তোমারই আছি আমি

তোমারই আছি আমি !! Part- 13

আকাশ আর মেধার বিয়ের কার্ড দেখে সারা একদম চুপ হয়ে গেল। কার্ড হাতে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। যেন নড়াচড়া করার কোন শক্তি নেই। জমে পাথর হয়ে গেছে।
সায়ান বারবার ডাকতে লাগল, এই সারা,,,বোনু,,,কি হয়েছে। কি আছে এতে ? সারা–
( সারাকে ধরে জোরে ঝাকাচ্ছে আর ডাকছে)
সায়ানের ডাকে সারা ওর দিকে তাকায়। একদম শূন্য দৃষ্টি। তারপর সায়ানের হাতে আকাশের বিয়ের কার্ড দিয়ে নিজের রুমের দিকে রওনা দেয়। এমনভাবে যাচ্ছে যেন ওর পায়ে হাঁটার শক্তি নেই। পা দুটো টেনে টেনে নেশাগ্রোস্তদের মতো সারা নিজের রুমে গেল। তারপর খট করে বন্ধ করে দিল ঘরের দরজাটা।
কার্ডে মেধা ও আকাশের একসপ্তাহ পর বিয়ে। সায়ান স্তব্ধ হয়ে গেল। আকাশের এত্ত জেদ! সাতটা বছর ওর বোনটাকে যন্ত্রণা দিয়েছে তাও ওর শাস্তি দেওয়া শেষ হয় নি ওর। হ‍্যা,,যদি ওর বোন ভুল করে থাকে সাত বছরে আকাশ তারচেয়ে হাজারটা বেশি ভুল করেছে। আকাশের কি নিজের দোষগুলো চোখে পড়ে না? নাকি সারার একটা ভুলের কাছে ওর সব অন‍্যায় মাফ! আর যে ভালবাসায় অপরজনকে ক্ষমাই করা যায় না,,,সেটা কেমন ভালোবাসা। নাকি আকাশ আসলেও সারাকে ভুলে গেছে,,,সত্যিই এতবছরে মেধার সঙ্গে সত‍্যিকারের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে ওর? এটা যদি সত্যি হয়,,,সায়ান শেষ করে দেবে আকাশকে। এমন নরক করবে আকাশের জীবনটা যেখানে সুখ-শান্তি প্রবেশ করতেও ভয় পাবে। এতবছর আকাশ না সারার থেকে দূরে গিয়ে সারাকে একেবারে মুক্তি দিয়েছে,,না সারার কাছে ফিরে এসেছে। আর সায়ান শুরু থেকে শেষ সবটা জেনেও শুধু আকাশের কথা রাখতে কাউকে কিচ্ছু বলে নি বরং আকাশের সাপোর্ট করেছে। আর না,,এবার আকাশকে বলতেই হবে সে কি চায়।
আকাশের ওপর রাগে-ক্ষোভে সায়ান বারকয়েক দেয়ালে আঘাত করল। হঠাৎ ওর চোখ খেল ফ্লোরের কোনায় পড়ে থাকা খামের ওপর। খামটা সারা’র হাতে ছিল। যাওয়ার সময় পড়ে যায়। সায়ান ধীরে ধীরে কুড়িয়ে তুলল খামটা।
খামের মুখ খুলে দেখা গেল একটা চিঠি। সায়ান পড়তে শুরু করল। পড়তে পড়তে ওর চোখমুখের অবস্থা বদলে গেল। অর্ধেক চিঠি পড়তে না পড়তেই ও চিঠিসহ সারার রুমে ছুটে গেল।
