তোমারই আছি আমি

তোমারই আছি আমি !! Part- 28

মেধা: বেবিন খান ছিলেন ঐসবকিছুর মাস্টারমাইন্ড। আমরা দুইজনে তো পুতুলমাত্র তার কথার। আমি আকাশকে ভালবাসতাম। সারার প্রতি ওর দুর্বলতা, যত্ন সারাকে আগলে রাখা আমাকে হিংস্র করে তুলছিল। কিন্তু ওদের বিচ্ছিন্ন করে আকাশের কাছে পৌঁছানোর আমার কোনপ্রকার ইচ্ছা ছিল না। বেবিন খান বারবার সারা আর আকাশকে দেখিয়ে আমাকে জেলাস ফিল করাতো। নিবিড়কেও উনিই উৎসাহিত করেন এইসব করার জন্য। নাহলে নিবিড়-ও সারাকে ভালবাসত মনে মনে ঠিকই কিন্তু এরপর অদ্বিতীকে নিয়ে ও ভালোই ছিলো। বেবিন খান লোকটা ওর মাথায় প্রতিশোধ রাগ ঘৃণা ঢুকিয়ে দিয়েছে। এমনকি সেই যে সারাদের স্কুল থেকে পিকনিক গিয়েছিল সেইখানেও বেবিন খানের প্ল্যান অনুযায়ী ওকে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে ওর বিবস্ত্র শরীর নিয়ে জঘন্য ছবিগুলো ওঠায় নিবিড়। ছিঃ ছিঃ আমরা ওনার কথায় কি পরিমাণ ভুল কাজ করেছি!
মেধার কোনো কথাই আকাশের কানে যেন প্রবেশ করছিল না। সে বিস্ফোরিত চোখে নিচের দিকে তাকিয়ে আচমকাই হাটু ভেঙে মাটিতে বসে যায়। যেন কোনকিছু ভাবা বা চিন্তা করার অবস্থাতেই নেই সে।
মেধা ধীরপায়ে আকাশের কাছে আগায়। আলতোভাবে হাত রাখে ওর কাধে,
: আকাশ আমাকে ভাল না বেসেও শিখিয়েছে ভালবাসা কেমন হয়। দূরে থেকেও কিভাবে অন্তরের সবটুকু দিয়ে অপরজনের খেয়াল রাখা যায়। হাজার দিনের না দেখা হয়াতেও কিভাবে চোখের সামনে অপরজনের প্রতিচ্ছবি আঁকা যায়। কিভাবে ভালবাসার চেয়েও ভালবাসার মানুষের ভালো থাকাকে বেশি ভালবাসা যায়। ভালবাসার মানে এখন আমি বুঝি আকাশ। এটা মানে জোর করে আদায় করা নয়; বরং নিঃশর্তভাবে অপরজনের সুখ প্রার্থনা করা। ভালবাসা হিংস্র করে না; উদার করে মানুষকে। আমি এখন থেকে সেই ভালবাসায় বলীয়ান হবো; যেখানে কোন হিংস্রতা নেই, পাপ নেই কোন। আমি ক্ষমা চাইব না তোমার কাছে; কারণ আমি চাই না আমাকে তুমি কোনদিন ক্ষমা করো। আমাদের কারণে তুমি সারাকে অনেক কষ্ট দিয়েছ। অনেক ভুল বুঝেছ। যা কষ্ট এতবছর ওকে দিয়েছ হয়তো সারাজীবন ভালবাসার প্রলেপ দিয়েও মুছবে না। আর যাদের জন্য ওকে কষ্ট দিয়েছ তাদের ক্ষমা করা অর্থ ওকে দ্বিতীয়বার অপমান করা।
আকাশ চুপচাপ মেধার কথাগুলো শোনে। ধীরস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকায় ওর দিকে। তারপর ঘরভর্তি মানুষকে নিমেষে অবাক করে দিয়ে প্রচণ্ড জোরে চড় লাগায় ওর গালে। রাগে জ্বলজ্বল করছে চোখজোড়া। কপালের শিরা-উপশিরাগুলো কম্পিত হয় রাগের প্রকোপে। হাতদুটো বারবার মুষ্টিবদ্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে জোর নিঃশ্বাসের বেগ উত্তোরত্তর হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং অল্প কয়েক মুহুর্তেই পুলিশের হেফাজতে হাতকড়া পড়া নিবিড়ের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে সেই রুদ্রমূর্তি নিয়ে। না, নিবিড়ের শাস্তির ভার ও কাউকে দেবে না। নিজে হাতে শাস্তি দিবে নিবিড়কে। নিবিড়ের প্রাপ্য ও নিজে বুঝিয়ে দেবে।
পুলিশ: স‍্যার,,স‍্যার প্লিজ মারবেন না। আর মারবেন না একে। এটা কিন্তু আইন বিরোধী। তারোপর সে একজন দাগী ক্রিমিনাল। ড্রাগ ডিলিং করত। ওর মুখ থেকে অনেক ইনফরমেশন চাই আমাদের।
আকাশ: আপনাদের ওর মুখ থেকে অনেক ইনফরমেশন লাগবে তাই না?
: জ্বি স‍্যার।
: তারজন্য আপনারা কি করবেন?
: রিমান্ডে নেব।
: ওর রিমান্ড প্রতিদিন হবে। সকাল বিকাল সন্ধ্যা। আর রিমান্ডে ওর গায়ে কেউ হাত তুলবেন না। নোবডি। ওর সব শাস্তি আমি নিজে দেব,,,আমি নিজে?
: স‍্যার,, কি বলছেন এইসব? এগুলো সম্ভব নয় কখনো। আইন আপনার কথায় চলবে নাকি?
: ওকে আইন আমার কথায় না’ই চলতে পারে। বাট আপনার পুরো থানার ট্রান্সফার আমার কথাতে ঠিকই চলবে।
: স‍রি স‍্যার,, এক্সট্রেইমলি ইউ আর স‍্যরি। আপনার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। অনেক বছর এই সিক্রেট ক্রিমিনাল কে ধরার ট্রাই করেছি। এট লাস্ট আপনার সাহায্যে আমরা তা পেরেছি। এই ক্রিমিনালের বিষয়ে যা আপনি বলবেন তাই হবে স‍্যার।
: থ‍্যাংক ইউ।
খবর পেয়ে ফারিহা ও আজমী তাদের বাসা থেকে কাউকে না কাউকে সাথে নিয়ে ছুটে এসেছ। বুদ্ধিমতী ফারিহা সব ঘটনা শুনেই প্রথম খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন করল যা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল সবাই।
: আমাদের ভার্সিটির প্রথম দিন যেইদিন আকাশভাইয়া কে বহুবছর পরে দেখি আমরা; সেইদিন আকাশভাইয়া সারাকে বন্ধ একটা ঘরে আটক রেখেছিল- সারা আমাকে বলেছে ঐদিন সে হঠাৎ নিবিড়কে দেখতে পায়। সে সারাকে বাঁচাতে এসেছিল।। এবং সে দেখতে ছিল হুবহু নিবিড়ের কার্বন কপি। আর এই ছেলের সাথে নিবিড়ের চেহারার আদৌ কোন মিল- ই নেই। তাহলে এ নিবিড় হলে ঐ ছেলেটি কে?
মেধা: আমি বলছি। ঐ ছেলেটা ছিল আমাদের-ই লোক। যাকে সার্জারি করিয়ে হুবহু নিবিড়ের চেহারা বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এবং বারবার আকাশের সামনে উপস্থিত করা হচ্ছিল যাতে আকাশের সম্পূর্ণ মনোযোগ ওকে ঘিরে থাকে। আসল নিবিড় অর্থাৎ তুরাগকে ও সন্দেহ না করে। এবং এ কারনেই আকাশ ঐ ছেলেটিকে আটকে রেখেছিল যাতে সারার কোন ক্ষতির সম্ভাবনা না হয়। এবং ঐ ছেলেই আকাশের প্রেসারে পড়ে আমাদের প্ল‍্যানের বিষয়ে ওকে জানিয়েছে।।
ফারিহা: সবাই শুনলেন তো? কত বড় গেইম চলছিল এতোদিন? আমার বোনটা কিন্তু এই গেমের আগেপিছে কোথাও ছিল না। ওর কোনোই দোষ ছিল না এখানে। ও তো জানত-ই না কত বড় একটা ষড়যন্ত্র চলছে সবার আড়ালে। আর আপনি? আকাশভাইয়া ছিঃ এতো ভালবাসেন যাকে তাকে এইটুকু চেনেন নি? অন‍্যের লেখা একটা ডায়েরী আপনার কাছে আমার সারার চেয়ে অনেক বড় হয়ে গেল? হ‍্যা এটা সত্যি যেইভাবে নিবিড়রা সম্পূর্ণ ঘটনা উপস্থাপন করেছিল তাতে ভুল বোঝা খুব স্বাভাবিক। ঐ কথাগুলো পড়ে আপনার কতটা কষ্ট লেগেছিল তা আমি বুঝতে পারি। ঐসময় হয়তো উত্তেজনায় আপনার মাথা ঠিক ছিল না। কিন্তু সাতটা বছর আপনি আপনার বৌকে একটা মিথ্যা ডায়েরীর জন্য কষ্ট দিলেন? সাত বছরে একদিনো মনে হলো না নিবিড়ের কথাগুলোও মিথ্যা হতে পারে,,সারা আপনার সাথে প্রতারনা করতে পারে না। আমার মনে হয় আপনি সারাকে কখনো কোনদিন চিনতে পারেন নি। স‍্যরি চিনতে পারেন নি না,,,আপনি ওকে কখনো ভালোইবাসেন নি। তারচেয়ে বড় কথা আপনি আমার সারাকে ডিসার্ভ করেন না। আপনার কোন যোগ্যতা নেই ওকে পাওয়ার।
কথা শেষ হয়ার আগেই আকাশকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না।
—————————————————————————-
রাস্তা দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে গাড়ি চালিয়ে এগোচ্ছে আকাশ। গাড়ির গতিবেগ শুধু বাবিয়েই দিচ্ছে উত্তোরত্তর। যদিও রাস্তা গভীর রাতের। আশেপাশে কোন গাড়ি নেই। তবুও এই রাস্তাটাকে দীর্ঘ মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে রাস্তাটা কিছুতেই ফুরাচ্ছে না। আকাশ আর পারছে না। শরীর কাঁপছে তার। বুকের খাচাটায় তোলপাড় শুরু হয়ে গিয়েছে। আর কতক্ষণ? আর কত সময় ধৈর্য ধরতে হবে? ধৈর্য্য কিছুতেই কুলাচ্ছে না তার। ইচ্ছা করছে এই মুহুর্তেই লুটিয়ে যাবে প্রেয়সীর পায়ে। তার অপরাধের জন্য শাস্তি চাইবে। শাস্তির জন্য এত তীব্র অপেক্ষা কেউ করে না। কিন্তু আকাশ করছে। কারন সে শাস্তি চায়। সে চায় তার প্রেয়সীর মনের জ্বালা মিটুক। তার ওপর হওয়া সমস্ত অপরাধের উসুল তুলুক সে।
অত বড় খালি বাড়িটাতে সারাকে একা রেখে গিয়েছে। বাড়িতে ঢুকেই সোজা ছুটে গেল নিচতলার ঘুপচি স্টোররুমটা তে। চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরে যাচ্ছে। পুরুষের কান্না শোভা পায় না। কিন্তু আকাশ যে পারছে না নিজেকে ধরে রাখতে। যাকে রানীর মতো মুকুট বানিয়ে মাথায় করে রাখা উচিত তাকে দাসীর মতো পায়ের কাছে ফেলে রেখেছিল।
স্টোররুমের দরজাটা জোর ধাক্কায় খুলতেই খালি ঘরটা ছাড়া আকাশ আর কিছুই দেখতে পেল না। সেখানে কেউ ছিল না। এমনকি খান প‍্যালেসের আনাচে কানাচে পেছনের বাগান, লেক, গেস্টহাউস উদভ্রান্তের মতো জায়গায় জায়গায় দৌড়েও কোথায় সারাকে দেখল না আকাশ। কিভাবে সম্ভব? আকাশ যাওয়ার সময় তালা দিয়েছিল মেইনগেটে। আবার দৌড়ে ফিরে গেল ঐ স্টোররুমে।
সেখানে গিয়ে দেখল বিছানার ওপর পড়ে আছে নিবিড়ের ডায়েরি। পাশেই টেবিলে ভাঁজ করা একটা কাগজ। আকাশ ছুটে গিয়ে কাগজটা খোলে,
“আকাশভাইয়া,
আমি যে কতটা খারাপ এতদিন জানতাম না। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে জানতে পেরেছি। ঐ ডায়েরীটা পড়ে। সত্যিই এতো পাপ কাজ জমা ছিল আমার!! আজ বুঝতে পারছি এত খারাপ কাজ করার শাস্তি হিসেবেই আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলে, মেধার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিলে, তারপর আবার আমাকেই বিয়ে করেছিলে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য। শুধুই প্রতিশোধ। তোমাকে এত বড় ধোকা দিয়েছি বলেই প্রতিরাতে পশুর মতো আমার শরীরটাকে ছিঁড়ে খেয়ে মনের জ্বালা মেটাও। এত খারাপ বৌ বলেই হয়তো বৌ পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে,,,তাই না? তাই তো তোমরা বাইরের সবার কাছে বলেছ আমি তোমাদের কাজের মেয়ে। চিন্তা করো না। তোমাকে আর লজ্জা দিবো না। আমি নাহয় তোমার স্ত্রী হতে পারি নি, তুমি তো আমার স্বামী। কোন স্ত্রী কি চায় তার স্বামী তার কারনে লজ্জায় পড়ুক? বিশ্বাস করো আকাশভাইয়া, আগে যদি বলতে এত খারাপ আমি,, তোমার এত ভালবাসা কে অবহেলা করেছি,,,তোমার পেছনে তোমার-ই ছোটভাইয়ের মতো একজনের সঙ্গে বিছানায় শুয়েছি পর্যন্ত এগুলো আগে যদি জানতাম না কোনদিন মুখ দেখাতাম না তোমাকে। থাকতাম-ও না তোমার সঙ্গে। আসলে জানতাম না তো আমি এত খারাপ তাই বিরক্ত করতাম তোমায়। বারবার কুকুর-বিড়ালের মতো পায়ে ঠেলে সরিয়ে দিলেও বেহায়ার মতো তোমার কাছে গিয়েই ঘুরঘুর করতাম। এতটা বেহায়া বোধহয় মানুষ বাদ দাও, পশুও হয় না। অবশ্য আমি তো পশুর চেয়েও নিম্নস্তরের। নাহলে এত খারাপ কাজ কিভাবে করেছি বলো? এই চিঠিটা যখন তুমি হাতে নিয়ে পড়ছ জানলে ভীষণ খুশি হবে আমি আর তোমার আশেপাশে কোথাও নেই। খুব খুশি, না ? আমি জানি তো ভীষণ খুশি হয়েছ তুমি? হয়তো একটু দুঃখ-ও লাগবে। হয়তো আর কাউকে শাস্তি দিতে পারবে না। ইচ্ছামতো মারধর করে রাগ মেটানোর মতো কেউ সামনে থাকবে না। তবে চিন্তা করো না জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর শাস্তিটা ঐ ডায়েরী পড়ে আমি পেয়ে গিয়েছি। যেটা তোমার মারের চেয়ে হাজার গুন ভয়াবহ। তোমার মারের দাগগুলো হয়তো একসময় মুছে যাবে,,,কিন্তু অবিশ্বাসের যেই দাগটা মনে দিয়েছ ঐটা কোনদিন চাইলেও মুছতে পারব না। প্লিজ আকাশভাইয়া একটু খুশি হও। আমি চলে গিয়েছি। অনেক দূরে চলে গিয়েছি। এইবার দয়া করে একটু খুশি হও। তুমি আমাকে সারাজীবন কতকিছু দিয়েছ,,,আমি কোনদিন তোমাকে কিছু দিতে পারি নি। এই মুক্তিটাই নাহয় আমার তরফ থেকে তোমার জন্য উপহার।”
চলবে