বধুবরন

বধুবরন-সিজন-2 ! Part- 05

শুভা সাহস সঞ্চার করে নীলের হাত থেকে জোর করে নিজের হাত সরিয়ে দৌড়ে রান্নাঘর চলে গেল।মনের মধ্যে সদ্য ফাগুন হাওয়ার দোল লাগা নীলের সেটা মোটেও পছন্দ হলো না।হাসি মুখটায় পরক্ষনেই রাগী রাগী ভাব এলো।জ্যাককে সাথে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলো। জ্যাক মালিকের মেজাজ ভালোই বোঝে।নীল রেগে থাকলে জ্যাক নীলের গা সহজে ঘেঁষে না।এখনও তেমন চুপচাপ খাটের উপর হামাগুরি দিয়ে বসে আছে।লেজ নাড়াতে ইচ্ছা করলেও নাড়াচ্ছে না ভয়ে।নীল একটানে টিশার্ট খুলে পাশের সিঙ্গেল সোফা টায় ফেলে কোমরে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে।তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ার নিচে দাড়িয়ে আবার ভাবতে থাকে একটু আগের অনুভূতি গুলো।কেন এমন অনুভূতি দোলা দিচ্ছে নীলের রুক্ষ শুষ্ক বিরান মনের গহীনে নীল বুঝে উঠতে পারছে না।এই মেয়ের সাথেই কেন? কেন অন্য কারো সাথে এমন হয় নি।উফ! নীল আর ভাবতে পারে না।শাওয়ার শেষ করে ভেজা ভেজা চুলগুলো হালকা নাড়িয়ে রুমে এসে জ্যাকের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি দেয়।জ্যাক মালিকের মন ভালো হওয়ার খুশিতে এবার মনের সুখে লেজ নাড়াতে থাকে।নীল আলমারি থেকে অ্যাশ কালার টিশার্ট আর কার্গো প্যান্ট পড়ে সোফায় বসতেই কিছুক্ষণ আগে ফেলে রাখা টিশার্ট দেখে হাতে নেয়।মৃদু হেসে টিশার্টের পেছন দিকটায় হাত বুলিয়ে মনে মনে ভাবে
“- এখানেই ছোঁয়া লেগেছিল মেয়েটার।নীল নাকের কাছে নিতেই শ্বাস টানে ভিন্ন সুবাসের আশায় কিন্তু পায় না।নিজের ঘামে ভেজা পারফিউমের গন্ধই কেবল পায়।হতাশ হয়ে বুয়াকে ডাক দেয়
“- বুয়া!মেয়েটাকে বলো কফি দিয়ে যেতে।
“- জ্বী! ভাইজান।
নীল টিশার্ট টা পাশে রেখে ল্যাপটপে মনোযোগ দেয়।শুভা কিছুক্ষণ পর কফি নিয়ে দরজায় এসে টোকা দেয়।শুভার প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে এই ঘরটায় আবার আসতে। গরিব বলে আজ মান অপমান, লাজ লজ্জা ফেলে কাজ করতে এসেছে নয়তো মরে গেলেও এই বাড়ি আর ঐ খারাপ লোকটার কাছে আসতো না।সেদিন কি করেছিল।কথাটা ভাবতেই লজ্জায় অপমানে ছি! বলে ওঠে।শুভা ভেতরে প্রবেশের অনুমতি না পেয়ে অনেক ইতস্তত করে আবার টোকা দেয়।এবার একটু জোরেই দেয়।টোকা আওয়াজ শুনে ল্যাপটপে কাজ করতে করতেই নীল জবাব দেয়।
“- ভেতরে আসো।শুভা আল্লাহর নাম নিয়ে কাপা কাঁপা হাতে কফির কাপ সহ ভেতরে ঢোকে।ঢুকতেই হৃদপিণ্ড বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয় জ্যাককে খাটের উপর গুটিশুটি মেরে বসে থাকতে দেখে।ধীর পায়ে এগিয়ে নীলে সামনা সামনি দাড়িয়ে বলে,
“- সাহেব আপনার কফি!
