তোকে চাই

তোকে চাই – Season 2 ! Part- 73 [ Extra part ]

রোদ কিছু বলার আগেই ভ্রু কুঁচকে বলে উঠে শুভ্র,
— ডায়েরি? এটা আবার কোন নতুন হিস্ট্রি? তাছাড়া, রোদ কখনো ইউএস যায় নি। তাহলে আপনি ওকে চিনেন কিভাবে? সবকিছুই কেমন অগোছালো লাগছে আমার।
শুভ্রর কথা শেষ হতেই জেনির হাত থেকে ডায়েরিটা নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলো সাহেল। কপাল কুঁচকে বললো,
— এটা তো কোলকাতায়…(একটু থেমে) আপনি এটা কি করে পেলেন মিস. কিংস্টোন? তবু এতোদিন পর!
জেনি এবার মুখ খুলে,
— বেশ কিছুদিন আগে বাবার স্টাডি রুমের এককোণায় হঠাৎই চোখে পড়ে ডায়েরিটা। ডায়েরিটা দেখে বেশ অবাক হই। ভেবেছিলাম, এটা হয়তো বাবার লেখা, আমার বাবা-মার জীবন কাহিনী। কিন্তু প্রথম পৃষ্ঠা খুলে বুঝতে পারলাম এটা রোদ নামের এক মেয়ের লেখা। তার জীবনের দারুন কিছু দিনকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে এই ডায়েরিটাতে। লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তার ভালোবাসাকে —-শুভ্রকে! ভালোবাসার অনুভূতি যে এতোটা সুন্দর হতে পারে জানা ছিলো না আমার। অদ্ভুত এক আকর্ষনে রাত জেগে পড়ে ফেলি আবেগমিশ্রিত সেই ডায়েরি। কিন্তু ডায়েরির শেষ পাতাটিতে কেঁপে উঠি আমি। সেখানে রোদের কোলকাতায় পাড়ি জমানোর কথা লেখা আছে, তারপর ফাঁকা! এই সাদা কাগজগুলো বড্ড জ্বালাপোড়া করছিলো মনে। একটা কথায় মনে হচ্ছিলো বারবার, কি হয়েছিলো তারপর? রোদ,শুভ্র আর তার সেই বাচ্চাটা কি বেঁচে আছে? এই আকর্ষন থেকেই বাবাকে ডায়েরির কথা জিগ্যেস করি। উনি জানান কোলকাতার এক ময়লার ঝুড়ি থেকে উদ্ধার করেছিলেন এই ডায়েরি তাও আবার প্রায় দু’বছর আগে। আমি আশাহত হই। কিন্তু প্রশ্নের উত্তরগুলো জানার আগ্রহটা এতো বেশি ছিলো যে হ্যারির প্ল্যানমতো চলে আসি বাংলাদেশে। আমাদের উদ্দেশ্য ছিলো শুভ্রকে খোঁজা। এই অচেনা এক দেশের অচেনা এক শহরের বেশ কয়েকটি ভার্সিটির দারপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়াই শুধুমাত্র শুভ্রকে খুঁজবো বলে। রোদ তার ডায়েরিতে লিখেছিলো তার শুভ্র ভার্সিটির লেকচারার৷ কিন্তু ভার্সিটির নাম কোথাও উল্লেখ করে নি সে…. ভেবেছিলাম, খালি হাতে ফিরতে হবে আমাদের কিন্তু কাকতালীয়ভাবে “সাহেল” আর “আদ্র-রোদ্র” নামটা শুনেই থমকে দাঁড়াই। বুঝতে পারি গন্তব্য নিজেই আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে এবার।
জেনির কথার মাঝেই অবাক বিস্ময়ে বলে উঠে সাহেল,
— ডায়েরিতে যদি আমার নাম লেখা থাকে তাহলে আমার সাথে যোগাযোগ করলেই তো হতো? তাছাড়া, হ্যারি তো শুভ্রর নামটাও জানে। কেলিফোর্নিয়ায় থাকার সময় অনেকবারই শুভ্রর কথা বলেছি ওকে।
কথাটা জেনির মাথাতেও খেলে গেলো। হ্যারি সাহেলকে চিনে এই কথাটা এতোক্ষণ সেভাবে ভেবেই দেখে নি জেনি। জেনি কপাল কুঁচকে তাকালো,
— হ্যারি? তুমি সাহেল-শুভ্রকে চিনতে তাহলে আমায় বলো নি কেন?
হ্যারি অপরাধী চোখে তাকায়। মাথা চুলকে বলে,
— আই এম সরি,জেনি। অ্যাশ কেলিফোর্নিয়া থেকে প্রায় তিন-চার বছর আগে চলে এসেছিলো। যখন তোমার থেকে কাহিনীটা শুনলাম তখন অ্যাশের কথাটা মাথায়ই ছিলো না। আসলে,শোওবরোর এক্সিডেন্ট হওয়ার পর অ্যাশকে বাংলাদেশে আসার জন্য টিকেটটা আমিই ম্যানেজ করে দিয়েছিলাম। আর তখনই শোওবরো আর রোওডের কথা বলেছিলো অ্যাশ বাট এতো বছর আগের সেই ছোট্ট কাহিনীর সাথে এই কাহিনীর লিংক থাকবে তা কখনো ভাবতেই পারি নি আমি। সো সরি সুইটহার্ট!
জেনি কি বলবে বুঝতে পারছে না। যে সমস্যার সমাধানটা মিনিটেই করে ফেলা যেত তারজন্য তিনদিন যাবৎ গাধার মতো খাটছে তারা। তবে সেই সুবাদে বাংলাদেশে তো আসা হলো! জেনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
—ইট’স ওকে হ্যারি। কিন্তু তারপর কি হয়েছিলো? আর রোদের কাছে এই দ্বিতীয় ডায়েরিই বা কিভাবে?
রোদ হাসলো। জেনির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
— আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না আমার একটা ডায়েরি এতোটা দূর টেনে এনেছে আপনাকে। ডায়েরি লেখাটা আমার ছোট বেলার অভ্যাস। আমার ষষ্ঠতম জন্মদিনে নানুভাই আমাকে ছয়টা ডায়েরি উপহার দেন। ডায়েরিগুলো দেখতে ঠিক একইরকম ছিলো। সেদিন নানু বলেছিলেন, ” নানুভাই? ডায়েরিগুলো কিন্তু ফেলে রাখার জন্য নয়। এই ডায়েরিগুলোই ৮০ বছর পর আয়না হয়ে তোমার সামনে দাঁড়াতে পারে। ৮০ বছরের বুড়ো হয়ে ৬ বছরের রোদকে দেখতে পাওয়াটা মজার নয় নানুভাই?” আমি জিগ্যেস করেছিলাম, কিভাবে? উনি বলেছিলেন,” এখন থেকে জীবনের সব ঘটনাগুলো এই ডায়েরিগুলোতে বন্ধী করে রাখো নানুভাই। সুখ-দুঃখ সব। যখন আমার মতো বুড়ো হয়ে যাবে। মুখের সব কটা দাঁত পড়ে যাবে তখন ভারি চশমা চোখে ডায়েরিগুলো খুলবে। তখন ম্যাজিক হবে, এই ছোট্ট তুমি চট করে তোমার সামনে এসে দাঁড়াবে।” সেদিন নানুভাইয়ের কথাগুলো অবাক হয়ে শুনছিলাম। কি বুঝেছিলাম জানি না তবে পরের দিন থেকেই ডায়েরি লেখা শুরু করে দিয়েছিলাম কেবলমাত্র বুড়ো হলে ম্যাজিক হবে বলে। তারপর ধীরে ধীরে ব্যাপারটা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়। আমার স্কুল লাইফ, কলেজ লাইফ, ভার্সিটি লাইফ সবকটার জন্য আলাদা আলাদা ডায়েরি আছে আমার। কিন্তু দুঃখের বিষয় ছিলো, ভার্সিটি লাইফ শেষ না হতেই ডায়েরিটাই হারিয়ে ফেলেছিলাম । সেই ডায়েরিই আজ দু’বছর পর আবারও ফিরে পাবো ভাবতেই পারি নি আমি।
জেনি বললো,

— ডায়েরির ব্যাপারটা তো বুঝলাম। কিন্তু হসপিটালের ব্যাপারটা এখনও একটা ধাঁধা। কি করে বেঁচে গেলেন আপনি? এটাও কি একটা ম্যাজিক? আর ডায়েরিটা হারালোই বা কিভাবে?
রোদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
— ম্যাজিক নয়। আল্লাহর রহমত। সেদিন যখন জানতে পারি বাঁচার মতো সময় নেই হাতে। তখনই মনে মনে হাজারবার ধন্যবাদ দিই নানুভাইকে। আমার বাচ্চার কাছে “মা” না থাকলেও মায়ের জীবনের প্রতিটি ঘটনা জানতে পারবে সে সেই মুহূর্তে এটাও আমার কাছে ছিলো ভীষন আনন্দের। আমার মনে হয়েছিলো ডায়েরিগুলোর মাধ্যমেই আমার মেয়েটার সাথে বেঁচে থাকবো আমি। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম জীবনের লাস্ট সময়গুলোও ডায়েরিতে তোলে দিয়ে যাবো যেন আমার মেয়ে তার মায়ের কষ্টগুলোও উপলব্ধি করতে পারে। কোলকাতায় রওনা দেওয়ার পর সাহেল ভাইয়াকে ডায়েরিগুলোর কথা বলি আমি। আমি চলে গেলে এই ডায়েরিগুলো শুভ্রকে দেওয়ার জন্যও রিকুয়েষ্ট করি। আর বাকি রাস্তাটুকুতে লিখে চলি সেদিন ঘটে যাওয়া সেই কষ্টবহ কাহিনীগুলো। কোলকাতা হসপিটালে ডক্টর বের হওয়ার পর শুভ্রও বেরিয়ে যান অটিতে ঢোকার জন্য পোশাক পাল্টাতে। নার্সকে রিকুয়েষ্ট করে পাঁচ মিনিট ওয়েট করতে বলে কয়েক লাইন লিখতে বসি কিন্তু সবটা লেখা হয়ে উঠে না। তার আগেই তাড়া পড়ে অপারেশনের জন্য। ডায়েরিটা থেকে যায় বেডের এক কোণে। ভেবেছিলাম শুভ্র অটিতে ঢুকলে, সেন্স হারানোর আগে ছোট্ট করে হলেও ডায়েরিটির কথা বলবো তাকে কিন্তু উনি আসেন নি।
রোদের কথার মাঝেই প্রশ্ন করে উঠলো জেনি,
— কেনো?
সাহেল বললো,

— উত্তরটা আমি দিচ্ছি। সানশাইনের সাথে অটিতে যাওয়ার বায়না করাটা সেদিন শুভ্রর পাগলামোরই একটা অংশ ছিলো। নিজেই অসম্ভব রকম অসুস্থ ছিলো সে। সেদিনই অপারেশন হয়েছিলো ওর। একা ঠিকভাবে দাঁড়াতেও পারতো না। তারওপর সানশাইনের কেবিন থেকে বেরিয়েই দু-তিনবার বমি হয় ওর। তার পরপরই সেন্স হারায়। আমি আর অভ্র ভাই দুজনেই যেন অকুল পাথারে পড়ি। শুভ্রকে হসপিটালের আইসিইউতে রাখা হয়। সেদিনের কথাটা মনে হলেও কেঁপে উঠি আমি। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় লাগছিলো সেদিন। একদিকে সানশাইন, একদিকে শুভ্র আর অন্যদিকে বাচ্চাটা। এক মুহূর্তের জন্য তো মনে হচ্ছিলো নিজেও মরে যাই। এতো টেনশন নেওয়াটা খুবই কঠিন ছিলো আমার আর অভ্র ভাইয়ের জন্য। প্রায় তিন-চার ঘন্টা অপারেশন চলার পর বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনে আমি আর অভ্র ভাই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। বুকের ভেতর আনন্দ না কষ্ট কাজ করছিলো তাই বুঝতে পারছিলাম না। ডক্টর বেরিয়ে এসে বললেন মেয়ে হয়েছে। আমরা বুঝতেই পারছিলাম না কি বলবো। নিশ্চিত মৃত্যু জেনে যে মানুষটাকে অটিতে নেওয়া হলো তার অবস্থা কি করে জিগ্যেস করতে হয় জানা ছিলো না দু’জনের কারোরই। দু’জনের গলাতেই কথা আটকে গিয়েছিলো। এক পর্যায়ে ডক্টর নিজেই বললেন, “আপনাদের পেশেন্ট এখনও মারা যায় নি। অজ্ঞান অবস্থায় আছে অর্থাৎ এখনও পার্লস চলছে।তবে কতক্ষণ চলবে তা বলতে পারছি না। মারা যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আমরা উনাকে আইসিইউতেই রাখবো।” ডক্টরের কথার প্রতিউত্তরে সেদিন কিছুই বলি নি আমরা। শুভ্রতাকে কোলে নিয়ে আইসিইউ এর সামনে বসে ছিলাম চুপচাপ। আর রোদ-শুভ্র দু’জনেই শুয়ে ছিলো আইসিইউ এর হাজারও যন্ত্রপাতির ভীরে। একদিকে কষ্টে বুক কাঁপছিলো অন্যদিকে মনে হচ্ছিলো,যা হচ্ছে বেশ হচ্ছে। মরে যাক শুভ্র। কারণ, রোদের চলে যাওয়ার পর একা শুভ্রকে সামলানোর থেকে শুভ্রকে এখনই হারিয়ে ফেলাটা কম কষ্টের মনে হচ্ছিলো আমার। কয়েকঘন্টার মধ্যে শুভ্রতার বাঁচাটাও আশঙ্কাময় হয়ে উঠে ডক্টরদের কাছে। বাচ্চার খাবার চায় কিন্তু বাচ্চার মা-ই তো নেই। কিন্তু সব ছাড়িয়ে একটা ব্যাপারে অবাক হই আমরা।আইসিইউ-তে শিফট করার ছয়ঘন্টা চলে যাওয়ার পরও সানশাইনের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় নি। সারা শরীর কাজ করা বন্ধ করে দিলেও বেঁচে আছে সে। ডক্টররা আবারও দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। এটা তাদের কাছে বিগ এচিভমেন্ট! পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আমাদের জানানো হয়, রোদের বেঁচে থাকা আর মারা যাওয়া একই। তারা রক্তক্ষরণ কমানোর জন্য যে ইনজেকশন উদ্ভাবন করে ছিলেন সেটা রোদের উপরই টেস্ট করা হয়েছে প্রথম। রোদের ব্রেনের রক্তক্ষরণ হুট করেই থেমে গেছে কিন্তু এরপর কি হবে তা তারা নিজেরাও জানে না। হয়তো কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস চলবে। ঔষধের ইফেক্ট শেষ হলে থেমে যাবে নিঃশ্বাস! তাই বাঁচার আশাটা ছেঁড়ে দেওয়াটাই মঙ্গল। শুভ্রর সেন্স আসে আরো দু’ঘন্টা পর। ততক্ষণে নাবিলা আর আঙ্কেলও পৌঁছে গেছেন হসপিটালে। শুভ্র চোখ মেলে প্রথমেই জিগ্যেস করলো, “রোদ কোথায়?” আমাদের কাছে কোনো উত্তর ছিলো না। আমরা জানতাম শুভ্র এখন ঠিক কি কি করতে পারে তাই ডক্টররা ঘুমের ঔষধ দিয়ে ঘুম পারিয়েই রাখে ওকে। কিন্তু একটা মানুষকে কতক্ষণ ঘুম পারিয়ে রাখা যায়? শুভ্রও জেগে ওঠে। আবারও তার মুখে একই প্রশ্ন, “রোদ কোথায়? ” আবারও উত্তরহীন দাঁড়িয়ে থাকি আমরা। শুরু হয় শুভ্রর পাগলামো। ফাজিলটা কি কি না করেছে তখন। হাতে যা পেয়েছে ছুঁড়ে মেরেছে। আটকাতে গিয়ে অভ্র ভাইয়ার হাত আর আমার কপাল কেঁটেছে। শুভ্রর এসব পাগলামো দেখে আংকেলেরও পেশার ফল করেছে। আমাদের জন্য নরকীয় একটা সময় যাচ্ছিলো তখন। একসময় সব ছুঁড়াছুঁড়ি করে ক্লান্ত হয়ে হাত আর মাথার ব্যান্ডেজ নিয়ে টানাটানি শুরু করে শুভ্র। ডক্টররা আতঙ্কিত হয়ে আবারও জোরপূর্বক ঘুমের ঔষধ পুশ করে। ওর এমন পাগলামো দেখে শুভ্রতাকে ওর সামনে পর্যন্ত নিয়ে যেতে ভয় পাচ্ছিলাম আমরা। যদি না বুঝে বাচ্চাটাকে কিছু করে! এভাবেই জিনিস ছুঁড়াছুঁড়ি আর ঘুমিয়েই কেটে গেলো পাঁচ/ছয়টি দিন। সানশাইনের বডিতেও কোনো রিয়েকশন দেখা দিলো না। ডক্টররা বললেন রুগী কোমাতে চলে গেছে। কোমা থেকে কখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারলেন না উনারা। তবে উনারা চেষ্টা করবেন। এটা উনাদের রিসার্চের জন্য একটা গুড সাইন। সেই মুহূর্তে ডক্টরদের ধরে খুন করতে ইচ্ছে করছিলো আমার। আমাদের রুগী মারা যাচ্ছে আর তারা তাদের রিসার্চ নিয়ে পড়ে আছে। এক সপ্তাহ পর শুভ্রর এমন একটা অবস্থা হলো যে চমকে উঠলাম আমরা। খাবার তো খাচ্ছেই না সেই সাথে ঔষধও না। যাকে দেখছে তার প্রতিই এগ্রিসিভ হয়ে পড়ছে। নার্স, ডক্টর তো দূরে থাক আমাদেরকে দেখেও পাগলামো শুরু করছে। ডক্টর যখন বললো এভাবে চলতে থাকলে এই রোগীকেও বাঁচানো যাবে না তখন নাবিলা সাহস করে শুভ্রতাকে সামনে নিয়ে গেলো। আমরা শুধু ভয় করছিলাম, না-জানি বাচ্চাটার কোনো ক্ষতি হয়। নাবিলা রুমে ঢুকতেই আবারও শুরু হলো পাগলামো। হসপিটালের স্টিলের ট্রলি তোলে নিলো ছুঁড়ে মারবে বলে। ভয়ে আমার আত্মা শুকিয়ে কাঠ। এতো শব্দে শুভ্রতা কেঁদে উঠতেই থেমে গেলো শুভ্র। ট্রলি দু’হাতে তোলে ধরেই ভ্রু কুঁচকে তাকালো সে। আমরা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। নাবিলা সাহস নিয়ে বললো, “শুভ্র তোর প্রিন্সেস। তোর আর তোর রোদপাখির প্রিন্সেস। কোলে নিবি না? দেখ, তোর প্রিন্সেস কাঁদছে।” শুভ্র একদমই শান্ত হয়ে গেলো। ট্রলি হাত থেকে ফেলে দিয়ে ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এসে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। শুভ্রর সেই শান্ত চেহারাটা দেখে বুক থেকে একটা ভারি বোঝা নেমে গিয়েছিলো সেদিন। ১০ দিনের শুভ্রতাকে চুমুতে ভরিয়ে দিয়েছিলো কিন্তু কোলে নেয় নি। তার যে শুধু তার রোদপাখিকেই চায়। এই দশদিনে সেদিনই শুধু চিৎকার করে কেঁদেছিলো শুভ্র। আঙ্কেল তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই পা জড়িয়ে ধরে বলেছিলো,” আমার শুধু রোদকেই চাই বাবা। আর কিচ্ছু না। আমার সাথেই এমনটা কেন হবে বাবা? আমার সাথেই কেন? যদি কোনো পাপ করে থাকি তো অন্যকোনো শাস্তি দিক আমি মাথা পেতে নিবো। একটু উফ ও করবো না বাবা। কিন্তু রোদকে দিয়ে আমি পাপমোচন করতে পারবো না। প্লিজ বাবা… প্লিজ! এনে দাও আমায়। আমার ওকে চাই। খুব প্রয়োজন ওকে। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না দেখো। দমটা কেমন আটকে আসছে।” (এটুকু বলে থামে সাহেল। শ্বাস টেনে নিয়ে আবার বলে) সেদিন সেই দৃশ্যটুকু আমার মনটাকে হাজারো ক্ষতে রক্তাক্ত করে দিয়েছিলো। শুভ্রকে শান্ত করতেই আঙ্কেল বলে দিয়েছিলেন যে, রোদ বেঁচে আছে কিন্তু জেগে নেই। শুভ্রর কাছে শেষের বাক্যটি প্রাধান্য পায় নি। তার রোদ বেঁচে আছে সেটাই তো অনেক। আরো কিছুদিন পর সানশাইনকে ঢাকায় ট্রান্সফার করা হয়। তখন থেকে নতুন এক শুভ্রকে দেখি আমরা। সানশাইনকে সেই অবস্থাতেই সম্পূর্ণ মেনে নিয়ে হসপিটালকেই বাসা বানিয়ে ফেলে সে। একমাস পর ডক্টরকে অনুরোধ করে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা করে রোদকে বাড়িতে ট্রান্সফার করে আনে শুভ্র। এতোটা ধৈর্য শুভ্রর মাঝে থাকতে পারে কখনো কল্পনায় করতে পারি নি আমি। শুভ্রতার দেখাশোনা, রোদের দেখাশোনা এবং নিজের দেখাশোনাও একা হাতেই করেছে সে। প্রতিদিন ভার্সিটিতে ক্লাস নেওয়া, মেয়েকে নিয়ে খেলা আর সানশাইনের খেয়াল রাখা কোনটাতেই কোনো কমতি রাখে নি সে। নিজেকেও ভেঙে পড়তে দেয় নি। শুভ্রর বিশ্বাস ছিলো সানশাইন আবারও চোখ খুলবে, হাসবে, তাকে মুগ্ধ চোখে দেখবে! আর সেই দিনটির জন্য হলেও শুভ্রকে আগের মতোই থাকতে হবে। যেন ঘুম ভেঙে জেগে উঠেই সানশাইন বলে, “আমার বড় সবথেকে কিউট। অন্নেক কিউট।” শুভ্রর সেই বিশ্বাস বাস্তবে পরিণত হয় টানা তিনমাস দশদিন পর জেগে উঠে সানশাইন। ছয়মাসের মাথায় ফিরে আসে স্বাভাবিক জীবনে। এই দীর্ঘ ছয়মাস পর আহমেদ পরিবারে আবারও খুশির ঝিলিক নামে। মেঘ কেটে গিয়ে আবারও দেখা দেয় রোদের হাসি।
একটানা কথাগুলো বলে থামে সাহেল। সামনে রাখা পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে সম্পূর্ণ পানিই এক নিশ্বাসে শেষ করে দেয় সে। জেনি সবটা শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। বুকে খুব ভারি কিছু অনুভব করছে সে। টেবিলের বাতাসটা কখন যে এতো শান্ত আর বিষাদময় হয়ে উঠেছে খেয়ালই করে নি জেনি। ছোট্ট শুভ্রতা পর্যন্ত বাবার গায়ে মাথা এলিয়ে নিশ্চুপ বসে আছে। এই ছোট্ট বাচ্চাটাও কতোটা স্ট্রাগল করে এই পৃথিবীতে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। জেনির চোখদুটো ঘোলাটে হয়ে আসছে। আচ্ছা, তার কি কান্না পাচ্ছে? টেবিলে বসে থাকা প্রত্যেকটি মানুষের চোখে-মুখে কষ্টের ছাপ। হয়তো বিগত দিনের কষ্টগুলোই আবারও চাড়া দিচ্ছে বুকে। জেনি আড়চোখে শুভ্রর দিকে তাকালো। শুভ্রর চোখ দুটো জলে টলমল করছে। হয়তো প্রিয়তমাকে হারানোর ভয়টা আবারও জেগে উঠেছে মনে। খুব সাবধানে নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠে শুভ্র,

— সাহেল, শালা তুই তো দেখি আমার মান-ইজ্জত কিছু রাখলি না। বউয়ের সামনে বলা এক কথা আর পাব্লিক প্লেসে এভাবে….
