তোকে চাই

তোকে চাই – Season 2 ! Part- 32

জানালা দিয়ে রহিমা খালাকে ডেকে দরজা খুলতে বললাম।।রুম থেকে বেরিয়েই সোজা হাঁটা দিলাম আঙিনায়।আপুর বিয়েটা এখনও শেষ হয় নি।সবাই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত।চুপ থেকে যে অন্যায়টা আমি করেছি তার মাশুল দেবো এবার।নিজের প্রতি ঘৃণা জাগছে আমার….নিজের ভালোবাসার মানুষটার জন্য প্রতিবাদই যখন করতে পারলাম না কেমন মানুষ আমি??নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে।।আমার জন্য শুভ্র ভাইয়ার চোখে জল…!! ছি রোদ ছি।আঙিনায় রাখা চেয়ারে মুরুব্বীরা বসে আছে।আমি সোজা মামুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম….. কাঁপা গলায় বলে উঠলাম-
.
মামু?
.
মামু আমার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালেন।মামুর দৃষ্টিতেই কান্না পেয়ে গেলো আমার।নিজেকে সংযত করে বলে উঠলাম –
.
মামু?গ্রামের সবাইকে জড়ো করো প্লিজ। একঘন্টা আগে যেমনটা ছিলো ঠিক তেমন… প্লিজ মামু…প্লিজজ(করুণ গলায়)
.
মামু কিছু বললেন না।কেউ একজনকে কিছু একটা ইশারা করলেন।।দশ পনের মিনিটের মধ্যেই বিয়ে বাড়ির সব লোক এক জায়গায় জড়ো হয়ে গেলো।আমি মামুর দিকে তাকিয়ে কান্না মিশ্র গলায় বলে উঠলাম-

সরি মামু?আই এক্সট্রিমলি সরি।শুভ্র ভাইয়া আমার সাথে কিচ্ছু করে নি।উনি তো কখনো আমার দিকে খারাপ নজরে তাকায়ও নি….আর অসভ্যতামো?? ছি! মামু?আমার জন্য তোমাদের এতো অপমানিত হতে হলো প্লিজ মাফ করে দাও…প্লিজজ।
.
কথাগুলো বলতে বলতেই শরীরটা নিস্তেজ হয়ে এলো আমার হাঁটু ভেঙে নিচে বসে পড়েই হাত জোড় করে বলে উঠলাম –
.
আ..আমি সাডেন শক গুলো নিতে পারি না।এই সমস্যাটা আমার ছোট থেকেই…সাডেন কোনো পরিস্থিতিতে ডিসিশন নিতে গেলে আমি নার্ভাস হয়ে যাই… আমার নার্ভাসনেসটা এতো বেশি হয়ে যায় যে কথায় বলতে পারি না…মনে হয় গলায়,কেউ জোরে চেপে ধরে আছে।। ঘুম থেকে উঠা মাত্রই এমন একটা সিচুয়েশন ফেইস করতে হয়েছে যে আমার সবকিছুই এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো….সবকিছু।যার কারণে তখন কিছু বলতেই পারি নি আর শুধু আমার ফলিসনেসের জন্য শুভ্র ভাইয়ার এতো অপমান!!! আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে মামু!এই মুহূর্তে মরে যেতে ইচ্ছে করছে।।মরে ফেলো তো আমায়…খুবই খারাপ মেয়ে আমি মামু…খুইব।
.
কি মনে করে সটান উঠে দাঁড়ালাম।চোখের পানি মুছে রহিমা খালাকে ডেকে উঠলাম।উনি পাশে এসে দাঁড়াতেই উনার হাতটা আমার হাতে নিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে উঠলাম –
.
আমাকে ছুঁয়ে বলো তো রহিমাখালা শুভ্র ভাইয়াকে এমন কিছু করতে দেখেছো কখনো??
.
রহিমা খালা মাথা নিচু করে মাথা নেড়ে বলে উঠলেন-
.
না ছুডু আম্মা দেহি নাই।
.
উনাকে কখনো আমার দিকে বাজে নজরে তাকাতে দেখেছো?তুমি না সবসময় আমার সাথে সাথেই থাকো!!বলো দেখেছো?
.
জি না আম্মা দেহি নাই।।উনি তো কোনো মাইয়ার দিকেই তাহায় না।।সবসময় কামের মধ্যেই থাহে..
.
তাহলে এমনটা বললে কেনো রহিমা খালা?কেনো?(কঠিন গলায়)
.
আ..আপনে বুকে দুক্কুর কতা কইলেন এইজন্য আমি ভাবচি যে….মাফ কইরা দেন আম্মা!!ভুল হইয়া গেছে..
.
মাফটা যাকে দোষারোপ করেছো তার কাছেই না হয় চাইবে।।আর এই যে মজিদ চাচা?(মজিদ চাচাকে ইশারা করে) আপনি না রহিমা খালাকে ভালোবাসেন….তো উনার দোহায় দিয়েই বলুন তো.. আপনি কি কখনোই এমন কিছু দেখেছিলেন?? কখনো??
.
মজিদ চাচা মাথা নিচু করে মুখ কাচুমাচু করে বলে উঠলেন-
.
জে না আম্মা! দেহি নাই
.
তাহলে বললেন কেনো??এতো নিঃসংকোচ মিথ্যা কেন??(রাগী গলায়)
.
আসলে রহিমা আমারে আর কমলার মারে এমনডায় কইতে কইছিলো এর লাইগ্যা।মাফ করবেন আম্মা।।আমি শুভ বাজানের কাছে মাফ চামু আম্মা…মাফ কইরা দেন…এমন কাজ আর করতাম না।জিন্দিগিতেও না…এই কানে ধরলাম!

