বধুবরন

বধুবরন-সিজন-2 ! Part- 20

গল্প শুনতে শুনতে নুরভি একসময় বাবাইয়ের কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছিল তাই বাকি রাস্তা নীল শুভাকে তেমন ভোগান্তি পোহাতে হয় নি।ঢাকায় ফ্লাইট নামতেই নুরভি ঘুম ঘুম চোখে বাবাইয়ের ঘাড়ে মাথা রেখে সব দেখতে থাকে।শৌর্য শুভার হাত ধরে গাড়িতে ওঠে।নুরভিকে গাড়িতে বসাতে সে মায়ের কোলের মধ্যে গুটিশুটি মেরে আবার ঘুমিয়ে গেল।নীল একটু পর হেসে হেসে আশিক ছোট চাচী, শর্মির সাথে গাড়ির কাছে আসলো।শুভা ওদেরকে দেখে খুশি হলো।
“- এই শুভা তুই আমাদের সাথে চল তো?
“- কেন!
“- তোর বিয়ে দেব তাই?
“- আরে কি যা তা বলছিস?
“- বেশি কথা বলিস না তো চল! শর্মি একপ্রকার জোর করে শুভাকে নিয়ে গেল নিজেদের গাড়িতে।শুভা নুরভিকে ছাড়া যাবেই না কারন এই মেয়ে মাঝ রাস্তায় জেগে উঠলে শুভাকে না দেখলে গলা ছেড়ে কাঁদবে। নীল শুভাকে আশস্ত করায় অবশেষে শর্মি আর ছোট চাচীর সাথে শুভা অন্য গাড়িতে যায়।যাওয়ার সময় শৌর্য আর নুরভির মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে।নীল ইশারায় আশস্ত করে শুভাকে আবারও।
শর্মি ছোট চাচী শুভাকে নিয়ে সোজা পার্লারে চলে আসে।শুভা এতোক্ষনে এদের আসল মতলব বোঝে।শর্মির দিকে রেগে তাকাতেই শর্মি বলে,
“- আমি নির্দোষ! দেখ আমারে মারিস না। আমার বাবুটা কষ্ট পাবে।শর্মি পেটের উপর হাত রেখে দাঁত বের করে হাসে।
“- চাচী! এসব শুনলে লোকে কি বলবে। আমাকে লজ্জায় ফেলছেন কেন?
“- কিসের লজ্জা তোর? স্বামীর বউ সাজবি তাতে আবার কিসের লজ্জা। চল! শুভাকে জোর করে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শুভা চাচীকে কিছু বলতে পারছে না কিন্তু শর্মির উপর চরম খেপে আছে।শর্মি শ্বাশুড়িকে জড়িয়ে শুভার রাগে জল ঢেলে দুষ্টুমিতে মজে ওঠে।
নীল অয়ন শৌর্য নুরভিকে নিয়ে খান মঞ্জিলে পৌঁছায়।সবাই গাড়ি থেকে নামতেই নীলের মা নাতিকে কোলে তুলে আদর করে।নীলের বাবা নীলের কাছ থেকে কিছু না বলেই নুরভিকে টেনে কোলে নিয়ে ভেতরে চলে আসে।নীলের মায়ের কোল থেকে মায়া শৌর্য কে কোলে নিয়ে গালে মুখে চুমু দিয়ে জড়িয়ে কাদে।শুভার দু সন্তানের মধ্যে শৌর্য মায়ের গায়ের রঙ পেয়েছে। চেহারাতেও মায়ের প্রতিচ্ছবি। আর নুরভি পুরোই নীলের কপি।দেখতে যেমন স্বভাবও তেমন খ্যাপাটে,জেদি নাকের ডগায় রাগ সবসময় থাকেই তবে মায়ের একটা গুন পেয়েছে তা হলো কিছু হলেই নাকে কাঁদে।
শৌর্য নানুর কোলে চুপটি করে বসে আছে।নীল চুপচাপ বসে বাবাকে রাগী চোখে দেখছে।নীলের বাবা রাশেদ ইকবাল খান নাতির দিকে চোখ তুলে দেখলও না।অথচ নাতনীকে নিয়ে তাদের আহ্লাদের কমতি নেই।রাশেদ খানের সাথে নীলের দাদীও যোগ দিয়েছে।ঘুমন্ত নুরভির গালে কপালে হাতে পায়ে কোথাও চুমু দিতে বাদ রাখছে না।মেহেরুন খাতুন নুরভির গায়ের রঙ দেখে এতোই খুশি হয়েছে যে নাহিদাকে দিয়ে আলমারি থেকে হিরার লকেট এ টানানো ন আদ্যাক্ষরের একটা চেইন এনে পড়িয়ে দেয়।