পাথরের বুকে ফুল

পাথরের বুকে ফুল ! সিজেন 2 !! Part- 03

আয়য়য়য়য়য়য়য়য়য়য়,বিকট চিৎকারে সারা ঘরময় কেঁপে উঠেছে।হাতের দিকে তাকিয়ে একের পর এক চিৎকার করেই চলেছে হাবিব।তার চিৎকার প্রতিধ্বনিত হয়ে একবার সব দেয়ালে ঘুড়ে বাড়ি খেয়ে তা আবার তার চোখেমুখেই এসে বাড়ি খাচ্ছে।তার হাতের প্রতিটি আঙ্গুল নিখুঁত ভাবে কেটেঁ ফেলা হচ্ছে। দুটি হাত খোলা থাকার পরেও সে কিছুই করতে পারছে না।শুধু চিৎকার করছে।আর তার সামনে খুবই সাবলিল ভঙ্গিতে বসে বসে তার একটা একটা আঙ্গুল হাত থেকে আলাদা করা হচ্ছে।লোকটা এবার আর সয্য করতে না পেরে বললো,

—” স্যার ছেড়ে দেন।আর জীবনেও বিশ্বাসঘাতকতা করবো না।বিশ্বাস করেন আর জীবনেও এই ভুল করবো না।”
সামনের ব্যক্তিটি শুনলো না।আট নাম্বার আঙ্গুলও কেটেঁ দিলো অনায়াসে। শৈকত কাপঁছে। তার কম্পোনের মাত্রা থেকে থেকে বারছে।মাথা ভর্তি ঘাম।ভয়ে তার সমস্ত কথা আটকে আসছে গলায়।তবুও সাহস নিয়ে মিনমিনে গলায় রিমনের দিকে তাকিয়ে বললো,
—” এনিই অরিত্রান খান??”
রিমন নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলো।মাথা তুলে তাকিয়ে বললো,
—” হুম।”
শৈকত আরো ভয়াত্নক হয়ে বললো,
—” আসলেই দয়ামায়া বলতে কিছু নেই।ভাই আমি আর উনার হয়ে কাজ করবো না।ভয়ে তো জান এখনই চলে যাবে।ওই দিকে ওই ইহান আর এই দিকে অরিত্রান।আমি যেদিকেই যাই জীবনরে ঝুলাইয়া যাই।না বাপ।কাজ ছেড়ে দিমু।”
রিমন মাথা দুলিয়ে হেঁসে উঠে।শৈকত ভ্রুকুঁচকে বললো,
—” হাসেন কেনো??”
—” কারন তুমি চাইলেও আর এখান থেকে যেতে পারবে না।তাই।”
শৈকত আরো ভীতু হয়ে সামনে তাকায়।লম্বাটে মুখ।হালকা কিছু গোঁফ।চাপা দাঁড়ি।চোখা নাক।কালো মোটা ভ্রু।লাল ঠোঁটজোড়া দেখে তার মনে হচ্ছে কেউ ঘুষি দিয়ে রক্ত জমা করে দিয়েছে।কালো শার্ট, কালো ব্লেজার, কালো প্যান্ট,কালো ঘড়ি কি মারাত্মক ডার্ক গ্রিন চোখ।জিম করা বডি।তুর্কি স্টাইলের হেয়ার কার্ট।হাতে একটা ছুঁড়ি।টেবিলের উপড়ে কাটা আঙ্গুল,রক্ত।শৈকত ভাবে লোকটার সাথে এখন একটা মেয়েকে দেখলে মানাতো।কিন্তু এত হেন্ডস্যাম, ফিট,ওসাম টাইপের লোকের হাতে এই ছুড়ি আর রক্ত বড্ড বেমানান।চোখেমুখে গম্ভীর ভাব।হাসির ছিটে ফোটাও নেই।ভয়ংকর চাহনি দিয়ে খুবই সাবলিল ভাবে সামনের লোকটার আঙ্গুল কাটছে।এতটা শান্ত ভাবে কেউ খুন করতে পারে এটা তার জানা ছিলো না।কাঁটা কাটির স্টাইল দেখে তো মনে হচ্ছে মেহমান দারি করছে।শৈকত ভয়ে শিউরে উঠে রিমনের দিকে তাকিয়ে আছে।রিমন নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।

লোকটা আবার চেঁচিয়ে উঠে।দুই হাত কাটা শেষ।এবার অরিত্রান মুখ খুলে।শান্ত স্বরে বলে,
—” বিশ্বাসঘাতক অরিত্রানের লোক হলেও সে তাকে ক্ষমা করে না।এদের একটাই শাস্তি মৃত্যু।”
লোকটার গলা বরাবর কেঁটে অরিত্রান দাঁড়িয়ে পড়ে।পাশের লোকটা তাকে একটা কাপড় এগিয়ে দেয়।অরিত্রান তাতে হাত মুছে বললো,
—” এর দেহ রহিত শেখের বাড়ি দিয়ে এসো।”
হাবিব অরিত্রানের কোম্পানিতে কাজ করতো।রহিতের লোক হয়ে সে অরিত্রানের খবরাখবর তার কাছে পৌছে দিতো।এর বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকা নিতো।অরিত্রান যানতে পারায় সে পালিয়ে যায়।তাই অরিত্রান দেশে আসে।
অরিত্রান খান দ্যা মাশহুর বিজনেসম্যান ইন দ্যা ওয়ালড।পৃথিবীর বিভিন্ন বড় বড় দেশে তার আধিপত্য রয়েছে।বিশ্বে অনেক বড় বড় ফ্যাসেন হাউজ রয়েছে তার।সে একপ্রকার বেস্ট ফ্যাশন আইকনদের মধ্যে একজন।মেয়েরা তো অরিত্রান বলতেই ফিদা।কিন্তু সে সবার থেকে দুরে থাকে।তাকে পাওয়া দেখা ততক্ষণ পর্যন্ত সম্ভবনা যতক্ষণ সে নিজে ধরা দেয়। তার প্রচণ্ড রাগ আর ভয়ংকর হিংস্র ব্যবহারের কারনে তার আশেপাশে খুব কম মানুষ ঘুড়ে।প্রয়োজন ছাড়া কেউ কথা বলে না তার সাথে।কম কথাই তার পছন্দ। উগরো টাইপের সভাব, তাকে কখনো কেউ প্রান খুলে হাসতে দেখে নি।মন বলতে যে কিছু হয় তা তার অজানা।তার ধারনা এমন কিছু হয় না। আমেরিকার বিখ্যাত বাইক রেইস,কার রেইস,হর্স রেইসে চেম্পয়ান সাথে বক্সার, বাস্কেট বল,ফুটবলের উপরও সে অধিক পারদর্শী। গাড়ির প্রতি তার প্রচণ্ড নেশা রয়েছে। তাই মোটামোটি সব নামিদামি ব্যান্ডের গাড়ি কাল্কেশন রয়েছে তার। বাড়িরও অভাব নাই বিশ্বের সকল উন্নত দেশে তার বাড়ি রয়েছে।তবে বাড়িত সে থাকেনা যেখানেই যায় পাইভ স্টারে,বা নামিদামি হোটেলে থাকে। তার যেমন প্রচুর অর্থ ভান্ডার রয়েছে তেমন দান করার জন্য দুটি হাতও আছে যা দিয়ে প্রচুর অর্থ দান করে তবে গোপনে নরমালি কেউ যানেনা।তবে তার খারাপ গুনগুলো ভায়াবহ। সে এক প্রকার সিড়িয়াল কিলার।আসলে যার কথা তার অপছন্দ তার পক্ষে আর দুনিয়ায় থাকা সম্ভব না।আল্লাহ ছাড়া কেউ বাচাঁতে পারবেনা।এক প্রকট ভয়ংকর ব্যক্তিত্বের অধিকারি সে। মনটা সম্পর্ণ পাথর।সে এক রহস্যময় ব্যক্তি।
