পূর্ব রোদ !! Part- 05
পূর্বের মা বাড়ির ভিতর ঢুকে গেলো।তিহান বিড়বিড় করে “ইন্না-লিল্লাহ!” বললো।পূর্ব সেদিকে মাথা না ঘামিয়ে রোদ’কে নিয়ে ভাবতে লাগলো।আজকের কাজের জন্য পূর্বের নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে।বরাবরই ছোট বেলা থেকে রোদ কান্না করলে পূর্বের নিজেকে অপরাধী মনে হয়।কিন্তু তবুও ঝগড়া করা থামায় না।
।
।
“রোদ তোর কাল বাদে পরশু পরিক্ষা আর তুই সকাল বেলা কিছু না বলে বেরিয়ে গেলি?”
“রাফিয়ার কাছে একটা ম্যাথ নিয়ে আলোচনা করছিলাম।”
“ওহ।ওমন তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলি আমি উল্টা পাল্টা ভাবছিলাম।যা ফ্রেশ হয়ে আয়।”
“হুম।”
মাথা নিচু করে রোদ নিজের রুমে চলে আসলো।শান্তভাবে বিছানায় বসে একটু আগের দৃশ্য মনে করতে লাগলো।হাতের মুঠোতে থাকা চেইনের দিকে তাকিয়ে মনেমনে বললো,”আমাকে দিয়ে?মিসেস রোদেলা মোহাম্মদ’কে দিয়ে হরিচন্দন নিজের জুতা মুছালো তো?আমিও এর শেষ দেখে ছাড়বো।”
পরক্ষণে চেইন হারানোর কথা মাথায় আসতেই বললো,”না না ওর সাথে ঝগড়া দিতে গিয়ে চেইন হারিয়ে যাচ্ছিলো।এই চে..চেইনটা আমার কতো আপন!এই চেইন যেটার দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে পূর্ব আমাকে হাতের আঙ্গুলে নাচালো।এবার আমিও পূর্বকে এড়িয়ে যাবো।তখন দেখি কীভাবে কী করে?”
আজ সকাল থেকে রোদের মন খুব ফ্রেশ।যদিও হালকা ভয় হচ্ছে কিন্তু এক্সাইটেড বেশি।আজ থেকে সকাল দশটার সময় রোদের পরিক্ষা শুরু।এখন সাড়ে আটটা।রোদ রুমের মধ্যে নুডলস খেতে খেতে ম্যাথ দেখছিলো।রোদের একটাই লক্ষ্য জিপিএ ফাইভ!কারন পূর্বের চেয়ে তাকে ভালো রেজাল্ট করতে হবে।পূর্বের প্রতি সেমিস্টারে ফাস্ট ক্লাস আসে।তাই রোদ কেও ভালো করতে হবে।রোদ নুডলসের বাটি এক পাশে রেখে এক ধ্যানে আগের করা ম্যাথগুলোর উপর চোখ বুলাচ্ছিলো।তখনি তার রুমে কেউ একজন প্রবেশ করে বললো,
“নয়টা বাজতে আর পাঁচ মিনিট বাকি।তাড়াতাড়ি আসো!”
দুলাইনের কথাটা রোদের মাথার উপর দিয়ে গেলো।পেছন ফিরে দেখলো ফর্মাল ড্রেসে,পেন্টের পকেটে দু’হাত দিয়ে পূর্ব দাঁড়িয়ে আছে।রোদ হা করে তাকিয়ে রইলো।প্রথম পূর্বকে ফর্মাল ড্রেসে এই প্রথম দেখছে,তার উপর এতো মধুমাখা কথা,রোদ’কে আদেশ দেওয়া।সব মিলিয়ে রোদের মাথা ঘুরে গেলো।বিড়বিড় করে বললো,”হায় আল্লাহ!আজকে সূর্য কোন দিকে উঁকি দিছে?”