নীলের রাগে মুখটা লাল হয়ে আছে।কিন্তু নাহিদার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলছে না।মায়া চুপচাপ শৌর্য কে কোলে নিয়ে বসে মায়ের নাটক দেখছে।এই বর্ণবাদী মায়ের ষড়যন্ত্রের কারনেই আজ মায়া শুভার কাছে শুধু জন্মদাত্রী। মেহেরুন, রাশেদ অয়নের বাবা মঈন সবার আদরের অত্যাচারে নুরভির ঘুম একসময় ভেঙে গেল।চোখ খুলতেই বয়স্ক মেহেরুনের মুখটা দেখে নুরভি বিরক্ত ভঙ্গি নিয়ে আশেপাশে তাকালো। নীলের দিকে তাকাতেই নীল হেসে দিল। নুরভি কিন্তু হাসলো না।শৌর্য কে ঐদিন মাকে কাদানো মহিলার কোলে বসে থাকতে দেখে মহিলার হাসি হাসি মুখটা দেখে চোখ সরিয়ে নিল।ঘাড় ঘুরিয়ে মাকে খুঁজতে লাগলো।নীল বুঝতে পেরে সোফা থেকে দাড়িয়ে নুরভিকে বললো,
“- মা! তোমার মাম্মী একটু বাইরে গেছে।তুমি আর শৌর্য আমার সাথে চলো ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নেবে।
মা এখানে নেই! কথাটা শুনে নুরভির এতোক্ষন গম্ভীর মুখখানা কান্নার পূর্বাভাস দিয়ে ফুলে উঠলো ছলছল চোখে।
ব্যাপারটা মেহেরুন বুঝে নুরভি কে আরো শক্ত করে জড়িয়ে গালে চুমু দিতেই নুরভি রাগে ফোস করে ওঠে,
“- ছাড়ো আমারে।আমি আমার মাম্মীর কাছে যাবো।নুরভি মেহেরুনের কোল থেকে নামার জন্য ছটফট করতে থাকে।
“- ও মা! কই যাও! তোমার মাম্মীর কাছে যাওয়া লাগবে না।ও একটা কালি ওর কাছে ঘেষাঘেষি করলে তোমার গায়ের কাচা হলুদ রঙও কালো হয়ে যাবে। আমার কোলে থাকো।থাকো!
“- না! তুই কালি! তোর বাপ কালি।আমার মাম্মীকে কালি কেন বললি? পচা ডিম বুড়ি।ছাড়! মাম্মী ইইই। দাদীর কথা শুনে এবার নীল চুপ থাকতে পারলো না।রেগে নুরভিকে নিজের কাছে এনে বললো
“- লজ্জা করে না এই টুকু বাচ্চাকেও এসব নোংরা মানসিকতা শেখাচ্ছ? ও শুভার মেয়ে দাদী! সংযত হয়ে কথা বলো নয়তো তোমার গুষ্ঠি উদ্ধার করতে ওর দুমিনিট লাগবে।মা! চলো আমরা উপরে যায়।শৌর্য বাবাই আসো।শৌর্য বাবাইয়ের ডাক শুনে ছুটে আসে। কিন্তু নুরভি চুপ থাকে না। রাশেদ মঈন মেহেরুনের দিকে ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।রাশেদ নুরভিকে কোলে নিতে গেলে নুরভি চিৎকার করে কেঁদে বাবাইকে জড়িয়ে ধরে।নীল ওদের নিয়ে ঘরে চলে আসে।দুটোকে ফ্রেশ করিয়ে নিজে হাতে নতুন পোষাক পড়িয়ে দিতে লাগে।নুরভি তো কোনোমতেই পোষাক পড়বে না।ওর মাকে চাই।কাঁদতে কাদতে হিচকি তুলে ফেলেছে সে।নীল মা সোনা বলেও থামাতে পারছে না।শেষে শৌর্যের বুদ্ধিতে মায়ের সাথে ভিডিও কলে কথা বলে কিছুটা শান্ত হয়।মাকে সাজতে দেখে সে মহা খুশিতে ফুপির কাছে সাজে।রোদি নুরভিকে গোলাপি কালার লেহেঙ্গা পড়িয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দেয়।নুরভি বার বার নিজেকে আয়নায় ঘুরে দেখছে।রোদি সেই সুযোগে নুরভি কয়েকটা ছবি তুলে নেয়।
“- আমার বারবি ডল টা! এদিক আয় তো
“- বলো ফুপি মনি! রোদির গলা জড়িয়ে ধরে বলে
“- ছবি তুলবি?
