তোকে চাই

তোকে চাই – Season 2 ! Part- 67

সোফায় পা গুটিয়ে বসে আছি আমি। আমার সামনে বিছানায় উবু হয়ে বসে আছে চিত্রা। আদ্র-রোদ্রর গলায় “A” আর “R” লেখা দুটো লকেট ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে করে কে আদ্র আর কে রোদ্র তা সহজেই বুঝা যাচ্ছে। আমাদের সবার কাছে বাবুদুটোকে এক মনে হলেও আপু দৃঢ় কন্ঠে বলছে তারা জমজ হলেও চেহারা এক নয়। দু’জনের মাঝে কিছুটা অমিল আছে। আমার আর চিত্রার কাছে বিষয়টা বিশ্বাসযোগ্য নয় তাই বাচ্চাদেরকে উল্টে পাল্টে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অমিল খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে চিত্রা। আদ্র রোদ্রর চেয়ে ৩ মিনিটের বড়, এই কথাটাও আপু থেকেই জেনেছি আমরা। ডক্টর বলেছিলো, কিন্তু কে আদ্র আর কে রোদ্র সেটাই যেখানে বড় প্রশ্ন সেখানে বড় ছোট নির্ণয় করা একরাশ কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে আপু কিভাবে যেন ব্যাপারটা ধরে ফেলেছে। কিভাবে ধরলো কে জানে? আদ্র- রোদ্রর সাথে দুষ্টুমি করতে করতেই কানে এলো শুভ্রর ডাক। চিত্রাকে গনেষনা চালিয়ে যেতে বলে আমাদের রুমের দিকে হাঁটা দিলাম আমি। দরজার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াতেই দুনিয়া ঘুরে এলো আমার। দরজা ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করলাম আমি। মাথা ঘুরানোর ব্যাপারটা শুভ্রকে বুঝতে দেওয়া চলবে না। কোনভাবে বুঝতে পারলেই শুরু করবে চিৎকার, “খাও না ঠিকমতো হেন তেন কতো কিছু।” অথচ এই দুসপ্তাহ ধরে আমি বেশ নিয়ম করেই খাবার আর ঔষধ খেয়ে চলেছি। তবুও এই দুর্বলতা পিছুই ছাড়ছে না। রুমে ঢুকতেই শুভ্রর গোমড়া মুখটা চোখে পড়লো। মুখ কালো করে জুতো আর মোজা খুলছে সে। আমি সামনে দাঁড়াতেই অভিমানী কন্ঠে বলে উঠলো সে,
— কি লাভ হলো, বলো? এতো পরিশ্রম করে লাভ টা কি হলো?
উনার কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে না পেয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম আমি৷ কনফিউজড হয়ে বলে উঠলাম,
— মানে? কিসের কথা বলছেন আপনি?

শুভ্র বাম পায়ের জুতোটাও ঠাস করে ফ্লোরে ফেলে উঠে দাঁড়ালো। আমার দিকে তাকিয়ে মুখ কালো করে বলে উঠলো,
— আপনার রেজাল্টের কথা বলছি। এতোকষ্ট করে পড়াশোনা করিয়ে ৩. ৭১?
শুভ্রর কথায় চোখ বড় বড় হয়ে এলো আমার। ৩.৭১? বলে কি? জামাইয়ের কাছে পড়ে এতো ইম্প্রোভমেন্ট হয়েছে ভাবতেই পারছি না আমি। বুকের ভেতর থাকা মনটা রীতিমতো লাফালাফি শুরু করেছে। আমার মনের অবস্থা “ভেরি হ্যাপি” টাইপ হলেও শুভ্রর মুখটা “ভেরি স্যাড” টাইপ হয়ে আছে। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে ক্লাস সিক্সের ম্যাথ এক্সামে সবাই যেখানে হান্ড্রেট পেয়েছে সেখানে সে পেয়েছে জিরো। বর যেখানে এতো কষ্ট পেয়েছে সেখানে আমার এতো খুশি খুশি ভাব মানায় না। তাই মুখে দুঃখী দুঃখী ভাব আনার প্রচেষ্টা চালালাম। কতটুকু সফল হয়েছি জানি না কারণ যখনই দুঃখ দুঃখ ভাব আনার চেষ্টা করি তখনই মনের মধ্যে খুশি নামক ভাইরাসগুলো লুঙ্গিডান্স মারে। তবুও যথাসম্ভব মন খারাপ ভাব নিয়ে বলে উঠলাম,
— মাত্র ৩.৭১? এতো কম! সরি…. নেক্সট টাইম ভালো করবো।
শুভ্র এ বিষয়ে কিছু বললো না। শার্টের বাটন খুলতে খুলতে বললো,
— তোয়ালেটা দাও। ফ্রেশ হবো।

আমি তোয়ালে নিতে সোফার দিকে এগিয়ে যেতেই আবারও মাথা ঘুরে গেলো আমার। এবার আর শেষ রক্ষা হলো না। আশেপাশে ধরার মতো কিছু না থাকায় ফ্লোরে গিয়ে পড়লাম আর খাটের কোনাটা লাগলো মাথায়। শব্দ শুনে ফিরে তাকিয়েই দৌড়ে এলো শুভ্র। আমার কপালে খানিকটা ফুলে উঠেছে। উনি আমাকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়েই বরফ আনতে ছুটলেন। কপালে বরফ ডলতে ডলতে প্রশ্ন করলেন,
— আবারও খাবারে অনিয়ম করছো? ঔষধও নিশ্চয় খাচ্ছো না? এক্চুয়েলি কি চাও তুমি? বলো প্লিজ। টেনশনে রেখে মেরে ফেলতে চাও আমায়? আজকের এই ইন্সিডেন্টটা যদি সিঁড়িতে বা রাস্তায় হতো তখন বাঁচতে তুমি? নাকি আমি বাঁচতাম? তুমি খুবই কেয়ারলেস একটা মানুষ রোদ। এতোটা কেয়ারলেস হলে চলে না। তুমি দু’বছরের বাচ্চা নও। সবকিছু তোমাকে বলে বলে করাতে হবে কেন?
উনি এক নিঃশ্বাসে বকে চলেছেন আমায়। আমাকে কিছু বলার সুযোগই দিচ্ছেন না। তবুও এক ফাঁকে ফট করেই বলে ফেললাম আমি,
— আমি নিয়মিত খাচ্ছি এবং ঔষধও নিচ্ছি। আমার মনে হয় ঔষধ গুলো কাজ করছে না।
শুভ্র এবার ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আমি তাড়াহুড়ো করে বলে উঠলাম,
— আমি সত্যি বলছি। মামানিকে জিগ্যেস করুন না। আধ ঘন্টা পর পর কিছু না কিছু খাচ্ছি। ভালো না লাগলে জোর করেই খাচ্ছি। ঔষধও নিচ্ছি। তবুও বারবার মাথা ঘুরাচ্ছে।
— বারবার? সকাল থেকে এখন পর্যন্ত কতোবার হয়েছে?
— ৫/৬ বার।
— তাহলে আমায় বলো নি কেন, ডাফার। এনিওয়ে,সব ঠিক থাকার পরও এতো দুর্বলতার কারণ কি? আঙ্কেল তো বলেছিলো এক সপ্তাহে ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু এখন তো দু’সপ্তাহ চলছে।
নিজের মনেই কথাগুলো বলে চুপ করলো শুভ্র। কিছুক্ষণ ভেবে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
— তোমার লাস্ট পিরিয়ড হয়েছে কবে?
উনার এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলাম আমি। মুহূর্তেই ভীষণ অস্বস্তির মাঝে পড়ে গেলাম আমি। শুভ্র সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বলে উঠলেন,
— কি হলো? বলো। লাস্ট ডেট কবে ছিলো?
আমি ইতস্তত করে বলে উঠলাম,
— মনে নেই। তবে ৩/৪ মাস হবে হয়তো।
আমার কথায় কেশে উঠলেন শুভ্র। শান্ত গলায় বললেন,
— তুমি কতোটা কেয়ারলেস তার প্রমাণ স্পষ্ট। এতোদিন ধরে পিরিয়ড হচ্ছে না তোমার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই?
এটুকু বলে থামলেন উনি। মাথা চুলকে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
— তুমি কি প্রেগনেন্ট?
উনার কথায় চোখ দুটো বড় বড় হয়ে এলো আমার। ডান হাতটা অটোমেটিক পেটের উপর গিয়ে স্থির হলো। আমি ড্যাবড্যাব করে পেটের দিকে তাকিয়ে আছি। সত্যিই কি আমি প্রেগনেন্ট? কথাটা ভাবতেই শরীরে এক অদ্ভুত শিহরণ জাগছে। শুভ্র উঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
— উঠতে পারবে? পারলে উঠে রেডি হয়ে নাও। হসপিটালে যাবো।
শুভ্রর গম্ভীর মুখ দেখে চিন্তায় পড়ে গেলাম আমি তবে কি শুভ্র বেবি চাচ্ছে না? অনেক জল্পনা কল্পনা শেষে শুভ্রর সাথে হসপিটালে চললাম আমি। সব শুনে ডক্টরও প্রেগনেন্সি টেস্ট করার জন্য সাজেস্ট করলো। আলট্রাসনোগ্রাফি শেষ করে বাসায় ফিরেই ঘুমিয়ে পড়লাম আমি। যখন জাগলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা। বিছানার এক কোণে ফাইল হাতে মাথা নিচু করে বসে আছে শুভ্র। মুখটা অসম্ভব রকম গম্ভীর তার। আমাকে উঠে বসতে দেখেই ফাইলটা এগিয়ে দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন,
— বেবি আসছে।

