প্রেমাতাল

#প্রেমাতাল পর্ব ১৭

 
একসময় নীরবতা ভেঙে মুগ্ধ বলল
-“ভাবছো আমি খুব খারাপ?”
-“না।”
-“তাহলে? কথা বলছো না, দূরে বসে আছো! এসবের কারন কি?”
-“কই?”
মুগ্ধ তিতিরের কাছে এগিয়ে ওর হাতটা ধরতেই তিতির আচমকা সরে গেল। মুগ্ধ বলল,
-“ভয় কেন পাচ্ছো?”
তিতির ভাবলো সত্যিই তো, ও কেন ভয় পাচ্ছে! বলল,
-“কই নাতো! ভয় পাচ্ছি না।”
মুগ্ধ তিতিরের হাতটা ধরে বলল,
-“শোনো তিতির, তোমার চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি তোমার আমাকে ভয় করছে। তুমি আমাকে এরকম ভাবোনি হয়তো তাই এক্সেপ্টও করতে পারছো না। কিন্তু তোমার ভয় পাওয়ার কোনো কারন দেখি না। ও অনেক বড় একটা অন্যায় করেছিল। রাগটা আমার সেদিনই উঠেছিল কিন্তু তোমার সেফটির কথা ভেবে পালিয়ে গিয়েছিলাম।”
তিতিরের মনে পড়লো মুগ্ধর মা বলেছিল মুগ্ধর অনেক রাগ, না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। মুগ্ধ বলল,
-“দেখো, আমি অল্পতে রাগি না কিন্তু কেউ বেঈমানি করলে প্রচন্ড রেগে যাই।”
তিতির ভয়ে ভয়ে বলল,
-“বেঈমানকে তার বেঈমানির শাস্তি দেয়ার জন্য আল্লাহ আছেন।”
-“হ্যা অবশ্যই আছেন। আমি তো শাস্তি দেইনি। আমি শুধু প্রটেস্ট করেছি। আমার প্রটেস্ট করার ধরনটা এমন। আমার বাবা ছোটবেলা থেকে আমকে এভাবে প্রটেস্ট করতে শিখিয়েছেন। তার কারন, মার কেই মানুষ সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। আমাদের সোসাইটিতে সবাই ক্রাইম করে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর আমরা কাপুরুষের মত হাত গুটিয়ে বসে থাকি! আমরা যত হাত গুটিয়ে বসে থাকবো ক্রাইম ততই বাড়তে থাকবে।”
তিতির চুপ করে বসে রইল। এতক্ষণে একবারও তাকায়নি মুগ্ধর দিকে। মুগ্ধ বলল,
-“কি হলো? কিছু বলো।”
-“তোমাকে তখন আমার অচেনা লাগছিল। তোমার ফেসটাও বদলে গিয়েছিল।”
মুগ্ধ তিতিরকে বুকে টেনে নিল। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-“কান পেতে শুনে দেখো তো, এই হৃদস্পন্দন অচেনা কিনা?”
তিতির শুনলো ওর চেনা সেই শব্দ, ঢিপঢিপ ঢিপঢিপ ঢিপঢিপ! পেল সেই চেনা ঘ্রাণ। মুগ্ধ একটু সময় দিল তিতিরকে। তারপর বলল,
-“তিতির প্রত্যেকটা মানুষের মাঝেই ভাল খারাপ দুটো দিক থাকে। ভালটা খুব সহজেই মানুষের চোখে পড়ে। কিন্তু খারাপটা একসাথে থাকতে থাকতে সামনে আসে।”
তিতিরের মনে হলো মুগ্ধ তো ঠিকই বলছে। অন্যায় দেখলে যারা চুপ করে থাকতে পারে না তারাই তো প্রকৃত মানুষ। বলল,
-“আমি হঠাৎ তোমকে এভাবে দেখছি বলে হজম করতে সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু প্রটেস্ট করা কোনো খারাপ কাজ না। সো এটাকে তোমার খারাপ দিক বলা যাচ্ছে না।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“আমি অনেক স্ল্যাং ইউজ করেছি তিতির। তুমি তো জানতে না তোমার মুগ্ধ এত স্ল্যাং ইউজ করে।”
তিতির কিছু বলল না। মুগ্ধ বলল,
-“শুধু মেরেই প্রটেস্ট করা যেত, স্ল্যাং টা এক্সট্রা ছিল যার কোনো দরকার ছিল না। বাট এধরনের সিচুয়েশনে এমনই হয়, আই কান্ট কন্ট্রোল মি। এটা আমার খারাপ দিক। এজন্যই বললাম আজ আমার খারাপ দিকটা তোমার সামনে এসেছে। একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে তোমার সবটা জানা দরকার। সব জেনেশুনে তারপর ডিসিশন নাও।”
তিতির মাথা তুলে সোজা হয়ে বসে বলল,
-“কিসের ডিসিশন?”
-“আমার সাথে সারাজীবন থাকার ডিসিশন।”
তিতির মুগ্ধকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“একদম বাজে কথা বলবে না। আমি ডিসিশন অনেক আগেই নিয়ে ফেলেছি। এখন তুমি যেমনই হও না কেন আমি তোমার সাথেই থাকব।”
-“যদি আমার আরো আরো খারাপ দিকগুলো তোমার সামনে আসে তবুও থাকবে?”
-“তবুও থাকব।”
-“যদি জানতে পারো আমার আরেকটা গার্লফ্রেন্ড আছে তবুও?”
তিতির মুগ্ধকে ছেড়ে দিয়ে ওকে মারতে শুরু করে দিল। মুগ্ধ হাসতে হাসতে ওর দুই হাত একসাথে ধরে নিজের কাছে নিয়ে এল। তারপর মুখটা ধরে গালে একটা চুমু দিল। তিতির মুগ্ধর বুকে মাথা রাখলো।
নীলাচলের সামনের টিকেট কাউন্টারে জীপ থামতেই মুগ্ধ আর ড্রাইভার নামলো টিকেট কাটতে। তিতিরও নেমে দাঁড়ালো। চিকন রাস্তা দুই ধারে খাদ! অনেক নিচে দূরে বান্দরবান সিটি দেখা যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে সাঙ্গু নদী আর অজস্র উঁচ নিচু পাহাড়। মুগ্ধ পাশে এসে দাঁড়ালো। বলল,
-“চলো।”
-“এত তাড়াতাড়ি চলে এলাম?”
-“মাত্র ৬ কিমি তো!”
-“ওহ।”
মুগ্ধ জীপের দরজা খুলতেই তিতির বলল,
-“আবার জীপে উঠব কেন?”