“হা করে কী দেখছো?তাড়াতাড়ি আসো।”
রোদের এবার মনে হলো সে সব কল্পনায় দেখছে।নাহলে সামনাসামনি এতো ভদ্রভাবে পূর্ব কোনোদিনও কথা বলবে না।কল্পনা মনে করে রোদ বিষয়টা এড়িয়ে আবারো পড়তে লাগলো।পরক্ষণে মনে হলো পূর্বকে নিয়ে এমন সুন্দর কল্পনা তো জীবনেও দেখেনি।তাহলে আজকে হঠাৎ পূর্বের ভদ্র ভূত তার সামনে কেনো আসবে?নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে রোদ বিড়বিড় করে বললো,”রোদ তুই দুদিন ধরে হরিচন্দনকে নিয়ে বেশি ভাবছিস তাই এমন হচ্ছে।নয়টা বেজে গেলো এবার পরিক্ষার জন্য বাড়ি থেকে বের হো।”
রুম থেকে বেরুনোর সময় রোদ খেয়াল করলো পূর্ব এখনো দাঁড়িয়ে আছে।তার কল্পনায় আসা পূর্ব মনে করে রোদ বললো,”তুই কী মনে করিস নিজেকে?যখন ইচ্ছে আমাকে কাঁদাস।সারাক্ষণ ঝগড়া করিস।এবার আমি ঠিক করে নিয়েছি তোর সাথে কথায় বলবো না।শুধু শুধু দাঁড়িয়ে না থেকে ভাগ এখান থেকে।”
পূর্বের গায়ে হালকা চড় দিয়ে রোদ কথাগুলো বললো।তখনি তার মনে হলো কল্পনায় আসা কোনো ব্যাক্তিকে তো ছুঁয়া যায় না।তারমানে পূর্ব সত্যি সত্যি এখানে আছে?
“তত..তুই সত্যি এখানে?”
“তোকে আমি পরে দেখছি।এখন নিচে চল।”
রোদ দৌড়ে নিচে গেলো।গিয়ে দেখলো পূর্বের বাবা-মা এসেছে।এবারে সে অবাকের উচ্চ সীমানায় পৌঁছে গেলো।রোদকে দেখতে পেয়ে চাঁদনি মোহাম্মদ বললো,”এইতো এলি তুই।পূর্ব কোথায়?”
“এইতো মা।রোদ চলো তোমাকে এক্সাম হল’এ ড্রপ করে আসি।”
রোদ শুধু অবাকের পর অবাক হচ্ছে।পরিক্ষা’র হল’এ যাবে তাও পূর্বের সাথে?রোদ “না” বলতে গিয়ে আবার মনে মনে ভাবলো পূর্ব করতে চাই চাইছে কী?এতো ভালো হওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।আমি দেখি কী কী করে?
“আচ্ছা আসি আমি।তোমরা সবাই দোয়া করিও।” (রোদ)
“যাহ।সাবধানে যাবি।পূর্ব বাইক আস্তে চালাবি।”(চাঁদনি)
রোদ নিজ ইচ্ছায় সব মেনে নিচ্ছে দেখে পূর্ব অবাক হলো।নরমাল বিহেভ বলতে ওদের মধ্যে ঝগড়াটা।পূর্ব মনে করেছিলো ভালো ব্যবহার করলে রোদ চেচামেচি শুরু করবে।ওর সাথে যেতে চাইবে না।কিন্তু উল্টো সব মেনে নিলো।
।
।
রোদ বাইরে বের হতে দেখলো তার বাবা’র পুরনো মোটরসাইকেল’টা দাঁড় করানো।অনেকদিন ধরে বাইকটাতে ধূলো পড়াছিলো কিন্তু এখন একদম পরিষ্কার।যদিও পুরনো কিন্তু স্মৃতি জড়ানো।রোদ হা করে বাইকটার দিকে তাকিয়ে রইলো।তখন পূর্ব এসে বললো,
“তোমার তো অনেক ইচ্ছে ছিলো বাবা’র সাথে উনার মোটরসাইকেলে করে এইচএসসি পরিক্ষা’র হল’এ যেতে।উনি তো বেঁচে নেই ভাবলাম আমি স্বামী হয়ে আমার স্ত্রীর ইচ্ছেটুকু পূরন করি!”
