পূর্ব রোদ

পূর্ব রোদ !! Part- 32

পূর্ব যথেষ্ট ভয়ার্ত হয়ে রোদকে সত্য কথা বলছিলো।মনের এক কোণে জমা আছে কোথাও সত্যিটা জেনে রোদ ভূল বুঝবে নাতো?অভিনয় করছে ভেবে রাগ করবে নাতো?
“পূর্ব,অভিনয় করে প্রেমটা শুরু হলেও ভালোবাসাটা তো সত্যি ছিলো!” রোদের ইতিবাচক কথা শুনে পূর্ব আকাশের তারা হাতে পাওয়া পরিমান খুশি হলো।সাথে কিঞ্চিত ভাবান্তর হয়ে রোদের দিকে তাকালো।রোদ আবারো বললো,
“প্রেমটা যেভাবেই শুরু হোক না কেনো ভালোবাসা’টা মিথ্যা নাকি সত্য সেটা মূল বিষয়।তুমি কেনো ভয় পাচ্ছো আমি ভূল ভাববো ভেবে?তখন আমাদের মধ্যে সাপে-নেউলের সম্পর্ক ছিলো।তাই তোমার স্বপ্ন পূরণের মাধ্যম আমি হওয়ায় তোমার মাথা ব্যাথা ছিলো না।এন্ড এইটা স্বাভাবিক!তাই তুমি নিজের মধ্যে আর গ্লিটি ফিলিং আনিও না।”
রোদ পূর্বের বাহু দুহাতে ধরে তার স্বামীর কাঁদে মাথা রাখলো।এই জায়গা যেনো পরম শান্তির জায়গা রোদের কাছে।পূর্ব রোদের মাথায় চুমু দিলো।পূর্বের শান্তির ঘুমটা আজকে হবে।এতোদিন রোদ দূরে যাবে ভয়ে কিছু ঠিক মতো করতে পারতো না।কিন্তু রোদ এতো সহজে সবটা মেনে নিবে সেটা ভাবেনি।অবশ্য যখন থেকে তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছে তখন থেকে রোদের মধ্যে সংসারিক একটা ভাব।আগের মতো অবুঝ নেই।বুঝদার হয়ে গেছে এক কথায়!


“কী বলছিস তুই নাবিলা?নিলয় এতোকিছু করেছে?”
“ইন্না-লিল্লাহ!”

