তোকে চাই

তোকে চাই – Season 2 ! Part- 57

– উঁহু! কিসের উঁহু? সরুন, দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার….
— আসুক দম বন্ধ হয়ে। ছাড়বো না।
— এখন কিন্তু কান্না করবো আমি। ছাড়ুন বলছি। উফফ..মরে গেলাম। সররররুন….(চিৎকার করে)
— সরা তো যাবেই না তার চেয়ে বরং মেরেই ফেলি।
কথাটা বলেই ঠোঁট ঠোঁট ছোঁয়ালেন উনি। এতোক্ষণ যতটুকু শ্বাস নিতে পারছিলাম এখন সেটুকুতেও বাঁধ সাধলেন উনি। একেই বলে সুখে থাকতে ভূতে কিলাই। আগেই তো ভালো ছিলাম। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য হাত-পা নাড়ারও সুযোগ নেই আমার। সবই এখন উনার শরীরের নিচে পিষ্ট। উনি প্রায় দশমিনিট পর ছেঁড়ে দিয়ে মুখ দিয়ে জোড়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলেন,
— আবার যদি ছাড়ুন ছাড়ুন করো তো পরেরবার এর থেকেও ভয়াবাহ হবে। আমার ঘুম পাচ্ছে। ঘুমোতে দাও ডিস্টার্ব করবে না।
কথাটা বলে আরো একটু জোড়ে চেপে ধরে গলায় মুখ গুঁজলেন উনি। আমি কয়েকবার জোড়ে জোড়ে শ্বাস টেনে নিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখে শুঁয়ে রইলাম। উনার এভাবে জাপটে ধরায় সারা শরীর যেন কাঁপছে আমার। হৃৎস্পন্দনটাও বেড়ে গেছে হাজার গতিতে। মনে হচ্ছে এটাই সেই প্রথম স্পর্শ। প্রথম অনুভূতি!কিছুক্ষণ পরই গলায় ঠোঁটের স্পর্শ পেলাম আমি। সাথে সাথেই গলা শুকিয়ে গেলো আমার। চোখ-মুখ কুঁচকে বন্ধ হয়ে এলো মুহূর্তেই। এবার চোখদুটোতে ঘুমের খুব প্রয়োজন আমার…খুব খুব প্রয়োজন। চোখে ঘুম এলেই যেনো রেহাই আমার। এই স্বর্গীয় যন্ত্রণা থেকে মিলবে মুক্তি!

সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুরু হয়ে গেলো লাফালাফি। আজ চিত্রার গায়ে হলুদ কথাটা ভাবতেই নাগিন ডান্স দিতে ইচ্ছে করছে আমার৷ উফফ…সেই স্কুল লাইফ থেকে স্বপ্ন দেখে আসছি চিত্রার বিয়ে হবে আর তার দেবরের সাথে আমি চুটিয়ে প্রেম করবো। জুতো চুরি করে মাধুরী আর সালমানের মতো নাচানাচি করবো। আহা! কিন্তু তা আর হলো কই? শিশির স্যারের ছোট ভাই ঠিকই আছে কিন্তু বেচারা ট্রেনটা মিস করে ফেলছে। এখন সে ট্রেন ধরতে গেলে শুভ্র তাকে ফ্লাইটের টিকেট ধরিয়ে দিবে কনফার্ম। সকাল দশটা বাজতেই চিত্রা ফোনের পর ফোন দিতে লাগলো। আমিও রেডি ফটাফট রেডি হয়ে শুভ্রর গলায় ঝুলাঝুলি করে অবশেষে তাকে নিয়ে হাজির হলাম চিত্রানিবাশ। আর সেখান থেকে গেলাম ওয়েডিং হাউজ। তিন দিনের জন্য বুক করা হয়েছে এই হাউজ। হলুদ, মেহেদী, বিয়ে আর রিসেেশনের অনুষ্ঠান হবে এখানে। কনে পক্ষ আর বর পক্ষ এই কটা দিন একসাথেই থাকবে। শুভ্র ভাইয়ার সব ফ্রেন্ডস্ এবং রাতুল ও সাকিব ভাইকেও দাওয়াত করেছে চিত্রা। সবাই এখানে উপস্থিত। আমাকে আর শুভ্রকে উপরের তলার একটা রুম দেওয়া হলো। রোহুন- সাব্বির ভাইয়াদের দেওয়া হলো আমাদের পাশের রুম। রাহি আপু আর নীলি আপুও এসেছেন। সবাই যার যার মতো রুমে চলে গেলো রেস্ট নিতে। বিকেল তিনটায় হলুদের ফাংশন শুরু হবে। হলুদের পর পরই হবে মেহেদী নাচ- গান সব।। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই দেখি শুভ্র হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। গায়ে লাল টি-শার্ট আর পরনে ব্ল্যাক থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট। পায়ের লোমগুলো পায়ের সাথে ল্যাপ্টে আছে….চুলগুলোতেও ভেজা ভাব। মুখটা মুছে তোয়ালেটা বারান্দায় ছড়িয়ে দিয়ে উনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভ্রু কুঁচকে খানিকক্ষণ উনাকে দেখে নিয়েই বলে উঠলাম,
— গোসল করেছেন নাকি?
উনি চোখ বন্ধ করেই বলে উঠলেন,
— হুম।
— কোথায় করলেন? ওয়াশরুমে তো আমি ছিলাম,তাহলে?
— সাব্বিরদের ওয়াশরুমে করে নিয়েছি। ছাড়ো ওসব, মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও তো। প্রচন্ড মাথা ধরেছে আমার।
আমি কোনো কথা না বলে চুপচাপ উনার মাথার কাছে গিয়ে বসে পড়লাম। আমি পাশে বসতেই কোলে মাথা রেখে দু’ হাতে শক্ত করে কোমর জড়িয়ে ধরলেন উনি। সাথে সাথেই চমকে উঠলাম আমি৷ তাড়াহুড়ো করে উনার কপালে হাত রেখেই কেঁপে উঠলাম,
— এতো জ্বর! আবারও এতো জ্বর কি করে?
আমার কথার কোনো উত্তর দিলেন না উনি। কোমরটা আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চুপ করে রইলেন। উনার গায়ে হাত দিতেই কান্না পেয়ে যাচ্ছে আমার। এখানে তো আম্মুও নেই ডাক্তার কোথায় পাবো আমি? আপাতত সব চিন্তা বাদ দিয়ে জ্বর কমানোর আয়োজন করতে উনাকে ছাড়াতে গেলেই আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলে উঠলেন,
— খবরদার কোথাও যাবে না। কোত্থাও যাবে না। আচ্ছা রোদ? আমাকে একটা হেল্প করবে প্লিজ?
আমি অবাক চোখে তাকালাম। আমার কাছে কি হেল্প চায় উনার? আমি কৌতূহলী গলায় বলে উঠলাম,
— কি হেল্প?
— আমায় মেরে ফেলতে পারবে রোদ? প্লিজ?
উনার কথায় হৃদস্পন্দন যেনো থমকে গেলো আমার। কি সব বলছেন উনি? হঠাৎ এসব অদ্ভুত কথা কেন?আমি ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলাম,
— এসব কি বলছেন আপনি? পাগল হয়ে গেলেন?
— পাগল হয়ে যাচ্ছি রোদ। পাগল হয়ে যাচ্ছি। মেরে ফেলো না আমায়। আচ্ছা? আমি মরে গেলে কি সাহেলকে বিয়ে করবে তুমি?
— কি বলছেন এসব? এসব বাজে কথা বন্ধ করুন প্লিজ। না আপনার কিছু হবে আর না আমি অন্য কাউকে বিয়ে করবো। বুঝতে পারছেন আপনি?
শুভ্র হাসলো। খুবই মৃদুভাবে হাসলো। শীতল কন্ঠে থেমে থেমে বলে উঠলো সে,
— কে তোমায় বেশি ভালোবাসে রোদ? আমি? নাকি সাহেল? সাহেল কি তোমাকে ভিক্ষা দিলো আমায়? তুমি কি সাহেলকে ভালোবাসো রোদ?
এবার ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি। কিসব অদ্ভুত কথা বলছেন উনি। আমি সাহেল ভাইয়াকে ভালোবাসতে যাবো কেন? এতোদিন পর শুভ্র এই কথাটা কেন বলছে? কেন? আমার কান্নার শব্দ শুনে মাথা তুলে তাকালেন শুভ্র।কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলেন উনি,
— কাঁদছো কেন রোদপাখি? কার জন্য কাঁদছো? আমার জন্য? নাকি সাহেলের জন্য? আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রোদ… খুব। বন্ধুত্ব আর ভালোবাসার মধ্যে আটকে গেছি আমি। সাহেলের মুখ দেখলে কষ্ট হয় আবার তোমার মুখ দেখলেও কষ্ট হয়। এই বোঝাটা বয়ে বেড়ানো খুব কষ্টের রোদপাখি, খুব কষ্টের। ছোট থেকে কখনো কিছু সেক্রিফাইজ করতে হলে সেক্রিফাইজটা সবসময় আমিই করতাম সাহেলকে কখনো সুযোগই দিই নি। সাহেল সবসময় বলতো ” তোর এই জিতটা বেশিদিন থাকবে না শুভ্র। কোনো একদিন আমি এমন কিছু করবো যে তুই জাস্ট তাকিয়ে থাকবি।” সত্যিই আমি এবার তাকিয়েই আছি,, সাহেলের কাছে প্রথমবারের মতো হেরে গেছি।। কি করবো বলো? তোমাকে যে ছাড়তে পারি নি আমি। কেনো এলে বলো তো আমার জীবনে? কেনো এলে তুমি? আমি না পারছি বাঁচতে আর না পারছি মরতে। আমি মরে গেলেই সব ঝামেলা চুকে যেতো রোদপাখি। আমি জিতে যেতাম। আচ্ছা, আমার খাবারে বিষ মিশিয়ে দিতে পারবে না তুমি? আমার কোনো অভিযোগ থাকবে না রোদ শুধু অনুরোধ থাকবে তখনও আমার মাথাটা এভাবেই কোলে রেখো। ব্যস! আর কি চাই?

এবার আর সামলাতে পারলাম না নিজেকে। জ্বর হয়েছে বলে কি যা ইচ্ছে বলবেন নাকি উনি? মুহূর্তেই এগ্রেসিভ হয়ে উঠলাম আমি। দু’হাতে কোমর থেকে উনার হাতদুটো সরিয়ে দিলাম। মাথাটা কোল থেকে সরাতেই অবাক হয়ে তাকালেন উনি। উনি আরো অবাক হলেন যখন উনার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবালাম আমি। মনের সবটা ঝাঁঝই ঢেলে দিলাম উনার ঠোঁটে। উনি প্রথমে অবাক হলেন তারপর চোখবন্ধ করে সবটা সহ্য করলেন।। ।কিছুক্ষণ পর উনাকে ছেড়ে দিয়ে উনার বুকে মাথা রেখেই ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি। কাঁদলাম…. ইচ্ছেমতো কেঁদে নিয়ে একসময় শান্ত হয়ে গেলাম। উনি কিছু বলছেন না শুধু দেখে যাচ্ছেন আমায়। আমি হেঁচকি তুলতে তুলতেই বলে উঠলাম,
— ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি আপনাকে। কেন বুঝেন না আপনি? সেই প্রথম দিন থেকে ভালোবাসি। সেই ভালোবাসাকে কি করে অপমান করলেন আপনি? সাহেল ভাইয়াকে নিয়ে কখনো এমন কিছু ভাবিই নি। আপনাকে ছাড়া অন্যকারো দিকে কখনো চোখ তুলে তাকাই নি। না বিয়ের আগে না পরে। তবুও এই অপবাদটা কি করে দিলেন আপনি? সাহেল ভাইয়া আমাকে ভালোবাসতে পারে কিন্তু আমি তো বাসি না। সেটা উনার সমস্যা আমার নয়। আমার বিয়ের পর হুট করে একদিন জানতে পারলাম সাহেল ভাইয়া আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু তাতে কি আমার কোন দোষ ছিলো শুভ্র? অনেকেই অনেককে ভালোবাসে তাই বলে সবাই তো সবাইকে পায় না। ডক্টর আহানও ভালোবাসতো তাই বলে কি তাকেও ভালোবাসতে হবে আমায়? কলেজে সাব্বির নামে একটা ছেলে সুইসাইড এট্যাম্প করেছিলো তাহলে কি তাকেও ভালোবাসতে হবে আমায়? ভালোবাসাটা দু’দিকেই থাকতে হয়। ওয়ান সাইডেড লাভ আর কতোদূর এগোই? ভিক্ষাটা তখন হতো যখন আমি সাহেল ভাইয়াকে ভালোবাসতাম কিন্তু তা তো নয়। ভালো তো আমি আপনাকেই বাসি। উনার কাছে কি সরে যাওয়া ছাড়া অন্যকোনো অপশন ছিলো? আমি আপনাকে পেয়ে নিজেকে সুভাগ্যবতী মনে করি। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মনে হয় যখন ভাবি আপনি আমায় ভালোবাসেন। শুধু এবং শুধুই আমায় ভালোবাসলেন। কিন্তু আজ যখন জানলাম আমার জন্য আপনার মরে যেতে ইচ্ছে করে। আমি আপনার জীবনে একটা ঝামেলা মাত্র। তখন মনে হলো আমার তো বেঁচে থাকার কোনো অধিকারই নেই। আপনি ভুল বলেছেন শুভ্র। আপনি নয় আমি মরে গেলেই সব শেষ হয়ে যাবে। খাবারে বিষের কথা বললেন না? ঠিক আছে, মরবো আমি।
কথাটা বলতেই চট করে উঠে বসলেন শুভ্র। আমাকে টেনে উঠিয়ে চড় বসালেন গালে। গাল দুটো চেপে ধরে বলে উঠলেন উনি,
— এই কথা বলার সাহস কোথায় পেলে তুমি? এতোটা সাহস বেড়ে গেছে তোমার?
