জান্নাত !! পর্বঃ 02
আবিদা চলে আসার পর আর সাদমানের বাসায় যায়নি। ও নিজেকে একদম রুমে বন্দী করে চাপা কষ্ট সারাক্ষণ কান্না করে। খাওয়া দাওয়া সব বন্ধ। বাবা-মা জোর করেও পারেনি। আবিদা জান্নাত আর সাদমানকে ছাড়া থাকতে পারছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর। কিন্তু কিছুই করতে পারছে না।
অন্যদিকে সাদমান পড়েছে মহা বিপদে৷ কোন ভাবেই এ বিপদ থেকে বের হতে পারছে না। জান্নাত সারাক্ষণ আম্মু আম্মু করছে। কান্না করতে করতে অবস্থা খারাপ। কোনভাবেই জান্নাতকে কন্ট্রোল করতে পারছে না। এমন অবস্থা হয়েছে যে সাদমান আর অফিসেই যেতে পারেনি। ও আর ওর মা কোন ভাবেই জান্নাতকে খাবার খাওয়াতে পারছে না। সে শুধু কাঁদছে আর আম্মুকে খুঁজছে। সাদমান খুব অস্থির হয়ে গিয়েছে। জান্নাত কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। এখন প্রায় সন্ধ্যা। কোনভাবেই জান্নাতকে একটু খাবার খাওয়াতে পারে নি কেউ। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। সাদমানের বেশুমার কষ্ট হচ্ছে জান্নাতের এই অবস্থা দেখে। ও মেয়েকে এভাবে না দেখতে পেরে ড্রয়িং রুমে সোফায় গিয়ে মাথা হাত দিয়ে বসে। অনেক সুরা কলমা পড়ে ফু দিয়েছে তাও মেয়ে শান্ত হয়নি। তার আবিদা চাই ই চাই। তার মায়ের কোল চাই। তার মায়ের স্পর্শ চাই। তার মায়ের আদর চাই। হঠাৎই,
~ সাদমান…(জোরে ডাক দিয়ে)
সাদমান লাফিয়ে উঠে মায়ের জোরালো ডাক শুনে। মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে তার চোখেমুখে ভয়ের ছাপ। সাদমান অস্থির হয়ে বলে,
– কি হয়েছে মা কি হয়েছে? বলো তাড়াতাড়ি…
~ জান্নাতের গায়ে জ্বর এসেছে।
সাদমান একলাফে উঠে দাঁড়িয়ে দৌঁড়ে জান্নাতের কাছে গিয়ে গায় কপালে হাত দিয়ে দেখে গা গরম। সাদমানের মা পিছ থেকে বলে উঠে,
~ সাদমান ওকে খাওয়ানো এখন অনেক বেশী প্রয়োজন। ও না খেলে অনেক অসুস্থ হয়ে পড়বে। কিছু কর বাবা।
– কি করবো আমি? জান্নাত যা চাচ্ছে সেটা কীভাবে আমি আনবো? মা আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। (অসহায় ভাবে)
~ তোর মেয়ের সুস্থতার চেয়ে কি তোর জিদ বড় সাদমান? জান্নাতের মায়ের প্রয়োজন। আমি সবসময় থাকবো না বাবা। ও একদিন বড় হবে। ও একটা মেয়ে। তুই ওর বাবা। পুরুষ মানুষ। তোকে ও ওর সব কথা বলতে পারবে বলতো? তখন ও একা হয়ে যাবে। মেয়েটার ভবিষ্যতের কথা ভেবে আবিদাকে মেনে নে৷ এতো সুন্দরী ভালো মেয়ে যে জান্নাতকে নিজের চেয়েও বেশী ভালবাসে। আবিদা কি বলেছে জানিস? বলেছে, লাগলে ও কখনো মা হবে না। তাও তোদের দুজনকে ও চায়। যা বাবা ওকে তাড়াতাড়ি নিয়ে আয়। যা।
সাদমান কি করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। মাথা কাজ করছে না। কোন রাস্তাও খুঁজে পাচ্ছে না। সাদমান আবার জান্নাতের গায়ে কপালে হায় দিয়ে দেখে জ্বরটা বাড়ছে। নাহ! আর পারছে না সাদমান। ও উঠেই অস্থির হয়ে সোজা আবিদার বাসায় চলে যায়।
আবিদার বাসায় গিয়ে কলিং বেল দিতেই আবিদার মা দরজা খুলে। তিনি সাদমানকে দেখে ভীষণ অবাক। সাদমান তাকে চিন্তিত গলায় সালাম দেয়।
~ অলাইকুম আসসালাম। কি হয়েছে বাবা তোমার এ অবস্থা কেন?…
– কে আসছে আবিদার মা? আরে সাদমান তুমি! কি হয়েছে বাবা তোমার সব ঠিক আছে? তোমাকে এরকম লাগছে কেন? কি হয়েছে?
