ও আমায় ভালোবাসেনি

ও আমায় ভালোবাসেনি !! Part- 10

মাঝখানে কেটে যায় একটা বছর ।
এর মাঝে বদলে যায় অনেক কিছুই , আমার বড় হওয়ার সাথে সাথে বন্ধুমহল বড় হতে থাকে ।
অন্যান্য ছেলেদের সাথে মেশা রাইদ অতো বেশী পছন্দ করতেন না কিন্তু কিছু বলতেনও না।
কিন্তু জানিনা কেনো আমার সাথে কোনো ছেলে বেশী ক্লোজ হলে পরদিন সেই ছেলেকে আর কলেজে পাওয়া যেত না সে একদমই গায়েব৷খোঁজ নিয়ে দেখা যেত সে টিসি নিয়ে চলে গেছে ।
সবাই আমাকে ভয় পেতে শুরু করলো ।
আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি করবো!
সন্দেহ হতো রাইদকে কারণ ও কনজার্ভেটিভ ছিলো কিছুটা ।
আমার সন্দেহ প্রবল হলো একদিন , আমি কলেজ থেকে ফিরেছি মাত্র তো ওর ঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় শুনতে পারলাম কাকে যেন ফোনে বলছে_ আরেহ্ মামা এই ম্যাটার টাও সলভড্ হয়া যাবে নো পেইন । আমি আমার প্রিয় মানুষদের উপর কখনো কারো আঁচড় পড়তে দিবো না আর না নজর দিতে দিবো!
,
এতটুকু শুনেই আমি শিওর হয়ে যাই সবকিছু রাইদই করছে ।
রাগ লাগতে শুরু করে আমার , কিন্তু ঐ মুহুর্তে কিছু বলিনা ।
সন্ধ্যার দিকে নোটস নেয়ার জন্য একটা ছেলে ফ্রেন্ডকে কল করলে সে সাফ সাফ বলে দেয় আমাকে কল করবি না , তোর জন্য প্রবলেন হোক এটা আমি চাইনা ।

ব্যাপারটা আমার রাগের আগুনে আরো ঘি ঢালে যেন!
আমি রাগে কেঁদে ফেলি আর সোজা রাইদের রুমে চলে যাই ।
প্রচন্ড ঝগড়া হয় আমাদের ।
ঝগড়ার এক পর্যায়ে আমি বলেছিলাম_ তুমি সাইকো হয়ে যাইতেছো! ভালোবাসলে স্বাধীনতা দিতে হয় । তুমি যদি আমার স্বাধীনতা কেড়ে নিতে শুরু করো তাইলে আমার পক্ষেও রিলেশন কান্টিনিউ করা পসিবল হবে না!
ব্যাস কথাটা শেষ করা মাত্রই জোরসে থাপ্পড় পড়ে গালে ।
ও এতক্ষণ শান্ত হয়ে হ্যান্ডেল করছিলো ব্যাপারটা কিন্তু এবার ক্ষেপে ওঠে ।
রক্তচোখ নিয়ে বলে_ আমাকে ছাড়ার চিন্তা করলে জিন্দা কবর দিয়ে তারপর নিজে মরবো বলে দিলাম !
,
ও বেরিয়ে যায় বাসা থেকে । ফুপ্পি ততদিনে জেনে গেছেন আমাদের সম্পর্ক । তাই উনি এগিয়ে এসে আমায় রুমে নিয়ে যান ।
মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেন ।
কিন্তু আমার কান্নার বেগ কমেনা । ফুপ্পিকে বলি প্লিজ একা ছেড়ে দাও আমাকে ।
,
অর্ধেকটা রাত কাঁদি আমি কিন্তু এক সময় মনে হয় আমি একটু বেশীই বলে ফেলেছিলাম ।
এবার রাইদ আসলে স্যরি বলবো কিন্তু রাত্রিবেলা রাইদ আর ফেরে না ।
আমি সারারাত তার জন্য অপেক্ষা করি কিন্তু অপেক্ষার প্রহর কাটে না ।

পরদিন সকালে রাইদ বাসায় আসেন । তাকিয়ে দেখি শার্ট প্যান্টের অবস্থা খারাপ , মনে হচ্ছে রাস্তাঘাটে গড়াগড়ি দিয়ে আসলো ।
চোখ ফুলে আছে আর লাল হয়ে আছে ।
রাইদ না ঘুমালে ওর চোখ লাল হয়ে থাকতো ।
খুব কষ্ট লাগে আমার ।
আমি ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করি কিন্তু ও ইগনোর করে চলে যায় ।
আমারও অভিমানের পাল্লা ভারী হয় ।
আর এটাই একটা বিরাট ভুল ।
,
একটা সম্পর্কে থাকা অবস্থায় কখনোই অভিমানকে প্রায়োরিটি দিতে নেই । দু’জন মানুষের সমানভাবে স্যাক্রিফাইসের মাধ্যমেই সম্পর্ক টিকে থাকে ।
এই স্যাক্রিফাইস জিনিসটা আমাদের মাঝে খুব কম ছিলো অথবা আমার মাঝে?
আমি ছোট ছিলাম আমি বুঝে উঠতে পারিনি আমার ভুল গুলো ।
তাই হয়তো স্যাক্রিফাইসটা একটু বেশীই করতে হয়েছে রাইদকে ।
কিন্তু সেও একসময় হাঁপিয়ে উঠলো বোধহয়!
,
আমি আমার অভিমান ধরে রাখলাম আর রাইদও..
,
আমাদের ঝগড়ার মাঝে তৃতীয় ব্যক্তির আগমন ঘটলো আর সে হলো শব্দ!
শব্দ ভাই আমাকে বোঝাতো অনেক , আমি বুঝতাম আবার অভিমান টাকেও সাইড করতে পারতাম না ।
তারপরও রাইদের দিকে খুব লক্ষ রাখতাম । কিছুদিন থেকে লক্ষ করলাম রাইদ ফোনে কথা বলতেন খুব । আমি বুঝে উঠতে পারতাম না কার সাথে এতো কথা!
ভয় , শঙ্কা তৈরী হতো মনে ।
যদি আমাকে ছেড়ে যায় তাহলে কি হবে আমার?
ওকে হারানোর ভয় মনটাকে কুড়ে কুড়ে খেতো ।
ওকে না জানিয়েই আমি মনে মনে শেষ হতে লাগলাম ।
রাতে ঘুম হতো না , খেতে পারতাম না ।
এরকম চললো এক মাস , ততদিনে ওর রাগ প্রশমিত হয়ে গেছে ।
ও আমার সাথে কথা বলতে শুরু করেছে কিন্তু আমি কেনো যেন আগের মতো ফিল পেতাম না , কমফোর্ট লাগতো না আমার৷
সবসময় একটা ভয়ের কারণে আমার মনটা আস্তে আস্তে অন্যরকম হতে শুরু করলো ।
ভাইয়াকে একদিন ফোন করে খুব কান্নাকাটি করলাম , বললাম ও যদি হারিয়ে যায় তাহলে আমি তো মরেই যাবো । তোমরা প্লিজ ওকে আমার করে দেয়ার ব্যবস্থা করো!

ভাইয়া আমার কথা শুনে বাবার সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করলেন ।
এক সপ্তাহের মাঝে ফুপ্পির বাসায় রাইদ আর আমার বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন ।
ফুপ্পি খুশিই ছিলেন , উনি বললেন মা কে জানাতে ।
রাইদও খুশি বেশ!
মনে হচ্ছিল সব হয়তো ঠিক হয়ে যাচ্ছে ।
এর মাঝে ও বিসিএস এ আ্যাডমিন ক্যাডারে হয়ে গেলো ।
ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ওর পোস্টিং হলো টাঙ্গাইলে ।
বাসায় একটা সাকসেস পার্টি আ্যারেঞ্জ করা হলো ।
পার্টির উদ্দেশ্য অবশ্যি ডাবল । ওর জয়েনিং এর আগেই ও বিয়েটা সারতে চায় ।
আকদ করে রাখার প্ল্যান আপাতত আর আমি অনার্স কামপ্লিট করার পর ধুমধাম করে বিয়ে ।
,
সেদিন প্রোগ্রামে ওর সব ফ্রেন্ডরা আসলো এবং চারু আপুও আসলো অবশ্যি আমার ফ্রেন্ডরাও ছিলো ।
সন্ধ্যা অবধি ফর্মাল পার্টিই চললো , ডিনার শেষে যখন গেস্টটা চলে গেলো তখন শব্দ ভাইয়া বললো এবার হবে আসল ব্যাচেলর পার্টি ।
শুধু ও, ওর ফ্রেন্ডরা, আমি আর সিমি মিলে ।
,
গার্ডিয়ানরা সব শুতে চলে গেলেন আর আমরা গেলাম গেস্ট রুমে ।
আমার কোনো আইডিয়া ছিলো না ওদের সেলফ ক্রিয়েট পার্টির সম্পর্কে আর আ্যাটেন্ড করার আগেই আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি ।
পেটে ব্যাথার আভাস পেতে থাকি , সিমিকে আলাদা ডেকে ওকে বলায় ও আমাকে নিয়ে রুমে চলে যেতে চায় ।
রাইদকে বলে আমরা চলে আসি , কিন্তু চলে আসার পূর্ব মুহুর্তে আমি চারু আপুর মুখে অদ্ভুত এক হাসি দেখেছিলাম যা আমি সেদিন বুঝতে পারিনি ।
,
আমি আর সিমি গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে গেছিলাম ।

পরদিন সকালে শুধু চারু আপু চলে যায়, একদিন পর বিয়ে আমাদের তাই বাকি ফ্রেন্ডরা চলে যায় না ।
সেদিন দুপুরে মা আসে , আমার খুব খুশি লাগে মনে হয় এবার সব ঠিক হতে চলেছে ।
আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া আদায় করি আমি ।
সন্ধ্যায় হলুদ ছোঁয়ানো হয় ।
রাইদকে খুব খুশি লাগছিলো আর আমায় এটা স্বস্তি দিচ্ছিলো ।
পুরোটা সময় রাইদ দুষ্টুমিতে মেতে ছিলো ।
আমি নতুন স্বপ্নে বিভোর ছিলাম ।
সুন্দর মুহুর্ত খুব জলদি চলে যায় ।
রাত পেরিয়ে যায় ক্ষিপ্র স্রোতের মতো ।
সকাল বেলা থেকে নার্ভাস ফিল করতে শুরু করি আমি ।
সকাল বেলা দু’হাত ভরে মেহেদী পরানো হয় আমাকে , দু’হাতে রাইদের নাম লিখে দেয়া হয় ।
আমি মনে মনে ভাবি বাসর রাতে বলবো_ হাতে নাম খুঁজো জলদি নইলে বাবার বাড়ি চলে যাবো কিন্তু!
আর ও ভয় পেয়ে আমার হাতে নিজের নাম খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে যাবে,আমি ওর পাগলামি দেখে হাসবো ।
কিন্তু আমার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায় ।
হয়তো সুখ জিনিসটা আমার জন্য নয় ।
বধুবেশে সাজার কিছুক্ষণ পরে ড্রেসিং টেবিলের উপর পড়ে থাকা ফোনটায় একটা মেসেজ টোন বেজে ওঠে ।
চাইলেও অগ্রাহ্য করতে পারিনা আমি ।
ফোনটা হাতে নিয়ে লক খুলে দেখি একটা এমএমএস ।
কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে যায় আমার , স্বাভাবিকভাবেই ভিডিও প্লে করি কিন্তু এই দৃশ্য দেখতে হবে ভাবতে পারিনি ।
আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না আমার রাইদ একটা মেয়ের সাথে বাজে অবস্থায় বিছানায়.. তাও আবার সেই মেয়েটা আর কেউ না তারই বন্ধুর গার্লফ্রেন্ড!
জ্বী হ্যাঁ চারুমতি আপুর সাথে রাইদ…
আমার পৃথিবী থমকে যায় ।
ভিডিওটা প্লে হতে হতে অফ হয়ে যায় , দু চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে শুরু করে ।
তখন মা আসে কাছে , মাথায় হাত রাখে আর বলে_ একটা কথা বলবো রাখবি?
আমি জানিনা তখন কি বলছি ।
মাথা নেড়ে সম্মতি দিই ।
মা বলে_ রাইদকে বিয়ে করবি না । তুই না আমার সাথে থাকতে চাস? আমি রাখবো তোকে আমার কাছে । সব ঠিক হয়ে যাবে শুধু রাইদকে ছাড়তে হবে ।
,
আমি হয়তো বুঝিনি মায়ের কথা , তবে মায়ের সাথে আমি চলে এসেছিলাম বাসায় ।
সবাই আমাকে ধোঁকা দিলো , রাইদকে বিয়ে করতামই কি করে? তার তো ছলনা ছিলো সব ।
ভালোবাসার প্ল্যাটফর্মে আমি হেরে যাওয়া এক প্রেমিকা হয়ে মাথা নিচু করে চলে এসেছিলাম সেদিন ।
পরে কি হয়েছে জানতে চাইনি । বাবা-ভাই জবাবদিহি করেছিলো কিন্তু উত্তর দিতে পারিনি । উত্তর ছিলোনা আমার কাছে ।
কি করে বলতাম সবাইকে ” ও আমায় ভালোবাসেনি”

মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয় ।
জীবন থেকে আরো দু’টো বছর চলে যায় , সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া আমির হঠাৎ ভার্সিটিতে দেখা হয় সিমির সাথে ।
সেদিন সিমিকে আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদেছিলাম আমি ।
ও বলে জীবনকে উপভোগ করতে শেখ , অতীত ভুলে যা ।
হুম জীবনকে উপভোগ করতে শুরু করি আমি । আবার সোশ্যাল সাইট গুলোতে আ্যাক্টিভ হতে শুরু করি, নিয়মিত ক্লাসে যাই , বাসার সব কাজ করি অর্থাৎ সব মিলিয়ে খুব ব্যস্ত আমি!
,
তেমনই একদিন লাইব্রেরি থেকে বই কালেক্ট করবার সময় ফয়সালের সাথে দেখা হয় ।
হঠাৎ কথাও হয় অনেক কিন্তু সে পূর্বের কথা জিজ্ঞেস করেনা ।
ফেইসবুকে আ্যাড হয়ে যাই আমরা ।
প্রতিদিন কথা হতে শুরু করে , জানতে পারি চারুর কোথায় যেন একটা সম্পর্ক আর সেটার জের ধরে চারু চলে যায় তাকে ছেড়ে ।
আমি তাচ্ছিল্য ভরে হাসি , যার জন্য ছেড়েছিল সে যে তারই বেস্ট ফ্রেন্ড এটা বুঝি ফয়সাল জানতো না!
কি দরকার জানানোর! মুভ অন সবাই করেছে তাহলে বেঁচে যাওয়া সম্পর্ক গুলো নষ্ট করার দরকার আছে??
,
আমাদের মন বড্ড বেহায়া এবং অসহায় ।
অসহায় মুহুর্তে যে কেউ সিম্প্যেথীই দেখাতে শুরু করলে তাকে আপন মনে হয় ।
আমার ক্ষেত্রে সেটা হয় ।
স্রোতের বিপরীতে গিয়ে আমার ফয়সালের প্রতি সফট্ কর্ণার তৈরি হয়ে যায় ।
কিছু অনুভূতি জায়গা পায় । দেখা হয় ঘনঘন আবার কথাও হয় ।
কথার ধরণও পাল্টে যায় ।
কেউ কাউকে বলিনা ভালোবাসি কিন্তু দু’জনেই যেন জানি মনের খবর ।

কিন্তু এবারেও আমারই ভুল হয় ।
আমি বুঝতে পারিনা ফয়সাল শুধুই আমাকে বন্ধু ভাবে ।
কিন্তু আমিই বেশী ভেবে ফেলি হয়তো ।
আসলে এমন সময় সে আসে যে সময় আমার খুব করে কাউকে দরকার ছিলো ঢাল বানাবার জন্য!
,
ঐ যে মনটা বেহায়া তাই তো চারু মাফ চাইতেই ফয়সাল তাকে মাফ করে দেয় ।
আবার এক হয় তারা আর প্রতিবারের মতো মাঝখান থেকে আমি ছিটকে পড়ি ।
সেদিন চারুর সাথে ফয়সালকে দেখে একটা কথাই মাথায় ঘোরে আমি কি খুব খারাপ? আমাকে কেউ ভালোবাসেনা কেনো?
একটুখানি ভালোবাসলে কি খুব ক্ষতি হয়??
আসলে সুখ পেতে বুঝি ভাগ্য লাগে?
না ফয়সাল ভালোবাসলো আর না ”ও”…
মাঝেমধ্যে নিজেকে জিজ্ঞেস করতে মন চায় আচ্ছা সবাই তো কাউকে না কাউকে ভালোবাসলো আর আমি? আমি কাকে ভালোবাসলাম?
আমি জানি এর উত্তর হবে রাইদ । সে আমার আকৈশোরের ভালোবাসা আর ফয়সাল?
সে তো আমার ভালোলাগা যাকে আমি প্রয়োজনে পেয়ে আজীবনের প্রয়োজন বানাতে চেয়েছি ।
কিন্তু পারিনি । সেও আমায় ভালোবাসেনি…
,
দিনশেষে সবাই সুখে থাক । আমি না’হয় দূরে গিয়ে ভালো থাকলাম?
,
স্মৃতির কালো অধ্যায় টা রাতের নিকষ কালো অন্ধকারের সাথে মিলিয়ে যেতে শুরু করে ।
একটা শুভ্র বাতাস আচমকা মিথির সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে আর দু চোখ দিয়ে অবাধ্য দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে ।
চোখটা বন্ধ করে নেয় মিথি , খুব ঘুম পাচ্ছে তার ।
,
চলবে,