ও আমায় ভালোবাসেনি

ও আমায় ভালোবাসেনি- সিজন ২ – Part- 08

শব্দ’র দাফন শেষ করে অন্তর আর ঐশী মিথিদের বাসায় আসলো কিছু জিনিসপত্র দিতে ।
মিথি রাইদ কে খাবার বেড়ে দিচ্ছে এমন সময় কলিংবেল বেঁজে ওঠে । তানভীর চেয়ার ঠেলে উঠতে উঠতে বলে, আমি দেখছি ।
দরজায় অন্তর আর ঐশী কে দেখে সালাম দিয়ে ভেতরে নিয়ে আসে ।
মিথির মা ও রাইদ কে বলে ড্রয়িংয়ের দিকে চলে আসেন । এই মুহুর্তে ডাইনিং টেবিলে রাফনিদ , রাইদ আর মিথি ।
রাফনিদের খেতে খুব সমস্যা হয় । পাঁচ মিনিট পর পর এক লোকমা মুখে দেয় সে । ওর আবার বিশেষ খেয়াল রাখতে হয় ।
খেতে খেতে রাফনিদ কেই দেখছিলো রাইদ । হঠাৎ প্রশ্ন করে_
— নিদ তুমি এত অসুস্থ তা’হলে ডাক্তার দেখাও না কেনো?
— দেখাই তো ভাইয়া । রাজশাহীতে দেখিয়েই এসেছি ।
— তোমার আসলে এই অবস্থায় ট্রাভেল করা উচিৎ হয়নি । আর ভালো ডাক্তার দেখাতে হবে তো । শোনো আমার এক ফ্রেন্ড পিজি তে কর্মরত আছে আজ তার সাথে কথা বলে এপয়েন্টমেন্ট নিবো তুমি চেকআপ করাতে যাবে কেমন?
— জ্বী ভাইয়া ।
— গুড ।
রাফনিদ মুচকি হাসে । মিথি রাইদের দিকে একবার তাকিয়ে ভাবে এত স্বাভাবিক আচরণ সে সত্যি করতে পারছে? সে আসলেই অতীত ভুলে গেছে?
— আমার খাওয়া হয়ে গেছে ।
— হু?

— বলছি যে খাওয়া হয়ে গেছে আমার ।
এবার যেন ধ্যান ভাঙে মিথির । রাইদের খাওয়া শেষ ও উঠে পড়েছে । মিথি এঁটো প্লেট টা নিয়ে রান্নাঘরে রেখে আসে ততক্ষণে আবার তানভীর এসে বসেছে । মিথি কে দেখে ও বলে , “আপু অন্তর ভাইয়া এসেছে দেখা করতে চাইছে তোর সাথে”
— হু যাচ্ছি তুই নিদের খেয়াল রাখ ।
ডাইনিং এর পর্দা সরিয়ে দু কদম হাঁটলেই ড্রয়িং রুম । সোফায় বসে আছে অন্তর আর ঐশী । অন্তরের চোখ ফুলে আছে , মুখ শুকনো । ওকে দেখে মিথির মনে কষ্টের ঝড় উঠছে আবার । শব্দ কে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিলো এই মনটা । সুখের সংসার গড়ার বাসনা জেগেছিলো কি অদ্ভুত সম্পর্ক জুড়ে গেলো অন্য কারো সাথে, বেহায়া মনটা আবার কষ্ট পেলো ।
— অন্তর ভাই ভালো আছেন?
ফিঁকে হেসে প্রশ্ন করে মিথি । অন্তর জবাবে হাসেনা । শুকনো মুখে বলে_
— কি করে ভালো থাকি ম্যাম । আমার পরম বন্ধু আমার বস নির্মমভাবে খুন হলো তা’হলে কি করে ভালো থাকবো আমি?
— অন্তর ভাই কিছু কি জানা গেছে কে করলো এসব?
— ম্যাম আপনার সাথে একটু একা কথা বলতে চাইছিলাম ।
— আসুন আমার রুমে ।
অন্তর কে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো মিথি ।
— এবার বলুন অন্তর ভাই কি ব্যাপার?