– আঙ্কেল জান্নাত। উনাকে ছাড়া সে কোনভাবেই খাবে না। গায় জ্বর এসে গেছে। দয়াকরে একটু তাকে ডেকে দিন।
– কিহহ! বলো কি বাবা?
~ আবিদাও সারাদিন না খেয়ে রুমে বন্দী হয়ে বসে আছে৷ দাঁড়াও আমি এখনি ডেকে নিয়ে আসছি।
কিছুক্ষণ পরই আবিদা রুম থেকে দৌঁড়ে আসে বাইরে গেইটের কাছে। আবিদার অবস্থা খুব খারাপ। সাদমান একপলক শুধু ওকে দেখে। আবিদা এসে বলে,
~ কি হয়েছে? কি হলো বলুন? (অনেক চিন্তিত কণ্ঠে)
– জান্নাত খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সারাদিন কিছু খায়নি। আপনাকে খুঁজছে আপনি একটু আস….
আবিদা রীতিমতো সাদমানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দ্রুত সাদমানের বাসায় চলে যায় অস্থির হয়ে। সাদমান বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। ও দ্রুত ওর বাসার দিকে ফিরে। এসে দেখে জান্নাত ঘুম থেকে উঠে গেছে। আবিদা আর জান্নাত দুজনেই কান্না করছে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে।
~ থাক পরীটা আমার কান্না করে না। এই যে আম্মু চলে আসছি। আর কখনো যাবোনা। তুমি খাওনি কেন আমার পরী জান্নাত। ইসসস গায় জ্বর উঠে গেছে। আহরে আমার আম্মুটা থাক আর কাঁদে না মা। আসো আমরা খাবো এখন।
~ আম্মু আত্তে আম্মু আত্তে আম্মু আত্তে। তুমি কান্না করো না। আমি খাবো।
~ গুড গাল। হা করো আম্মুটা।
এরপর জান্নাতকে সুন্দর করে খাইয়ে দেয় আবিদা। সাদমান আর ওর মা দাঁড়িয়ে সব দেখছে। আবিদা আর জান্নাত যেন ওদের দেখেই না। ওরা দুজন দুজনকে পেয়ে খুশীতে সব ভুলে গিয়েছে। সাদমান মুগ্ধ হয়ে সব দেখছে। ও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। শুধুমাত্র জান্নাতের জন্য আবিদাকে বিয়ে করবে। কারণ ও চায় জান্নাত এভাবে হাসিখুশি থাক ভালো থাক।
আবিদা জান্নাতকে খাইয়ে দিয়ে ঔষধ খাইয়ে দিয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আদর দিয়ে ঘুম পড়িয়ে দেয়। জান্নাত এখন অনেকটা সুস্থ। আবিদা জান্নাতকে শুইয়ে দিয়ে পাশে বসে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সাদমানের মা আস্তে করে আবিদার কাছে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখে। আবিদা তার দিকে ফিরে তাকায়। মা অসহায় ভাবে বলেন,
~ একি অবস্থা করেছিস মা তোর? জান্নাতের চেয়েও তোর অবস্থা খারাপ মনে হচ্ছে।
আবিদা সাদমানের দিকে একনজর তাকিয়ে অসহায় ভাবে বলে,
~ মা কিছু খেতে দেননা খুব ক্ষুধা লেগেছে। ওনার উপর রাগ করে সারাদিন কিছু খায়নি। জান্নাতের জন্য মন কাঁদছিল। খুব ক্ষুধা পেয়েছে মা।
সাদমানের মা কান্নাসিক্ত কণ্ঠে বলে,
~ এভাবে বলিস না মা বুকটা ফেটে যায়৷ আয় আমি তোকে নিজ হাতে খাওয়াবো। আয় মা।
আবিদা উঠে সাদমানের মায়ের সাথে খেতে আসে। আর আসার আগে সাদমানকে বলে,
~ মায়ের কাছ থেকে মেয়েকে আলাদা করলে এরকমই হয়। জান্নাত আমারও মেয়ে।
সাদমান চুপ করে আছে। কিছু বলার সাহস বা ইচ্ছা ওর নেই। ও এরপর নামাজ পড়তে চলে যায়। আজ সারাদিন অনেক ধকল গেছে ওর ওপর৷ আজকে ও বুঝতে পেরেছে মায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। দীর্ঘ ৫ টি বছর মেয়ের দেখাশুনা করেও সামান্য কয়টা দিনে মেয়েটা মায়ের মমতায় জড়িয়ে গিয়েছে।
মারা আসলে এমনই। সন্তান মা ছাড়া ভালো থাকে না। যাদের কাছে “মা” নামক মানুষটা আছে তারা সত্যিই খুব ভাগ্যবান। তারা মা বলে ডাকতে পারে। মা এমন একজন, যে সন্তানের সব কষ্ট নিমিষেই শেষ করে দেন। মায়ের ছায়াতলে সন্তান ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। দুনিয়ার যত কষ্ট, বিপদ কিংবা ঝড় সব মায়ের উপর দিয়ে যায়। তাও সন্তানকে এসব স্পর্শ করতে পারেনা শুধুমাত্র মায়ের জন্য। এই সেই মা যার অবস্থান আল্লাহ পাকের পরেই। মা ছাড়া এই দুনিয়ার আলো কখনো দেখা সম্ভব না। তাই মায়ের মতো বা মা বলে ডাকার মতো যদি একজন থেকে থাকে, জেনে রাখুন আপনি এই দুনিয়ার সবচেয়ে ভাগ্যবান/ভাগ্যবতী একজন মানুষ। মা পাগল হলেও সন্তানকে নিজের সাথে বেঁধে রাখে। একথা ভাবলে চোখের জল আর আটকানো যায় না। সেই মায়ের মনে যদি কেউ বিন্দু পরিমাণ আঘাত করে তার জীবন ধ্বংস হতে অনিবার্য। বাবা-মা উভয়ই প্রধান। তাদেরকে তিল পরিমাণ কষ্ট দেওয়া মানে আল্লাহকে কষ্ট দেওয়া। তাই আমরা এ কাজ থেকে সবাই বিরত থাকবো। বাবা-মাকে সবসময় আগলে রাখবো। মনে রাখতে হবে, আজ আমি যা সব ওই আল্লাহ আর আমার বাবা-মার জন্য। নাহলে আমার অস্তিত্বই থাকতো না।
এই গল্পটি লেখক আবির খানের। যদি কেউ আমার নাম না দিয়ে তা কপি করে কোথাও দেয়। তাহলে তার আইডিতে রিপোর্ট করুন। – সাদমান জান্নাতের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। রুমির মতো হয়েছে একদম। কিন্তু আবার আশ্চর্য হলেও সত্যি যে আবিদার সাথেও অনেক মিল আছে জান্নাতের। দুধের মতো গায়ের রং দুজনার। আর দুজনেরই মুখে মায়ায় ভরা। চোখগুলো সবচেয়ে সুন্দর। খাওয়া শেষে আবিদা আবার জান্নাতের কাছে আসে। সাদমানকে দেখেও না দেখার ভান করে সোজা জান্নাতের কাছে এসে গায়ে কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বর আছে কিনা। না এখন আর জ্বর নেই। আবিদা জান্নাতের নরম তুলতুলে গালে একটা চুমু দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখে। জান্নাতের টুকরা একটা। সাদমান বসে বসে সব দেখছে৷ ওর বুঝতে বাকি নেই আবিদা আপন মা না হলেও আপন মায়ের চেয়ে কোন দিক থেকে কম না৷ আবিদা সাদমানের দিকে একনজর তাকিয়ে চলে আসতে নেয়। সাদমানও উঠে বাইরে আসে৷
– আবিদা শুনুন কিছু কথা আছে আপনার সাথে।
সাদমানের মাও ছিল সেখানে। আবিদা এবার ভ্রুকুচকে রাগী ভাবে বলে,
~ দেখুন আমার মেয়েটা আজ সারাদিন অনেক কষ্ট পেয়েছে৷ আমি আর ওকে কষ্ট দিতে পারবো না। আপনি না করলেও আমি বেহায়ার মতো আমার মেয়ের কাছে চলে আসবো। আমি আর কিছু শুনতে চাই না।
– বেহায়ার মতো আসতে হবে না। জান্নাতের মা হয়ে একেবারে আসিয়েন।
আবিদা আর সাদমানের মা স্তব্ধ সাদমানের কথা শুনে। তারা একে অপরের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। আবিদা এককদম কাছে এসে বলে,
~ কি বললেন বুঝিনি?