কথাটা শুনে যেখানে খুশিতে লাফিয়ে উঠার কথা ছিলো সেখানে চুপচাপ বসে রইলাম আমি। শুভ্রর গম্ভীর মুখটা আমার সব খুশিই যেন চুষে নিয়েছে কোনো অন্ধকার গহ্বরে। আমি একটা ঢোক গিলে ফাইলটা হাতে নিলাম। সাথে সাথেই ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো শুভ্র। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না, হঠাৎ এতো গাম্ভীর্যতা কেন? উনি তো বাচ্চা পছন্দ করেন তাহলে? প্রশ্নগুলো মাথায় নিয়ে ফাইলটা বেড সাইড টেবিলে রেখে উল্টোদিক ফিরে শুয়ে পড়লাম আমি। কিছুক্ষণ পরই ওয়াশরুমের দরজা খুলার শব্দ হলো। কোমরে কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্শ আর ঘাড়ে কারো ঠোঁটের স্পর্শটাও প্রকট আকার ধারণ করলো। বিরবির করে বলে উঠলো,
— আই লাভ ইউ রোদু। জীবনটাকে আজ হঠাৎ করেই অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। আমি বাবা হচ্ছি! ভাবতে পারছো তুমি? আমাকেও কেউ আধো আধো স্বরে “বাবা” বলে ডাকবে। কালো বড় বড় দুটো চোখ, ভুবন ভুলানো হাসি আর নরম তুলতুলে ছোট্ট শরীর থাকবে তার। ইশ! রোদ, এতো আনন্দ যে ধরে রাখতে পারছি না আমি। আমার প্রিন্সেসকে কিভাবে বুঝাবো যে আমি তার আগমনের খবরে প্রচন্ড রকম খুশি…প্রচন্ড! বেশি খুশি আর বেশি দুঃখে মানুষ নাকি অনেকটা স্তব্ধ হয়ে যায়? আমারও আজ একই অবস্থা রোদপাখি।
আমি এবার ঘাড় ঘুরিয়ে উনার দিকে তাকালাম। উনার চোখে পানি টলমল করছে যেন চোখদুটোতে আস্ত দুটো বিল নিয়ে শুয়ে আছেন উনি। আমি মিষ্টি হেসে উনার বুকে হাত রেখে বলে উঠলাম,
— কিভাবে জানলেন প্রিন্সেস আসছে? প্রিন্সও তো হতে পারে।
— কি জানি? কেন জানি মনে হচ্ছে প্রিন্সেস আসছে তবে যেই আসুক আই এম অলওয়েজ হ্যাপি। আমি তো এটা ভাবছি, তুমি একমাসের প্রেগনেন্ট হওয়ার পরও ডক্টর আঙ্কেল ধরতে পারলেন না কেন? অদ্ভুত না, ব্যাপারটা?
আমি কিছু বললাম না। চোখ জোড়ায় আবারও ঘুম নেমে আসছে। মনে হচ্ছে, কতোদিন ঘুমোয় না আমি।
#চলবে…