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনের দিকে তাকালাম আমি।।কি বলবো বুঝতেই পারছি না।এতোকিছুর পরও কি কিছু বলার বাকি আছে?সামনে দাঁড়ানো লোকদের মাঝে চাপা গুঞ্জন।আমি আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলাম-
.
এবার তো ঘটনার সত্যটা জানলেন আপনারা।আফসোস হচ্ছে না আপনাদের?? একটি নির্দোষ মানুষকে এভাবে হেনস্তা করার দায়ে সামন্য অনুশোচনা তো থাকা উচিত।।শুভ্র ভাইয়ার মতো একটা মানুষ যিনি মেয়েদের সাথে হাসি ছাড়া কথায় বলে না….তাকে নিয়ে এতো জঘন্য কুৎসা??লজ্জায় আমারই মাথা কাটা যাচ্ছে।।নিজের এই অপরাধবোধটা মেরে ফেলছে আমায়।আপনারা কি প্লিজ শুভ্র ভাইয়ার সামনে একবার বলবেন যে উনি নির্দোষ…ভুল ছিলো আপনাদের উনার নয়… প্লিজজ!! আমি হাতজোড় করছি আপনাদের কাছে…একটু বলবেন?
.
আবারও চাপা গুঞ্জন করে উঠলো সবাই।তাদের মধ্যে থেকে কয়েকজন বলে উঠলেন-
.
অবশ্যই কইবো। কইবো না কেন?একটা নির্দোষ মানুসরে এতো কতা হুনাইলাম।মাফ চাইমু না?সক্কলে মাফ চাইবো….
.
আমি মামুর দিকে করুণ চোখে তাকালাম মামু জলভরা চোখে মুচকি হেসে আমার মাথায় হাত রেখে বলে উঠলেন-
.
থেংকিউ মা! থেংকিউ সো মাচ!!
.
আমি অনেক কষ্টে একটু হেসে নিয়েই সাকিব ভাইয়াকে জিগ্যেস করলাম “শুভ্র ভাই কোথায়?” উনি বললেন “ছাদে!” সাথেসাথেই দৌড় লাগালাম ছাঁদের দিকে।
.
🍁
.
ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন শুভ্র ভাই।উনার সামনে যাওয়ার সাহসটাও হচ্ছে না আজ।কোনোরকম কাঁপা পায়ে উনার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিভাবে ডাকবো বুঝতে পারছিলাম না।ইতস্ততভাবে এদিকসেদিক তাকাচ্ছিলাম…চোখ ফেটে কান্না পাচ্ছে…ঠিক তখনই এদিকে না ফিরেই বলে উঠলেন শুভ্র ভাই-
.
কেন করলে এমন রোদ? কেনো??
.
আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না…কাঁপা স্বরে বলে উঠলাম- “সরি” সাথে সাথে পেছন ফিরে খুব শক্ত করে চেপে ধরলেন আমার হাত….রাগী কন্ঠে বলে উঠলেন-
.
শুধু সরি??আমার সব শেষ করে দিয়ে শুধু সরি রোদেলা??একটাবার ভাবলে না ফুপ্পি,ফুপা,গ্রামের লোক সবার সামনে আমি কতটা নিচে নেমে যাবো…কতোটা!!বাবার মাথাটাও তো হেট হয়ে গেলো শুধু আমার জন্য।এই অপমান কি সহ্য করা যায়??
.
স স সরি!!আ আমি আসলে..
.
আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই ছাদের রেলিং এ একপ্রকার ছুঁড়ে ফেললেন আমায়।সাথে সাথেই আবার চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলেন-
.
আই সয়ার রোদেলা।তোমার জায়গায় অন্যকোনো মেয়ে হলে জাস্ট খুন করে ফেলতাম তাকে…জাস্ট খুন করে ফেলতাম।কিন্তু ভাগ্য দেখো আমার..তোমার গায়ে হাত তুলতেও বুক কাঁপে আমার।।বউ বলে কথা!(তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে)
.
কথাটা বলেই ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজের চুল টেনে ধরে ফুলের টপে লাফি মারলেন উনি…ফিরে এসে আবারও চেপে ধরে চলে উঠলেন-
.
মিসেস আবরার শুভ্র?? আই জাস্ট হেইট ইউ।।জাস্ট হেইট ইউ….
.
কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকেই হুট করে জড়িয়ে দড়লেন আমায়!!ফিসফিস করে বলে উঠলেন- “কাঁদছো কেন? তোমার এই কান্নায় রাগ কমবে না আমার।স্টপ ক্রায়িং..জাস্ট স্টপ!!” আমার কান্নার বাঁধ যেনো ভেঙে গেলো এবার।নিজেকে কোনোভাবে আটকাতেই পারছিলাম না।ঠিক তখনই ছাঁদের দরজা থেকে কেউ একজন বলে উঠলো-
.
ভাই?আঙ্কেল নিচে ডাকছে….আর্জেন্ট!!
.
শুভ্র ভাইয়া আমায় ছেড়ে একরকম ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েই সিঁড়ির দিকে হাঁটা দিলেন।আমার মাথা গিয়ে লাগলো ছাদের রেলিং এর কোণে।সাথে সাথেই ঝিমঝিম করে উঠলো মাথা…তবুও কোনোরকমে ছাদের ডানপাশে গিয়ে দাঁড়ালাম…. এখান থেকে আঙিনাটা দেখা যায় স্পষ্ট।শুভ্র ভাইয়া নিচে গিয়ে দাঁড়াতেই রহিমা খালা দৌড়ে গিয়ে উনার হাত চেপে ধরলেন…উনার দেখাদেখি মজিদ চাচাও অন্যহাতটা চেপে ধরলেন।সবাই কিছু একটা বলছিলো উনাকে আর উনি অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন।।মামু গভীর আবেগ নিয়ে জড়িয়ে ধরলেন তাকে।মাকেও দেখলাম উনার মাথায় হাত রেখে মুচকি হাসলেন।আমি আর দাঁড়ালাম না,,, ছাঁদের ওই কোনটাতেই গুটিশুটি মেরে বসে পড়লাম।মাথাটা ব্যাথা করছে খুব….হয়তো ফুলে গেছে।।যাক ফুলে… যা হওয়ার হোক।শুভ্র ভাইয়ার পাওয়া ব্যাথার তুলনায় এই ব্যাথা কি খুবই তুচ্ছ নয়??
.
🍁

হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসেছিলাম ছাদের এককোণে।হঠাৎই মনে হলো কেউ একজন এসে বসেছে আমার পাশে।মাথাটা তুলে মানুষটাকে দেখতে ইচ্ছে করছে না মোটে।মাথাটা ব্যাথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে যেনো।তিন চার ঘন্টা যাবৎ একভাবেই বসে থাকায় পা,ঘাড় দুইই ব্যাথা করছে খুব…শরীর নাড়াতেও কষ্ট হচ্ছে।তবুও মাথাটা কাত করে আড়চোখে তাকালাম।শুভ্র ভাইয়া!! রেলিং এ মাথা ঠেস দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন উনি।।উনাকে দেখেই মাথা সোজা করে বসলাম…চারপাশে অন্ধকার নেমে এসেছে খেয়ালই করি নি আমি।পা দুটো সোজা করে রেলিং এ ঠেস দিয়ে বসে উনার দিকে তাকালাম।এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ছেলেটায় হয়তো আমার পাশে বসে আছে আনমনে।সন্ধ্যার হালকা আলোয় স্বর্গীয় দূতের মতো লাগছে তাকে।মাথাটা আরেকটু হেলিয়া ডান কানটা ধরে দুর্বল গলায় বলে উঠলাম আমি-“সরি!!ক্ষমা করবেন না আমায়?লাস্টবারের মতো প্লিজ।” উনি এবার আমার দিকে তাকালেন…উনার শীতল চাহনীতে সারা শরীরটাই ঠান্ডা হয়ে আসছিলো আমার।উনি খুব স্বাভাবিকভাবেই একহাতে কোমর জড়িয়ে বুকে টেনে নিলেন আমায়।ঠান্ডা গলায় বলে উঠলেন- “বেশি ব্যাথা লেগেছে মাথায়?একদম ফুলে গেছে তো।।সরি!! আর হবে না।” আমি অবাক চোখে উনার দিকে তাকিয়ে আছি…উনি আমায় সরি বলছেন?এতোকিছুর পরও??এতোটা ভালো হতে কে বলেছে উনাকে??ঋণের পাল্লা যে ভারি হয়ে চলেছে ক্রমাগত!!
.
#চলবে…