আমি মুচকি হাসলাম। গাল থেকে হাতটা সরিয়ে দিয়ে উনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম,
— ভয় লেগেছে? বুক কেঁপে উঠেছে? আমারও এমনটায় লেগেছিলো শুভ্র। কিন্তু আমার ভাবনা বা ভালোবাসা কোনোটায় আপনার নজরে পড়ে নি। আপনারা সবাই তো একে অন্যের জন্য সেক্রিফাইজ করতে ব্যস্ত….আমি কি চাই সেটা আপনাদের কাছে বড় বিষয় নয়। সাহেল ভাইয়া এজন্য সরে যায় নি যে আপনি আমায় ভালোবাসেন। সাহেল ভাইয়া এজন্য সরে গিয়েছে কারণ আমি আপনাকে ভালোবাসি। উনি আমার ভালোবাসাটা বুঝলেন অথচ আপনি বুঝলেন না? এবার আমাকে হারিয়ে বুঝবেন কতোটা ভালোবাসতাম আমি। ভালোবাসতে আপনারাই জানেন না আমিও জানি। আমার ভালোবাসাকে অপমান করার শাস্তি আপনাকে পেতে হবে। আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা বলার জন্য শাস্তি আপনাকে পেতে হবে। খাবারে বিষ মিশবে কিন্তু খাবারটা আপনার হবে না আমার!
আমার কথায় উনি যেনো কেঁপে উঠলেন। আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন,
— কোনো পাগলামো করো না প্লিজ। আমি সরি…আর কখনও এমন কথা বলবো না। তুমিও বলো না…
— বলবো না করবো। ছাড়ুন আমায়। আপনার জ্বরটা ভালো হওয়ার পরেই করবো। এখনই চলে গেলে আপনার সেবা করবে কে? আপনি যা কেয়ারলেস। তাই আগে জ্বর ভালো হবে তারপর বিষ থেরাপি শুরু হবে। এবার ছাড়ুন, সেবা করতে দিন আমায়।

— চুপ! একদম চুপ! আবার এসব বললে মাইর দিবো বলে দিলাম। ভালোবাসি পিচ্চি। আমার পিচ্চিটাও যে আমায় এতো ভালোবাসে বুঝি নি আমি। সরি তো।
— ডিসিশন নিয়ে নিয়েছি আমি। এখন সরি টরি তে চলবে না। ছাড়ুন আমায়….আমি কোনো হার্টলেস মানুষের বুকে থাকবো না।
— আচ্ছা ছেড়ে দিবো তার আগে গালটা দেখি। ইশশ খুব জোড়ে লেগেছে না? আমার গালেও দুটো চড় বসিয়ে দাও তো। নয়তো হাতটাই কেটে দাও। এই হাতটার এতো সাহস আবরার শুভ্রর বউকে মারে!
কথাটা বলেই বাম গাল টা অসংখ্য চুমুতে ভরিয়ে দিতে লাগলেন উনি। আমি গম্ভীর মুখে বসে আছি। বুঝতে পারছি জ্বর অনেকটায় কমে গিয়েছে উনার। কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো বিষ কোথায় পাবো আমি? অনলাইনে অর্ডার করা যায় নাকি?
#চলবে….