— আপনি হয়তো জানেন না “visor” নামক ডার্ক ওয়ার্ল্ডের একটা সংগঠন আছে যারা ড্রাগসের ব্যবসা করে । আমাদের দেশে প্রতিবছর বিপুল পরিমান ড্রাগস আসছে তাদের থেকে এবং এসব আনাচ্ছে আমাদেরই দেশের মানুষ । মজার ব্যাপার হলো ঐ আন্ডার ওয়ার্ল্ডের সাম্রাজ্ঞীও একজন বাংলাদেশী । সে এবং তার পার্টনার কে গ্রেফতার করার জন্য আমাদের অর্ডার দেয়া হয়েছিল । বিগত এক বছর থেকে আমরা এর জন্যই কাজ করে যাচ্ছি ম্যাম । আমরা অনেক প্রমাণ জোগাড় করে ফেলেছিলাম তাদের বিরুদ্ধে । সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের দিকে হঠাৎ ব্ল্যাঙ্ক কল আসে একটা । জানায় তারা আমাদের সাথে দেখা করতে চায় , টাকা দিয়ে কিনতে চায় আরকি!
স্যারের পরিকল্পনা ছিলো ওদের সাথে মিট করবে ওদের কথা অনুযায়ী এবং আমাদের টিম রেডি থাকবে । কথার মধ্যেই ওদের আটকে দেয়া হবে তা’হলে ওরা আমাদের আ্যাটাক করার সুযোগ পাবেনা আর কিছু প্রুফ এবং ভিডিও তো আছেই ।
সেপ্টেম্বরের শুরুতে কথা বললেও ওরা আমাদের সঠিক টাইম টা আর জানায় না । স্যার চিন্তা করেন ওদের সাথে মিট করার আগে বিয়ের ঝামেলা টা সারতে কারণ ঐ কাজে আটকা পড়লে দেখা যেত এব্রডেও যেতে হতো স্যারকে ।
আপনাদের বিয়ের খবরটা সিক্রেট ছিলো ম্যাম তবে ওরা জেনে গেলো কি করে?
— আপনি বলতে চাইছেন ওরাই মার্ডার টা করেছে?
— হ্যাঁ ম্যাম ওদের মারার ধরণ টা এরকমই । ওরা একজন মানুষ কে মোট ছ’টা গুলি করে চারটা বুকে পেটে এবং একটা ঠিক কপালের মাঝ বরাবর । স্যারকেও এভাবেই মারা হয়েছে এই দেখুন ।
অন্তর পকেট থেকে একটা ছবি বের করে দেখালো । ছবি দেখে আঁতকে উঠলো মিথি । গা গুলিয়ে আসলো তার আর চোখ ঠিকরে পানি বেরিয়ে আসলো ।
অন্তর স্বান্তনা দেবার ভঙ্গিতে বললো_
— কাঁদবেন না ম্যাম ধৈর্য্য ধরুন । আমি আপনার সাথে একান্তে কথা বলতে চেয়েছিলাম কারণ স্যারকে ন্যায় বিচার দেয়াতে আপনার সাহায্য লাগবে ম্যাম ।
— আমার সাহায্য?

— হ্যাঁ । ম্যাম আমাদের টিম ছিলো পাঁচজনের । স্যারের মার্ডারের পর বাকি তিনজন গায়েব ,শুধুমাত্র আমাকেই কেন যেন ছেড়ে দিয়েছে তবে কতদিন আমি ফ্রী থাকতে পারবো তা জানিনা । স্যারের খুনের ইনভেস্টিগেশন করতে পারবো কি না তাও জানিনা তাই আপনাকেই যা করার করতে হবে ম্যাম ।
স্যার মৃত্যুর সময় আমায় একটা লকেট দিয়ে বলেছিলেন সেটা যাতে আপনাকে দিই । একটা গোপন বক্সের চাবি আছে এখানটায় যেখানে ঐ সংগঠনের বিরুদ্ধে সকল প্রুফ আছে ।
যেহেতু এটা সিক্রেট মিশন ছিলো এবং আমাদের পরিকল্পনা জেনে গেছে ওরা তাই আমি ধারণা করছি আমাদের আশেপাশে ওদের লোক আছে ।
নেক্সট টার্গেট হয়তো আমাকে করা হবে তাই সকল প্রুফ আপনার কাছে রেখে দিন ম্যাম ।
কখনো যদি কোনো সৎ অফিসারের দেখা পান তা’হলে তার হাতে ওগুলো তুলে দিবেন যাতে অপরাধীরা ধরা পড়ে । আর যতদিন আমি অক্ষত আছি ততদিন আমরা ট্রাই করে যাই স্যারের খুনি কে খুঁজতে ।
আমাদের আশেপাশে কোন ব্যক্তিটা ওদের সংগঠনের , কে জানালো তাদের আপনাদের বিয়ে সম্পর্কে?