রোদের কানে পূর্বের বলা শেষ কথাটা বার বার বাজছে।পূর্ব তাকে নিজের স্ত্রী বলছে?স্বামী দাবি করছে?রোদের ইচ্ছের দাম দিচ্ছে?কিন্তু পূর্ব এসব করছে কেনো?তাদের মধ্যে তো কোনোদিন স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্ক ছিলো না।তাহলে আজ কেনো পূর্ব সেই অধিকার নিয়ে কথা বলছে?পূর্বের কথায় রোদের মনে অনেক প্রশ্নের উদয় হয়েছে।পরিক্ষা হয়ে গেলে রোদ পূর্বের থেকে এমন করার কারণ জিজ্ঞেস করবে।
পূর্ব বাইকে বসলে রোদ গিয়ে তার পেছনে বসলো।আলতো করে পূর্বের কাঁধে হাত রাখলো।রোদের ছোট বেলার কথা মনে পড়ে গেল।এরকম বাইকে করে রোদ পিএসসি পরিক্ষা দিতে গেছিলো।তবে পূর্বের জায়গায় তার বাবা ছিলো।আজ বাবার জায়গায় পূর্ব বসে আছে ভাবতে বৈশাখের মাতাল হাওয়া রোদ’কে ছুঁয়ে গেলো।রোদ চাইছে সময়টা এখানেই থেমে যাক!স্থীর হয়ে যাক সবকিছু!
।
।
“চাঁদনি পূর্বের এতো ভালো ব্যবহার?রোদের নরমাল বিহেভ..এসব কী?” (ছায়া)
“ওদের ভালো ব্যবহার দেখে তোর ভালো লাগছে না?” (চাঁদনি)
“আহা!ভালো কেনো লাগবে না।এই রকম একটা দিনের জন্য এতো বছর অপেক্ষা করেছিলাম।আর সেই দিন দেখে খুশি হবো না?কিন্তু হুট করে পরিবর্তন?”
“পরশু দিন পূর্ব আমাদের বাসায় এসেছিলো।খুব সকালে।তুই জানিস না মনে হয়।”
“পরশু দিন?”
রোদের মা মিসেস ছায়া একটুখানি জোর দিয়ে ভাবতেই মনে পড়লো রোদ সেদিন সকালে রাফিয়া’র বাসায় গেছিলো।
“পরশুদিন তো রাফিয়া’র বাসায় গেছিলো।তারমানে রোদ তোদের বাসায় গেছিলো?কিন্তু কেনো?”
সেদিন চাঁদনি মোহাম্মদ সব কিছু না জানার ভান করে থাকলেও তিনি সবই জানতেন।তিহানের থেকে চাঁদনি মোহাম্মদ সব কিছু জিজ্ঞেস করলে তিহান সব বলে দেয়।সেদিনের রাত এবং সকালের ঘটনা ছায়া’কে খুলে বলতেই রোদের মা হতাশ হলেন।তাকে হতাশ হতে দেখে চাঁদনি মোহাম্মদ বললেন,
“ছায়া এভাবে ভেঙ্গে পরিস না।”
“কী হবে ছেলে-মেয়ে দু’টোর?ওদের বুঝ কখন হবে?এভাবে…”
ছায়া’র গলায় কান্না কান্না ভাব।কন্ঠ স্বর জড়িয়ে আসছে।ছায়া’র অবস্থা দেখে চাঁদনি মোহাম্মদ সোফার তার পাশে বসে শান্তনা দিয়ে বললো,
“ছায়া শান্ত হো তুই।আমি কথা দিচ্ছি তোকে আজকের পর থেকে ওদের মধ্যে সবকিছু, সবকিছু নরমাল হয়ে যাবে।”
“কিন্তু কী ভাবে?”