সাহেল হেসে বলে,
— যা পাগলামো করছিস তার তো দুইভাগও বলি নি। ওগুলো বললে তো মান-ইজ্জত যেটুকু আছে সেটুকুও থাকবে না। পাগলামো করার সময় মান-ইজ্জতের ভয় করে আমাদের একটু রেহাই দিলেই তো পারতি দোস্ত।
শুভ্র হাসে। জেনি জোরে একটা শ্বাস টেনে নিয়ে বলে,
— থেংক গড ডায়েরিটা হারিয়েছিলো নয়তো এমন একটা ভালোবাসা দেখার সৌভাগ্যটা হতো না।
সাহেল হেসে বলে,
— কি করবো বলুন, এদের জামাই-বউয়ের চিন্তায় এই ডায়েরির কথা আর মাথায় ছিলো না। কিভাবে যে ওটা ময়লার ঝুড়িতে গেলো আল্লাহ মালুম।
এতোক্ষণে কথা বলে হ্যারি। বিস্ময় নিয়ে স্পষ্ট ইংরেজিতে বলে উঠে,
— জেনি সবসময়ই লাভ ম্যাজিকের কথা বলে। আমার আজ কথাটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। সত্যিই হয়তো ভালোবাসা নামক ম্যাজিক আছে। যে ম্যাজিক পাওয়ারটা স্বয়ং ঈশ্বর আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন।
মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে শুভ্রর ডানবাহুটা শক্ত করে চেপে ধরে টলমলে চোখে বলে উঠে রোদ,
— চোখ খোলে আবারও এই পৃথিবীটাকে দেখতে পাবো ভাবি নি কখনো। যেদিন চোখ খুললাম আর নিজের ঘর নিজের স্বামীর মুখটা আবারও দেখলাম। আমি তখন বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। সবকিছুকে স্বপ্ন বা কল্পনাও ভাবতে পারছিলাম না। মৃত্যুর পর তো স্বপ্ন বা কল্পনা থাকে না। মনে হচ্ছিলো কোনো জান্নাতে আছি। যেখানে আস্ত একটি জান্নাত, আমার বর আমাকে বুকে আগলে রেখেছে সেই আগের মতো। আল্লাহকে এই নতুন জীবনের জন্য প্রতিটি মুহূর্তে শুকরিয়া জানাই। আমাকে এতোটা ভাগ্যবতী করে পৃথিবীতে পাঠানোর জন্যও শুকরিয়া জানাই।
কথা বলতে বলতেই চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। শুভ্রতা মায়ের মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। মাকে কাঁদতে দেখেই ঠোঁট ভেঙে কান্নাভাব নিয়ে বাবাকে বলে,
— বাবা? আম্মু কাঁদে…
শুভ্র হেসে রোদের কপালে চুমু দিয়ে মেয়ের দিকে তাকায়। নিচু হয়ে মেয়ের কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বলে,
— তুমি মানা করো তাহলেই আর কাঁদবে না।
শুভ্রতা খুব যত্নে জল মুছে দিয়ে মাথা দুলিয়ে বলে,
— তাক,কাঁদে না।
জেনির চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। কেন কাঁদছে জানে না সে। শুধু জানে কান্না পাচ্ছে…প্রচুর কান্না পাচ্ছে। হঠাৎই কারো হাতের স্পর্শে ফিরে তাকায় জেনি। হ্যারি একহাত জড়িয়ে আছে তাকে। জেনি তাকাতেই হাসি ফুটে তার মুখে। ফিসফিস করে বলে,
— ইশ! বাচ্চাদের মতো কাঁদছো দেখি। ডোন্ট ক্রাই সুইট লিটল বেবি। হ্যারি লাভ’স ইউ…. এন্ড হি উইল লাভ ইউ ইন এভ্রি মোমেন্ট অফ হিজ লাইফ।
জেনি হাসে। আবারও শুরু হয় হাসি-মজা। খাওয়া শেষে স্টল থেকে বেরিয়ে বিদায় নেওয়ার সময় বলে উঠে রোদ,
— জেনি? আপনারা আমাদের অতিথি। আমাদের খুঁজে এতোটা দূর এসেছেন অথচ সামান্য আতিথেয়তার সুযোগ আমরা পাবো না। তা তো হতে পারে না। পরশো আমার ভাইয়ার বিয়ে। এই ক’টা দিন আমাদের বাড়িতে আমাদের সাথেই থাকুন না প্লিজ।
জেনি হেসে দেয়। এমন একটা দারুন সুযোগ কখনোই মিস করতে চায় না সে। রোদকে জানায় তারা আসবে তবে তার আগে হোটেলে যেতে হবে তাদের। রোদও হেসে সম্মতি জানায়।
#চলবে….