“- হুমম! রাখো।
“- সাহেব আমি যাই
“- না! শুভা যাওয়ার জন্য প্রস্তুতিই নিচ্ছিল তার মধ্যে নীল নিষেধাজ্ঞা জারি করে বসলো।শুভা বিরক্ত আর অস্বস্তি দুটোকে একত্রে ধারন করে দাড়িয়ে থাকে বোবা মূর্তির মতো।আড়চোখে জ্যাকের দিকে ফিরে ফিরে তাকায়।
নীল কফিতে চুমুক দিয়ে ল্যাপটপের উপর চলমান ব্যস্ত হাতটা থামিয়ে দেয়। শুভার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে কফিতে আরেকবার চুমুক দেয়।
“- ওয়াও! ইটস টু গুড! টু বি অনেষ্ট জাস্ট অসাধারণ তোমার তৈরি এই কফি।তুমি কালো হলে কি হবে? তোমার রান্না খুবই টেস্টি।কথাটা বলেই নীল অপরাধবোধে ভুগলো। নত মস্তকে দাড়িয়ে থাকা শুভার ওড়নার ঘোমটার আড়ালের আধা আধো মুখটা দেখে মৃদু হেসে আবার বললো,
“- উপস!কালো বলেছি বলে কষ্ট পেলে?
শুভা মাথা ঝাঁকিয়ে না সূচক ইশারা করে।
নীল মুগ্ধ নয়নে কফিতে চুমুক দিতে দিতে মেয়েটাকে দেখে।একদম খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলো।কি আছে স্পেশাল এই মেয়ের মাঝে? আপাত দৃষ্টিতে দেখতে দেখা যায় কিছুই নেই।তামাটে কালো গাত্রবর্ণ, টেনে টুনে ৫ ফুট উচ্চতা হবে হয়তো? সুন্দরী বলতে যা বোঝায় তার কিছুই নেই।তাহলে নীলের মনে ঝড় ওঠে কেন এই মেয়ের উপস্থিতিতে? কেন মনটা আকুলিবিকুলি করে একটু দেখার জন্য। মাত্র তো ক দিনের পরিচয়। এতেই মনটা এমন হচ্ছে?নীল গভীর মনোযোগ দিয়ে এই মেয়েটাকে দেখে যাচ্ছে। একটা তো খুঁত ধরে মনটা ফেরানো লাগবে যেখানে হাজারটা খুঁত চোখের সামনে আছেই।তবুও একটা মারাত্মক দোষ লাগবে যাতে এই মেয়ের থেকে মনের দূর্বলতা কাটে।নীল কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে শুভার দৌড়ে পালাতে ইচ্ছা হচ্ছে।হাত পা অসাড় হওয়ার উপক্রম এই পরিস্থিতিতে।শুভা অনেকটা সাহস যুগিয়ে আমতা আমতা করে অতি আস্তে বললো,
“- সাহেব! এবার আমি যাবো?নীল প্রথমে না শুনলেও শুভার দ্বিতীয় বার বলাতে শুনে শুভার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আবার ল্যাপটপে মনোযোগ দেয়।শুভা উত্তরে উপেক্ষায় উদগ্রীব হয়ে দাড়িয়ে আছে।অবশেষে নীল বললো,
“- যাবে? আচ্ছা যাও।এই শোনো?
“- জ্বী সাহেব!
“- নাম কি তোমার?
“- শুভা!
শুভা! এটা কেমন নাম।শুনলে মনে হয় হিন্দু হিন্দু। পুরো নাম কি?
“- শুভাসিনী জান্নাত।
“- হোয়াট এ কম্বিনেশন! হিন্দু মুসলিম দুটো নামই একসাথে। অসম্প্রদায়িক নাম।গুড! গুড।যাও।শুভা তাড়াতাড়ি নীলের ঘর থেকে গিয়ে বাচে।নীল পড়ে থাকা টিশার্ট টার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।শুভা রান্নাঘরে গিয়ে ঘটঘট দুগ্লাস পানি খেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে।শুভাকে আতঙ্কিত হতে দেখে রিনা বুয়া এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
“- কি হয়েছে?