কথাগুলো বলে রিমন একটা দীর্ঘশ্বাস নেয়।শৈকত হা করে সব শুনছে।তার মায়ের অপারেশনের জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন ছিলো অরিত্রান তাকে সে টাকা দিয়েছে।তাই সেও অরিত্রানের হয়ে কাজ করতে চেয়েছে।তার কাজ গুপ্তচরের।ইহানের হয়ে কাজ করবে তবে সে অরিত্রানের লোক।প্রথমে সেও খুশি হয়ে কাজে মন দেয়।কিন্তু দিন দিন এই কাজ আর কাজের লোকেদের দেখে তো তার হার্টঅ্যাক হওয়ার মত অবস্থা।
অরিত্রান ইহানের বাগান বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।তার লোকেদের ভিতরে যেতে বলে সে বললো,
—” কাগজ গুলো নিয়ে এসো।ফার্স্ট।”
ইহানের বাড়ি তন্ন তন্ন করে খোজা হলো তালা দেওয়া রুম গুলো বাদে।কিন্তু সেই কাগজ পেলো না কেউ।নিরাশ হয়ে অরিত্রানের সামনে দাড়িয়ে মাথা নিচু করে বললো,
—” স্যার কাগজ গুলো নেই বাড়ির ভিতরে।”
অরিত্রান শক্ত হয়ে দাড়িয়ে পড়ে।কিছুই বলেনা।তার রাগ বাড়ছে সবাই বুঝতে পেরে সরে দাঁড়ায়। অরিত্রান রেগে বললো,
—” সারা বাড়ি জ্বালিয়ে দেও।”
অরিত্রান নিজের ব্লেজার খুলে ছুড়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়।কিছু একটা ভেবে পিছনে তাকাতেই কাঁচের জানালাতে কারো ছাঁয়া দেখতে পায়।অরিত্রান আরো একটু এগিয়ে গিয়ে সামনে তাকায়।হুম কেউ আছে বাড়িতে।অরিত্রান কয়েক কদম ফেলে ভিতরে ডুকে পড়ে।ততক্ষণে বাড়িতে আগুন লাগানো হয়েগেছে। চারপাশে আগুন জ্বলেও উঠেছে।অরিত্রান সিঁড়ি বেয়ে উপড়ে উঠে।কয়েকটা রুম পরেই তালাবন্ধ একটা রুম দেখতে পায়।দেখেই অরিত্রান কিছুসময় তাকিয়ে থাকে।কেনো যেনো একবার খুলতে ইচ্ছে করছে।কে আছে এই রুমে??অরিত্রান পাশে থাকা লোহার ফুলদানী দিয়ে তালা ভাগে।দু’হাতে ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ফেলে।সামনে তাকিয়ে অরিত্রান নিজের চোখে দু’হাত দিয়ে ডাকে।এত আলো??এত আলো এই রুমে কেনো??অরিত্রান ধিরে ধিরে চোখ থেকে হাত সরিয়ে সামনে তাকায়।বিরক্তি নিয়ে প্রশ্ন করে,
—” কে এখানে??”
জবাব পায় না।অরিত্রান আরো দু’কদম এগিয়ে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।একটা মেয়ে!!সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে।হাত পা বাঁধা।ঘামে ভেঁজা ছিপছিপ মুখ লাল হয়ে আছে।চোখবুজে একপাশে কাত করে মাথা ফেলে রেখেছে সে।হলুদ রং এর জামা।হলুদ হেজাব।এলোমেলো হয়ে আছে। শরীর জড়িয়ে ছোট ছোট ফেইড়ি লাইট।অরিত্রান এইটুকু দেখেই চোখ ফিরিয়ে বাহিরে চলে আসে।কে না কে??মরলে মরুক তার কি।কিছুদূর যেতেই চাপা আর্তনাদ করে মেয়েটি বলে উঠে,
—” পানি!!!!!!!”

অরিত্রানের কানে ঝঙ্কার লাগার মত সে শব্দ বাজে।সামান্য একটা শব্দে কেমন যেনো ঝুনঝুন করে বাজার মত শব্দ হচ্ছে তার কানে।অরিত্রান পিছনে ফিরে তাকায়।এই প্রথম তার মনে হচ্ছে মেয়েটাকে মরার আগে একটু পানি দিয়ে দেওয়া উঁচিত। মরে তো যাবেই।যদিও সে মৃত্যু পথ যাত্রীদের শেষ ইচ্ছে কখনোই পুরোন করে না।তবুও হঠাৎ মনে হলো।অরিত্রান আরো একটু এগিয়ে গেলো।খুব কাছে গিয়ে মেয়েটার দিকে তাকালো।ঘামে ভিজা চোখে মিটমিট করে একবার তাকাচ্ছে আবার চোখ বুজে ফেলছে।অদ্ভুত ভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। মনে হচ্ছে খুব কষ্ট হচ্ছে।অরিত্রান চোখ ঘুড়িয়ে মেয়েটার হাতের বাঁধন খুলে দেয়।পায়েরটা খুলতে গিয়েই মনে পরে সে তো নিচু হয়ে কখনোই কিছু করে না।তবে এই মেয়ের পা কেনো খুলবে।অরিত্রান আবার একবার সোজা হয়ে দাঁড়ায়। পিছনের জানালার আয়নায় আগুনের ফুলকি দেখা যেতেই অরিত্রান চমকে তাকায়।সে নিজেই আগুন দিতে বলেছিলো।অরিত্রান দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে যেতে নেয়।হঠাৎ মেয়েটার দিকে একবার তাকিয়ে তার শরীর থেকে সব তার খুলে দেয়।মেয়েটা মনে হচ্ছে জ্বলজ্বল করছে।অরিত্রান আর তাকালো না।মেয়েটার হাত ধরতে গিয়েও ধরতে ইচ্ছে করছে না।মেয়েদের তার একদম পছন্দ না এক কথায় ঘৃন্না লাগে।এমন একটা ভাব নিয়ে অরিত্রান নিজের দু আঙ্গুল দিয়ে মেয়েটার হাত টাচ করে।মুহূর্তেই মেয়েটা কেঁপে উঠে।অরিত্রানের হৃৎপিন্ড ধাক করে উঠে।অরিত্রান আবার তাকায় মেয়েটার দিকে।আগুনের পোড়া গন্ধ যখন প্রকট হয় অরিত্রান চারিদিকে তাকিয়ে উপায় না পেয়ে দু’হাতে জামা জড়িয়ে মেয়েটাকে কোলে তুলে নেয়।অরিত্রান আর তাকালো না মেয়েটার মুখের দিকে।দ্রুত হেঁটে বেড়িয়ে আসে বাড়ি থেকে।অরিত্রানের মনে হচ্ছে তার শ্বাস আঁটকে আছে।রিমন মাত্র এসেছে।সাথে শৈকত। অরিত্রানের কোলে মেয়েটিকে দেখে সে উত্তেজিত হয়ে বললো,
—” ওয়াসেনাত!!!”
রিমন চমকে তাকালো।সে হতভম্ভ। এটা কি দেখছে??অরিত্রানের কোলে মেয়ে??তাও এই আগুন থেকে বাচানো অবস্থায়??অরিত্রান আর বাচানো??রিমনের মাথা ঘুড়ছে।মনে হচ্ছে জীবনে প্রথম সে ভয়ংকর রকমের চমকালো।চোখ বড় বড় করে সে তাকিয়ে থেকে বললো,
—” ভাই শৈকত না টৈকত একটা চিমটি না পারলে দশবারোটা দে।তবুও প্রমান কর আমি যাহা দেখিতেছি সবই মিথ্যা।”
শৈকত সত্য সত্য দু’হাতে চিমটি দেওয়া শুরু করে।রিমন লাফিয়ে দূরে সরে গিয়ে বললো,
—” বলেছি দেখে কি এত গুলা দিবি গর্দভ!!ওহহ্ আমার হাত!!”
—” আমি কি করবো আপনিইত বলেছেন।”
রিমন বিরক্তি নিয়ে একবার তাকিয়ে আবার সামনে তাকালো।অরিত্রান দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে এসে নিচে শুয়ে দিলো।তার শরীর ভয়ংকর রকমের কাপঁছে।এতগুলো খুন করতেও তার এত ভয়ংকর অবস্থা হয় নি।কিন্তু আজ বাচতে গিয়ে কেনো হলো??জীবন বাচানো ভয়ংকর কাজ এটা অরিত্রানের বুঝা হয়েগেছে। রিমন এগিয়ে এসে অবাক হয়ে বললো,
—” এই মেয়ে কি তোর গার্লফ্রেন্ড??? ”
অরিত্রান চোখমুখ শক্ত করে তাকায়।রিমন দমে যায়।অরিত্রান রাগি গলায় বললো,
—” কে এই মেয়ে??যেই হোক জ্ঞান ফিরিয়ে বাসায় ফেলে আসবে।ডিজগাস্টিং।”
অরিত্রান দ্রুত জায়গা ত্যাগ করতে গিয়ে শুনতে পায় শৈকত বললো,
—” ওয়াসেনাত নাম এই মেয়ের।আমি চিনি।মানে ইহান ওকে এখানে রেখে দিতে বলেছে।আল্লাহ বাচায়ছে।ওহহ্।”
অরিএান গাড়িতে উঠে বসে।কাঁচের জানালা দিয়ে আর একবার বাহিরে তাকায়।ওয়াসেনাত এখনো ঘাসের উপর পরে আছে।অরিত্রান দ্রুত চোখ ফিরিয়ে সামনে তাকায়।
ওয়াসেনাতের জ্ঞান ফিরতেই তাকে ভার্সিটির হলে দিয়ে আসে শৈকত আর কিছু লোক।কিন্তু ওয়াসেনাতের চোখে ভাসছে সেই সবুজ চোখ।একটু করেই দেখেছে সেই চোখ।তার আধোআধো মনে আছে।সম্পূর্ন মনে নেই।কে সেই লোক??ওয়াসেনাত মাথায় শুধু ঘুড়ছে সব।দূর্বল লাগছে শরীর।এই দূর্বল পায়ে ওয়াসেনাত হেটে হেটে হলের সামনে আসে।রিমি আজ দুইদিন সব জায়গায় ওয়াসেনাতকে খুজে ক্লান্ত। তাকে হলের সামনে দেখেই জাপ্টে ধরে তাকে।উদ্বেগের সাথে বলে,
—” কোথায় ছিলি??তোকে কত খুঁজেছি। আর এই অবস্থা কেনো??দস্ত কি হয়েছে বলবি??”
ওয়াসেনাত কিছু বললো না।হেটে সামনে এগিয়ে রুমে ডুকে পরে।এই রুমে সে আর রিমি থাকে।ওয়াসেনাতের বাবা তার সাথে তেমন থাকে না তাই হলেই থাকে।আর রিমি তো ওর জানের জান পরানের পরান।তাই রিমিও নিজের বাড়ি ছেড়ে এখানে থাকে।রিমি অনেক প্রশ্ন করে কিন্তু একটারও উত্তর ওয়াসেনাত দেয় না।ফ্রেশ হয়ে এসে হাত মুখ ধুয়ে সে চাদুর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরে।অনেক ক্লান্ত সে।
___________________________
—” অরিত্রান তুই এদের দুজনকে বেধে কেনো রেখেছিস??”
—” কারন আছে তাই।”
সামনে বসে আছে দুজন ছেলে।অরিত্রান কোনো ভণিতা ছাড়াই বললো,
—” নুহাশ আর মাহির তাই তো??”
দুজনেই ভয়ে ভয়ে বললো,
—” হুম।”

অরিত্রান মাথা ডান বাম কাত করে বললো,
—” ছয়মাস তোমরা এই দেশে থাকবে না।তোমাদের ভার্সিটিতে যাওয়া হবে না।বাই দ্যা ওয়ে ভার্সিটিতে কি একদিনও মাস্টার্স করতে ডিপার্টমেন্টে গিয়েছিলে??”
দুজনেই মাথা দুলিয়ে বললো,
—” না স্যার।”
—” গ্রেট।তোমাদের বাকি কথা আর টাকা ও বুঝিয়ে দিবে।চালাকি করতে গেলে কি হবে আশা করি দু’জনেই জানো!!”
দু’জনেই দ্রুত বললো,
—” না স্যার চালাকি করবো না।আপনি আমাদের সব ব্যবস্থা করেন।আমরা চলে যাবে।”
অরিত্রান ঠোঁট বাঁকিয়ে তাকালো।রিমন বিস্ময়ে হতভম্ভ। এই অরিত্রানের মাথায় কি চলে সে বুঝতেই পারে না।ছেলেগুলো বেড়িয়ে যেতেই রিমন প্রশ্ন করে,
—” এই নুহাশ আর মাহিরকে দিয়ে তুই কি করবি?? কেনো বেচারাদের ধরে নিয়ে এলি??”
অরিত্রান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সবুজ চোখে কালো লেন্স লাগালো।বিছানার উপড় থেকে এক রং এর একটি নরমাল শার্ট তুলে নিলো।ওয়াসরুম থেকে পরে এসে আবার আয়নার সামনে দাড়ালো।গোল চশমা পরে নিলো।তারপর রিমনের দিকে তাকিয়ে বললো,
—” আজ থেকে আমি নুহাশ তুই মাহির।”
—” মানে??”রিমনের ভারী অবাক গলা।
অরিত্রান জবাব দিলো না।রিমনের নিজের মাথা নিজে ফাঁটিয়ে আবার নিজেই ব্যান্ডেজ করতে ইচ্ছে করছে।এই ছেলেটা এমন কেন??আল্লাহ এর জীবন দুষ্কর করতে পারবে এমন কাউকে বানাইছ??বানাই থাকলে একটু তাড়াতাড়ি এন্ট্রি দেও।দয়া করে।অরিত্রান একটা নকল গোঁফ এগিয়ে দিয়ে বললো,
—” এটা লাগা।”
রিমন নিরুপায় ভঙ্গিতে লাগিয়ে নিলো।সাথে বিরক্ত আর রাগকে দমন করে।

___________________________
ওয়াসেনাত আর রিমি ক্যান্টিনের টেবিলে বসে আছে।ওয়াসেনাত এখনো ভাবনায় বিভোর।রিমি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ভারী অবাক হয়ে বললো,
—” সবুজ চোখ!!!”
ওয়াসেনাত আগের মত থেকেই বললো,
—” হুমরে।ওই লোকটার চোখ সবুজ ছিলো।”
রিমি ওয়াসেনাতের এক হাত চেপে ধরে বললো,
—” দোস্ত এত পুরা ফিল্মি কাহিনী।না জানি কেমন দেখতে হবে??তুই একবার চিন্তা কর ছেলেটা তোকে কোলে তুলে নিয়ে এসেছে পিছনে আগুন জ্বলছে ইশশশশ্। ভাই তরে একলা কিডন্যাপ করতে গেলো কা??শালা আমারেও নিতো। আমিও একটু দেখতাম।”
ওয়াসেনাত বিরক্ত হয়ে বললো,
—” ফাইজলামি করবি না রিমি।মাথা এমনেই খারাপ।”
রিমি তার কথা পাত্ত দিলো না।হাত মুঠ করে আবার বললো,
—” দোস্তরে না জানি কত হেন্ডস্যাম ছিলো!!আমি তো না দেখেই ক্রাশ।”
ওয়াসেনাত রেগে বললো,
—” দিনে কয় জনের উপর ক্রাশ খাছ বলবি??পাগল তুই??সারা দিন এর উপড়ে ওর উপড়ে ক্রাশ।আর তোর না ওই অরিত্রান না পরিত্রাণ আছে।তাকে ফেলে এখন আবার আর একজনের দিকে নজর দেস কেন??”
—” আরে অরিত্রান তো আমার জান।দাড়া দাড়া।সবুজ চোখ তো অরিত্রানেরও আছে।তাহলে সে কি অরিত্রান??”
—” মাথা খারাপ তোর।ফালতু বকা বন্ধ কর।ওই পরিত্রাণ ক্যারেক্টার লেস, জল্লাদ,ও তো মানুষকে মারে বাঁচাতে যাবে কেন??”
রিমি কিছুক্ষণ ভাবলো।তারপর বললো,
—” হ রে কথাটা সত্য।কিন্তু একদম ক্যারেক্টার লেস বলবি না।ও মেয়েদের সাথে একদম লাগা লাগি করে না।পিত্তর ক্যারেক্টার।”
—” হ তরে কইছে!!যে ছেলের জন্য মাইয়ারা হুমড়ি খাইয়া আছে সে বুঝি একদম সাধু হইবো??মোটেও না।এসব সুন্দর পোলাদের মাঝে দুনিয়ার গাফলা।”
কিছুক্ষণ অনমনে হয়ে আবার বললো,
—” আর যে আমাকে বাঁচিয়েছে সে তো সবার থেকে আলাদা।তার চোখ পড়েই বুঝতে পেরেছি।সে হয় তো খুবি দয়াবান হবে বুঝলি।মানুষকে খুবই ভালোবাসে সে।একদম হৃদয় বান মানুষ।তা না হলে আগুনে ঝাপ দিয়ে আমাকে বাঁচাতো না।”
রিমি হা হয়ে শুনে।এই প্রথম ওয়াসেনাত কোনো ছেলের ক্যারেক্টারে দয়ামায়া, ভালো, হৃদয়বান লাগিয়েছে।ব্যাপারটা ভাবনার বিষয়।
_______________________
ভার্সিটির মাঠে হুল্লুর হচ্ছে।কাউকে রেগ দেওয়া হচ্ছে। ওয়াসেনাত আর রিমি একটু উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখলো।অনেক কষ্টে ঠেলে ঠুলে ভিতরে ডুকে দেখলো দুইটা ছেলেকে রেগ দেওয়া হচ্ছে। কেউ চশমা টেনে বলছে,
—” আরে বেটারি যে!!ডাবলবেটারি!!নাচতে বললাম না??নাচ!!”
ওয়াসেনাত ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে।একটা নীল শার্ট পড়া ছেলে।চোখে চমশা।মুখে গম্ভীর ভাব।গায়ের রং শ্যামলা।গালে চাপা দাঁড়ি।শার্ট টা এত ডিলা হয়েও ফিট হয়ে লোগে আছে বডিতে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে বলিষ্ঠ দেহ।হাতের শেষ ভাগ পর্যন্ত শার্টের হাতা।গলায় আইডিকার্ড। মাথা নিচের দিকে দিয়ে আছে।তার পাশেই চঞ্চল চোখের এক ছেলে।এদিক ওদিক তাকিয়ে সে পরিবেশ দেখছে।তার রেগ ফেগে তেমন ইন্টেরেস্ট নেই।গায়ে একটা বাদামি টিশার্ট। মুখে ঘন একটা গোঁফ দেখে মনে হচ্ছে আলাদা লাগানো হয়েছে।একবার টেনে দেখলে ভালো হত বলেই ওয়াসেনাতের মত হচ্ছে।কাঁধে ব্যাগ।দুজনকে দেখতেই ভারী ইনসেন্ট লাগছে।ওয়াসেনাতের মায়া হলো।এগিয়ে গিয়ে বললো,
—” ভাইয়া ছেড়ে দেন নতুন মনে হয়।”
ছেলেটা বললো,
—” আরে নাম জিজ্ঞেস করছি সেটাও বলেনা এই ছেলে ঘাড় ত্যাড়া।তুমি বুঝবে না এই ডাবলবেটারির চাল এগুলো।যাও তুমি।”
ওয়াসেনাত এবার ছেলেটার দিকে ফিরে বললো,
—” নাম কি আপনার??”
ছেলেটা মাথা তুলে তাকালোও না আর জবাবও দিলো না।ওয়াসেনাত আবার বললো,
—” নাম কি আপনার ভাইয়া??বলেন??”
জবাব নাই।ওয়াসেনাতের আরো মায়া হলো।মনে মনে বললো,
—” আহারে কপাল এত সুদর্শন দেখতে হয়েও বেচারা বোবা।”
ওয়াসেনাত আইডিকার্ড দেখে বললো,
—” নুহাশশশশশ…”
একটা টান দিয়ে বলে।ছেলেটা মাথা তুলে তাকায়।মুহূর্তে চমকে যাওয়ার মত চোখ হয়।কয়েকবার পাতা ফেলে আবার তাকায়।এই মেয়ে এখানে??কথাটা বলতে চেয়েও বললো না।গলায় আঁটকে গেছে।রিমন লাফিয়ে উঠার মত বললো,
—” তু…
শেষ করার আগেই অরিত্রান হাত চেপে ধরে।রিমন চোখ ফাটা ফাটা করে তাকিয়ে থাকে।রিমির দিকে ফিরে তার এখন জ্ঞান হারাবো মরেই যাবো বাঁচাতে পারবে না কেউর মত অবস্থা হচ্ছে। অরিত্রান হা করে তাকিয়ে আছে।মেয়েটাকে কালও দেখেছে তখন ফ্যাকাশে মুখ আর ঘামে ভেঁজা ছিলো চেহারা। কিন্তু এখন।অরিত্রান থমকায়।নীলাভ চোখের অধীকারি মেয়েটির দিকে গভীর নজরে তাকায়।কিছুক্ষণ আগ পর্যন্তও তার মেয়েটাকে সাধারন মনে হয়েছে।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভিন্ন কিছু আছে??ওয়াসেনাত চেহারায় দুঃখী ভাব এনে বললো,
—” ভাইয়া বেচারা বোবা কথা বলতে পারে না।ছেড়ে দেন।”
অরিত্রান রিমন দুজনেই চমকে তাকায়।চোখ বড় বড় হয়েগেছে তাদের।বলে কি এই মেয়ে??বোবা??তাও অরিত্রান খান??অরিত্রানের কান গরম হয়।চোখমুখ লাল হয়ে উঠে।তবুও নিজেকে সামলে রেখে নিচের দিকে তাকায়।ওয়াসেনাত চট করে অরিত্রানের হাত ধরে।অরিত্রানের বুক ধড়াস করে উঠে।ওয়াসেনাত হাত ধরে সবার সামনে থেকে টেনে ভিড়ের বাইরে দিয়ে আসে অরিত্রানকে।রিমি আর রিমনও অবাক হয়ে পিছনে পিছনে আসে।অরিত্রান তাকিয়ে আছে ওয়াসেনাতের হাতের দিকে।প্রথম স্পর্শ না।দ্বিতীয় স্পর্শ এটা।কাঁপুনিও দ্বিতীয় হারে বাড়ছে।অরিত্রান নিজের হাত টেনে নেয়।মেয়েদের ছোঁয়াতেও এত ভয়ংকর অনুভুতি হয় এটা তার জানা ছিলো না।ওয়াসেনাতকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওয়াসেনাত বলে উঠে,
—” আরে আপনি বোবা এটা এত লুকোনোর কিছু নেই।এটা তো আল্লাহর সৃষ্টি। আপনি বরং একটা নোটবুক রাখবেন।সবাইকে লিখে বলবেন কেমন??”
কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
—” ও স্যরি যারা কথা বলতে পারে না তারা তো কানেও শুনেনা স্যরি স্যরি।”
রিমন ফোঁড়ন কাঁটলো।দাঁত কেলিয়ে বললো,
—” আরে ও কানে শুনে।”
ওয়াসেনাত হাত নাচানি বন্ধ করে বললো,
—” ও ভালো।আপনারা বুঝি নতুন??”
রিমন বললো,
—” হুম।আজই প্রথম এলাম।”
ওয়াসেনাত চোখ গোল করে তাকিয়ে বললো,
—” এত বড় ছেলে হয়ে আপনারা ফার্স্ট এয়ারে আমার সাথে পড়বেন??”
—” আরে না আমরা মাস্টার্স করবো।তাই তোমাদের বড় আমরা।”
—” ওহ্।”

রিমি শুধু দেখছে।দুজনকেই তার চেনা চেনা লাগছে। তবুও অচেনা কেনো এরা।রিমন এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।আর মনে মনে বলছে,
—” আল্লাহ মিস ঝুগরুটে যাতে আমাকে না চিনতে পারে।প্লিজজ আল্লাহ।”
ওয়াসেনাত মিষ্টি করে হাসে।অরিত্রান চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে।ওয়াসেনাত হেসে হেসে বললো,
—” আমার নাম ওয়াসেনাত। তৌফিক বিনতে ওয়াসেনাত। আপনার নাম কি??ওও নুহাশশশ।তাই না!!”
অরিত্রান মুহূর্তেই চোখ ঘুড়ায়।মনে মনে বলে মেয়েটা এমন টেনে নামটা উচ্চারন করে কেনো??কানে ঝনঝন করে বাজে এর উচ্চারণ।রিমি এক হাত এগিয়ে বললো,
—” আমি রিমি।”
অরিত্রান হাত মিলালো।কিন্তু কই আগের মত তো কাঁপছে না সে??বুকটাও ধড়াস করলো না।কেনো??অরিত্রান হাত সরিয়ে ফেললো।রিমন হাত বাড়িয়ে বললো,
—” আমি মাহির।”
রিমি মিলালো না।সন্দেহ নিয়ে তাকিয়ে থাকলো।ওয়াসেনাত বললো,
—” এই যে মিস্টার গোঁফা মাহির আপনার এই গোঁফ আসল??”
রিমন দ্রুত হাত দিয়ে গোঁফ চেপে ধরে।ভালো করে ঠিক করে বললো,
—” হ্যা হ্যা আসল।তবে গোঁফা মানে কি??”
—” এটা আপনার নিক নেম।”
বলেই ওয়াসেনাত খিলখিল করে হেসে উঠে।অরিত্রান তাকিয়ে দেখে।আবার চোখ সরিয়ে নেয়।রিমনের এখন এই মাঠে বসেই কেঁদে দিতে ইচ্ছে করছে।একদম হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।শেষে কিনা গোঁফাও হতে হলো??
রিমন গায়েবি আওয়াজ শুনে,
—” এটা তো মাত্র শুরু।আগে আগে দেখো হোতা হে কেয়া গোঁফা মাহির।”
.
.
#চলবে___________________