-“এটা তো কাউন্টার। আরেকটু যেতে হবে। হেটে যাবে নাকি?”
-“ওহ।”
জীপ সাঁই করে একবার নিচুতে গিয়ে আবার উঁচুতে উঠে নীলাচলে নামিয়ে দিল। মুগ্ধ জীপটাকে পার্কিং এ দিয়ে ড্রাইভারের নাম্বার নিয়ে বলল,
-“আমরা হাইয়েস্ট ২ ঘন্টা থাকব। তুমি যেখানে ইচ্ছা অপেক্ষা করতে পারো। এসে তোমাকে ফোন দিলে তুমি চলে এসো।”
চওড়া সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল তিতির। ওর মনে হলো ওরা কোনো পার্কে বেড়াতে এসেছে। মানুষের অভাব নেই। মুগ্ধ ওর হাত ধরে বাম পাশের একদম কিনারে নিয়ে গেল। এখানটায় ইটসিমেন্ট দিয়েই গাছের গুড়ির ডিজাইন করে তা দিয়ে বারান্দার মত বানিয়েছে। এখানে এসে সামনে তাকাতেই তিতিরের মন ভাল হয়ে গেল। মুগ্ধ ওর পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
-“কি এখন ভাল লাগছে তো?”
-“হুম। তুমি বুঝতে পেরেছিলে প্রথমে আমার ভাল লাগেনি?”
-“হ্যা, সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় তোমার এক্সপ্রেশন দেখেই বুঝেছি।”
তিতির হাসলো।এরপর মুগ্ধ ওকে হাত ধরে কোথাও নিয়ে যাচ্ছিল। তিতির দেখলো এখানে একটা গোল দোতলা বিল্ডিং আছে। কাছাকাছি যেতেই বুঝলো এটা একটা রেস্টুরেন্ট। মুগ্ধ রেস্টুরেন্টের দোতলায় চলে গেল। দোতলায় স্টাফদের রেস্টরুম বোধহয়। মুগ্ধ একটা ওয়েটারকে ডেকে বলল ছাদে যেতে চায়। ওয়েটার বলল,
-“পারমিশন নাই।”
মুগ্ধ ওয়েটারের হাতে ১০০ টাকা গুঁজে দিতেই ওয়েটার হেসে হেসে বলল,
-“ভাই আসলে তো এভাবে কাউকে উপরে যেতে দেইনা। বেশিক্ষণ থাকবেন না।”
-“হ্যা হ্যা আমি একটু তোমার আপুকে উপর থেকে পাহাড় দেখিয়েই চলে আসব।”
উপড়ে উঠতে উঠতে তিতির বলল,
-“পুলিশের ছেলে হয়ে তুমি ঘুষ দিচ্ছ?”
-“এটা ঘুষ না। আমাকে ও কিছু দিচ্ছে আমি ওকে কিছু দিচ্ছি, শোধবোধ। তাছাড়া আমাকে অত অনেস্ট ভাবার কোনো কারন দেখি না। আমার প্রয়োজনের জিনিসটা আমি যেভাবে হোক আদায় করে নিই। এটা আমার আরেকটা খারাপ দিক।”
একথা বলেই হাসলো মুগ্ধ। উপরে উঠেই তিতির বুঝলো কেন মুগ্ধ ঘুষ দিয়ে হলেও এখানে নিয়ে এসেছে ওকে। মুগ্ধ একেবারে কিনারে নিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“আশেপাশে তাকিও না। দূরে থাকাও। যতদূরে চোখ যায়।”
তিতির তাই করলো। তারপর মুগ্ধর বুকে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। বলল,
-“খুব মনে পড়ছে নীলগিরির কথা। কিভাবে পাহাড় দেখিয়েছিলে আমাকে। আমি তো দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম।”
-“হুম।”
-“আচ্ছা তুমি কি সবাইকে ওভাবে পাহাড় দেখাও?”
-“নাহ, তোমার মধ্যে মুগ্ধতা বেশি তাই তোমাকে দেখিয়েছি।”
এখান থেকে সব পাহড়গুলোকে নীল দেখাচ্ছে। এজন্যই বোধয় এটার নাম নীলাচল। ডান পাশে তাকাতেই দেখতে পেল কয়েকটা ঘর। সবগুলোর চাল নীল। তিতির জিজ্ঞেস করল,
-“ওটা কি?”
-“নীলাচল এস্কেপ রিসোর্ট।”
-“ওখানে কি টুরিস্টরা থাকতে পারে?”
-“হ্যা। গুজব আছে আর্মিরা ছাড়া কেউ থাকতে পারেনা কিন্তু আসলে পারে। আমি তো এক রাত থেকেছি উইদাউট এনি রেফারেন্স।”
-“সত্যি?”
-“হ্যা।”
তিতির ঘুরে দাঁড়াল। মুগ্ধর গলার পিছনে দুহাত বেঁধে বলল,
-“আমি থাকব।”
-“মানে?”
-“তুমি কাল ছুটি নিতে পারবে?”
-“কেন?”
-“তাহলে আজ রাতে ফিরব না। এখানেই থাকব।”
-“পাগল হলে নাকি?”
-“প্লিজ প্লিজ না করোনা।”
-“বান্দরবান টু ঢাকার টিকেট আমি গতকালই চিটাগাং থেকে কেটে রেখেছিলাম।”
-“তো? এখন ফেরত দেয়া যাবে না? আর ফেরতই কেন? আমরা তো যাবই বাট আজকের বদলে কাল বা পরশু। দুদিন পাহাড়ে থাকব। শুধু তুমি আর আমি।”
মুগ্ধ হেসে তিতিরের কোমর জড়িয়ে বলল,
-“আমার পাগলীটার মাথা দেখছি পুরো খারাপ হয়ে গেছে।”
-“এই বলোনা টিকেট চেঞ্জ করা যাবে?”