“আমার উপর আস্তা আছে তো তোর?আমি সব ঠিক করে দিবো।”
চাঁদনির কথায় ছায়া বিশ্বাস রাখলো।মাধ্যমিক থেকে দুজন খুব ঘনিষ্ঠ বান্ধবী।কলেজে তো সবাই ওদের বন্ধুত্ব দেখে জেলাস হতো।ওদের মাঝে ছায়া মানসিক ভাবে দূর্বল হলেও চাঁদনি মোহাম্মদ যথেষ্ট সবল।বরাবর ছায়া ভেঙ্গে পড়লে তার পাশে সবসময় চাঁদনি নামক ‘ছায়া’টা থাকে।
“পরিক্ষা কেমন হয়েছে?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”
“ফুল মার্ক্স করেছো?”
“হ্যা।”
পূর্ব যেসব প্রশ্ন করছে রোদ শান্তভাবে সবটার উত্তর দিচ্ছে।রোদ দেখতে চাইছে পূর্ব আরো কী কী করে?পূর্ব মোটরসাইকেলে বসলে রোদও তার পেছনে বসলো।দুজনে কোনো কথা বলছে না।তবে রোদের মনে অনেক প্রশ্ন।নিজের মধ্যে আগ্রহ দমিয়ে রাখতে না পেরে বললো,
“এতো নরমাল বিহেভ ক্যান করছিস?তোরে কে সুপারি দিছে?”
“রোদেলা!স্বামীর সাথে কেউ তুই-তোকারি করে না।”
“তোরে আমি জীবনেও স্বামী মানিনি আর না মানবো।”
“বিয়ে হয়ে গেছে তাই মানা না মানাতে কিছু আসে যায় না।”
পূর্বের কথা শুনে রোদ কিছু বলার শব্দ খুঁজে পেলো।সে না মানলেও তাদের বিয়ে হয়ে গেছে।তবে রোদ নিশ্চিত পূর্বের এমন ব্যবহারের পেছনে “কিন্তু” অবশ্যই আছে।নাহলে যার সাথে চিরশত্রুতা তার সাথে হুট করে নরমাল বিহেভ করাটা মানায় না।
রোদ অনেকক্ষণ ধরে পূর্বের হাতের পিটের দিকে তাকিয়ে আছে।মাধ্যমা থেকে অনামিকা আঙ্গুল পর্যন্ত কাটা দাগ।লাল হয়ে আছে কাটা অংশে।হয়তো কাল’কের কাটা!কিন্তু পূর্ব কাটলো কোথায়?প্রশ্নটা পূর্বকে করতে গিয়ে নিজের মধ্য আড়ষ্টতা অনুভব করলো।তাদের সম্পর্ক যদি অন্য চার-পাঁচটা স্বামী-স্ত্রীর মতো হতো তাহলে হয়তো প্রশ্ন করলে মানা যেতো।কিন্তু এখন..?
সেদিনের পর থেকে পূর্ব প্রতিদিনই রোদ’কে পরিক্ষার হল’এ নেওয়া-আসা করতো।পূর্বের নরমাল বিহেভটা রোদের কাছে অদ্ভুত মনে হতো শুধু।রোদের পরিক্ষা প্রায় শেষের দিকে।প্রত্যেক পরিক্ষায় পূর্বের সাপোর্ট সবচেয়ে বেশি পেয়েছে।তবে রোদের কাছে এসব আদিক্ষেতা ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি।
রোদের পরিক্ষা আর মাত্র দুটো বাকি।তবে আজ শুক্রবার।সকাল বেলা চোখ খুলতেই বিরিয়ানি’র সুগন্ধি নাকে বেঁধে গেলো।সুবাশে রোদ চোখ বন্ধ করে সুগন্ধ অনুভব করলো।একটুপর বিছানা ছেড়ে তাড়াতাড়ি রান্না ঘরে গেলো।গিয়ে দেখলো তার মামুনি চুলার উপরে থাকা বিরিয়ানির নেড়ে দিচ্ছে।তার পাশে রাফিয়া বসে নিজের ইচ্ছে মতো কথা বলছে।
(চলবে..)