– এভাবে বিয়ে ছাড়া আমার বাসায় যাওয়া আসা করতে হবে না। ব্যাপারটা ঠিক না। তাই কাল আপনাকে বিয়ে করে জান্নাতের মা করে একেবারে এই বাসায় নিয়ে আসবো।
আবিদা প্রচন্ড খুশী আর অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
~ আপনি কি সত্যি বলছেন? নাকি আমি স্বপ্ন দেখছি?
– জ্বি সত্যি বলছি। জান্নাতের মা হওয়ার সব যোগ্যতা আপনার আছে।
আবিদা সাদমানের মায়ের কাছে গিয়ে বলে,
~ ও মা তুমিও কি শুনছো উনি আমাকে বিয়ে করবে আমি জান্নাতের মা হবো। তুমি শুনছো?? (কাঁদতে কাঁদতে)
সাদমানের মাও খুশীতে চোখের জল ছেড়ে দিয়ে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে। আবিদা তাকে জড়িয়ে ধরে খুশীতে। হঠাৎই সাদমান বলে উঠে,
– কিন্তু আমার কিছু শর্ত আছে৷ যা না মানলে এ বিয়ে সম্ভব না৷
আবিদা সাদমানের সামনে এসে ভয়াতুর কণ্ঠে বলে,
~ কি শর্ত?
– আপনাকে সম্পূর্ণ ইসলামিক নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে৷ মর্ডান কোন কিছু করা বা পরা যাবে না৷ মানে খোলা মেলা ভাবে চলাফেরা করা যাবে না৷ জানি আপনি পারবেন না। তাও এই শর্ত না মানলে…
~ আমি রাজি। লাগবে না আমার ওই নরকের জীবন। ওখানে কোন শান্তি পাইনি আমি। আমার শান্তি আপনারা। আমি সব শর্তে রাজি। তবে আমারও যে একটা শর্ত আছে।
– কি শর্ত?
~ আপনি আমাকে ঠিক আপনার মতো পরহেজগার বানাবেন। আমাকে কুরআন পড়া শিখাবেন। একদম আপনার মতো বানাবেন আমাকে। কি রাজি?
সাদমান ছোট একটা হাসি দিয়ে বলে, “রাজি।” সাদমানের মা বলে উঠে খুশীতে,
~ মাশাল্লাহ। আবিদা মা যা তোর বাবা-মাকে খুশির সংবাদটা দিয়ে আয়। গিয়ে বল পাথর গলে গিয়েছে হাহা।
আবিদা খুশীতে মাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর দ্রুত বাসায় চলে যায় এবং গিয়ে সব বলে। এরপর দিন সত্যি সত্যি আবিদা আর সাদমানের বিয়ে হয় সম্পূর্ণ ইসলামিক নিয়মে। আবিদার বাবা সাদমানকে তাদের বাসায় এসে থাকতে বলে। কিন্তু সাদমান সম্পূর্ণ নাখোশ। সে তার বাসায় আবিদাকে নিয়ে থাকবে। সে যা আয় করে তাতেই সবার আনন্দে চলে যাবে৷
আবিদা আজ অসম্ভব খুশী। আজ ওদের ওর খুশী অাজ হিসাবের বাইরে। জান্নাতের মতো একটা মেয়ের মা হওয়ার স্বপ্ন ওর সেই বুঝে ওটার পর থেকেই ছিল। আর সাদমানের মতো আল্লাহর ইবাদাতকারী স্বামীকে পাওয়াতো সবচেয়ে বড় ভাগ্যের ব্যাপার। আবিদার খুশী যেন আজ শেষ হচ্ছে না। ও সাদমানের রুমে অনেক অজানা ইচ্ছা আর স্বপ্ন নিয়ে বসে আছে। অপেক্ষা শুধু সাদমানের। আবিদার এই খুশী সত্যিই কি টিকে থাকবে নাকি আয়নার মতো ভেঙে যাবে! এখন অপেক্ষা শুধু সাদমানের।
চলবে..?