“-ককই কিছু না।পিপাসা পেয়েছিল তো তাই পানি খেলাম।শুভা মনে মনে তওবা করে নিল মিথ্যা বলার জন্য।
“- মিথ্যা বলো না শুভা।আমি প্রথম দিন থেকেই লক্ষ্য করছি তুমি ভাইজানকে দেখলেই ভয়ে চুপসে থাকো।সে রাগী এটা সবাই জানে তাই বলে এমন ভয় পাওয়ার কিছুই নাই।
“- আন্টি আমি কি করবো? সাহেব কে দেখলেই কলিজা শুকিয়ে লইট্টা শুটকি হয়ে যায়।শুভার মুখে এমনতর কথা শুনে রিনা বুয়া শব্দ করে হেসে ওঠে।
“- পাগলি একটা! আমি জানি তোমার সাথে ভাইজানের প্রথম দেখা সুখকর ছিল না। হয়তো ওটার জন্যেই ভয়টা বেশি তোমার।সত্যি বলতে ভাইজান মনের দিক দিয়ে ভালো মানুষ।তার কাছে কিছু সাহায্য চেয়ে কেউ ফেরত গিয়েছে এমন কথা জীবনেও শুনবে না।মানুষ হিসেবে শতভাগ ভালো না হলেও ওতোও খারাপ না।আন্টির মুখে নীলের প্রশংসা শুনে মনে মনে রেগে যায় শুভা।এতোই যদি ভালো তাহলে এতোক্ষন শুভাকে দাড় করিয়ে চোখ দিয়ে গিলছিল কেন?ব্যাটা ভালো না ছাই! আস্তো বদ।মনে মনে একধাপ বকা দিয়ে আন্টির সামনেও বেখেয়ালে সেটা জাহির করে ফেললো
“- কে বলছে খারাপ না! অনেক খারাপ আপনার ভাইজান।আমাকে বলে আমার নাম হিন্দু।আবার বলে অসম্প্রদায়িক নাম।যে ধর্ম নিয়ে মজা করে সে কি ভালো?
“- ওহ! এই কথা। আসলে ভাইজানের কিছু খারাপ দিক আছে যা আমারও পছন্দ না তার পরিবারেরও না।তাইতো এই বাড়িতে একা একা থাকে।
“- পরিবার ছাড়া থাকে? কেন?
“-ভাইজান সৃষ্টি কর্তাকে বিশ্বাস করে না।নাস্তিক উনি।কোনো ধর্ম পালনের ছিটে ফোটাও তার মধ্যে নেই।এই জন্য তার পরিবারের সাথে তার বনিবনা হয় না।আরও একটা কারন আছে,,রিনা বুয়ার আরেকটা কারন না শুনেই শুভা অধৈর্য হয়ে মুখ বেঁকিয়ে বলে,
“- ছি! কি খারাপ লোক।এই লোকের জন্য রান্না করলেও তো আমার ইবাদত নষ্ট হবে।আমি করবো না এই চাকরি।
“- আস্তে বলো! শুনে ফেলবে।
“- শুনলে কি হবে? শুভার কথা শেষ হতেই উপর থেকে নীলের কন্ঠস্বর শোনা গেল।
“- বুয়া একটু এদিক আসো তো?
শুভা চোখ বড় করে বুয়ার পেছনে লুকিয়ে পড়ে নীলের কন্ঠস্বর শুনে।তা দেখে হেসে কুটিকুটি হয় রিনা বুয়া।
“- কি হলো তো! শুনলে কি হবে বুঝেছ এবার? চুপচাপ কাজ করে যাও।আমরা হলাম কাজের লোক।সাহেবদের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে মাথা ঘামালে আমাদের পেটে ভাত ঢুকবে না।তুমি রান্নাঘরে যাও।আমি গিয়ে দেখি কি বলে ভাইজান।
“- আচ্ছা! আন্টি?
“- কি বলো!
“- আমি যা বলেছি বলে দেবেন না তো?
“- না রে পাগলি!বলবো না।যাও কাজ করো।
শুভা ভয়ে ভয়ে রান্নাঘরে গেল।কি দরকার ছিল সাহেব কে নিয়ে ওসব বলার।ঐ ব্যাটা একটা খাটাশ।ওরে নিয়ে তোর এতো মাথা ব্যথা কেন শুভার বাচ্চা। এরপর চুপ থাকবি। একদম চুপ।পেটের মধ্যে কথা জমাতে পারিস না কেন তুই? এজন্য কোনদিন না লাথি দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয় ঐ বদ টা।শুভা নিজের মনে নিজেই কথা বলে।
নীল বুয়াকে ডেকে শুভাকে কাজ বুঝিয়ে দিতে বলে।আরও কিছু কথা বলে।নীল ৩ দিনের জন্য অস্ট্রেলিয়া যাবে সে কথাও জানায়।এ তিনদিন রিনা বুয়াকেই সব দেখে শুনে রাখতে বলে প্রতিবারের মতোই।রিনা বুয়া সব বুঝে শুনে চলে আসে।মনে মনে ভাবে এতো ভালো মনের একটা মানুষ হঠাৎই কেমন পশুর মতো হয়ে যায়।তখন রিনার কাছে অচেনা হয়ে যায় মানুষটা।রিনা বোঝে না আল্লাহ কে বিশ্বাস করলে ক্ষতি কি? বুয়ার মতো তুচ্ছ অচেনা অজানা একজন মানুষকে আপন ভেবে বিশ্বাস করতে পারলে যে সৃষ্টি করেছে তাকে কেন বিশ্বাস করা যাবে না? খুবই প্যাচের বিষয়? বুয়া যতোবার এ বিষয় নিয়ে ভাবে ততবার মাথায় ব্যথা হয়।আজও হচ্ছে। চিনচিন করে মাথার পেছন ধরে আসছে।এখন এই চিন্তা থেকে মুক্তি জন্য অন্য কিছু ভাবতে হবে।মনোযোগ অন্য দিকে নিতে।বুয়া রান্নাঘরে শুভার সাথে গল্প জুড়ে বসে কাজ করতে করতে।এভাবেই একসপ্তাহের বেশি কেটে যায় এ বাড়িতে শুভার।এখন আর কোনো কিছুতেই জড়তা লাগে না।এ বাড়ির প্রতিটি মানুষ শুভার আপন শুধু ঐ সাহেব ছাড়া।সাহেব কে শুভা মন থেকেই অপছন্দ করে।আজ সকাল সকালই চলে এসেছে শুভা।এতোদিনে নীলের অনুপস্থিতিতে এই বাড়িকে নিজের অভয়ারণ্য মনে করে চলাফেরা কাজকর্ম করেছে।ভুলেই গেছে নীলের কথা।শুভা ওড়না পেচিয়ে কোমরে গুঁজে সোফা টোফা ঝাড়ু দিচ্ছিলো তখনই জ্যাক আস্তে আস্তে ঘেউ ঘেউ করতে করতে শুভার পেছন এসে দাঁড়ালো। শুভা ভয়ে দৌড়ে সোফার পেছনে গিয়ে দাড়িয়ে বুকে থু থু দেয়।নীল যাওয়ার পর থেকেই জ্যাককে বাড়ির ভেতর ঢুকতে দেয় না শুভা।সবাইকে বলেও দিয়েছে যেন জ্যাকের বাইরের ঘরেই খাবার দাবার দিয়ে ওখানে আটকে রাখে। বাড়ির বাকি কাজের লোক ভেবেছে শুভা ভয় পায় তাই তারাও কিছু বলে নি।শুভা মনে মনে খুশি হতো জ্যাককে যখন শিকল দিয়ে বাঁধা বাইরের ছোট্ট ডগ হাউজ টায় ফ্যালফ্যাল করে বসে থাকতে দেখতো।মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ পেতো এই ভেবে যে এর বদমাইশ মালিককে শায়েস্তা না করতে পারলেও এটার এই জ্যাককে শায়েস্তা করতে পেরেছে। কিন্তু আজ কে ছেড়ে দিল? শুভা নাক মুখ কুঁচকে দাঁত কিড়মিড়িয়ে জ্যাকের দিকে ঝাড়ু উঠিয়ে বললো,
“- এই বদের হাড্ডির বদ জ্যাক! যা বাইরে যা।হুশ! হুশ।জ্যাককে একচুল ও নড়াতে না পেরে আবার বললো,
“- যাচ্ছিস না কেন? বেহায়া একটা।যেমন মালিক তেমন কুকুর।কুকুর তো নয়।কুত্তা! উলে! তোকে তো আবার কুত্তা বলা নিষেধ! জ্যাক বলতে হবে। জ্যাক!হু নিষেধের নিকুচি করি।তুই একটা কুত্তা!কুত্তা! জ্যাক বুঝলো কি না কে জানে? শুভার আঙ্গুল উচিয়ে বলা কথাগুলো শুনে রেগে গিয়ে জোরে জোরে ঘেউ ঘেউ করে,
“- এই চুপ! চুপকর! বেশি চিৎকার করবি তো মেরে বস্তা ভরে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিয়ে আসবো বুঝলি! আদিখ্যেতা করে কুত্তার নাম রেখেছে জ্যাক। হু! শুভার কথা শেষ না হতেই জ্যাক দৌড়ে সিঁড়ির কাছে গিয়ে আহ্লাদের ডাক দিল।তখনি শুভার মাথায় বাজ পড়ার মতো অবস্থা হলো।পুরো শরীরে ৪৪০ ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক শক লাগলো।নীল সিঁড়ির কাছেই দাড়িয়ে আছে শুভার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে।শুভার জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা নীলের তীক্ষ্ণ চাহনী দেখে।শুভাকে আজ নীল দ্বিতীয়বার মাথায় কাপড় ছাড়া দেখলো।এ কদিনে অনেক পাল্টে গেছে মেয়েটা।সেদিন খুজেছিল কি দোষ পাওয়া যায় কিন্তু আজ তো দোষ নয় নিজের মন টাই খুজছে এই মেয়ের ভীরু চোখের চাহনীতে।চিকন ঘন ভ্রু যুগলের নিচে হরিনী দুটি বড় বড় চোখের অসহায় দৃষ্টির মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলে নীল।কোনোমতে নিজেকে সামলে জ্যাককে নিয়ে উপরে উঠতে উঠতে পাশে দাড়ানো বুয়াকে লক্ষ্য করে আড়চোখে শুভার দিকে তাকিয়ে বলে,
“- বুয়া! এই মেয়েকে আমার ঘরে এখনি পাঠাও।কুইক!