-“তা যাবে, পরিচিত। অপরিচিত হলেও যেত.. কিন্তু।”
তিতির মুগ্ধর মুখ চেপে ধরে বলল,
-“এত কিন্তু কিন্তু করোনা প্লিজ প্লিজ প্লিজ।”
মুগ্ধ ওর মুখ চেপে ধরা তিতিরের হাতে চুমু দিয়ে বলল,
-“যদিও আগে বুকিং না দিলে পাওয়া যায় না। তবু চলো দেখছি কি করা যায়।”
ভাগ্য ওদের সাথে ছিলনা। নীলাচলে একটা রুমও পাওয়া গেল না। ইভেন এখন বুকিং দিলে তিন মাস পরে পাওয়া যাবে। একথা শুনে তিতিরের মন খারাপ হয়ে গেল। মুগ্ধ বলল,
-“প্রমিস তোমাকে এখানে আবার আনবো। এই নীল চালওয়ালা এস্কেপ রিসোর্টেই রাখবো। নিলগিরি হিল রিসোর্টেও রাখবো। কিন্তু মন খারাপ করোনা বাবা।”
-“তাহলে অন্যকোথাও থাকি? আজ আমার ঢাকা যেতে ইচ্ছে করছে না। ঢাকা গেলেই তো আর তোমাকে এত কাছ থেকে দেখতে পাব না।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“আমরা অনেক কাছাকাছি থাকি তিতির। আর হতে পারে দূর থেকে তবু তো এই মুখটা প্রতিদিনই অফিসে যাওয়ার সময় দেখিয়ে যাই। কাছ থেকেও তো দুএকদিন পর পর দেখা হয়।”
তিতির রাগে গটগট করে বলল,
-“তুমি থাকতে চাচ্ছো না? ওকে চলো।”
বলেই হাটা শুরু করলো। মুগ্ধ দৌড় দিয়ে ওকে ধরে ফেলল। বলল,
-“এই পাগলী! আমি কি বলেছি থাকতে চাচ্ছি না? তোমার কথার প্রেক্ষিতে ওই কথা বললাম।”
তিতির মাথাটা এক দিকে হেলিয়ে বলল,
-“তাহলে বল থাকবে।”
-“আচ্ছা আচ্ছা থাকব। মিলনছড়ি হিল রিসোর্টের কথা মনে আছে বলেছিলাম?”
-“হ্যা, পাখির নামে নাম সব কটেজের।”
-“হুম। ওখানে থাকবে?”
তিতির লাফিয়ে উঠে বলল,
-“উফফফ… ওয়াও!!! চলো চলো।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“আন্দাজে গিয়ে কি করবো? খালি থাকলে ফোনেই পাব। চলো নিচে চায়ের দোকান আছে। চা খাই আর খুঁজি কোথায় থাকা যায়।”
-“খুঁজতে হবে? যদি পাওয়া না যায়? আচ্ছা এত বড় বান্দরবানে আমাদের থাকার যায়গা হবে না?”
-“শোনো, সিটিতে তো হোটেলের অভাব নেই। কিন্তু ওখানে থেকে লাভ নেই। কোনো রিসোর্টে থাকলে থাকাটা সার্থক হতো।”
-“তাহলে?”
-“রিসোর্ট না পেলে থাকব না। চলে যাব।”
তিতির মন খারাপ করে রইল। মুগ্ধ জিজ্ঞেস করলো,
-“আচ্ছা তুমি যে আজ রাতে থাকতে চাচ্ছো তোমার ভয় করছে না?”
-“কিসের ভয়? তুমি আছো না? তুমি থাকতে ভয় কিসের?”
-“আরে ভয়টা তো আমাকে নিয়েই।”
-“তোমাকে নিয়ে কি ভয়?”
-“তোমাকে একা পেয়ে যদি ভুল কিছু করে ফেলি।”
-“আমি জানি আমার মুগ্ধ কোন ভুল করতে পারেনা। এর আগেও আমরা অনেক রাত দুজনে একসাথে থেকেছি।”
-“হ্যা, তখন তো তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড ছিলেনা।”
-“তাতে কি?”
-“তাতে কি জানোনা? মুগ্ধর তো তোমার উপর অনেক লোভ জন্মেছে যা আগে ছিলনা।”
তিতির মুগ্ধর পিঠে ঘুষি দিতে দিতে বলল,
-“তুমি শুধু শুধু আমাকে কনফিউজড করবে না।”
মুগ্ধ হাসতে লাগলো। তিতির মারপিট থামিয়ে মুগ্ধর হাত জড়িয়ে হাটতে হাটতে বলল,
-“তোমার উপর আমার বিশ্বাস আছে।”
চায়ের দোকানগুলো পাহাড়ের পাশেই। টেবিল আর বেঞ্চ পাতা। অনেক রকম পাহাড়ী জিনিস পাওয়া যায় এখানে। বেঞ্চে বসতেই তিতির খেয়াল করলো ফ্লোরটা কাঠের। দেয়ালগুলো বাশের। ওরা যেখানে বসে ছিল তার দেয়ালগুলো বারান্দার মত অর্ধেক। দূরের সব দৃশ্যই দেখা যাচ্ছে যা উপর থেকে দেখেছিল কিন্তু এখান থেকে আবার অন্যরকম লাগছে। অত দূরে লাগছে না। মনে হচ্ছে কাছেই। মুগ্ধ দোকানী মেয়েটাকে বলল,
-“দিদি দুটো চা দিয়েন।”
তারপর তিতিরকে জিজ্ঞেস করলো,
-“ম্যাম, বলেন কয়দিনের ছুটি নেব?”
-“দু’দিন।”
-“বুঝে বলো। কারন তারপর আবার বায়না ধরলে রাখতে পারব না। দু’দিন ছুটি নিলে মরতে মরতে হলেও তিন দিনের দিন অফিসে এটেন্ড থাকতে হবে।”
-“হ্যা হ্যা দুদিনই। কাল আর পরশু। কারন, কাল রাতে আমরা রওনা দিব। পরশু সকালে পৌঁছে সারাদিন রেস্ট নিবে। পরের দিন অফিস যাবে।”
-“শুধু আজ রাত আর কালকের দিনটা থাকবে তো?”
-“হ্যা।”
-“আচ্ছা। তাহলে আমি শুধু কালই ছুটি নেব। রেস্ট লাগে না। এতদিন তো রেস্ট করলামই।”
-“তবু জার্নি করে ফিরে একটু রেস্ট নিবে না?”
-“আরে না। একটা ছুটি মানে অনেক কিছু। এভাবে রেস্ট নিয়ে নষ্ট করার মানে হয়না। আমি ট্যুরে গেলে ভোরবেলা ফিরেই অফিস যাই, অভ্যাস আছে।”
তিতির আর কিছু বলল না। মুগ্ধ ফোন করে একদিন ছুটি নিয়ে নিল। তারপর মিলনছড়ি হিল রিসোর্টে ফোন দিয়ে জানতে পারলো কোন কটেজ খালি নেই। তিতির বলল,
-“এখন কি হবে?”