— আমাকে কি করতে হবে?
— ম্যাম এমন অবস্থায় রয়েছি যে কেউ ই সন্দেহের তালিকা থেকে দূরে নয় । স্যরি টু সে আপনার এন্টায়ার ফ্যামিলিকেও সন্দেহ করছি । কষ্ট করে হলেও আপনার ফ্যামিলি মেম্বারদের ওপর আপনাকে নজর রাখতে হবে । এই যে লকেট টা এটা আপনি সামলে রাখবেন ম্যাম ।
— আমি কি ওনার বাসায় যেতে পারবো?
— উঁহু স্যারের বাসা তো আর্মি প্রোটেকশনে আছে কড়া নজরদারি । বারবার সার্চ করা হচ্ছে ।
— তা’হলে ঐ বক্সটা পাবো কি করে?
— একটু সময় নিন ম্যাম । কয়েকটা দিন এমন এক্ট করুন খুব কষ্টে দিনযাপন করছেন । একটা মাস অতিবাহিত হলে অফিসারদের নজর আপনার ওপর থেকে সরে যাবে তখন মুভ অন করে নিবেন এমন এক্ট করবেন ।
পুরোপুরি সন্দেহ দূর হওয়ার পর স্যারের বাসায় চলে যাবেন ম্যাম । আমি স্যারের বাসার চাবি আপনাকে দিয়ে যাচ্ছি । যেতে হবে রাতের আঁধারে । আমি আপনাকে নকশা দিয়ে যাচ্ছি স্যারের বাসার গোপন রাস্তার । ম্যাম আমি যতদিন আছি ততদিন একসাথে কাজ করে যাবো আমরা । আমি না থাকলে আপনি কষ্ট করে সামলে নিয়েন ম্যাম । হাল ছেড়ে দিবেন না । স্যার আপনাকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছিলো ।
— আমি শব্দকে ন্যায় বিচার পাইয়ে দিবো অন্তর ।
— আমি মাঝেমধ্যে কন্ট্রাক্ট করবো ম্যাম । ক্লু পেলে জানাবেন । আর হ্যাঁ ম্যাম , স্যারের শেরওয়ানি টা খুব পছন্দ হয়েছিল ।
অন্তর দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো ।
এবার আর কান্না চেপে রাখতে পারলো না মিথিলা । লকেট টা বুকে চেপে হু হু করে কেঁদে উঠল ।
বারবার তার সাথেই কেনো এমন হয়? কি দোষ তার?

রফিক এইমাত্র ফোন করে জানালো মিডিয়ায় রাইদের বিয়ের নিউজটা বোম ব্লাস্টের মত ফেটেছে ।
নানা মানুষ নানামুখী নিউজ বানিয়ে প্রচার করছে । রাইদের বাসার সামনে শত শত লোকজন এসে ভিড় জমিয়েছে , সকাল থেকে কয়েকজন ফিল্ম মেকার রাইদকে না পেয়ে তাকে ফোন করেছে ।
কেউ বেশ খুশি কেউবা খুশি নয় এই ভেবে যে ও দাওয়াত না দিয়েই বিয়ে সেরে নিলো!
রাইদের এসব নিয়ে চিন্তা নেই ওর চিন্তা অন্য জায়গায় । এই খবর যেহেতু লিক হয়েছে তা’হলে বন্ধুর বিয়ের দাওয়াতে এসে বিয়ে এমন নিউজ ছড়াতেও বেশি সময় লাগবে না ।
মিডিয়ায় শব্দের মার্ডারের নিউজ আর রাইদের বিয়ের নিউজ রিলেট করলেই ঝামেলায় ফেঁসে যাবে । নাহ্ কিছু ভাবতে হবে , কিছু তো একটা করতে হবে । কোনো স্টোরি বানিয়ে মিডিয়ার সামনে প্রেজেন্ট করতে হবে নয়তো..
— বাবা আসবো?
মিথির মায়ের গলা শুনে পেছনে ফেরে রাইদ ।
হেসে বলে_
— আসুন না আন্টি ভেতরে আসুন ।
— বাবা এখনো আন্টি ডাকবে?
— অভ্যাস ছিলো যে । পাল্টাতে একটু টাইম লাগবে ।
— বাবা এখানে থাকতে কি কোনো সমস্যা হচ্ছে?
— নাহ্ না কোনো সমস্যা নেই ।
— বাবা একটা কথা বলতাম?
— জ্বী আন্টি বলুন না?
— বাবা বলছিলাম কি এমন দূর্ঘটনায় তোমাদের বিয়েটা হলো । তুমি আমাদের পূর্ব পরিচিত এই খবর খুব কম মানুষই জানে আর তাছাড়া তুমি একটা বিরাট পেশায় আছো । প্রেস মিডিয়া তোমার প্রতিটা নিঃশ্বাসের খবর জানে , তারা হয়তো মানতেই পারবে না এত বড় তারকা আমাদের মত মিডেল ক্লাস ফ্যামিলির সাথে সম্পর্ক গড়েছে ।
— আন্টি , মানুষ কি বললো না বললো এটা নিয়ে আমার কোনো ভাবনা নেই । ওদের ততটুকুই জানার বা বলার অধিকার আছে যতটুকু আমি দেবো । আমিও ততটুকুই শুনতে বাধ্য যতটুকু আমার প্রয়োজন । আপনি এসব নিয়ে চিন্তা করবেন না । আর আমি এমনিতেও আমার পারসোনাল লাইফ মিডিয়ার সামনে আনতে চাইনা । আপনারা কমফোর্ট ফীল করবেন না জানি আর তাই আমি বাইরে ডিটেইলস বলতে যাবো না । মিথি কে দেখার আগ্রহ তাদের জাগতেই পারে , এ ব্যাপারটা আমি নিজে হ্যান্ডেল করবো আর আপনি চিন্তা করবেন না সব দিক সামলে নিবে আমার পিএ ।
— ঠিকাছে বাবা । আরেকটা কথা বাবা অতীত মনে রেখো না । যা হবার তো হয়েই গেছে । তিক্ত স্মৃতি গুলো অযথাই তোমাদের মধ্যে ঝামেলার সৃষ্টি করতে পারে ।
— আমি সব ভুলে গেছি আন্টি ।
— দোয়া করি বাবা তোমরা সুখী হও ।
রাইদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন মিতা ।

লকেট টা আলমারিতে তুলে রাখলো মিথি । রাইদ বলেছে আজ সন্ধ্যায় ওরা বাসায় যাবে । বিয়ের আরেকটা অনুষ্ঠান হবে সম্ভবত এখনো শিওর বলা যাচ্ছে না ।
সময় নষ্ট না করে লাগেজ টা গুছিয়ে নিলো ও ।
এখন থেকে তো রাইদের সাথেই থাকতে হবে কে জানে ও জবটা করতে দিবে কি না!
ওকেই জিজ্ঞেস করা ভালো হবে ।
রাইদ বিছানায় আধশোয়া হয়ে ওর কাজকারবার ই দেখছিলো ।
হঠাৎ বললো_
— তোমার বইখাতা আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সবই নাও । বিয়ে হয়েছে বলে লেখাপড়া বা চাকরি বাদ দেয়া যাবেনা । আধা শিক্ষিত বউয়ের সাথে সংসার করবো না আমি ।
লাস্ট কথাটা শুনে রাইদের দিকে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো শুধু তারপর আবার সবটা গুছিয়ে নিতে শুরু করলো কিন্তু মনে মনে বেশ খুশিই হলো ।
আবার অদ্ভুত ও লাগছে হুট করেই লোকটার সাথে বিয়ে হয়ে গেলো , সম্পর্কও তৈরি হয়ে গেলো কিন্তু ভালোবাসা?
সেটা কি আর সম্ভব! একটা মনে কতবার ক’জন কে সুযোগ দেয়া যায়?
চলবে,