“তিহান তুই চুপ থাক।মাঝখানে কথা বললে লাথি দিয়া ট্রেনের নিচে ফেলে দিবো।”
পূর্বের কথায় তিহানের মধ্যে কোনো ভাবান্তর হলো কি-না বুঝা গেলো না।সে মনোযোগ দিয়ে নাবিলা’র অবস্থা বুঝার চেষ্টা করছে।পূর্ব সেদিকে আর মাথা না ঘামিয়ে নাবিলাকে জিজ্ঞেস করলো,
“তুই নিলয়ের সাথে একা ছিলি?যদি নিলয় কিছু করে ফেলতো?”
“কাম অন ইয়ার।তোরা আমাকে ঐ দু’কথায় ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না করা মেয়ে ভেবেছিস?এতো নরম আমি নই।”
“হ্যাএএ!তাই তো নিলয় গদগদ করে তোর প্রেমে পরে গেলো।”
তিহানের কথায় পূর্ব-নাবিলা দুজনে তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।তিহান তাদের দৃষ্টি বুঝে চুপ হয়ে গেলো।নাবিলা তার দিকে শাসানোর মতো করে তর্জনী আঙ্গুল নাড়লো।তারপর শান্ত হয়ে বললো,
“আমি সাথে করে মরিচ গুড়া আর আমার যে দুটো কাটি ছিলো ওগুলা নিয়ে গেছিলাম।যদি নিলয় সত্যি সত্যি কিছু করতো তাহলে আমিও আমার কাজ করতাম।”
“ইন্না-লিল্লাহ!”
“সবই বুঝলাম কিন্তু নিলয় কোথায় গেলো?”
“এগজ্যাক্টলী সেটা আমিও বুঝছি না।ওর কিছু একটা হয়েছে নাহলে আমাকে ফোন করা অফ করতো না।”
“মানে?” (পূর্ব)
“ও আমাকে প্রতিদিন সকাল ও রাতে ফোন করতো।তবে ও মনে করতো আমি জানি না কে কল করে।”
“ইন্না-লিল্লাহ।তুই কীভাবে জানলি তাহলে?”
“আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিলো ওটা নিলয়।ক’দিন আগে মেঘের মোবাইল চেক করলে সিওর হয়।”
নাবিলা’র বক্তব্যে তিহান বিজ্ঞদের মতো “ওহ” বললো।ওরা তিনজন বাড়ির সামনের দিকে বসে ছিলো।নাবিলা সকালেই ঢাকা পৌঁছে যায়।তারপর তার দুই বন্ধুকে একসাথে পেতেই নিলয়ের বিষয়টা আলোচনা করে।নাবিলা’র কাছে এখন একটাই প্রশ্ন,”নিলয় কোথায় গেলো?”
“নাবিলা,রোদ বলেছিলো মেঘ আসবে।ও আসেনি?”
“ইন্না-লিল্লাহ!মেঘ?”
“তুই অফ তিহান!নাবিলা বল”
“পূর্ব তুই কী পাগল?মেঘকে দাওয়াত দেওয়া মানে বিপদকে ডেকে ডেকে সংসারে আনা।আর তাছাড়া আমার যতটুকু মনে হয় মেঘ এবার শোধরে যাবে।”
“কেনো?কী করেছিস?”
“বাদ দেয়।শুন,রাফিয়া’র থেকে শুনলাম রোদ নাকি তোর কানাডা যাওয়ার কথা জেনেছে?”
“হুম।কিন্তু আল্লাহ অশেষ শুকরিয়া যে রোদ সবটা পজিটিভলি এক্সপেক্ট করলো।”
“রোদ কিন্তু নিজেকে একদম সামলাতে পারবে না তুই চলে গেলে।খুব কান্না করবে।”
“হু।”
“কখন ফ্লাইট তোর?”
“দশ তারিখ।”
“কিহ?এতো জলদি?”
“জলদি নাতো অনেক সময় কেটে গেলো।সবকিছু রেডি এখন।”
“ইন্না-লিল্লাহ পূর্ব।রোদ জানে?”
“উহু আজ বলবো।”