“- হ্যাঁ!
রোদি নুরভির সাথে সেলফি তোলে।নুরভি মোবাইল ঘেটে ঘেটে সব ছবিগুলো দেখে ওয়াও! কি সুন্দর এসব বলে খুশিতে খিলখিল করে হাসে।
“- ফুপি মনি! আমাকে পুতুল বউ লাগছে তাই না বলো?
“- হ্যাঁ সোনা!
“- তাহলে কি আজ আমার বিয়ে? আচ্ছা আমার পিচ্চি বর কই।ও ফুপি মনি আমার বর কই!
“- এই সেরেছে রে! বারবি ডল! কান্না করলে কিন্তু পুতুল বউ সাজ নষ্ট হয়ে যাবে।একদম কাদা যাবে না।
“- তাই!
“- হুমম সোনা! আসো ফুপির কাছে আসো।ফুপি আজ তার বারবি ডলটাকে খুব আদর করবে।
“- আমিও আমার ফুপি মনিকে আদর করবো?
“- কিভাবে?
“- এভাবে! রোদির গালে চুমু দিয়ে বলে।রোদি হাসতে হাসতে নুরভিকে জড়িয়ে ধরে।
শুভাকে সাজিয়ে গুজিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে।নীল কয়েকবার চেষ্টা করেও শুভার দর্শন পায় নি।নীলকে শুভার ধারের কাছে তো যেতে দিলোই না উল্টে অয়ন ভাইকে ধরে নিয়ে সাদা পাঞ্জাবির উপরে খয়েরি রঙের শেরওয়ানি পড়িয়ে দেয়। নুরভি পুরো বাড়ি জুড়ে শৌর্য আর অনুষ্ঠানে আসা অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে দৌড়ে দৌড়ে খেলছে।ওদের হাসিতে খান মঞ্জিলে ঈদের আমেজ ফুটে উঠে। নাহিদা, মায়া, আসিফ,মেহেরুন, সবাই দুচোখ ভরে নিজেদের ভবিষ্যত কর্ণধারদের দেখে যাচ্ছে। এমন সময় রিনা বুয়া জ্যাককে নিয়ে হাজির হলো।নুরভি নাদুস নুদুস কুকুর টার দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে দৌড়ে জ্যাকের গলা জড়িয়ে ধরলো।
“- ভাই দেখ! কি সুন্দর কুত্তা!
“- এই নুরভি চলে আয় এদিক।কুত্তা কামড়ে দেবে তোকে।শৌর্য ভয়ে ভয়ে সোফায় বসা নানুর কোলে গিয়ে বসলো।
“- আরে কিছুই করবে না।দেখলেই বোঝা যায় কি ভদ্র কুত্তা।তুই আয় শৌর্য।কি নরম তুলতুলে গা।আহ! হাত বুলাতে কি মজা রে শৌর্য!
“- নুরভি ও তোকে কামড়ে দেবে চলে আয় বলছি!
“- আরে চুপ থাক ভীতুর ডিম।নুরভিকে কামড়াবে এতো সাহস ওর আছে।এই সুন্দর কুত্তা! তুই কি আমাকে কামড়াবি রে? কামড়ালে তোর দাত টেনে তুলে ফেলবো না।জ্যাক নুরভি কথা শুনে চোখে চোখ রেখে নুরভির হাত চাটতে লাগে।নুরভি সুড়সুড়িতে হেসে লুটোপুটি খায়।নীল উপরে দাড়িয়ে মেয়েকে হাসতে দেখে নিজেও হাসে।শৌর্যের মুখটা দেখে শুভার জ্যাক ভীতির কথা মনে পড়ছে নীলের।শুভাও এভাবে ভয় পেয়ে মুখ কালো করে বসে থাকতো।
“- কেমন আছ বুয়া!