-“দেখছি।”
কিছুক্ষণ নাম্বার ঘেটে তারপর বলল,
-“তিতির, আমি এখন ফোন করছি আমার সবচেয়ে প্রিয় রিসোর্টের কেয়ার টেকারের কাছে। অমায়িক লোক, অনেকটা মংখাইয়ের মত। দোয়া করো যাতে ওখানে একটা ব্যবস্থা হয়।”
-“ওকে।”
তিতির খুব এক্সাইটেড ছিল। ফোন করল,
-“হ্যালো।”
-“হ্যালো, বংশী দা.. মুগ্ধ বলছি।”
-“আরে সাহাব। আপ? আপ কাহাসে?”
-“বান্দরবান থেকেই। কোনো কটেজ খালি আছে? বউ নিয়ে এসেছি।”
-“আপ সাদি ভি কার লিয়া? সুবহানাল্লাহ সুবহানাল্লাহ!”
-“হ্যা দাদা। এবার একটা কটেজ দাওনা গো।”
-“লেকেন দুখ কি বাত ইয়ে হে সাহাব, কোয়ি ভি কামরা খালি নেহিহে।”
-“আহা। গেল সব।”
-“কা গায়া সাহাব?”
-“খুব ইচ্ছে ছিল তোমাদের “হলিডে ইন” এই থাকব। আমার বউটা ওইরকম যায়গা খুব পছন্দ করত।”
-“আফসোস কি বাত হে। আগার আপ হামকো কুছ দিন পেহলে বাতা দে তো হাম আপকো অর বিবিজিকো লিয়ে ও লেকওয়ালা কামরা রাখ দেতা।”
-“হুট করে এসেছি। কোনো প্ল্যানিং ছিলনা দাদা। আচ্ছা, কি আর করা। রাখছি তাহলে।”
-“আচ্ছা সাহাব, কেয়া আপ হামকো কুচ সামে দে সাকতা? হাম ম্যানেজার সাহাব কো পুছকে বাতা তা হু কেয়া তাম্বু খাটানা যাবে কি নেহি!”
-“দাদা আমি তো তাঁবু আনিনি।”
-“হামারে পাস তো হেয়।”
-“ওহ, আচ্ছা দেখ তাহলে।”
-“ঠিক হেয় সাহাব। ম্যানেজারবাবু বান্দরবান গায়া হেয়। কুছ দের বাদ আয়েগা।”
-“আচ্ছা আচ্ছা।”
আরো কয়েকটা রিসোর্টের ফোন নাম্বার ছিল মুগ্ধর কাছে। একে একে সব গুলোতে ফোন করলো মুগ্ধ। কোনোটাতেই কোনো কটেজ খালি নেই। তিতিরের মনটা পার্মানেন্টলি খারাপ হয়ে গেল। আর মুগ্ধ শেষপর্যন্ত বংশীর আশায় রইলো।
বিকেলটা নীলাচলে কাটিয়ে ওরা বান্দরবানে ফিরে এল। সন্ধ্যা হতে হতে মুগ্ধ তিতিরকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে গেল যার নাম মেঘদূত। এটা যে রেস্টুরেন্ট সেটা বুঝতেই কতক্ষণ সময় লেগে যায়। বান্দরবান ক্যান্টনমেন্টের শুরুতেই রাস্তার ডান পাশে একটা বড় একতলা বিল্ডিং। বিল্ডিং এর একপাশে বিশাল কিচেন আর কাউন্টার। অন্যপাশে রেস্টুরেন্ট, এসি জোন। সামনে বাগান। বাগানে কম করে হলেও ১০/১২ টা টেবিল। মাঝখানে পানির ফোয়ারা। মুগ্ধ তিতিরকে জিজ্ঞেস করলো,
-“কোথায় বসবে? ভেতরে না বাগানে?”
-“অবশ্যই বাগানে।”
বাগানের কোনো টেবিলই খালি ছিল না। কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর একটা টেবিল খালি হলো। মুগ্ধ বলল,
-“এখনে গিয়ে অর্ডার করতে হয়। তুমি বসো আমি অর্ডার করে আসি।”
-“আচ্ছা।”
মুগ্ধ অর্ডার করে ফিরে এসে বলল,
-“মুখটা প্যাঁচার মত করে রেখোনা তো। তোমাকে পেঁচিমুখী রুপে মানায় না।”
তিতির ক্ষেপলো না, মারলো না কিছুই করলো না। চুপ করে বসে রইল। মুগ্ধ বলল,
-“আরে বাবা। আমি তো চেষ্টা করলাম। এত মন খারাপ করার কি আছে? কদিন পর নাহয় আগে থেকে বুকিং দিয়ে আসব।”
তিতিরের মন তাতে ভাল হল না। ও বলল,
-“আমি কোন কিছু একবার ঠিক করলে তারপর যদি না করতে পারি খুব অস্থির লাগে, আর কিছুই ভাল লাগে না তখন।”
-“দেখছি তো বাবা। একটু ধৈর্য ধর। বংশী ম্যানেজারের সাথে কথা বলেই জানাবে। থাকার ব্যবস্থা হলে তো জানাবেই নাহলেও জানাবে। কারন ও জানে আমি অপেক্ষা করছি।
খাবার চলে এল। মুগ্ধ গপাগপ খাচ্ছে। তিতির এখনো মুখেই দেয়নি। মুগ্ধ ওকে খাইয়ে দিতে চাইল। বলল,
-“একবার খেয়ে দেখো খাবাবগুলো। ঢাকায় কোথাও নেই এত টেস্টি কাবাব। আর এই কাবাব টার নাম “অস্কার পুলে”। সাথে বসনিয়া রুটি। আমার জানামতে বসনিয়া রুটি পাওয়া গেলেও বাংলাদেশের আর কোথাও অস্কার পুলে পাওয়া যায়না। একবার মুখে দিয়ে দেখ জাস্ট, অমৃত।”
-“আমার খেতে ইচ্ছে করছে না তুমি খাও।”
মুগ্ধ রেখে দিল। বলল,
-“যাও আমিও খাবনা। খিদে নিয়ে সারারাত বসে থাকব।”
এমন সময় মুগ্ধর ফোন বেজে উঠলো। বংশী কল করেছে। তিতির ওর হাত আটকে ধরে বলল,
-“প্লিজ ফোন ধরোনা। যদি বলে ব্যবস্থা হয়নি আমি হার্ট অ্যাটাক করবো।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“আরে দুটোই তো হতে পারে। ফোন না ধরলে জানবো কি করে?”
-“জানিনা আমি।”
ফোন কেটে গেল ততক্ষণে। এবার মুগ্ধ নিজেই কল করলো।
প্রেমাতাল
তিতির ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে মুগ্ধর দিকে। ও বংশীর কথা তো শুনতে পাচ্ছে না কিন্তু মুগ্ধ চুপ করে থেকে একসময় বলল,
-“আচ্ছা আচ্ছা নো প্রব্লেম। হুট করে এলে এমনটা হতেই পারে। আচ্ছা বংশী দা। রাখছি তাহলে।”
ফোন রাখতেই তিতির বলল,
-“ব্যবস্থা হয়নি না?”
মুগ্ধ তিতিরের গাল টিপে দিয়ে বলল,
-“মন খারাপ করোনা। আমি সামনের মাসেই আগে থেকে বুকিং দিয়ে তোমাকে নিয়ে আসব।”
তিতির বলল,
-“আমি পারমিশন পাব না।”
-“পাবা পাবা।”
-“না পাবনা।”
-“আচ্ছা বাদ দাওনা এখন, যেভাবেই হোক আমি তোমাকে নিয়ে আসবো। এখন একটু খাও।”
তিতির প্লেট এগিয়ে নিল। খাওয়া শুরু করে বলল,
-“হ্যা, এতক্ষণ তো টেনশনে ছিলাম তাই খেতে পারছিলাম না। এখন তো আর কোনো টেনশন নেই, সব শেষ।”
-“বোকার মত কথা বলোনা তিতির। কিসের সব শেষ?”
তিতির কিছু বলল না, মন খারাপ করে খেতে থাকলো। হঠাৎ তিতিরের চোখ পড়লো টেবিলের উপর রাখা লাচ্ছির দিকে। ৪ গ্লাস লাচ্ছি আর সাথে হাফ লিটারের বোতলের এক বোতল লাচ্ছি। তিতির বলল,
-“এত লাচ্ছি দিয়ে কি হবে?”
-“খাব। গ্লাসের গুলো এখন খাব। বোতলের টা রাস্তায় যেতে যেতে খাব। নষ্ট হয়ে যাবে নাহলে আরো নিতাম। এটা আমার প্রিয় লাচ্ছি। সব ইনগ্রিডিয়েন্স গুলো এত পারফেক্ট পরিমাণে দেয় যে একদম পারফেক্ট একটা লাচ্ছি হয়। তিতির এতক্ষণে হাসলো। বলল,
-“তুমি পাগল একটা।”
-“না, খাদক।”
রাস্তার অপজিটে আর্মিদের একটা সুপার শপ ছিল। খাওয়া শেষ হতেই মুগ্ধ ওই শপটা দেখিয়ে বলল,
-“চলো ওই শপটাতে একটু যাব।”
-“কি কিনবে আবার?”
-“চকলেট কিনবো।”
-“তুমি যাও। আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। এখানেই বরং ভাল লাগছে। তুমি যাও। কেনাকাটা শেষ করে এসো। আমি এখানেই বসে থাকি।
মুগ্ধ আর জোর করলো না, চলে গেল। মুগ্ধ যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই হঠাৎ করে বৃষ্টি নামলো। তিতির ভিজে যাচ্ছে, ধুর! সবগুলো টেবিলের উপর ছাতা আছে, শুধু ওদেরটাতেই নেই। ভেতরে চলে যেতে পারে কিন্তু তাহলে তো মুগ্ধ ওকে খুঁজে পাবে না। ফোনটাও তো ব্যাগে আর ব্যাগ মুগ্ধর কাছে। যখন বৃষ্টির জোর বাড়লো তখন তিতিরের ভালই লাগলো ভিজতে। এর মধ্যেই মুগ্ধ দৌড়াতে দৌড়াতে এল। এসেই ওকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। তিতির বলল,
-“কোথায় যাচ্ছি?”
-“সিএনজি ঠিক করেছি।”
-“ওহ।”
মুগ্ধ বলল,
-“ভিজছিলে কেন তুমি?”
-“তো কি? যদি হারিয়ে যাই, আমার ফোন তো তোমার কাছে।”
মুগ্ধ তাকিয়ে দেখলো তিতিরের ঠোঁট বেয়ে বৃষ্টির পানি পড়ছে আর সেই ফোঁটা ফোঁটা পানিগুলো তিতির ওর ঠোঁট দিয়ে পিষে ফেলছে কথা বলার সময়। মুগ্ধর সেই ফোটাগুলোকে এখন হিংসা হচ্ছে। তিতির বলল,
-“কি হলো দাঁড়িয়ে পড়লে যে?”
-“এমনি, চলো চলো।”
সিএনজিতে উঠেই মুগ্ধ আবার তাকালো তিতিরের দিকে। ওর ঠোঁটদুটো ভিজে সপসপে হয়ে আছে। এই মুহূর্তে মুগ্ধর প্রচন্ড ইচ্ছে করছে ওই ভেজা ঠোঁটের ছোঁয়া পেতে। এই অন্ধকারে সিএনজিতে সেটা পাওয়াও সম্ভব। কেন যেন মনে হচ্ছে তিতির আজ বাধা দেবে না। কিন্তু নিজেকে সামলে নিল মুগ্ধ। ওদের প্রথম চুমুটা কিনা এভাবে হবে? নাহ! সুন্দর, পারফেক্ট একটা সময়ের জন্য মুগ্ধ অপেক্ষা করবে। যখন কোনো তাড়া থাকবে না, কেউ দেখে ফেলার আতঙ্ক থাকবে না আর যখন তিতিরের কোনো সংকোচ থাকবে না।
সিএনজি বাস স্ট্যান্ড পার হওয়ার পর তিতির বলল,
-“এই আমরা বাস স্ট্যান্ড পার হয়ে এলাম তো।”
মুগ্ধর ঠোঁটে মুচকি হাসি দেখেই তিতির বুঝে ফেলল। বলল,
-“আমরা আজ থাকছি?”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“হ্যা, বংশী ফোন দিয়ে কনফার্ম করেছিল তখন, আমি তোমার সাথে একটু মজা করছিলাম। আর তাঁবুতে থাকতে হবে না। আমরা কটেজ পেয়েছি।”
তিতির একমুখ হাসি নিয়ে এক লাফ দিয়ে মুগ্ধর গলাটা জড়িয়ে ধরলো। মুগ্ধ হাসতে হাসতে বলল,
-“তুমি এত পাগলী কেন?”
তিতির ওর পিঠে খামচি মেরে বলল,
-“তুমি এত খারাপ কেন? কি মন খারাপ হয়েছিল আমার।”
মুগ্ধ হঠাৎই তিতিরের কোমর জড়িয়ে ধরে ওকে কোলের মধ্যে উঠিয়ে নিল। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
-“আই লাভ ইউ পাগলী!”
তিতিরের ইচ্ছে করছিল রিপ্লাই দিতে কিন্তু দিলনা। যখন দিবে বলে ঠিক করে রেখেছে তখনই দিবে। ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ কি শুধু লাভ ইউ টু বললেই হয়? আরো কত উপায় আছে! তিতির তারই একটা বেছে নিল। মুগ্ধর শার্টের ডান পাশের কলারটা সরিয়ে মুখ ডুবিয়ে দিল ওর গলার ডান পাশে। তারপর ইচ্ছেমত চুমু দিল। মুগ্ধর পায়ের রক্ত এক লাফে মাথায় উঠে গেল। হাওয়ায় ভাসতে লাগলো। নিজ উদ্যোগে করা তিতিরের প্রথম আদর। মুগ্ধ ওকে জাপ্টে ধরে রাখলো নিজের বুকের মধ্যে।
কিছুক্ষণের মধ্যে যখন ওরা “রিসোর্ট হলিডে ইন” এ পৌঁছল, গাড়ির শব্দ পেয়ে বংশী দৌড়ে এল,
-“আইয়ে বিবিজি আইয়ে। আল্লাহ মেহেরবান কি হাম আপকো লিয়ে কুছ কার পায়া।”
তিতির হাসলো কিছু বলল না। ওদের ব্যাগ দুটো জোর করে নিয়ে নিচ্ছিল। মুগ্ধ দিলনা। জিজ্ঞেস করলো,
-“বংশী বিবিজিকে কেমন দেখলে? পছন্দ হয়েছে?”
বংশী মাথা নিচু করে বলল,
-“সাহাব ইয়ে আপনে কেয়া পুছা? মুজহে তো লাগা কি বেহেশত সে কোয়ি হুর আগেয়া।”
মুগ্ধ বলল,
-“হ্যা তা ঠিক, কিন্তু বেশি বাচ্চা না?”
-“লেড়কি কাভি বাচ্চা নেহি হোতি সাহাব। উহারা পালাট কে সাত সাত জোয়ান বান যাতা।”
কথা বলতে বলতে ওরা রিসিপশনে চলে এল। তিতির বসলো। মুগ্ধ ফর্মালিটিজ সেরে তিতিরকে নিয়ে কটেজের সামনে যেতেই তিতির বলল,
-“আমরা এখানে থাকব?”
-“হ্যা।”
-“আর ইউ সিওর?”
-“হ্যা।”
-এই পুরো কটেজটা আজকের জন্য আমাদের?”
মুগ্ধ এবার হেসে দিল। তারপর বলল,
-“হ্যা।”
তিতির আরেকবার তাকিয়ে দেখে নিল কটেজটাকে। ছোট্ট একটা একতলা ঘর। কিন্তু দোতলা সমান উঁচু। নিচতলা সমান যায়গা ফাকা। টোঙ ঘরের মত করে বানানো। সামনেই চওড়া সিঁড়ি। সিঁড়ির উপরে দোচালা ডিজাইনের চাল। সিঁড়ি দিয়ে উঠলেই বারান্দা। বারান্দা দিয়েই ভেতরে ঢোকার দরজা দেখা যাচ্ছে। তিতির পা বাড়াতেই মুগ্ধ থামালো,
-“এই দাঁড়াও।”
-“কেন?”
-“বংশী একটা ছেলেকে পাঠালো না আমাদের ব্যাগ নিয়ে?”
-“হ্যা।”
-“ও বের হোক, তারপর আমরা যাব।”
-“আচ্ছা।”
ছেলেটা বের হয়ে চলে যেতেই মুগ্ধ তিতিরকে কোলে তুলে নিল। তিতির মুগ্ধর গলার পিছনে দু’হাত বাধলো, মুখে হাসি। মুগ্ধ ওকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপড়ে উঠে গেল। ভেতরে নিয়ে নামালো। তিতির ভেতরটা দেখে বিস্ময়ে মুখ চেপে ধরলো। পুরো রুমটাই কাঠের, ইভেন দেয়াল, ফ্লোর সব কাঠের। রুমে ঢুকেই হাতের ডান পাশে বিছানা সাদা বেড কভার বিছানো। বিছানার পাশেই বিশাল আয়নার বিলাশবহুল ড্রেসিং টেবিল। একটু সরে একটা আলমারি। সব ফার্নিচার ম্যাচিং ডিজাইনের। বাম পাশের দেয়ালের কর্নারে একটা দরজা, হয়তো টয়লেট। বাকী দেয়ালটুকু পুরোটাই সাদা পর্দা দিয়ে ঢাকা, নিচে কি? জানালা নাকি? কে জানে। সামনের দেয়ালে থাই গ্লাস লাগানো সিলিং থেকে ফ্লোর পর্যন্ত পুরোটা। এখানেও সাদা পর্দা। মুগ্ধ পর্দাটা টেনে দিয়ে তিতিরের সামনে এসে দাঁড়ালো। তারপর বলল,
-“কি ম্যাম? পছন্দ তো?”
-“পছন্দ হবে না মানে? আমি তো বিশ্বাস করতে পারছি না কি দেখছি আমি!”
-“আচ্ছা শোনো, অনেকক্ষণ ভেজা কাপড়ে আছো। চেঞ্জ করো। নাহলে ঠান্ডা লেগে যাবে। সারারাত যখন এখানেই আছো তখন সব দেখতে পারবে আস্তে আস্তে।”
-“আচ্ছা। আমি বাথরুমে যাচ্ছি চেঞ্জ করতে। তুমি রুমেই চেঞ্জ করে নাও।”
-“হুম।”
তিতির যখন ব্যাগ থেকে কাপড় বের করতে যাচ্ছিল মুগ্ধ বাধা দিল। তারপর নিজের ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে তিতিরের হাতে দিয়ে বলল,
-“এই নাও। এটা পড়ো।”
-“এটা কি?”
-“শাড়ি। তোমার জন্য কিনলাম একটু আগে।”
-“মানে আর্মি শপটাতে তুমি এজন্যই গিয়েছিলে?”
-“হ্যা। কাল তো একটু দেখেছি শাড়ি পড়া বউ তিতিরপাখিকে। আজ যখন সুযোগ পেয়েছি মিস করতে ইচ্ছে হলোনা।”
-“কিন্তু শাড়ি পড়তে তো আরো অনেক কিছু লাগে। পেটিকোট, ব্লাউজ। ওগুলো কোথায় পাব স্যার? কাল তো পিউয়ের টা পড়েছিলাম।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“তোমার কি আমাকে বলদ মনে হয়? আমি আর যাই হইনা কেন বলদ নই। আর মেয়েদের ব্যাপারে সবই জানি সো শাড়ি পড়তে কি লাগে না লাগে তা আনবো না ভাবলে কি করে?”
তিতির হেসে বলল,
-“জানি আমি। কিন্তু আমি তো শাড়ি পড়তে পারিনা। কালই প্রথম পড়লাম। তাও মা পড়িয়ে দিয়েছিল।”
-“তো তুমি দেখোনি মা কিভাবে পড়িয়েছিল?”
-“হুম দেখেছি, শিখেছি কিন্তু অনেক প্যাঁচ। সব ভুলে গেছি।”
-“হায় খোদা! এখন শাড়ি পড়ানোটাও আমার শিখিয়ে দিতে হবে?”
-“তুমি পারো?”
-“পারব না কেন? মুগ্ধ সব পারে।”
-“কিভাবে পারো?”
সন্দেহের দৃষ্টি তিতরের চোখে। মুগ্ধ বলল,
-“ইউটিউবে আজকাল কি না শেখা যায় বলো? আমার খুব সাধ জেগেছিল শাড়ি পড়া দেখবার। কিন্তু জিএফ বউ কিছুই তো ছিলনা। তাই ইউটিউব থেকেই দেখেছি। আর শিখেও ফেলেছি।”
-“তুমি ওই মেয়েটার পেটের দিকে তাকিয়েছিলে?”
মুগ্ধ চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলো,
-“কোন মেয়ে?”
-“ইউটিউব ভিডিওতে যে মেয়েটা শাড়ি পড়া শেখাচ্ছিল?”
মুগ্ধর মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এল। বলল,
-“হ্যা। মানে একটা সুন্দরী মেয়ে চোখের সামনে সুন্দর, মসৃন পেট বের করে শাড়ি পড়ছে। আর আমি কি চোখ বন্ধ করে থাকবো বলো? আমি কি পুরুষ মানুষ নই?”
-“তুমি সত্যি দেখেছো?”
-“হ্যা দেখেছি। বাট আই প্রমিস আমি আর কোনো শাড়ি পড়া মেয়ের পেটের দিকে তাকাব না। তখন তো তুমি ছিলে না তাইনা?”
তিতির উত্তর নাদিয়ে রাগ করে বাথরুমে ঢুকে গেল। ঢুকে তো ভিমরি খাওয়ার জোগাড়। বাথটাব, হাই কমোড সব আছে। কিসের সাথে কিসের কম্বিনেশন! যাই হোক, ওর মুডটা অফ! মুগ্ধ কি বলল এটা! সত্যি কি দেখেছে নাকি ওকে ক্ষ্যাপানোর জন্য বলেছে কে জানে!
প্যাকেট টা খুলতেই তিতির দেখলো সিলভার পাড়ের লাল তাতের শাড়ি এনেছে মুগ্ধ। উফ শাড়িটা এত সুন্দর কেন? মুগ্ধর পছন্দ আছে বলতে হবে। সাথে লাল ব্লাউজ, পেটিকোটও আছে। ফ্রেশ হয়ে শাড়িটা পড়ার অনেক চেষ্টা করলো তিতির কিন্তু পারলো না। কোনোভাবে পেঁচিয়ে বেড়িয়ে এল। বাইরে এসে দেখলো মুগ্ধ সোফায় হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। ইশ! কাল রাতে ঘুমাতে পারেনি বলেই হয়তো এখন ওর অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গেছে। তিতির ওর কাছে গিয়ে ভেজা চুলগুলো মুগ্ধর চোখের উপর ধরলো। কয়েক ফোঁটা পানি পড়তেই মুগ্ধ লাফিয়ে উঠে হেসে দিল। তারপর তিতিরের দিকে তাকাতেই চোখে যেন নেশা ধরলো। লাল শাড়িতে কিযে অপূর্ব লাগছে তিতিরকে! কাল নীল শাড়িতে বউ বউ লাগছিল আর আজ লাল শাড়ি, ভেজা চুল সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে নতুন বউ বিয়ের পরদিন সকালে গোসল করে বেড়িয়েছে! কি বলবে! কিভাবে এক্সপ্রেশ করবে তিতিরকে দেখে ওর ভেতরে কি হচ্ছে। বাকরুদ্ধ হয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল মুগ্ধ।
মুগ্ধ এমনভাবে তাকিয়ে ছিল যে তিতির লজ্জায় কোনো কথাই বলতে পারছিল না। মুগ্ধ আচমকা তিতিরকে কোলে তুলে নিল তারপর টয়লেটের পাশের দেয়ালের পর্দা সরিয়ে দরজা ঠেলে বারান্দায় চলে গেল। বারান্দাটা দেখে আরও একবার মুগ্ধ হলো তিতির। সামনে বিশাল লেক। লেকটা কি কৃত্রিম না প্রাকৃতিক কে জানে! মুগ্ধকে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে পরে। এখন আর কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
বারান্দাটা বেশ বড়। বারান্দায় কোনো ছাদ দেই। আর ঘরের সাথে লাগোয়া দেয়কলটি ছাড়া বাকি তিন দিকের দেয়ালগুলো ছোট ছোট হাটুসমান। প্রত্যেকটা কর্নারে ফুলের টব। একপাশে একটা সাদা রঙের সোফা। একটা ইরানি লাইটও জ্বলছিল বারান্দার এক কোনায়। মুগ্ধ তিতিরকে কোল থেকে নামিয়ে লাইটটা বন্ধ করে দিল। কারন লাইট টা চোখে লাগছিল। যদিও আকাশে মেঘ ছিল, পূর্নিমাও ছিল। মেঘের বিচরণ যেন খেলছিল ওদের সাথে। সরে গেলেই জোছনায় ভেসে যাচ্ছিল চারপাশ। আর মেঘে চাঁদ ঢেকে যেতেই আবছা অন্ধকারে লুকোচুরি খেলছিল। তিতির লেকের দিকে তাকিয়ে ছিল। মুগ্ধ লাইট অফ করে তিতিরকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই তিতির বলল,
-“একটা গান শোনাবে?”
মুগ্ধও আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল গান শোনাবে তাই বিনাবাক্যে শুরু করে দিল,
“মোর প্রিয়া হবে এসো রানী
দেব খোঁপায় তারার ফুল
কর্ণে দোলাবো তৃতীয়া তিথির
চৈতি চাঁদেরও দুল..
খোঁপায় তারার ফুল
মোর প্রিয়া হবে এসো রানী
দেব খোঁপায় তারার ফুল
কন্ঠে তোমার পড়াবো বালিকা
হংস সাড়ির দোলানো মালিকা
বিজরী জরির ফিতায় বাধিব
মেঘরঙ এলোচুল…
দেব খোঁপায় তারার ফুল।
মোর প্রিয়া হবে এসো রানী
দেব খোঁপায় তারার ফুল
জোছনার সাথে চন্দন দিয়ে
মাখাব তোমার গায়ে..
রামধনু হতে লাল রঙ ছানি
আলতা পড়াব পায়ে..
আমার গানের সাত সুর দিয়া
তোমার বাসর রচিবও প্রিয়া
তোমারি হেরিয়া গাহিবে আমার
কবিতার বুলবুল
দেব খোঁপায় তারার ফুল
মোর প্রিয়া হবে এসো রানী
দেব খোঁপায় তারার ফুল।”
গানটা শেষ হতেই তিতির বলল,
-“এটা শুধু একটা গান ছিলনা। তার চেয়েও যেন অনেক বেশি কিছু ছিল।”
মুগ্ধ হেসে বলল,
-“হুম চলো বসি।”
একথা বলেই মুগ্ধ সোফায় গিয়ে বসলো। তিতিরও যাচ্ছিল পেছন পেছন। হাঁটা শুরু করতেই পায়ে বেঝে তিতিরের শাড়ির কুচি খুলে গেল। তিতির কুচিগুলো কুড়িয়ে নিল। মুগ্ধ উঠে এসে হেসে বলল,
-“এসো আমি পড়িয়ে দেই।”
-“না আমি পারব।”
এই বলেই তিতির ঘরে যাচ্ছিল। মুগ্ধ তিতিরের কোমর আঁকড়ে ধরে আটকালো। তারপর বলল,
-“পারলে প্রথমবারই পারতে। একবার পড়িয়ে দেইনা। কি হয়েছে? আমার অনেক ইচ্ছে ছিল আমি আমার বউকে শাড়ি পড়িয়ে দেব তাইতো শিখেছিলাম।”
-“কিন্তু তখন যে বললে..”
-“ওটা তো তোমাকে রাগানোর জন্য বলেছি।”
তিতির দাঁড়ালো। মুগ্ধ দেখলো তিতির শাড়ি উলটো পড়েছে। শাড়িটা ঠিক করে পড়িয়ে তিতিরের সামনে হাটু গেরে বসে যখন কুচি দিচ্ছিল তখন তিতির বলল,
-“ব্লাউজটা একদম ঠিক মাপের হয়েছে। তোমাকে তো আমি কখনো বলিনি তাহলে মাপ জানলে কোত্থেকে?”
-“তোমার মাপ আমি জানবো না তো জানবে কে? তোমার পা থেকে মাথা অবধি কত শতবার চোখ দিয়ে মুখস্থ করেছি জানো?”
তিতির লজ্জা পেল। মাঝে মাঝে মুগ্ধ যে কিসব বলে, মুখে কিছু আটকায় না। এরপর মুগ্ধ বলল,
-“অবশ্য মেয়েদের সবচেয়ে সুন্দর লাগে কিভাবে শাড়ি পড়লে জানো?”
-“কিভাবে?”
-“আগের যুগে ওভাবে পড়তো। এখন যা দিনকাল পড়েছে তাতে অবশ্য ওভাবে শাড়ি পড়া যাবে না আমাদের সমাজে। তবে হাজবেন্ডের জন্য প্রত্যেক মেয়েরই পড়া উচিৎ। পাহাড়ীরা তো এখনো পড়ে।”
-“কিভাবে বলবে তো?”
-“চোখের বালি সিনেমা টা দেখেছো? ইন্ডিয়ান বাংলা সিনেমা।”
-“কোনটা ওইযে প্রসেনজিৎ, ঐশরিয়া আর রাইমা সেনের টা?”
-“চোখের বালি একটাই হয়েছে।”
-“দেখিনি, তবে ট্রেইলর দেখেছি।”
-“ওখানে ঐশরিয়া কিভাবে শাড়ি পড়েছে দেখেছো?”
-“ব্লাউজ ছাড়া? পেঁচিয়ে?”
-“হ্যা, মারাত্মক লাগে… উফ।”
-“ছিঃ”
-“ছিঃ কেন? সবার সামনে পড়ার কথা তো বলছি না।”
তিতিরের এত লজ্জা লাগছিল! মুগ্ধ কিভাবে যে বলে এই কথাগুলো কে জানে! শেষমেশ তিতির বলল,
-“প্লিজ তুমি থামবে?”
-“তুমি কেন এত লজ্জা পাচ্ছো? তোমার জন্য তো ব্লাউজ এনেছিই।”
তিতির আর কথাই বলল না। ওর সাথে এ নিয়ে আরো কথা বললে আরো লজ্জা দেবে। কুচি দেয়া শেষ হতেই মুগ্ধ তিতিরের হাতে দিয়ে বলল,
-“নাও এবার গুঁজে নাও।”
তিতির শাড়ি উলটো গুঁজছিল মুগ্ধ ধরে ফেলল,
-“শাড়ি গুঁজতেও জানোনা? কি শেখালো তোমার শ্বাশুড়ি মা তোমাকে?”
তিতির কিছু বলল না, হাসছিল। মুগ্ধ কুচিগুলো ঠিক করে ধরে গুঁজে দিল। এই কাজ করতে গিয়ে তিতিরের নাভিতে চোখ চলে গেল, তারপর ঠোঁটও অটোমেটিক্যালি চলে গেল। নাভির ডানপাশে চুমু দিল মুগ্ধ। তিতির শিউরে উঠলো। দুহাত দিয়ে ওর চুল খামচে ধরে সরিয়ে দিতে চাইলো। মুগ্ধ সরলো না। আশেপাশে আরো কয়েকটা চুমু দিল। মুগ্ধর ঠোঁটের প্রতিটা স্পর্শে তিতির কেঁপে কেঁপে উঠছিল, আর সরে সরে যাচ্ছিল। তিতিরের পিছনেই ছিল ঘরের দেয়াল। কাঁপতে কাঁপতে আর সরতে সরতে ও দেয়াল পর্যন্ত চলে গেল। পেছনে হাত দিয়ে দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে ব্যালেন্স রাখছিল। মুগ্ধ উঠে দাঁড়াল?