নীল উঠে যেতেই শুভা বাচ্চাদের মতো কেঁদে ওঠে আন্টিকে ধরে।
“- আন্টি আমার ভয় লাগছে।
“- এতো বেখেয়ালি কেন তুমি? ভাইজান সেই কখন থেকেই দাড়িয়ে তোমার এসব বকা শুনছে।জ্যাককে কি পরিমাণ ভালোবাসে ভাইজান তুমি চিন্তাও করতে পারবে না।আর তুমি কি না এসব বলছো? আমি কিছুই জানি না।যাও তুমি উপরে।
“- আন্টি!
“- আরে যাও! বেশি বকলে দৌড়ে চলে আসবে বাকিটা আমি দেখে নিবো।যাও এবার।নয়তো ভাইজান বেশি রেগে যাবে।ভাইজান আবার বেশি রাগলে হুশ থাকে না।
বুয়া কথাটা বলেই রান্নাঘরে চলে গেল।শুভা কাপা কাপা পায়ে দুকদম এগোয় আবার পেছোয়।এমন করতে করতে নীলের দরজায় এসে দাড়িয়ে থাকে।টোকা দেওয়ার মতো সাহস শক্তি কোনোটাই নেই শুভার।শুভা ভয়ে কেঁদে চোখ লাল করে ফেলেছে।শুভাকে দরজা বাইরে দাড়ানো দেখে নীলের ধৈর্য্যের বাধ ভেঙে যায়।নিজে উঠে দরজা খুলে শুভার মুখোমুখি রেগে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
“- ভেতরে আসার জন্য মহারানীকে কি ইনভিটেশন কার্ড দেওয়া লাগবে? ভেতরে আসো!
নীলের ধমকে শুভা চমকে ওঠে।ভীরু পায়ে নীলের পাশ কেটে ভেতরে আসতেই ধাড়াম করে দরজা লাগিয়ে দেয়।শুভা তাতে আরেকদফা চমকে ওঠে।এই মুহুর্তে হার্ট ফেল হওয়ার মতে অবস্থা শুভার।ওড়নার ঘোমটার আড়ালে ভয়ে মুখটা শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে।যা নীলের দৃষ্টি এড়ায় না।নীলের এই একঘেয়ে, পানসে জীবনে কিছুটা আনন্দ, কিছুটা উন্মাদনা নিয়ে এসেছে শুভা।আগে যা অসহ্য লাগতো এখন ভালো লাগে।নির্জীব মৃত প্রায় মনটাতেই সঞ্জীবতা ফিরে এসেছে।এ কদিন পর অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে আবার সেই উন্মাদনা, আনন্দ মনে অনুভব করছে।মনে হচ্ছে হ্যাঁ বেঁচে আছি এখন।শুভার সামনে চুপচাপ বসে শুভাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলো।পিচ্চি মেয়ের কতো সাহস! আমাকে কি সব বলছিল? আবার এখন মেনি বিড়াল হয়ে আছে।নীল জ্যাক কে আদর করতে করতে বললো,
“- বড্ড সাহস তোমার রাধূনী!
“- সাহেব! আমিইই আসলেএএ
“- চুপ! একদম চুপ! কোনো কথা না।আমাকে যা বলেছ বলেছ আমার জ্যাককে মেরে বস্তায় ভরে বুড়িগঙ্গা ফেলার কথা বলার সাহস কই পাও?
“- সাহেব! শুভা কাঁদো গলায় কিছু বলতেই যাবে নীল আবার ধমকে উঠল।এই মেয়েকে ভয় দেখাতে বেশ লাগছে নীলের।মনে মনে হাসি আসলেও দমিয়ে রাখছে।ইদুর বেড়াল খেলার মতো মজা পাচ্ছে নীল।
“-বলেছি না কথা না বলতে? চুপ! অনেক সাহস তো তোমার তাই সাহসের পরীক্ষা নেবো তোমার আজ।আজ থেকে জ্যাককে গোসল করানো, খাওয়ানো, পটি করানো সব তুমি করবে। জ্যাক বাড্ডি যাও ঐ রাধুনীকে ধরে নিয়ে আসো। জ্যাক মালিকের এক কথায় দৌড়ে শুভার কাছে যেতেই শুভা শব্দ করে কাঁদতে থাকে চোখ বন্ধ করে।জ্যাক শুভার কামিজের নিচের অংশ কামড়ে নীলের কাছে নিয়ে আসে।
“- চোখ খোলো রাধূনী! চোখ খোলো!
নীলের ধমকে চমকে তাড়াতাড়ি চোখ খুলে ফুঁপিয়ে কাঁদে।নীল সোফা থেকে উঠে দাঁড়াতে শুভা দু কদম পেছনে সরে যায়।নীল মৃদু হেসে সামনে এগিয়ে শুভার থুতনি ধরে নিজের দিকে তাক করে।বন্ধ চোখের মায়াবি মুখের দিকে বিভোর হয়ে যায় নীল।কে বলেছে এ অসুন্দর? আমি! তোর দৃষ্টির উপর লানত নীল! এই শ্যামাঙ্গিনী শ্যামাসুন্দরীর রূপের কাছে সব ফ্যাকাশে,নির্জীব। এই রাধূনীর কম্পনরত দু ওষ্ঠের নেশা কতোটা ভয়াবহ তা আমি ছাড়া এই মুহুর্তে কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না।কেউ না!নীল মুগ্ধতায় ডুবে শান্ত স্বরে বলে,
“-তোমাকে আমার ভালো লেগেছে।কেন লেগেছে জানি না।তবে যতোদিন এই ভালোলাগাটা না শেষ হবে তুমি আমার বাড়ি থেকে যেতে পারবে না।আর হ্যাঁ! আমি তোমার সাথে ফিজিক্যালি সম্পর্ক করতে চাই।বলতে পারো কন্টাক্ট ম্যারেজ যাকে বলে।এ বাড়ির সবাইকেই বলেছি তুমি জানো না জেনে গেলে।কাল তৈরি থেকো।যাও!শুভার থুতনি ছেড়ে নিজের অনুভূতির উন্মাদনা সামলে বসে পড়ে নিচে নীল।
শুভা যেন সাত আসমান থেকে পড়ে খেজুর গাছে আটকে আছে এমন মনে হচ্ছে। মাথা ঝিমঝিম করছে।
“-কি বললো এই লোক? আমি মরে গেলেও তো তার মতো খারাপ লোককে বিয়ে করবো না।শুভাকে চুপচাপ পাথরের মূর্তির মতো দাড়িয়ে থাকতে দেখে নীল আবার ধমকের সুরে বললো,
“- কি হলো?সম্পর্ক কি এখনই শুরু করতে চাও।যদি রাজি থাকো আমার সমস্যা নাই।
শুভা সামনে কি আছে না দেখেই দৌড়াতে গিয়ে হুড়মুড় করে পড়ে যায় কার্পেটে পা মচকে।মচকানো পায়ের ব্যথা হজম করেই উর্ধশ্বাসে হনহন করে নীলের রুম থেকে বেরিয়ে বাঁচে।মনে মনে সংকল্প করে এমন খারাপ লোকের ধারের কাছেও শুভা থাকবে না।যেই ভাবা সেই কাজ।কাওকে কিছু না বলেই ব্যাগ নিয়ে গাড়ি ধরে বাড়ি চলে আসে।ঐ বাড়ির কুকুরকে দেখে ভয় লাগে এই অজুহাতে দিয়ে মা’ কে বলে, শুভা আর ও বাড়ি চাকরি করবে না।মনিরা বেগম মেয়ের খুশিতেই খুশি যদিও চাকরিটা থাকলে ভালো হতো ভেবে মনে মনে একটা আফসোস করে।তবুও মেয়েকে কিছু বলে প্রকাশ করে না।

চলবে,,,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *