তারে আমি চোখে দেখিনি ! সিজনঃ-2 !! Part- 07
আয়াতকে টান দিয়ে মেঘ এক হাত দিয়ে আয়াতের কোমড় জড়িয়ে রেখেছে আর অন্য হাত আয়াতের পিটে রেখেছে।আয়াত এক ধাক্কা দিয়ে মেঘকে দূরে সরাতে যায় আর মেঘ আয়াতের হাতদুটি শক্ত করে ধরে বসে।আর বলে,
মেঘঃ কখন থেকে একটা কথা বলতে চাচ্ছি আর তুমি পালিয়ে বেড়াচ্ছো।সমস্যাটা কি তোমার?
আয়াতের চোখে চোখ রেখে কথাটা বলে মেঘ।আর আয়াত ভয়ে একদম নিশ্চুপ হয়ে যায়। আয়াতের কোনো সাড়া না পেয়ে মেঘ আয়াতের মুখ ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয় আর বলে,
মেঘঃ এখনো খারাপ ভাবছো আমাকে? চুপ করে থেকো না আয়াত কথা বলো?
আয়াত এবার সাহস দেখিয়ে মেঘের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে সরে দাড়ায়। তারপর বলে,
আয়াতঃ আমি যাই ভাবি সেটা আমার ব্যাপার। প্লিজ আমায় আপনারা ক্ষমা করে দিন।আমি আর কখনো এমন কিছু করবো না যাতে আপনারা বিরক্তি বোধ করেন।
মেঘঃ কিসব বলছো আয়াত।তুমি কেন ক্ষমা চাইছো?
মেঘের কোনো কথার উত্তর না দিয়েই বলে,
আয়াতঃ দেখুন স্যার! আমার মাম্মাম অসুস্থ তাই আজ ভার্সিটিতে আসতে পারে নি।আমাকে তারাতাড়ি ফিরতে হবে। আল্লাহ হাফেজ!
কথাটা বলে আয়াত চলে যেতে লাগে আর মেঘ আয়াতের হাতটা শক্ত করে ধরে বসে।
মেঘঃ আমার তোমার সাথে কথা বলা এখনো শেষ হয় নি আয়াত।
আয়াতঃ আমার হাতটা ছাড়ুন স্যার!
মেঘের খেয়াল আসে হ্যাঁ সে আয়াতের হাতটা ধরে আছে।আর সঙ্গে সঙ্গে আয়াতের হাতটা ছেড়ে দেয়। তারপর আয়াত ঘুরে মেঘের সামনে দাড়ালে মেঘ বলে,
মেঘঃ বিশ্বাস করো আয়াত আমি কিচ্ছু করি নি।লাবন্যর এমন জঘন্য প্লানের সাথে আমি যুক্ত নই।আমি জানতাম তুমি আর আমি একই রুমে আছি এটা শুনলে লাবন্য রুমের দরজাটা খুলে দেবে।তাই আমি লাবন্যর প্লানটা শুনে আগে থেকেই ওখানে লুকিয়ে ছিলাম।
আয়াত পাশ ফিরে দেখে কাঁদা মাখা শরীরে লাবন্য মাথাটা নিচু করে মাটিতে বসে কাঁদছে। আর ভার্সিটির সকলে লাবন্যকে দেখে হাসছে।আজ যেন লাবন্যর নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে।লজ্জায় লাবন্য কিছু বলতেও পারছে না।মেঘ আরও কিছু বলতে যাবে আয়াত না শুনেই লাবন্যর কাছে চলে আসে।আর নিজের গায়ের চাদরটা খুলে লাবন্যর শরীরে জড়িয়ে দেয়।তারপর লাবন্যকে উঠিয়ে ওয়াশরুমে নিয়ে যেতে লাগে।মেঘ সেটা দেখে আয়াতকে বলে,
মেঘঃ এসব তুমি কি করছো আয়াত?
আয়াতঃ যেটা করলে আমার আল্লাহ খুশি হবে সেটা করছি।
মেঘঃ মানে?
আয়াত আসপাশের দিকে ইশারা করে দেখায়।ভার্সিটির মাঠের মাঝখানে লাবন্য কাঁদা মাখা শরীরে পরে আছে আর সেটা দেখে সকলে হাসছে।
মেঘঃ তো কি হয়েছে? এটাই ওর জন্য উচিৎ শিক্ষা হয়েছে।আর তুমি ভুলে গেলে ও কি কি করেছে তোমার সাথে?
লাবন্যঃ না ভুলিনি।
মেঘঃ তাহলে? ওকে ওর অবস্থায় থাকতে দাও।এভাবেই ওর শিক্ষা হোক।বাড়ি যাচ্ছিলে না তুমি যাও বাড়িতে যাও।
আয়াতঃ না স্যার! এই অবস্থায় এই বোনকে ফেলে রেখে আমি যেতে পারবো না।তাছাড়াও কেউ ইট মারলে তাকে পাটকেলটা মারা শিখিনি আমি।
আয়াতের কথাটা শুনে লাবন্য আয়াতের দিকে এক অনুশোচনাময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।আর আয়াত লাবন্যকে ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়। আর সেখানে লাবন্যর গায়ের থেকে কাঁদা ধূয়ে পরিষ্কার করে দেয়।
লাবন্য আয়াতকে জোড়িয়ে ধরে কাঁদে। আর কাঁদতে কাঁদতে বলে,
লাবন্যঃ আমি সত্যিই খুব খারাপ আয়াত।তোমার গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেছি।সবসময় সবাইকে হেনস্তা করতে চেয়েছি।আর আজ দেখও সবাই আমাকে নিয়ে হাসছে।
আয়াতঃ না বোন! আপনি আপনার নিজের ভুলটা যে বুঝতে পেরেছেন এটাই অনেক।
লাবন্যঃ আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও আয়াত!
আয়াতঃ ছিঃ কি বলছেন আপু? আপনি, আমার বড়।প্লিজ ক্ষমা চাইবেন না।শুধু একটা রিকুয়েষ্ট করবো রাখবেন?
লাবন্যঃ একটা কেন হাজারটা বলো?
আয়াতঃ আর কখনো এমনটা কারও সাথে করবেন না।
লাবন্যঃ প্রমিস! আর করবো না।
আয়াত বাড়িতে এসে ছুটে তার মাম্মামের রুমে যায় এটা দেখতে যে তার মাম্মাম এখন কেমন আছে।কিন্তু সেখানে গিয়ে যেটা দেখে তারপর আয়াত আর নিজেকে সামলাতে পারে না।যেন বড়সড় একটা ধাক্কা খাই আয়াত।আয়াত তার মাম্মামের রুমের সামনে দাড়িয়ে আছে আর দেখছে মাহিরের শরীরের উপর নিজের সবটুকু ভার ছেড়ে দিয়ে শুয়ে আছে মায়া।আর মাহিরও মায়াকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।পাশের দরজার শব্দে মায়া আর মাহির চেয়ে দেখে আয়াত দাড়ানো।সঙ্গে সঙ্গে মায়া মাহিরের উপর থেকে উঠে বসতেই আয়াত চলে যায়। আর মায়া চিন্তা করে এবার আয়াতকে কি বোঝাবে?
মাহিরঃ কি হলো মায়া? কে ছিলো ওই মেয়েটা?
মায়াঃ আপনার মেয়ে আয়াত!
মাহিরঃ আমার মেয়ে আয়াত? আমি কখনো ওকে দেখি নি।যখন ও তোমার গর্ভে ছিলো তখন আমি তোমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম।চলো মায়া ওর সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবে।
মায়াঃ অনুভব!
মাহিরঃ হুমমমম।
মায়াঃ আয়াত জানে না আপনি বেঁচে আছেন।আপনার যখন জাবৎ জীবন জেল হয়েছিলো। আমি দেখা করতে গেলেও আপনি দেখা করতেন না।তখন আমি সিদ্ধান্ত নিয় আমাদের মেয়েকে জানাবো না তার বাবা বেঁচে আছে।এতে ও কস্ট পেত না বলুন?