“- এই তো ভাইজান ভালো।
“-তোমার ভাগ্নে ভাগ্নিকে দেখেছ? নুরভি আর শৌর্যের দিকে ইশারায় দিতেই। বুয়া মুখে হাত দিয়ে খুশিতে অশ্রুফেলে।জ্যাক এতোদিন বাদে মালিককে পেয়ে ছুটে আসে নীলের কাছে।নীল জ্যাককে আদর করতে করতে বুয়াকে উদ্দেশ্যে করে বলে,
“-ও ভেতরে আছে।যাও দেখা করে আসো।বুয়া নুরভি শৌর্য কে মন ভরে আদর করে শুভার সাথে দেখা করতে যায়।জ্যাককে আদর করতে দেখে শৌর্য নুরভি চুপচাপ দাড়িয়ে বাবাইকে দেখে।নীল হাতের ইশারায় দুজন কে কাছে ডাকতেই নুরভি ছুটে আসলেও শৌর্য আসে না।
“- ও বাবাই! এই কুত্তা তোমার?
“- মা! এর নাম জ্যাক।ওকে কু্ত্তা বলো না ও কষ্ট পাবে।
“- জ্যাক! কোন জ্যাক? জ্যাক ফেসের জ্যাক।
নীল মুচকি হাসতেই নুরভি বিষয়টা বুঝে মাথা নুয়েই ড্যাবড্যাবিয়ে ঘুরে ঘুরে জ্যাকের মুখটা দেখে উৎফুল্ল হয়ে বলে
“- ও বাবাই!জ্যাক ফেস তো কিউট ফেস।তার মানে কাঁদলে আমাকে কিউট দেখা যায়?
“- আমার মা তো এমনিতেও কিউের ডিব্বা! সবসময়ই কিউট লাগে।
“- হি! হি! হি! এই শৌর্য এটা আমাদের বাবাইয়ের কুত্তা! থুক্কু জ্যাক। নীলের দিকে তাকিয়ে গলা জড়িয়ে হেসে দেয় নুরভি।ছুটে গিয়ে শৌর্য কে টানতে টানতে থাকে।কিন্তু শৌর্য নানুকে ধরে কান্না জুড়ে দেয়।সে কিছুতেই যাবে না। নুরভির কেন যেন শৌর্য কে ভয় দেখাতে ইচ্ছা করলো।ও জ্যাককে টেনে শৌর্যের কাছে আনতেই শৌর্য মায়ার গলা জড়িয়ে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিল।
“- এ শৌর্য ভীতু! শৌর্য ভীতু! এই জ্যাক আমার শৌর্য কে একটু আদর করো তো?
জ্যাক ল্যাজ নাড়িয়ে শৌর্যের আরেকটু কাছে যেতেই শৌর্য কাঁদতে কাদতে দৌড়ে মায়ের কাছে চলে যায়।নুরভি হাসতে হাসতে সেদিক যাবে তখনি নীল আটকে ফেলে।
“- না! মা! ভাইকে ভয় দেখানো ভালো নয়।
“- তাহলে ও এতো ভীতু কেন?
“- তুমি সাহসী যে তাই।শৌর্য জানে ওর এই সাহসী বোনটা থাকতে ওর কিছুই হবে না।
“- তাই বাবাই! তাহলে আমি আর ভাইকে ভয় দেখাবো না।কিন্তু জ্যাককে আমার ভালো লাগছে।ওকে আমি আমার কাছে রাখবো।
“- এই কাজ সেরেছে রে! না মা এমন আবদার করিস না।তোর মা হার্ট ফেল করবে তো করবে আমাকেও আস্ত রাখবে না।জ্যাককে তুই মাঝে মাঝে দেখে আসিস?
“- না! আমার এই জ্যাককেই চাই।বাবাই ওকে আমি কোথাও যেতে দেবো না।বাসার সবাই নুরভি শৌর্যের কান্ড দেখে অতীত স্মৃতি ভুলে প্রানখুলে হাসতে থাকে।নুরভি জ্যাকের গলা জড়িয়ে বসে আছে।এদিকে নীল শুভার সামনে যেন জ্যাক না পড়ে সে চিন্তায় চিন্তিত হয়ে আছে।

চলবে,,,,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *