1. নতুন গল্পঃ2. ছোট গল্প গুলোঃ

কালো মেয়ে!! লেখাঃ মেহরাব নয়ন

মিহির আমাকে করা প্রথম মেসেজটা ছিলো-
“আমি কালো বলে আমার ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট এক্সেপ্ট করেন নি তাইনা”?
মেসেজটা চোখে পড়তেই বড্ড অবাক হলাম। ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট না করার জন্য এরকম মেসেজ সাধারণত আজ পর্যন্ত কেউ করেনি।
মেয়েটার আইডিতে ঢুকে দেখলাম প্রোফাইল পিকচার এবং কভারে কালো একটা মেয়ের পিক দেওয়া। এক্সেপ্ট করে মেসেজের রিপ্লাই দিলাম-
— নিজেকে অনেক ছোট মনে করেন আপনি?
কয়েক সেকেন্ডের ভিতরে রিপ্লাই আসলো-
— না, কিন্তু কোনো রাইটারকে এড দিলে নিজেকে ছোট লাগে। এমনিতেই তারা কারো রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করেনা, তার উপর আবার আমার মতোন কালো একটা মেয়ে !!
— কালো মানেই অসুন্দর এটা আপনাকে কে বললো”?
— দেখুন রাইটার সাহেব, এই দুনিয়ায় সবচাইতে অবহেলিত মেয়ে মানুষ তারা যাদের রঙ কালো। আর আমি তাদের মধ্যেই একজন !!
— আপনার সাথে তর্কে যেতে চাইনা। শুধু একটা কথা বলি মাথায় রাখবেন, ফর্সা মানেই সুন্দর বা কালো মানেই অসুন্দর না। যার মনটা যত বেশি ফ্রেশ, সে ততো বেশিই সুন্দর। কালো মানেই অসুন্দর হলে আল্লাহ কখনো ক্বাবাঘর কালো করে দিতেন না। আর মানুষ কালো ঘরটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতোনা !!
কিছু সময়ের জন্য মেয়েটা আমার মেসেজ সিন করে রেখে দিলো। রাগ করছে না’কি কোনো কিছু ভাবছে আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। প্রায় মিনিট তিনেক পরে রিপ্লাই আসলো-
–মেহরাব স্যার, কথাগুলো একদম মনের ভিতর এসে লেগেছে। নিজেকে আর কখনো কালো বলে ছোট মনে করবোনা। ধন্যবাদ আপনাকে !!
.
মিহির সাথে প্রথম পরিচয়টা এভাবেই হয়েছিলো। ওইদিনের পর থেকে প্রায় প্রতিদিন আমাদের টুকটাক চ্যাট হতে থাকে। আমি মিহির সাথে কথা বলার পর বুঝতে পারলাম
“মেয়েটা অনেক একলা। বয়ফ্রেন্ড তো দূরে থাক, ওর কোনো ফ্রেন্ড ই নাই। মেয়েটাকে দেখতাম সারাদিন অনলাইনে পড়ে থাকতো।
“হয়তো এই পৃথিবীর সবচাইতে একলা মানুষগুলোই অনলাইনে সবচেয়ে বেশি এক্টিব থাকে” !!
.
প্রায় ৩ সপ্তাহ পর একদিন সকালে মিহি একটা মেসেজ করলো-
–মেহরাব আমি তোমাকে একটা রিকুয়েস্ট করি? তুমি প্রমিস করো আমাকে “না” করবে, রিকুয়েস্টটা রাখবেনা !!
বড্ড অবাক হলাম মিহির মেসেজ দেখে। রিপ্লাই দিলাম-
— কি অদ্ভুত। কেউ “না” শুনার জন্য কোনো রিকুয়েস্ট করে? তাও আবার আগে না বলতে হবে”??
— হু। রিকুয়েস্টটা রাখবেনা বলো, তাহলেই আমি বলবো !!
–আচ্ছা ওকে। বলো কি রিকুয়েস্ট”?
— মেহরাব আমি জানি আমি তোমার ফ্রেন্ড হওয়ার যোগ্য না। তারপরেও বলছি, এই কালো মেয়েটার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করবে? ফেসবুক ফ্রেন্ডশিপের একটু উপরে আমাকে জায়গা দিবে”?
সাথে সাথে আরেকটা মেসেজ পেলাম “এবার তুমি না বলো”।
আমি বুঝতে পারছিলাম মিহি আসলে ঠিক কি চাচ্ছে। সত্যি বলতে আমি এই মেয়েটাকে যতোই দেখছি ততোই অবাক হচ্ছিলাম। কিছু তো আছে এই মেয়েটার ভিতর। নিজেই আমাকে ফ্রেন্ডশিপ করার জন্য বলছে, আবার উল্টো আমাকেই রিজেক্ট করতে বলছে, অদ্ভুত। আমি বললাম-
— আচ্ছা আমাকে “না” করতে বললে কেনো”?
–তুমি না করলে নিজের মনকে এই বলে শান্ততা দিতে পারবো যে আমি রিকুয়েস্ট করার জন্যই তুমি “না” বলছো। অন্যথায় “হ্যা” বলতে।
এই মেসেজটা দেখে আমি আর কোনো রিপ্লাই দিলাম না। কিছু মেসেজের রিপ্লাই দেওয়া যায়না, কিছু মেসেজের কোনো রিপ্লাই হয়না” !!
.
ওইদিনের পর প্রায় ৬মাস কেটে গেছে। এই ৬মাসে এমন একটা দিন নেই যে দিনটা আমি মিহির সাথে কথা বলিনি। এমন কোনো ঘটনা নেই যেটা আমি ওর সাথে শেয়ার করিনি। কিভাবে যে মিহির সাথে এত্তটা ক্লোজ হয়ে গেলাম নিজেও বুঝতে পারিনি। কিন্তু এই ৬মাসে আমি এটা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছি
“এই মেয়েটার মন অনেক ভালো। অসম্ভব রকমের ভালো” !!
.
ওইদিন রাতেই মিহি আমাকে কল দিয়ে বললো-
-মেহরাব, আগামীকাল আমাকে দেখতে আসছে”।
কথাটা শুনে আমি কেনো জানিনা খুশি হলাম। বললাম-
-আরে বাহ, এটাতো খুশির খবর”।
মিহি কিছু সময় চুপ করে রইলো। একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো-
“জানো মেহরাব? আগেরবার যে ছেলেটা আমাকে দেখতে আসলো, ওই ছেলেটাও না কালো ছিলো। কিন্তু ওনারা তারপরেও ৫লক্ষ টাকা চাইলো। আমার মতো কালো মেয়েকে বিয়ে করার জন্য না’কি ৫লক্ষ টাকা অনেক কম।
আমার আব্বুর তো এতো টাকা দেওয়ার ক্ষমতা নাই, আব্বু বললেন ২লক্ষ টাকা দিতে পারবেন। ওরা শেষে বললো ৪ লক্ষ।
আমি দরজার আড়াল থেকে নিজেকে কোরবানির পশুর মতো দামদর হতে শুনলাম। এখন দেখা যাক আগামীকাল ওরা এসে কতো টাকা চায়”।
আমি মিহিকে ঠিক কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। চুপ করে রইলাম।
মিহি আবার বললো-
“এই জীবনটা আর ভালোলাগেনা মেহরাব, আমার মাঝেমধ্যেই মনে’হয় এই দুনিয়াটা আমার জন্য না। আমি কখন কি করে ফেলি ঠিক নাই”।
মিহিকে একটা ধমক দিলাম। এসব উল্টাপাল্টা চিন্তা মাথা থেকে বের করার জন্য বললাম। কিন্তু আমি জানি, আমি যাই বলিনা কেনো এটা স্রেফ ওর কাছে একটা শান্তনা মনে হবে”।
.
পরেরদিন সকাল থেকে মিহির নাম্বারটা সুইচ অফ পাই। সারাটাদিন নাম্বার সুইচ অফ ছিলো, সারাদিন আমি মিহির নাম্বারটা ডায়েল করেছি, কেনো এতোবার ডায়েল করেছি নিজেও জানিনা। কিন্তু ভিতরটায় অনেক ভয় লাগছিলো।
বারবার মনে হচ্ছিলো কিছু একটা নেই, কিছু একটা হারাতে যাচ্ছি।
ফেসবুকে গিয়ে একটু পর পর মিহির আইডি চেক করছিলাম।
প্রচন্ড টেনশন আর অস্বস্তি লাগছিলো।
ঠিক ওই মুহুর্তে আমি ফিল করতে পারলাম “আমি মিহিকে ভালোবেসে ফেলেছি”… আমি এটাও অনুভব করলাম এই ভালোবাসায় কোনো শরীরের চাহিদা নেই। এই ভালোবাসায় কোনো সুন্দর চেহারার মায়া নেই। জাস্ট একটাই চাওয়া “আমার ঐ মানুষটা লাগবে… ঐ সুন্দর মনের মানুষটা”।
.
সারাদিন পর ওইদিন রাত ১টায় মিহি আমাকে কল দিলো।
“হ্যালো মেহরাব”।
আমি বড় একটা নিশ্বাস নিলাম। মনে হলো বহু বছর পর মিহির কন্ঠ শুনছি। কোনো কথা বলতে পারলাম না। ওপাশ থেকে মিহি আবারো বললো-
— মেহরাব সরি, কারেন্ট ছিলোনা সারাদিন। মোবাইলে একদম চার্জ ছিলোনা, সরি।
আমি আবারো কোনো কথা বললাম না। আমার মনে তখন একটাই কথা বারবার রিপিট হচ্ছে “আমি এই মেয়েটাকে আর হারাতে পারবোনা। এম মুহুর্তের জন্য ও না”।
মিহিকে জিজ্ঞাস করলাম-
“দেখতে আসছিলো তোমায়”?
মিহি হাসলো, মিথ্যা হাসি। বললো-
-হু আসছিলো। কিন্তু কালো মেয়েকে কারো পছন্দ হয়”?
আগের রাতে যে মেয়েটাকে দেখতে আসছে শুনে আমার মন খুশি হয়েছিলো, ঠিক তার পরের রাতে ওই মেয়েটাকে পছন্দ হয়নি শুনে আমার মনটা আবারো খুশি হলো৷ কি অদ্ভুত এই মনের খেলা।
মনে মনে ভাবলাম
“এখন ই মিহিকে বলে দিবো তোমাকে ভালোবেসে ফেলছি। না’কি দেখা করে বলা উচিত?? মিহিকে জিজ্ঞাস করলাম-
— আচ্ছা মিহি, তোমার ইচ্ছা হয়না আমার সাথে দেখা করতে??
— হয়তো, অনেক ইচ্ছে হয় !!
— তাহলে চলো আগামীকাল দেখা করি?
মিহি কথাটা শুনে অনেক খুশি হলো। বললো-
–সত্যিইই? সত্যি দেখা করবা”?
— হু, বলো কোথায় দেখা করবে”?
প্রশ্নটা শুনে মিহি এবার একটু বিষণ্ণ হয়ে গেলো। মন খারাপ করে বললো-
— কিন্তু মেহরাব আমার চেহারা যে কালো। আমি কিভাবে দাঁড়াবো তোমার সামনে”?
— উফফফ মিহিইই। তুমি এসব কথাবার্তা কবে বাদ দিবা? আগামীকাল আমাদের দেখা হচ্ছে ওকে? আমি মেসেজ করে তোমাকে জায়গা বলে দিচ্ছি”।
— হু ওকে”।
.
সত্যি বলতে মনের ভিতর একটা আনন্দ কাজ করছিলো। ভালোবাসার মানুষটাকে প্রথমবার কাছ থেকে দেখার আনন্দ। কিন্তু এই মেয়েটা কালো বলে নিজেকে এতো অসহায় মনে করে কেনো? আচ্ছা পৃথিবীর সব কালো মেয়েরাই কি মিহির মতো এরকম অসহায় ফিল করে”??
.
পরেরদিন বিকাল বিকাল ৩টা। ঠিক একঘন্টা পর মিহির সাথে আমার দেখা হওয়ার কথা, একটা রেস্টুরেন্টে।
বাসা থেকে বের হওয়ার পর মিহিকে কল দিলাম, নাম্বার সুইচ অফ। পুরো রাস্তা যেতে যেতে মিহিকে কল দিলাম, নাম্বার সুইচ অফ।
অনেক রাগ হচ্ছিলো মিহির উপর। আমি বারবার বলেছি নাম্বারটা যাতে খুলা রাখে, মোবাইলের চার্জ যাতে ফুল থাকে। কিন্তু ওর নাম্বারটা এখন অফ।
রেস্টুরেন্টে গেলাম ঠিক চারটা বাজার ১০মিনিট আগে৷ আবারো মিহিকে কল দিলাম, কিন্তু স্টীল নাম্বারটা সুইচ অফ বলছে।
.

.
অনেক রাগ হচ্ছিলো মিহির উপর। আমি বারবার বলেছি নাম্বারটা যাতে খুলা রাখে, মোবাইলের চার্জ যাতে ফুল থাকে। কিন্তু ওর নাম্বারটা এখন অফ।
রেস্টুরেন্টে গেলাম ঠিক চারটা বাজার ১০মিনিট আগে৷ আবারো মিহিকে কল দিলাম, কিন্তু স্টীল নাম্বারটা সুইচ অফ বলছে। ভাবলাম রেস্টুরেন্টের ভিতরে গিয়ে কিছু সময় অপেক্ষা করি, ভালোবাসার মানুষটার জন্য একটু অপেক্ষা তো করাই যায় !!
.
বিকাল ৫টা, প্রায় ১টা ঘন্টা হয়ে গেছে কিন্তু মিহির কোনো খুঁজ নাই। মোবাইলটা বের করে মিহিকে আবারো কল দিলাম। উফফফ, নাম্বারটা এখনো সুইচ অফ। মনেহয় মোবাইলের চার্জ দিতে ভুলে গেছে। কিন্তু কতো সময় এভাবে অপেক্ষা করা যায়? তাও আবার ভালোবাসার মানুষটাকে প্রথমবার দেখার অপেক্ষা।
ঠিক ওই মুহুর্তে আমার মনে হলো “পৃথিবীর সবচাইতে কঠিন কাজ হচ্ছে অপেক্ষা করা”।
.
সন্ধ্যা ৬টা, আমি এখনো অপেক্ষায়। আমার বিশ্বাস মিহি আসবে। হয়তো কোথাও জ্যামে আটকে আছে।
পকেট থেকে মিহির জন্য নিয়ে আসা আংটিটা বের করলাম।
আংটির দিকে তাকিয়ে চিন্তা করতে থাকলাম মিহিকে কিভাবে প্রপোজ করবো? আচ্ছা মিহি আসার পরে তাকে কি বকা দেওয়া উচিত? এত্ত দেরি করে কেউ? এসব চিন্তা করছিলাম ঠিক এমন সময় আমার টেবিলের ঠিক সামনের টেবিলে বসা ৩টা মেয়ে অনেক জোরে “হেহেহে” করে হেসে উঠলো। এই সময় ওদের হাসির আওয়াজ আমার কাছে পেত্নীদের হাসির চাইতেও জঘন্য লাগছে।
কিন্তু একটা ব্যাপার খেয়াল করে দেখেছি এই ৩টা মেয়ে আমি আসার আগে থেকেই এখানে বসে আছে।
এমনি কিসব আজাইরা গল্প করছে, আর একটু পর পর এটা সেটা খাচ্ছে।
ওরা যাই করুক তাতে আমার কি??
আমি তো ব্যাস অপেক্ষা করছি। মিহির অপেক্ষা !!
.
সন্ধ্যা ৭টা, মিহি এখনো আসেনি।
আমার মনের ভিতর ভয় কাজ করা শুরু করলো।
এখন পর্যন্ত মিহি না আসার ২টা কারণ হতে পারে। এক, মিহির কোনো বিপদ হয়েছে। দুই, মিহি আমার ভালোবাসার সাথে বেঈমানী করেছে। আমি মনে মনে দোয়া করলাম যাতে ২য়’টাই হয়। অন্তত মিহির যেনো কোনো ক্ষতি না হয় !!
.
রাত ৮টা, মন খারাপ করে টেবিলের উপর মাথা দিয়ে বসে আছি। খুব বেশি কান্না পাচ্ছে, কিন্তু পাবলিক প্লেসে কান্না করাটা একদম ঠিক হবেনা।
সামনের টেবিলের ওই মেয়েগুলোকে দেখলাম এখনো বসে আছে, অবশ্য তারা আমার দিকে তেমন একটা খেয়াল করছেনা। আচ্ছা আমার কি এখন চলে যাওয়া উচিত? হয়তো চলে যাওয়াটাই উচিত হবে। ঠিক করলাম আরো ৩০মিনিট অপেক্ষা করবো, তারপর চলে যাবো !!
.
শেষবারের মতো মিহির নাম্বারটায় কল দিলাম, আবারো বললো সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা।
আমার চোখটা না চাইতেও ভিজে যাচ্ছে। পকেট থেকে টিস্যু বের করে চোখটা মুছতেছি, এমন সময় দেখলাম ওই মেয়েগুলো আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। নীল শাড়ি পড়া একটা মেয়ে বললো-
“একটু বসতে পারি”?
যদিও ইচ্ছা ছিলোনা হ্যা বলার, তারপরেও ভদ্রতা সরুপ হ্যা বললাম। ৩টা মেয়েই আমার অন্য পাশে বসলো। এবার আমি তাদের দিকে একটু ভালোভাবে খেয়াল করলাম।
২টা মেয়ের পড়নে ছিলো ড্রেস, একজনের কালো ড্রেস, অন্যজনের সাদা।
যে বসার পারমিশন চাইলো তার পড়নে ছিলো নীল শাড়ি।
সাদা ড্রেস পড়া মেয়েটার রঙ একটু কালো, কিন্তু চেহারায় অনেক মায়া আছে। কালো ড্রেস পড়া মেয়েটার চেহারা অনেক সুন্দর, ঠিক পূর্ণিমার মতো বলা যায়। আর নীল শাড়ি পড়া মেয়েটার চেহারাও যথেষ্ট সুন্দর।
যাইহোক, ওদের চেহারা দেখে আমার কি লাভ? ওরা যেমন ই হোক তাতে আমার কি?? কি জন্য এখানে বসেছে, বা কি বলতে চায় সেটাই হচ্ছে আসল কথা !!
.
নীল শাড়ি পড়া মেয়েটাই প্রথমে বলা শুরু করলো-
-হাই আমি মায়া”।
কোনো উত্তর দিলাম না আমি।
সত্যি বলতে এই সময়ে কথা বলার মতো মন বা ইচ্ছা কোনোটাই আমার নেই। মাথা থেকে আমার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো সরাতে পারছিনা। মিহি আমার সাথে কিভাবে এমনটা করতে পারলো??
মেয়েটা আবারো প্রশ্ন করলো-
-আচ্ছা আপনার কি মন খারাপ?
আপনি কি কান্না করছিলেন? আপনার চোখগুলা এমন টলমল করছে কেনো”?
এই মুহুর্তে মেয়েটার প্রশ্নগুলো আমার কাছে বিষের মতো লাগছে।
আমি আবারো কোনো উত্তর দিলাম না।
মেয়েটা বললো-
-আপনি চাইলে কিন্তু আমাদের সাথে শেয়ার করতে পারেন। জানেন তো কষ্ট শেয়ার করলে নিজেকে হালকা লাগে”।
মেয়েটার এই কথাটা আমার ভীষণ ভালো লাগলো। ভাবলাম আসলেই এই ৬মাসের গল্পটা কাউকে বলা দরকার। আজকের কাহিনীটা কাউকে শুনানো দরকার, তাহলে হয়তো মনে একটু শান্তি পাবো। কিন্তু ওই ড্রেস পড়া ২টা মেয়ে এখনো কোনো কথা বলছেনা কেনো বুঝতে পারলাম না।
যা বলার মায়া নামের মেয়েটা একলাই বলছে। অবশ্য কে কথা বললো, কে বলছেনা এগুলো আমার দেখার বিষয় না। আমি জাস্ট নিজের কথাগুলো কাউকে বলে আমার কষ্টের ভারটা একটু কমাতে চাচ্ছিলাম। আমি মিহির গল্পটা ওদেরকে বলা শুরু করলাম।
.
সবকিছু খুলে বলার পর ৩টা মেয়েই একসাথে হেসে উঠলো। এবার কাছ থেকে ওদের হাসিটা আর পেত্নীদের মতো লাগছেনা, দেখতে ভাললাগছে। ৩জনের হাসিই সুন্দর। কিন্তু আমার কষ্টের কথা শুনে ওরা হাসছে কেনো?? কারো কষ্টের কথা শুনে কেউ মজা পায়?
মায়া নামের মেয়েটা হাসতে হাসতেই আমাকে বললো-
-তারমানে আপনি বলতে চাচ্ছেন এই যুগেও এমন ছেলে আছে? এই যুগেও এরকম ভালোবাসা সম্ভব?
আপনি এতোটাই ভালো যে মিহির চেহারা যেমন’ই হোক আপনি তাকে ভালোবেসে যাবেন? হ্যালো স্যার, এটা কোনো মুভি না ঠিক আছে”?
আমি মেয়েটার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলাম না। বুঝতে পারলাম মেয়েটা কখনো কাউকে সত্যিকার’ভাবে ভালোবাসেনি। আর যারা ভালোবাসেনি তাদেরকে ভালোবাসার ফিলিংসটা কখনোই বুঝানো সম্ভব না !!
.
হাসি থামিয়ে মায়া বললো-
-আচ্ছা ধরুন আমিই আপনার মিহি। আপনি কি বিশ্বাস করবেন”?
কথাটা শুনে বড় বড় চোখ করে মেয়েটার দিকে তাকালাম। কয়েকটা মুহুর্তের জন্য মনের ভিতর সুখ অনুভূতি হচ্ছিলো, মিহিকে পাওয়ার সুখ।
কিন্তু পরক্ষনেই আমার মনে হলো
“মিহির কন্ঠ তো এরকম না, মিহির কন্ঠ তো আরো সুন্দর। আর এই মেয়েটার তো চেহারা সুন্দর, মিহি তো কালো”।
আমি কিছু বলার আগেই মায়া বললো-
-আচ্ছা আপনি এতো অস্থির হইয়েন না। না জানি কখন হ্যার্ট এট্যাক করে ফেলেন কে জানে। আমার মনে হচ্ছে আপনাকে আর জ্বালানো উচিত হবেনা, এখন আপনাকে সব সত্যিটা বলা উচিত”।
কথাটা শুনে বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম। কোনো কথাই আমার মাথায় ঢুকছেনা। মেয়েটা কি বলতে চাচ্ছে বুঝতে পারলাম না।
মায়া এবার একটু সিরিয়াস হয়ে বললো-
-আমি এবার যা বলি মন দিয়ে শুনুন ওকে? আমি মায়া, কালো ড্রেস পড়া মেয়েটা হচ্ছে মৌ, আর সাদা ড্রেস পড়া মেয়েটার নাম হচ্ছে মিহি। আপনার মিহি”।
মিহির নামটা শুনা মাত্রই বুকটা ধুক করে উঠলো। ভ্রঁ কুঁচকে জিজ্ঞাস করলাম-
-মিহি? আমার মিহি”?
-হু আপনার মিহি। আসলে আপনি সত্যিই আমাদের বান্ধবীকে ভালোবাসেন কি’না এটা দেখার জন্যই আপনাকে এতো বেশি কষ্ট দিলাম। এখন মিহিকে দেখার পর আবার বলিয়েন না আপনার মিহিকে পছন্দ হয়নি। মিহি কিন্তু আগেই বলেছিলো ওর রঙ কালো !!
.
মায়ার কোনো কথা আর আমার কানে যাচ্ছিলো না। আমি ফ্যালফ্যাল করে মিহির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। একটু কালো হলেও সাদা ড্রেসটায় ওকে ভালো মানিয়েছে। চেহারায় মায়া আছে অনেক। অবশ্য চেহারায় মায়া না থাকলেও আমার চলতো, কারন মিহির মনটা অনেক বেশি ভালো। আর আমি ওই মনটাকেই ভালোবেসেছি।
.
আস্তে আস্তে চেয়ার থেকে উঠে মিহির কাছে গিয়ে হাটু ভেঙে বসলাম।
মিহিকি বললাম-
“তোমার হাতটা একটু ধরতে পারি”? মিহি ওর হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো। আমি হাতটা নিজের গালে শক্ত করে ধরলাম। চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি বের হলো। এই পানিটা কষ্টের পানি না, সুখের পানিও না, ভালোবাসার পানি। একটু আগে যেই মানুষটাকে মনে হচ্ছিলো জীবন থেকে হারিয়ে ফেলেছি, সেই মানুষটার হাত এখন আমার হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রাখা”।
.
চারপাশে কে কি ভাবছিলো আমার দেখার সময় ছিলোনা। আমি পকেট থেকে আংটিটা বের করলাম মিহিকে প্রপোজ করার জন্য। আংটিটা বের করার সাথে সাথে মিহি হাসলো। অনেক জোরে হাসলো। এই হাসিটা বড্ড অপরিচিত আমার কাছে। মেয়েটা হাসতে হাসতে বললো “আরে ভাইয়া আমি মৌ। তুমি আবারো বোকা হয়েছো”।
মেয়েটা যে মিহি না সেটা আমি ওর কন্ঠ শুনে নিশ্চিত হলাম। মায়ার দিকে তাকালাম, মায়া জোরে জোরে হাসছে। আর মায়ার পাশেই কালো ড্রেস পড়া পূর্ণিমার মতো মেয়েটা মাথা নিচু করে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করছে।
আমার বুঝার বাকি রইলোনা এটাই মিহি। মিহি মাথা নিচু রেখেই ওর হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো।
কান্না করতে করতে বললো-
“আংটিটা পড়িয়ে দাও”।
আমি সেই পরিচিত কন্ঠটা শুনতে পেলাম। যে মধুর কন্ঠটা প্রতিদিন শুনি। যে কন্ঠটা আমাকে প্রতিদিন সকালে গুড মর্ণিং বলে, যে কন্ঠটা শুনে প্রতিটা রাতে ঘুমাতে যাই। মিহি আবারো কান্না করতে করতে বললো-
-আংটিটা পড়াও তাড়াতাড়ি”।
আমার ভিতরে কি’রকম রাগ হচ্ছিলো বলে বুঝানো সম্ভব না। মিহিকে শুধু একটা প্রশ্ন করলাম-
-তারমানে আগে যা যা বলেছিলে সব মিথ্যা”?
-সব ই সত্যি। কিন্তু আমার জায়গায় ঘটনাগুলো ছিলো আমার বড় আপির সাথে। ব্যাস তফাৎটা এখানেই”।
আমি বসা থেকে উঠে দাড়ালাম। আংটিটা বক্সের ভিতরে রেখে কোনো কথা না বলেই বাইরের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। মোবাইলটা সুইচ অফ করে দিলাম। আগামী ২দিন মোবাইলটা আর অন করবোনা। আমি জানি মিহি এখন কান্না করবে। করুক, বেশি করে কান্না করুক। আমাকে এতো মিথ্যা আর কষ্ট দেওয়ার অপরাধে একটু কান্না তো ও ডিজার্ভ করেই।
এটা তো মাত্র শুরু, মিহি জানেনা আগামীতে ওর জীবনে কি কি হতে চলেছে। আমি মিহিকে সপ্তাহে ৭দিন কালো বানিয়েই রাখবো। সবাই বিয়ের দিন পাত্রীকে পার্লারে নিয়ে যায় সুন্দর দেখানোর জন্য, কিন্তু আমি মিহিকে কালো বানিয়ে তারপর বিয়ে করবো। কারণ আমি কালো মিহিটাকেই ভালোবেসেছিলাম, পূর্ণিমার মতো চেহারার কাউকে না।
এই শহরে সুন্দর মানুষকে ভালোবাসার মতো মানুষদের অভাব নেই। সরি, ভুল বললাম। সুন্দর মানুষকে কাছে পাবার মানুষদের অভাব নেই।
ভালোবাসা বললাম না এজন্য “যারা ভালোবাসে তারা রঙ খুঁজেনা, যারা রঙ খুঁজে তারা কখনো ভালোবাসেনা”।
তাই দিনশেষে এই শহরে “তোমাকে খুব করে চাই” বলা মানুষদের অভাব নেই,
এই শহরে প্রেমিক প্রেমিকাদের ও অভাব নেই, কিন্তু সত্যিকার ভাবে ভালোবাসতে পারে এমন মানুষের বড্ড অভাব। দিনশেষে ভিতরটা অনুভব করতে পারা মানুষগুলোর ই বড্ড অভাব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *