নীরবতা

নীরবতা !! Part- 10

বাড়ি ছেড়ে হলে ফেরার সময় হয়ে এসেছে মুবিনের। আবারও তার সেই একঘেয়ে জীবন শুরু। পড়া পড়া আর পড়া, যেখানে নেই একদন্ডের জন্য স্বস্তি। না জানি কবে মুক্তি মেলবে এর হাত থেকে! এদিকে চৈতালি মেয়েটাও এক দৃঢ় ভালোবাসার জালে জড়িয়ে ফেলেছে তাকে। খুব বেশি কষ্ট হয় আজকাল তাকে ছাড়া থাকতে। মন চায় সব ছেড়েছুড়ে গ্রামে এসে চৈতালির আশেপাশে পরে থাকতে। তাকে নিজের করে নিতে। তবে নানান বাঁধার কারণে তা আর হয়ে উঠে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাগ গোছানোয় মন দিল মুবিন। বিকেল পাঁচটায় তার ট্রেন। এখন বাজে বেলা বারোটা। বেশি একটা সময় নেই মাঝে…
-“আমি সাহায্য করবো?”
চৈতালির প্রশ্নে চোখ তুলে তার দিকে তাকালো মুবিন। মৃদু হেসে বললো,
-“এসো…”
মুবিনের একটি শার্ট হাতে তুলে নিল চৈতালি। তা ভাজ করতে করতে অভিমানী গলায় বললো,
-“আজ না গেলে হয় না?”
-“অনেক দিন তো হলো এসেছি..”
গলা খানিকটা ধরে এল চৈতালির। ভারী স্বরে সে বললো,
-“কষ্ট হয় আমার..”
-“তোমার এইচএসসির তো আর বেশিদিন নেই। ভালো করে পরীক্ষা দিয়ে কোচিংয়ের জন্য রাজশাহী চলে আসবে৷ চাচার সঙ্গেও এই বিষয়ে আমি কথা বলে রেখেছি।”
-“কোচিং তো মাত্র কয়েকমাসের.. তারপর?”
-“তারপর তোমাকে কোনো না কোনোভাবে আমার কাছেই রেখে দেবো। তোমার এনিয়ে টেনশন করতে হবে না।”
চোখ ভর্তি জল নিয়ে বিছানায় বসে পড়লো চৈতালি। এই একটি দিন কেন আসে তার জীবনে?
-“কাঁদে না চৈতালি। দেখি উঠে দাঁড়াও।”
একরকম জোর করেই চৈতালিকে টেনে উঠালো মুবিন। তারপর নিজের বুকে চেপে বললো,
-“যাবার দিন কান্নাকাটি না করলে হয় না?”
সে কথার জবাব না দিয়ে ভেজা গলায় চৈতালি বললো,
-“আমাদের বিয়ে? তা কী শুধু আমাদের ভাবনাতেই রয়ে যাবে?”
বুকচিরে বেড়িয়ে আসা একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো মুবিন। পঁচিশ বছরের এই জীবনে তার বাবাকে চিনতে আর বাকি নেই তার। চৈতালিকে সহজভাবে মেনে নেবেন না তিনি। নানান অযুহাত দেখাবে, নানান কথা শোনাবে। তবে সেও কম যায় না! বাবা না মানলেও কি করে চৈতালিকে নিজের করে পেতে হয় তাও জানা রয়েছে তার। ম্লান হেসে চৈতালির চুলে ঠোঁট ডোবালো মুবিন। অস্পষ্ট গলায় বললো,
-“উহু.. সেটাও হবে। শুধু একটু বিশ্বাস রাখো আমার উপর।”
মুবিনের ঘরে ঢুকতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো অনা। বিস্ময়ে চোখজোড়া প্রশস্ত হয়ে এল তার। এসব কী দেখছে সে? চৈতালি আর ভাই একে অপরকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে রেখেছে? ঠিক কী ঘটছে এখানে? তাছাড়া এমন এক পরিস্থিতিতে ঠিক কী করা উচিৎ তার? ভেবে পেল না অনা। কয়েকদন্ড চুপচাপ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার পর একরাশ অস্বস্তি নিয়ে নিঃশব্দে সে বেরিয়ে পড়লো সে ঘর ছেড়ে।
দুপুরে ভাত ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো মেসবাহ। কাল থেকে আবারও ব্যস্ত জীবন শুরু হয়ে যাবে তার। যাতে দুপুরে ঘুম তো দূরের কথা চোখ বোজার সময়টুকুও নেই! তবে সবকিছুর মাঝে উল্লাসীকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে তার। মেয়েটি সবটা সামলে সারাদিন একা বাসায় থাকতে পারবে তো?
-“ঘুমিয়েছেন?”
চোখ মেলে মেঝেতে গুটিসুটি মেরে বসা উল্লাসীকে একনজর দেখে আবারও চোখ বুজলো মেসবাহ। অস্পষ্ট গলায় বললো,
-“কিছু বলবে?”
-“হ্যাঁ.. কিছু না অনেক কিছু।”
-“শুরু করো।”
-“আজ আপনি বাইরে যাবার পর ওই মহিলা এসেছিল?”
-“কোন মহিলা?”
-“ওই যে কাল এসেছিল যে!”
চোখ মেলে উল্লাসীর দিকে তাকালো মেসবাহ। ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“তুমি দরজা খুলেছিলে?”
দু’হাতে কান চেপে ধরলো উল্লাসী। নরম গলায় বললো,
-“ভুল করে ফেলেছিলাম! উনি আমাকে নানান উল্টাপাল্টা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছিলো। তবে সেসবের উত্তর তো আপনি আমায় শিখিয়ে দেন নি।”
-“শিখিয়ে দেইনি বলে সত্যিটাই বলে দিয়েছো?”
-“উহু.. কিচ্ছু বলিনি। উনার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরেই বলেছি জানিনা জানিনা জানিনা।”
উল্লাসীর কথা বোধগম্য হলো না মেসবাহর। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে চাইতেই ধীরেসুস্থে তাকে সবকিছু গুছিয়ে বললো উল্লাসী। সব শুনে ঠোঁটে ফুটলো মেসবাহর একরাশ হাসি। উচ্চস্বরে খানিক্ষন হেসে সে বলিলো,
-“গুড জব। এবার কান থেকে হাত নামাও।”
-“মাফ করে দিয়েছেন আমায়?”
-“হ্যাঁ, তবে মুন্নি ভাবি যে মানুষ! দেখবে কালই আবার এসে হাজির হবে! তবে আজকের করা ভুল কাল রিপিট করা যাবে না। হাজার কলিংবেল বাজলেও তুমি কী করবে?”
-“দরজা খুলবো না।”
-“মনে থাকবে তো?”
-“থাকবে..”
স্বস্থির শ্বাস ছেড়ে আবারও চোখ বুজলো মেসবাহ। মেয়েটির মাঝে বেশ চঞ্চলতা রয়েছে। তবে তা প্রকাশে কিছু দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে সে। ভয়, সংকোচ, জড়তা তাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে চেপে ধরে রাখছে। তাহলে কী কেউ ভুলভাল কথা তার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে? যার দরুন প্রভাবিত হয়ে নিজেকে প্রকাশ করতে চেয়েও পারছে না সে? হতেই পারে। উল্লাসীকে সে একয়দিনে যতটুকু চিনেছে তাতে নিজস্বতা বলতে কিছু নেই তার ভেতর। এমতবস্থায় কারো কথায় প্রভাবিত হয়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখা অসম্ভব কিছু নয়।
-“আপনি আজও আমায় একা ফেলে পাশের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়েছিলেন.. তাই না?”
-“না, আজও ফজরের সময় উঠে তারপর ওঘরে গিয়েছি।”
-“সুহার কসম?”
আবারও চোখ মেললো মেসবাহ। হাই তুলে বললো,
-“সুহাটা যেনো কে?”
-“আমার বোন…”
-“বয়স কত ওর?”
-“পাঁচ বছর..”
-“তারপরই তোমার ভাই। তাই না?”
চোখমুখ শক্ত হয়ে এল উল্লাসীর। হালকা মাথা নেড়ে সে উঠে পড়লো মেঝে থেকে। সুহার জন্মের সময়ই মারা যায় মা। পিচ্চি সেই সুহাকে দেখাশোনার জন্যই বাবা বিয়ে করে আনেন ছোটমাকে। তার ঠিক এক পছর পরই জন্ম হয় খোকোনের। সেই সাথে সুহার সকল আদরযত্ন স্থানান্তর হয় খোকনে। মাঝেমাঝে মন হয়, ভালোবাসাও বুঝি স্থানান্তর হবার জিনিস? তবে পরমুহূর্তেই নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। মায়ের জায়গায় তো ছোটমা এসেছে বেশ ক’বছর হলো! স্বয়ং মানুষই যেখানে স্থানান্তর হয় সেখানে ভালোবাসা আর কি জিনিস!
রাতে দ্রুত খাওয়াদাওয়ার কাজ সেরে উল্লাসীকে ঘুমের জন্য তাড়া দিতে শুরু করলো মেসবাহ। আগামীকাল যেহেতু সকাল সকাল উঠেই নিজের কর্মক্ষেত্রে ছুটতে হবে সেহেতু বেলা করে ঘুমোনোর কোনো সুযোগ নেই। আবার উল্লাসী না ঘুমোনোর আগে ওঘরে গিয়ে নিজের শরীর মেলে দেবারও কোনো উপায় নেই। তাই সব ভেবে রাত দশটার মাঝেই উল্লাসীকে ঘুমোনোর আদেশ দিয়ে শেক্সপিয়ারের দ্য টেমপেস্ট বই খুলে বসলো মেসবাহ। ঘন্টাখানেক সময় নিয়ে কিছু পাতা পড়ে উঠে পড়লো সে। ঘুমের দরুন গভীর নিঃশ্বাস ফেলছে উল্লাসী। একেকটি নিঃশ্বাস তার ঠোঁট ছুঁয়ে পুরো ঘরে মিশে যাচ্ছে। যা হয়তো একসময় তার নিঃশ্বাসের সঙ্গেও মিলিত হচ্ছে! অদ্ভুত এই ভাবনাকে আর এগুতে দিল না মেসবাহ। দ্রুত গতিতে পা বাড়ালো পাশের ঘরের দিকে।
গভীর ঘুমের তলিয়ে গিয়েছিল মেসবাহ। হঠাৎ শরীরের ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙে গেল তার। চোখমুখ কুঁচকে উঠে বসতে বসতে বললো,
-“কী হয়েছে? কাঁদছো কেনো?”
-“আমাকে একা ওঘরে ফেলে আপনি এঘরে এসে কেনো ঘুমিয়েছেন?”
-“তাতেই কাঁদতে হবে?”
-“জানি না। আমাকে ওরা ধরে নিয়ে যাচ্ছিল! আপনি কেনো এসে এঘরে ঘুমিয়েছিলেন?”
কিছু বুঝলো না মেসবাহ। হাই তুলে দেয়াল ঘড়ির দিকে নজর দিতেই সে দেখলো ঘড়িতে বাজছে রাত একটা। অর্থাৎ উল্লাসীকে ফেলে এঘরে আসার দু’ঘন্টাও হয়নি। অথচ এর মাঝেই উঠে পড়েছে সে! মেজাজ চরম খারাপ হয়ে এল তার। তবুও নিজেকে সে যথাসাধ্য সামলে নিয়ে বললো,
-“অবুঝের মতো করোনা উল্লাসী। ওঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। কাল আবার আমার সকাল সকাল উঠতে হবে।”
কান্নার বেগ বাড়িয়ে দিল উল্লাসী। উনি কেনো বোঝে না একা ঘরে শুয়ে ঠিক কতটা ভয় পায় সে! নানানরকম বাজে স্বপ্নও দেখে। তখন পাশে একজনকে না পেলে আতংকে দিশেহারা হয়ে পড়ে তার অবুঝ মন। এসব কেনো বোঝেন না উনি?
-“কান্না থামাও, উল্লাসী। এত রাতে এভাবে কাঁদলে আশেপাশের মানুষেরা কি ভাববে! কান্না থামাও বলছি।”
মেসবাহর ধমকে কান্নার বেগ খানিকটা কমালো উল্লাসী। মেসবাহর দু’হাত ধরে সে আকুল গলায় বললো,
-“আমি একা ওঘরে থাকবো না।”
-“তোমার থাকতে হবে। এখন কী আমার ঘুম বাদ দিয়ে তোমাকে পাহারা দিতে জেগে বসে থাকবো আমি? এসবের চাকরি নিয়েছি আমি? আমার নিজের জীবন নেই? কাজকর্ম নেই? সব ফেলে কী এখন তোমায় নিয়ে পরে থাকতে হবে আমার?”
ফোঁপাতে ফোপাঁতে উল্লাসী জবাব দিল,
-“আমি যাবো না।”
-“তুমি যাবে। এবং এক্ষুনি যাবে।”
বলেই উল্লাসীর হাত ধরে বিছানা ছেড়ে নামলো মেসবাহ। তারপর দ্রুত পায়ে তাকে টানতে টানতে নিয়ে এলো পাশের ঘরে। এক ধাক্কায় বিছানার মাঝ বরাবর উল্লাসীকে ফেলে ক্রোধে বিস্ফোরিত গলায় বললো,
-“একটা শব্দ যেনো না শুনি। চুপচাপ ঘুমোও। নয়তো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”
এরপর আর অপেক্ষা না করে উল্লাসীকে একা ঘরে রেখে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো মেসবাহ। রাগ হচ্ছে তার। রাগের চোটে পুরো শরীর, কপালের রগ কেঁপে কেঁপে উঠছে।
(চলবে)