সারা বিছানায় উপুড় হয়ে বালিশে মুখ ঢেকে আছে। বারবার দমকে দমকে কেঁপে উঠছে ওর শরীর। কাঁদছে যে তা বোঝাই যাচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে,,সত্যিই খুব কষ্ট হচ্ছে। আকাশভাইয়া বিয়ে করবে। ওর সামনে আকাশভাইয়া অন‍্যকারো স্বামী হবে। তাদের দুজনের একটা সংসার থাকবে,, একটাসময় পর ছেলেমেয়ে হবে। অথচ আকাশ আর তার ছোট্ট সংসারের কত স্বপ্ন ছিল সারার,,বাচ্চা ছেলে না মেয়ে নিয়ে আকাশের সঙ্গে ঝগড়া বাচ্চাদের নাম ঠিক করা নিয়ে তর্কাতর্কি- এগুলো কিভাবে ভুলে যাবে? কিন্তু না,,ও আর আকাশের কাছে নিজেকে ছোট করবে না। আকাশ যা নিয়ে ভালো থাকে তাই করুক। ওর ভালোবাসা থাকুক ওর কাছে। আকাশ হয়তো ওর ভাগ‍্যেই নেই।
:সারা,,,বোনু দরজা খোল্। কতক্ষণ থেকে ডাকছি আমি! দরজাটা একটু খোল। কথা আছে তোর সাথে।
ভাইয়া অনেকক্ষণ বাইরে দাঁড়ানো। সারা চোখের পানি মুছে খুব স্বাভাবিক ভাবে গিয়ে দরজা খুলে দিল। ও চায় না ওর কান্না আর কেউ দেখুক। কেউ জানুক এত অপমানের পরেও ও আকাশের জন্য কাঁদে।
সায়ান: বোনু,,চোখদুটো তো এক্কেবারে লাল হয়ে গেছে। কি করছিলি? কাঁদছিলি?
সারা: না। কাঁদব কেন? কাঁদার মতো কি হয়েছে।
সায়ান: বোনু আমরা চোখের সামনে যা দেখি তা অনেকসময় সত্যি না। দৃষ্টির বাহিরে এমন অনেক কথা থাকে যা বুঝে নিতে হয়। সারা লক্ষী বোনু,,,চিঠিটা একবার পড়। আমি জানি তোর মনের অবস্থা তবু একবার শুধু পড়। দ‍্যাখ,,, তোদের দুজনকেই বুঝতে হবে। একটা ভুল হয়ে গেলে তোরা কেউ ভালো থাকবি না।
সারা বেশ কিছুক্ষণ সায়ানের হাতের চিঠিটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কি আছে এতে?
সারা সায়ানের হাত থেকে চিঠি নেয় এবং একটানে ছিঁড়ে ফেলে। তারপর কুচি কুচি করে ফেলে দেয়।
সায়ান: সারা এটা কি করলি তুই?
সারা: এরপর থেকে ঐ লোকটা দূরে থাক, ঐ লোকটার সংস্পর্শের কোনো জিনিস আমার কাছে আনবে না। আমি তাকে নিয়ে কোনো কথা শুনতে বা জানতে কোনটাই চাই না। সে এই মুহুর্ত থেকে আমার কাছে মৃত। একটা কথা তুই ঠিকই বলেছিস ভাইয়া,আমরা চোখের সামনে যা দেখি তা অনেকসময় সত্যি না। একটাসময় আকাশভাইয়ার ভালবাসা দেখে আমি ভাবতাম সত্যি আমি এত ভাগ‍্যবতী। মানুষটা এতো বেশি ভাবে আমার জন্য! কিন্তু আসলে তো এগুলো সব-ই ভুল। সাজানো মিথ্যা পুতুলখেলা।
সায়ান: সারা আকাশ কিন্তু তোকে বিয়ে করেছে।
সারা(দুই হাতে কাধ চেপে): চুপ করো। বলবে না ঐ খেলনা বিয়ের কথা! ওটাকে বিয়ে বলা বিয়ের অসম্মান করা। ওর সঙ্গে আমার কোন বিয়ে হয় নি।
সায়ান: না সারা। তোরা পবিত্র বন্ধনে দুজন আবদ্ধ হয়েছিস। তোদের আংটি পড়ানো হয়েছে। কালিমা পড়ে কাবিননামায় স্বাক্ষর রেখে তোরা পরস্পরের হয়েছিলি দুই পরিবারের সামনে। শুধুমাত্র তোর বয়স কম বলে আইনিভাবে বিয়ে হয় নি। কিন্তু তাতে কি? আকাশ কিন্তু তোকে ছাড়ে নি। সুতরাং তুই এখনো ওর বৌ। তুই না চাইলে এই বিয়েই হবে না।
সারা: ভাইয়া প্লিজ চুপ করবে‌। এই কথাগুলো কেন বলছ? আমি কি এতোটাই সস্তা,,, আমাকে রেখে সে বিয়ে করবে আর আমি নিজের মান-সম্মান মিশিয়ে তাকে আটকাবো। তুমি বলবে অধিকার আছে আমার। আমার তার কোন অধিকার চাই না। ঐরকম লোকের থেকে মুক্তি পাওয়াই ভালো। আমি বেঁচে গেছি। আমার মনে তার জন্য এখন কোন জায়গা নেই। ও না,,জায়গা অবশ্য আছে। সেটা হচ্ছে ঘৃনার জায়গা। তাকে আমি ঘেন্না করি আর মনে করি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ। তুই প্লিজ যা ভাইয়া,,আমার ভালো লাগছে না। যাআআ।
সায়ানকে ঠেলেঠুলে বের করে আবার দরজা লাগিয়ে দেয়। তারপর সেই আগের মতোই কাঁদতে থাকে। চিৎকার করে অথচ নিঃশব্দে কাঁদছে। নাহয় কষ্টগুলো কাউকে দেখাবে না,,,তাই বলে তো কষ্ট কমে যাচ্ছে না।
—————————————————————————–
মেধার বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। এ্যনগেইজমেন্ট , মেহেন্দি, সংগীত, হলুদ। বিশাল আয়োজনের বিয়ে। কিন্তু বিয়ের প্রত‍্যেকটি অনুষ্ঠানেই গন্ডগোল।
এ্যনগেইজমেন্টের দিন। মেধা সাজার জন্য রুমে যেতেই ভেসে এলো তীব্র চিৎকার।
মেধার বাড়িতে মেধার রাগ আর জেদের ভয়ে সবাই তটস্থ। তাই চিৎকার শোনার সঙ্গে সঙ্গে সবাই মেধার ঘরে হাজির হলো। আবার না জানি কি পছন্দ হয় নি।
শিল্পী(মেধার মা): কি হয়েছে,,চিৎকার করছিস কেন?
মেধা(চিৎকার করে): এটা কি লেহেঙ্গা এনেছো! আমার গায়ে ফিট হচ্ছে না। আবার লম্বায়ও শর্ট।
শিল্পী: কি আজব! তোকে না নিয়ে গেলাম মাপ দেওয়ালাম তাও শর্ট হলো কিভাবে!
মেধা: আমি জানি না। বাট আমার এটা এক্ষুনি ঠিক চাই। এট এনি কস্ট।
এরপর আকাশ বলল লেহেঙ্গাটা সে ঠিক করতে দিয়ে আসছে। আর মেধার জন্য অন‍্য লেহেঙ্গা পাঠাচ্ছে। মেধার মনটা ভার হয়ে গেল। আগের লেহেঙ্গাটা বেশি গর্জিয়াস ছিল।
আকাশদের বাগানবাড়িতে অনুষ্ঠান হচ্ছে। অনুষ্ঠান উপলক্ষ‍্যে বাগানবাড়ির ডিজাইনটাই বদলে দিয়েছেন বেবিন খান। নির্জন গাছগাছালি ঘেরা বিশাল বাগানটাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে আরো অপরূপ করে তোলা হয়েছে। মেধা লাইট পিংক জর্জেটের কাজের লেহেঙ্গা পড়েছে। লেহেঙ্গাটা নিচের দিক থেকে চারদিকে ছড়ানো। মেধা বারবার লেহেঙ্গায় পা বাঁধিয়ে উস্টার পর্যায় থেকে ফিরে আসছে। তবে উস্টা যে খাবে না তার গ‍্যারান্টি শূন‍্য।
জায়গা রেডি,,,বৌ রেডি,,অথচ বর রেডি না।
বেবিন: এই মনি,,মনি তোমার ছেলে কোথায়? সমস‍্যাটা কি সে আসবে কখন? মেয়েটা আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে।
মনিরা: মি. বেবিন খান আপনার ছেলে কোথায় গেছে সেটা আপনি খুঁজে বের করুন। আমি আপনাদের কাউকে চিনি না।
বেবিন: দেখো মনি,,, অনেকক্ষণ ধরে তোমার এই অশান্তি সহ‍্য করছি। আমি কিন্ত আর পারছি না।
মনিরা: হেই মিস্টার আপনি আমাকে তুমি বললেন কেন? কোন সাহসে তুমি বললেন? বলছি না আপনাদের চিনি না। আপনারা আমার কেউ হন না। আর আমি তো ক্লিয়ার করেই বলেছি মেধার সঙ্গে আকাশের বিয়ে হলে আপনাকে আমি ডিভোর্স দিব। আপনি এবং আপনার পুত্র ঐ ছোটবাচ্চার জামা পড়া মশারি পেচানো মেধাকে নিয়েই থাকেন। তারপর একজন মেধার ভ‍্যানিটি ব‍্যাগ ধরবেন আরেকজন ওকে বাতাস করবেন। একজন ওর রান্না করবেন আরেকজন ওর কাপড় ধুয়ে দিবেন,,, ওকে? আমি আপনাদের সঙ্গে থাকতে পারব না। আমি বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছি।
আকাশের সঙ্গে মেধার বিয়ের কথা শোনার পর থেকেই মনিরার শুধু কান্না আসে। ইশ্, সারা এসব শুনলে কত কষ্ট পেত! আর আকাশ এগুলো কি কারনে করছে তাও তিনি বুঝতে পারছেন না। আপাতত বিয়ে বন্ধ করার জন্য তিনি সবাইকে জানিয়েছেন আকাশ মেধার বিয়ে হলে তিনি আকাশের বাবাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যাবেন এবং এটা তিনি সত্যি সত্যিই করবেন। আকাশ নিশ্চিত মা’কে যেতে দিবে না ঐ পাজি মেধার জন্য।
অবশেষে আকাশ ফিরে এলো। সবকিছু চলছিল ঠিকভাবেই হঠাৎ ঠিকঠিক আংটি পড়ানোর মুহুর্তেই কারেন্ট চলে গেলো। খানবাড়ির জন্য এটা কোন সমস‍্যাই না। সাথে সাথেই বলা হলো আই.পি.এস অন করতে। কিন্তু আই.পি.এস-ও নষ্ট। ঠিক সেই মুহুর্তেই আকাশ মেধার হাতে আংটি পড়িয়ে দিল যা কেউ দেখল না। অদ্ভুতভাবে ঠিক আংটি পড়ানোর পরপরই কারেন্ট ফিরে এলো।
কিন্তু মেধার মনে হলো আকাশ যখন অন্ধকারে আংটি পড়াচ্ছিল ওর হাতের ছোঁয়াটা অচেনা ছিল। সত্যিই আকাশ-ই আংটি পড়িয়েছে তো?
—————————————————————————–
সারার শরীর ভালো লাগছিল না। মাগরিবের নামাজেরর প‍র ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙল রাত আটটায়। ঘুম ভেঙ্গে নিজেকে আবিষ্কার করতেই সে যা দেখল তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না।
চলবে