কথাটা বলে মায়া কাঁদতে থাকে। মাহির মায়াকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়।
মাহিরঃ আবার কাঁদছো তুমি মায়া? আমি বলেছি না আর না কাঁদতে? তুমি যা করেছো ঠিক করেছো।আমাদের মেয়ের কথা ভেবেই করেছো।
হঠাৎ মাহির আর মায়া জিনিসপত্র ভাঙার আওয়াজ পাই।শব্দটা আয়াতের রুম থেকে আসছে।দুজনে এগিয়ে আয়াতের রুমের সামনে আসে।বাড়ির সকলেও আসে।এসে দেখে আয়াতের রুমের দরজাটা ভেতর থেকে লক করা।সকলে আয়াতকে ডাকে আয়াত দরজাটা খোলে না দেখে মাহির দরজাটা ভেঙে ফেলে।আয়াতের রুমে ঢুকে আয়াতকে ধরে বিছানার উপরে বসায়। আর আয়াতকে শান্ত হতে বলে।আয়াত চোখ তুলে তার মায়ের দিকে তাকায় না।বাড়ির সবাইকে বলে,
আয়াতঃ তোমরা জানো মাম্মাম কি করেছে? প্লিজ মাম্মামকে আমার সামনে থেকে তোমরা চলে যেতে বলো।সাথে এই লোকটাকেও।
কথাটা শুনতেই মায়া হাটু নুইয়ে আয়াতের সামনে বসে পরে।আর বলে,
মায়াঃ আমাকে ভুল বুঝছিস আয়াত। তুই যা দেখেছিস আমাকে একটু বোঝাতে দে?
আয়াত এক ঝাড়া দিয়ে মায়ার সামনে থেকে চলে আসে।আর রুসার রুমে গিয়ে দরজাটা আটকিয়ে রুসার পাশে এসে বসে থাকে। আর কেঁদে কেঁদে রুসাকে বলে, যা দেখেছে।
রুসার রুমের সামনে এসেও মাহির, মায়া আর বাড়ির সকলে আয়াতকে ডাকে।আয়াতকে ডাকার সময় রুসার কানে মাহিরের কন্ঠ আসে।রুসা স্পষ্ট শুনতে পায় তার ভাইয়ের কন্ঠ।এতোদিন পর ভাইয়ের কন্ঠ শুনে রুসার দুই চোখ বেয়ে পানি পরতে থাকে।রুসার ঠোঁট জোড়া থরথর করে কাঁপে যেন কিছু বলতে চাই।আয়াত রুসার চোখে পানি দেখে মুছিয়ে দেয়।তাকিয়ে দেখে রুসার হাতদুটো কাঁপছে।
আয়াতঃ কি হয়েছে ফুপ্পি? তুমি এমন করছো কেন?
রুসা মাহির ভাইয়া বলে চিৎকার দিয়ে উঠে বসে।আয়াতকে বলে,
রুসাঃ আমার মাহির ভাইয়া এসেছে আয়াত?
আয়াত অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুসার দিকে। এইভাবে রুসার সুস্থ হয়ে ওঠায় আয়াত খুশি হলেও মনের মধ্যে হাজারও প্রশ্ন ভর করছে আয়াতের।
রুসা দরজাটা খুলে দেয় আর সকলে হা হয়ে তাকিয়ে থাকে রুসার দিকে। কারও যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না রুসা সুস্থ হয়ে ওঠেছে।সকলে রুসাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। তরপর মাহির রুসার সামনে এসে দাড়ালে রুসা মাহিরের পা জড়িয়ে ধরে। আর বলে,
রুসাঃ আমাকে ক্ষমা করে দাও ভাইয়া! আমি ভুল করেছি।
মাহির রুসাকে উঠায়।আর জড়িয়ে ধরে কাঁদে।বলে,
মাহিরঃ তুই কোনো ভুল করিস নি বোন।যা করেছিস তোর ভালোবাসার জন্য করেছিস।সব দোষ তো স্নিগ্ধার।
আয়াত পেছনের থেকে বলে ওঠে,
আয়াতঃ স্নিগ্ধা কে?
মায়াঃ একটা ডাইনি।ওকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়ে আমরা বেশ ভালোই ছিলাম।আবিরের আর রুসার বিয়ের দিন ছিলো সেদিন।যেদিন স্নিগ্ধা আবার ফিরে আসে।একটা ভয়ংকর রূপে ফিরে এসেছিলো স্নিগ্ধা।বিয়ের দিন আবিরকে কিদনাপ করে সরিয়ে ফেলে।তারপর আবিরকে মেরে ফেলার হুমকি দেখিয়ে রুসাকে ব্ল্যাকমেইল করে।আমার পালিত বাবা-মা মুফতি খান আর সাহেদ খানকে রুসা স্নিগ্ধার কাছে দিয়ে রুসা আবিরকে ছাড়িয়ে আনে।তখন আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে স্নিগ্ধা। আমি যেন আমার অনুভবের সাথে ওর বিয়ে দিই।নইলে ও আমার বাবা-মাকে মেরে ফেলবে।আমি ওর হুমকি বিশ্বাস করি না।ভেবেছিলাম ও এমনি ভয় দেখাই।কাউকে মেরে ফেলার ক্ষমতা আর সাহস ওর মধ্যে নেয়। ওকে বলেছিলাম মেরে ফেলো তবুও আমি আমার অনুভবে তোমার হতে দেবো না।আর ও সত্যি সত্যি আমি চোখের সামনে আমার বাবা-মাকে গুলিতে গুলিতে ঝাঝড়া করে দেয়।মেরে ফেলে আমার বাবা-মাকে স্নিগ্ধা।তাই আমিও রাগে স্নিগ্ধাকে গুলি করি।তারপর অনুভব আসে।আর নিজের কাঁধে আমার খুনের সব দোষ তুলে নেয়। তখন তুই আমার গর্ভে ছিলি। তোর বাবা তোর ভবিষ্যতের কথা ভেবে চাইনি ওই অবস্থায় আমি জেলে যায়।
আয়াতঃ তাহলে আবির আঙ্কেল এখন কোথায়?
মায়াঃ তোর বাবার জেল হবার পর রুসা আর আবিরের আবার বিয়ের আয়োজন করা হয়।সেই বিয়ের সময় আবিরের অফিসের বস নেহা চৌধুরী একটা তিন বছরের ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েকে এনে আবিরের সামনে রাখে।আর আবিরকে বলে, বাচ্চাটা আবিরের। তিন বছর নেহা চৌধুরী দেশের বাইরে ছিলো।আর পাসপোর্টের ঝামেলায় দেশে আসতে পারে নি।বাচ্চাটা বাইরের দেশেই ভূমিষ্ট হয়েছে।আমরা কেউ তার কথাই বিশ্বাস করি নি।তোর বাবার বন্ধু ছিলো আবির।আমরা জানতাম আবির কখনো এমনটা করতে পারে না।কিন্তু আবির নিজেই বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নেয় আর স্বীকার করে বাচ্চাটা তারই।
আয়াতঃ আর ফুপ্পির এমন অবস্থা কিভাবে হলো?
মায়াঃ আবির বিয়ের আসর ছেড়ে চলে যায় রুসাকে ফেলে রেখে নেহা আর তার বাচ্চা মেয়েটার সাথে।রুসা অনেকবার আবিরকে ডাকে।আবির ঘুরে তাকায় না।আবির চলে যাওয়ার পর আবিরকে অনেকবার ফোনও করে কিন্তু আবির রুসার ফোন রিসিভ করে না।রুসা কখনো কল্পনাও করতে পারে নি তার ভালোবাসার মানুষটি এইভাবে তাকে ঠকাবে।রুসা আবিরকে পাগলের মতো ভালোবাসতো। তাই এই ধাক্কাটা সহ্য করতে পারে নি।কস্টে রুসা আত্নহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। তিন তলা ছাদ থেকে ঝাপ দেয় রুসা।আর তারপর থেকে আজ পর্যন্ত রুসা বেঁচে মৃত লাশের মতো পড়ে ছিলো।
আয়াত সবকিছু শুনে নিজের ভুল বুঝতে পারে।মায়ার সামনে হাত জোড় করে ক্ষমা চায় আয়াত। আর নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়।মাহির আর মায়া আয়াতকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে।আর বলে, আজ থেকে আর কোনো ভুল বোঝাবুঝি নয়।আমরা সকলে মিলেমিশে থাকবো।ভালো থাকবো।আর কেউ আসবে না আমাদের জীবনে অশান্তি নিয়ে।
,
,
,
ওদিকে,,,,
ভার্সিটি থেকে লাবন্য বাড়িতে গিয়ে অনেকক্ষণ নিজেকে রুমে বন্দী করে রাখে।সারাদিন কিছু খাই নি।এমনকি কেউ লাবন্যর খোঁজ পর্যন্ত নেয় নি।লাবন্য খেয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা ও করে নি।রাতে আবির অফিস থেকে ফিরে লাবন্যর রুমে আসে।দেখে লাবন্য ঘুমিয়ে আছে।আর লাবন্য চোখে মুখে কান্নার পানির দাগ।আবির বুঝতে পারে লাবন্য হয়তো খুব কেঁদেছে কিন্তু কেন?
,
,
,
চলবে,,,,,,