প্রেমাতাল

#প্রেমাতাল পর্ব ৩৮

লেখা- মৌরি মরিয়ম
দুই সপ্তাহ পর তিতিরের বাবাকে বাসায় আনা হলো। তারপর তিতির একটু নিশ্চিন্ত হলো। ডাক্তার বলে দিয়েছে বাবাকে এখন থেকে খুব সাবধানে রাখতে হবে, উনি আর কোন ভারী কাজ করতে পারবেন না। এমনকি ওনাকে বাজার করতেও দেয়া যাবে না। ফুল বেডরেস্টে থাকতে হবে, নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে।
তিতির ইদানিং খুব স্বাভাবিক আর হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করে। সবকিছুই বাবাকে একটু ভাল রাখার জন্য। সারাদিন অফিস করে ফিরে বাবার সাথে গল্প করে তিতির, সারাক্ষণ হাসতে থাকে। তারপর রাতে যখন বিছানায় যায়, আস্তে আস্তে একসময় অসহনীয় হয়ে ওঠে রাতটা। যে তিতিরের ঘুমাতে কোন নির্দিষ্ট সময় বা বিছানা লাগতো না সে তিতির আজ সারারাত বিছানায় শুয়ে ছটফট করে একটু ঘুমের জন্য, ঘুম আর আসেনা। আসবে কিভাবে, ঘুমের ওষুধ তো মুগ্ধর কাছে। সারাদিনের ব্যাস্ততার মধ্যে কোনভাবে ভুলে থাকা যায় মুগ্ধকে। কিন্তু রাতে? একসাথে থাক আর ফোনেই থাক রাতগুলো যে কতভাবে স্পেশাল করতো মুগ্ধ, নিজের জন্মটাকেই সার্থক মনে হতো তখন। আর আজ মুগ্ধর কণ্ঠস্বরটাও শুনতে পায়না ও। মুগ্ধ আর ওকে ফোন করেনা, ও নিজেও আর ফোন করেনা মুগ্ধকে। মুগ্ধর সাথে কাটানো মধুময় স্মৃতিগুলো ভেবে ভেবে কেটে যায় তিতিরের রাতগুলো। তারপর কোনদিন ভোরের দিকে ৩,৪ ঘন্টা ঘুমায়, কোনদিন তাও না। এভাবেই এক সময় অভ্যস্ত হয়ে যায় তিতির। এভাবেই কেটে যায় মুগ্ধহীন মৃতজীবনের অনেকগুলো মাস।
অফিস থেকে ফিরেই তড়িঘড়ি করে গোসলটা করে নিল তিতির। চুলগুলো কোনরকমে মুছে দ্রুত হেয়ার ড্রায়ারে শুকিয়ে নিল। তারপর মায়ের রেখে যাওয়া মেজেন্ডা রঙের কাতান শাড়িটা পড়ে নিল তিতির। চোখে কাজল টেনে বেড়িয়ে আসতেই মা বলল,
-“একি অবস্থা? একটুও সাজিসনি দেখছি। কেমন মরামরা দেখাচ্ছে! আয় আমার সাথে।”
মা তিতিরের হাত ধরে আবার ঘরে নিয়ে গেল। তিতির বলল,
-“আমাকে কিন্তু এভাবেই সুন্দর লাগছে।”
মা বলল,
-“না মা, একটু সাজতে হয়। হালকা একটু মেকাপ কর। আর শাড়ির সাথে মিলিয়ে লিপস্টিক লাগা।”
এসব বলতে বলতে মা আলমারি থেকে গয়না বের করে আনলো। তিতির বলল,
-“আমি গয়নাগাটি পড়বো না মা। ভাল্লাগেনা আমার এসব পড়তে।”
-“বেশি না, শুধু এই দুলটা আর এই নেকলেসটা পড়ে নে। আর হাতে এই দু’গাছা চুড়ি। নাহলে একদমই খালি খালি লাগছে।”
তিতির আর কথা বাড়ালো না, ওগুলো পড়ে নিল। হালকা মেকাপও করলো, লিপস্টিকও লাগালো। মুগ্ধর সাথে পরিচয় হবার পর ও কোনদিন লিপস্টিক লাগায়নি। আজই প্রথম। মা বলল,
-“বাহ এখন কত সুন্দর লাগছে আমার মেয়েটাকে।”
তিতির হাসলো। হাসিতো রেকর্ড করাই থাকে ঠোঁটের মধ্যে। প্রয়োজন হলেই তিতির ছেড়ে দেয় সেই রেকর্ড।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সুহাসের ফ্যামিলির সবাই চলে এল। সুহাসের বাবা-মা, দাদু, ভাই-ভাবি, ছোট বোন সবাই এসেছে। সবার মাঝে ঘোমটা মাথায় দিয়ে লাজুক মুখে বসে আছে তিতির। তিতিরের বাবা-মা, ভাই-ভাবিও আছে। সবাই কত গল্পগুজব করছে, কত হাসি-আনন্দ! আজ সবাই কত খুশি! হঠাৎ সুহাসের দিকে চোখ পড়তেই তিতির দেখলো সুহাস হা করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। চোখে চোখ পড়তেই সুহাস অপ্রস্তুত হয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। ওর যায়গায় মুগ্ধ হলে চোখ ফেরাতো না, বেহায়ার মত তাকিয়েই থাকতো। হাজার চেষ্টা করলেও কেউ কোনদিন মুগ্ধ হতে পারবে না, মুগ্ধ মুগ্ধই। তাই মুগ্ধর যায়গাটা এ অন্তরে সারাজীবন সুরক্ষিত থাকবে!
দুই ফ্যামিলির উপস্তিতিতে তিতির আর সুহাসের এঙ্গেজমেন্টটা হয়ে গেল। আজ সুহাস আলতো করে তিতিরের হাতটা ধরে যত্ন করে আংটি পড়িয়ে দিয়েছে। তারপর তিতিরও পড়িয়েছে। বাবা হাসছিল, বাবা খুশি। বাবার খুশির জন্য তিতির আজকাল সব করে। বাবার ভাল থাকার জন্যই আজও মৃত্যুর পথকে বেছে নিতে পারেনি তিতির।
আংটিটার দিকে কতক্ষণ চেয়ে থেকে রাত প্রায় ২ টার দিকে তিতির মুগ্ধকে ফোন করলো। প্রায় সাথে সাথেই ফোন ধরলো মুগ্ধ, ও বোধহয় জেগেই ছিল।
-“হ্যালো তিতির!”
-“কেমন আছো?”
-“ভাল, তুমি কেমন আছো?”
-“ভাল।”
-“মা, স্নিগ্ধ, পিউ সবাই ভাল আছে?”
-“হ্যা, কিন্তু মা সামান্য অসুস্থ।”
-“কি হয়েছে?”
-“তেমন কিছু না। ডায়াবেটিকস, হাই প্রেশার, এসব নিয়েই প্রব্লেম।”
-“ও।”
তারপর দুজনেই চুপ। একসময় মুগ্ধ বলল,
-“জানো? পিউয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে।”
-“বাহ, কবে? কার সাথে?”
-“ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথেই। সামনের মাসের ৭ তারিখ।”
-“ওহ। তাহলে তো বেশিদিন বাকী নেই।”
-“হুম।”
-“আমাকে জানালেও না।”
-“কার্ড এলেই পৌঁছে যাবে তোমার কাছে। যদিও জানি তুমি আসবে না, তবু।”
-“আসব কিভাবে তোমার ফ্যামিলির সামনে মুখ দেখাবার অবস্থা তো আমার নেই।”
-“ফালতু কথা বলোনা তো।”
-“যাই হোক, পিউকে বলো আমার দোয়া সবসময় ওর সাথে থাকবে। ও অনেক অনেক সুখী হবে।”
-“হুম, তা এতদিন পর হঠাৎ তুমি আজ ফোন করলে?”
-“হ্যা, একটা কথা বলার জন্য।”
-“কি?”
-“আজ রাতে সুহাসের সাথে আমার এঙ্গেজমেন্ট হয়েছে।”
-“ওহ! কংগ্রাচুলেশনস!”
-“থ্যাংকস।”
-“বিয়ে কবে?”
-“সামনের বছরের শুরুতেই।”
-“এত দেরীতে কেন?”
-“সুহাসদের কি একটা প্রব্লেম যেন আছে। তাই সময় লাগবে।”
-“ও।”
-“এবার তুমিও বিয়ে করে ফেল।”
মুগ্ধ হাসলো। তিতির জিজ্ঞেস করলো,
-“হাসছো যে?”
-“এমনি। আচ্ছা, এখন রাখি। কাল আবার অফিস আছে।”
-“আচ্ছা।”
-“ভাল থেকো, সুখে থেকো আর নিজের খেয়াল রেখো। টাটা…”
ফোন রেখেই তিতির কেঁদে ফেলল। কত কাছের মানুষ্টা আজ কত দূরের হয়ে গেছে! চাইলেই তাকে আর যা ইচ্ছা তা বলা যায়না। আংটিটা হাত থেকে খুলে রাখলো তিতির। এটুকুই ও পারে। আর তো কিছু ওর সাধ্যের মধ্যে নেই।
মুগ্ধ ইচ্ছে করেই ফোন রেখে দিল। আর কথা বলার মত শক্তি, সাহস আর মনের জোর নেই মুগ্ধর। রাত ২ টা বাজে, একসময় ৩ টা বাজবে। একসময় ৪ টাও বাজবে। কিন্তু মুগ্ধ ঘুমাতে তো পারবে না। একসময় সকাল হবে তারপর অফিসেও যেতে হবে। অফিসে না গেলে মা, ভাই-বোনদের খাওয়াবে কি? বাবা কেন এমন করলো? সবার দায়িত্ব ওর কাধে দিয়ে ফাঁকি মেরে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল! ঠিক না, ঠিক না।
আজ তিতিরের এঙ্গেজমেন্ট হয়েছে, কিছুদিন পর বিয়ে হবে, বাসর হবে অন্য একটা ছেলের সাথে। নাকে নাকফুল পড়বে তিতির কিন্তু অন্য একটা ছেলের জন্য। অন্য কারো বাচ্চার মা হবে তিতির। আর ও হাত গুটিয়ে বসে বসে দেখবে। কিছু করার নেই তো! ভালবাসা যে বড্ড অসহায়, বুকে প্রেম আছে কিন্তু বুকে জমানো সব আশার সলতেগুলো আস্তে আস্তে ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে। তবু বেঁচে থাকতে হবে মা, ভাই-বোনের জন্য। শালার মরারও উপায় নেই।
To be continued…