হ‌লে সম্প‌র্কে ধৈর্য্য, সহ্য, সম্মান, বিশ্বাস, ভা‌লোবাসা সব দি‌তে হয়। নয়‌তো সম্পর্ক গু‌লো টি‌কে না। য‌দি সম্পর্ক গু‌লো‌কে ভা‌লোবাসা দি‌য়ে আগ‌লে রাখ‌তে পা‌রো তাহ‌লে তার মা‌ঝে কোন ভয় বা শঙ্কা থাকে না। তু‌মি দয়া ক‌রে আমার মত ভুল কর‌বে না আশাক‌রি। যে মে‌য়েটা তোমা‌কে বিশ্বাস ক‌রে তোমা‌কে ভা‌লোবাসা দি‌য়ে‌ছে তা‌কে ভা‌লোবাসা দেবার চেষ্টা ক‌রো।
‌সোহান লা‌বিবার মু‌খের উপর থাকা চুলগু‌লো স‌রি‌য়ে দি‌য়ে নি‌জে নি‌জে বল‌লো বা‌ড়ি গি‌য়ে নতুন মাকে মা ব‌লে জ‌ড়ি‌য়ে ধর‌বো এত‌দিন তার সা‌থে খুব অন্যায় কর‌ছি। তা‌কে বল‌বো আবার ইলিশ ভা‌জি ক‌রে নিজ হা‌তে খাই‌য়ে দি‌তে। মা আজ স‌ত্যিই খুব খু‌শি হ‌বে। বাবা‌র কা‌ছে মাফ চাই‌তে হ‌বে । নেহা‌কে বোন ব‌লে আবার কা‌ছে টে‌নে নি‌তে হ‌বে ভাই‌য়ের সব দা‌য়িত্ব পালন কর‌বো আমি। ধন্যবাদ লাবু আমার জীব‌নে আসপর জন্য তু‌মি আমার জীব‌নে এসে আমার জীবন থে‌কে সব দুঃখ দূর ক‌রে দি‌য়ে‌ছো। দূর ক‌রে দি‌য়েছো বিবাহ শঙ্কা‌কে । জীব‌নে যত‌দিন বাঁচ‌বো তোমায় ভা‌লো‌বে‌সে কাঁটা‌বো, আমি তোমার সা‌থে মি‌লে গ‌ড়ে তুল‌বো সুন্দর ভ‌বিষ্যৎ । তু‌মি স‌ত্যি ব‌লে‌ছো বি‌য়ে মা‌নে জীব‌নের শেষ নয় বি‌য়ে না‌মে জীব‌নে নতুন রোমাঞ্চকর অধ্যা‌য়ের শুরু। ধন্যবাদ লাবু, ধন্যবাদ তোমায়।
বাসটা ছু‌লে চল‌ছে গন্ত‌ব্যের প‌থে আর সোহান লা‌বিবার হাত ধ‌রে স্বপ্ন বুন‌ছে সুন্দর আগামীর।
সমাপ্ত
ভুলত্রু‌টি ক্ষমার চো‌খে দেখ‌বেন