“কী ব্যাপার?তোমরা তিন বন্ধু মিলে কী গসুরগসুর ফুসুরফসুর করছো?”
রাফিয়ার কন্ঠ শুনে ওরা তিনজন পেছন ফিরলো।নেভি ব্লু কালারের গাউনের সাথে হালকা সাজে রাফিয়াকে বেশ মানিয়েছে।হাত ভর্তি নীল চুরি যেনো পরিপূর্ণতা!তিহান মুগ্ধ দৃষ্টিতে অল্পখানিক তাকিয়ে বললো,”ইন্না-লিল্লাহ!”
তিহানে বাক্যশুনে রাফিয়ার আগে নাবিলা রেগে গেলো।রাগী স্বরে নাবিলা বললো,
“তোর গার্ল ফ্রেন্ড এতো সুন্দর করে সেজেগুজে আসছে।কই তুই বেবি টেবি বলে জড়ায় ধরবি তা না করে বললি ইন্না-লিল্লাহ?তিহান তুই সারাজীবন নিরামিষ,পান্তা ভাত,কচুর লতিই থাকবি।যত্তসব!পূর্ব চলতো।”
একপ্রকার বিরক্তি নিয়ে নাবিলা পূর্বকে সাথে করে নিয়ে গেলো।তিহান-রাফিয়া সেই জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।তখন তিহান রাফিয়ার অনেকটা কাছে এসে বললো,”যেনো মেয়ে নয়।পরীর সপ্তম রাজ্য থেকে নেমে আসা সদ্য নীল পরি!তোমাকে কারো সাথে তুলনা করা যায় না।তাই তুমি আমার ‘ব্লু-লেডি'”
এখন বিকেল হতো চললো। নাবিলা আর পূর্ব ভিতরে গিয়ে দেখে সবকিছু রেডি।তাই হয়তো রাফিয়া ডাকতে এসেছিলো।নাবিলা-পূর্বকে দেখে রোদ তাদের কাছে এগিয়ে গেলো।রোদকে আসতে দেখে নাবিলা পূর্বকে একা ছেড়ে গেলো।
রোদ পূর্বের কাছে এসে বললো,”নাবিলাপু কোথায় গেলো?”
“তোমার হরিচন্দন এখানে আছে কিন্তু তোমার নাবিলাপু’কে লাগবে?কী ব্যাপার?তোমার আর নাবিলা’র মধ্যে কিছু চলছে না তো?”
“মানে?কী চলবে?”
“না মানে তুমি নাবিলা’র প্রেমে পড়ে যাওনি তো।”
পূর্বের এই কথায় রোদ ভালোভাবে বুঝলো সে কী মিন করছে।ওমনি তেড়ে পূর্বকে মারতে গেলে পূর্ব রোদের হাতজোড়া নিজের দখলে নিয়ে রোদকে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে তার গাড়ে থুতনি রেখে বললো,
“তোমার কালো জাদু’তে সম্পূর্ণভাবে ফেঁসে গেছি জাদুমন্ত্রী!”পূর্ব সম্পূর্ণ ঘোরে আছে।মাতাল করা কন্ঠস্বর!রোদ থেমে থেমে কেঁপে উঠছে।ঠোঁট জোড়া যেন নড়বে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছে।পূর্ব একই অবস্থায় থেকে বললো,”বেশি’র থেকেও বেশি ভালোবেসে ফেলেছি শঙ্খপুষ্পি!”
পাঁচ-ছ’ অক্ষরের বাক্যটি বিরতি নিয়ে নিয়ে রোদের কানে বার বার ধাক্কাধাক্কি করছে।একই কথা তার কানে বেজেই চলেছে।পূর্ব পেছন থেকেই রোদের কম্পনে থাকা হাত জোড়ায় নিজের ছোঁয়া দিলো।তখনি তাদের দুজনের কানে ভেসে আসলো,”হাউ রোমান্টিক!তিহান তোমার বন্ধু থেকে কিছু তো শিখতে পারো।”
বাক্যটি শুনে পূর্ব-রোদ দু’জন-দু’জন থেকে খুব দ্রুত দূরে সরে গেলো।লজ্জার আভায় রোদের গাল দুটো হালকা গোলাপি হয়ে গেছে।পূর্ব অসস্তি’তে ভুগছে।তারা হালকা মাথা তুলে দেখলো তিহান,রাফিয়া আর নাবিলা তিনজনই দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে।তখন নাবিলা রাফিয়া’র উদ্দেশ্য বললো,
“উফ রাফিয়া!ফ্রী’তে কতো সুন্দর একটা রোমান্টিক মুভি দেখছিলাম।একদম লাইভ!দিলে তো সব ভেস্তে।তিহান তুই রাফিয়া নিয়া গিয়া রোমান্স কতো প্রকার কী কী শিখা।পূর্ব-রোদ তোমরা কন্টিউ করো…”
নাবিলা’র কথা শুনে রোদের লজ্জার পরিমাণ আরো বেড়ে গেলো।এতো বিব্রতকর অবস্থার সাথে রোদ আজই পরিচিতি হলো।না পারছে নড়ছে,না পারছে কিছু বলতে।তখন পূর্ব আমতা আমতা করে কিছু একটা বলে জায়গা ত্যাগ করলো।এবার রোদও সুযোগ পেয়ে এক দৌড়ে রুমে চলে এলো।ওদের দুজনের পালাতন দেখে বাকি তিন মূর্তি হু হু করে হেসে উঠলো।

জলন্ত সিগারেট হাতে নিয়ে মেঘ রুমের মধ্যে পায়চারি করছে।কানে বাজছে নাবিলা’র বলা প্রত্যেকটি কথা।মেঘের ইচ্ছে করছে সবকিছু ছেড়ে অনেক দূরে চলে যেতে।এতো বিষন্নতা নিয়ে মেঘের বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না।চোখের সামনে ভেসে উঠছে তার মায়ের হাত জোড় করার দৃশ্য।তারপর পরই ভেসে উঠছে নাবিলা’র চেহেরা।যে তাকে নিজের ভাইয়ের মতো ভালোবাসে।নাবিলা’র ক্ষতি করার পরও এখনো সে তারই ভালো চাই।আর মেঘ কি’না ওদেরই এতো কষ্ট দিলো?
মেঘ নিজের ফোন খুঁজে নিলয়ের নাম্বারে ডায়াল করলো।ওপাশ থেকে জানান দিলো নাম্বারটি বন্ধ আছে।মেঘ নিলয়ের অন্য নাম্বারে ডায়াল করবো।চর্তুথবার রিং হতেই ওপাশ থেকে উত্তর এলো।মেঘ কানে ফোন লাগিয়ে বললো,
“কোথায় তুই?নাবু’কে কী কী বলেছিস তুই?ও তোর এক্স হয়ে ও কে সবটা বললি আর বলার আগে একবারও ভাবলি না ও কষ্ট পাচ্ছে কি’না?কীভাবে পারলি তুই এমনটা করতে নিলয়?”
“আমার মনে হয়েছিলো সবটা বলা উচিৎ তাই বলেছি।”
“আমার বোন কষ্ট পাবে এইটা তোর মাথায় আসেনি?”
“এখন তোর বোন কষ্ট পাবে?তাই না?কাজের বেলায় তো আমাকে একবারও বারণ করিসনি।”
“আমি নাহয় বারণ করিনি কিন্তু তুই?তোর কী বুদ্ধি ছিলো না?”
“মেঘ তুই শান্ত হয়।দেখ আমরা দুজনে ভূল বুঝতে পারছি তাই প্লিজ আর ঝামেলা করিস না।”
নিলয়ের কথায় মেঘ কিছুটা থামলো।পাশে থাকা গ্লাস ভর্তি জল ঢকঢক করে খেয়ে ফেললো।তারপর দুজনে খানিকটা সময় নিশ্চুপ থাকলো।একসময় মেঘ বললো,”কোথায় তুই?”

“রেলওয়ে স্টেশনে আছি!ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছি।”
“হুয়াট?তুই ইন্ডিয়া যাচ্ছিস আর আমাকে বলবি না?পাগল হয়ে গেছিস তুই নিলয়?”
“নাহ!বিডি’তে আর আমার কোনো কাজ নেই।নিজের মেয়াদও দিন দিন নিম্নতার দিকে এগোচ্ছে।তাই ভাবলাম মায়ের কাছেই চলে যায়।”
“তাই বলে তুই আমাকে জানাবি না?তোর পাশে আমাকে থাকতে দিবি না?”
“বাদ দে!নাবিলা’ আমার ব্যাপারো কিছু জিজ্ঞেস করলে তুই বলবি জানিস না।”
“কিন্তু ও কেনো জিজ্ঞেস করবে?”
“করবে।”
তারপর দুই বন্ধু আবারো নিরবতা বিরাজ করলো।একসময় কলটা কেটে গেলো।হয়তো মেঘের ব্যালেন্স শেষ হয়েছে।অনেকক্ষণ বিছানায় বসে সবকিছুর সমীকরণ মিলালো।তারপর এক দৌড়ে র‍্যাডি হতে লাগলো।
শত হলেও নিলয় তার বন্ধু! বিপদে-আপদে সবটা সময় ছায়ার মতো পাশে লেগে ছিলো।আজ শেষ মুহুর্তে মেঘ কিছুতেই নিলয়কে একা ছাড়বে না।কোনোদিনও না!এখন নিলয়ের পাশে মেঘকে খুব প্রয়োজন।খু-ব!
[চলবে]