ও আমায় ভালোবাসেনি

ও আমায় ভালোবাসেনি- সিজন ২ – Part- 03

বাথরুম থেকে গুনগুন আওয়াজ ভেসে আসছে । রাইদ শাওয়ার নিচ্ছে এক ঘন্টা যাবৎ ।
রফিক অপেক্ষায় বসে আছে , ঝিমোচ্ছে একপ্রকার । অপরাধীর মত ট্রিট করা হচ্ছে ওকে ।একটা মানুষ কি করে না ঘুমিয়ে থাকতে পারে? এ তো এক প্রকার শাস্তি ।
দু রাত থেকে রাইদের ঘুম নেই । বস কে নির্ঘুম থাকতে দেখে কি করে ঘুমুতে পারে?
এদিকে ডিরেক্টর সাহেবের পিএ হাজারবার ফোন করে ফেলেছে । শ্যুটিংয়ের লাস্ট উইক চলছে ।
ক্রাইম , সাসপেন্স জনরার মুভি ।
লিডিং চরিত্রে আছে রাইদ আর উচ্ছ্বাস নামক একজন নতুন অভিনেতা । যেহেতু রাইদ লিডিং রোলে তাই ওকে ছাড়া তো শট সম্ভব না । কিন্তু রাইদ একদম সিরিয়াসলি নিচ্ছেনা ব্যাপারটা কে । এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে রফিক । ওর এসব হেয়ালীপনার কারণে শেষ পর্যন্ত ফিল্মমেকার রা মুভিতে নেয়াই না বন্ধ করে নেয়!
— কি ব্যাপার রফিক বসে বসে ঝিমাচ্ছ?
— স্যার আপনি এসে গেছেন । প্লিজ তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিন এ পর্যন্ত হাজারবার কল দিয়ে ফেলেছে প্রণব ।
— আরো হাজারবার দিক । আমরা আমাদের সময় মতোই বেরুবো ।
— আরো লেইট করবেন স্যার?
— অফকোর্স । আমার এখন ক্ষুধা পেয়েছে আমি নাশতা করবো তারপর বেরুবো ।
— আচ্ছা স্যার আমি তা’হলে সবটা গুছিয়ে নিই ।
— এ্যাজ ইওর উইশ ওহ্ হ্যাঁ রফিক আমার বেস্ট ফ্রেন্ড শব্দ আহমাদ কে একটা কল দাও তো স্পিকারে দিয়ে চলে যাও ।
— জ্বী স্যার ।
শব্দ’র নাম্বারে কল দিয়ে স্পিকারে লাগিয়ে বেরিয়ে গেলো রফিক । ভ্রু কুঁচকে আপন মনেই বললো “একবার বলে বন্ধু না একবার বলে বন্ধু । আসলেই কোনটা? স্যারের কি মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে নাকি!”

__
সেট রেডি করে বসে আছে ডিরেক্টর আরিয়ান খান সাহেব , রাইদের অপেক্ষা ।
উচ্ছ্বাস এসে বসে আছে এক ঘন্টা যাবৎ । সবাই মোটামুটি বিরক্ত । আরিয়ান বারবার জিজ্ঞেস করছেন উচ্ছ্বাস কে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না!
উচ্ছ্বাস হাসিমুখে উত্তর করছে সমস্যা হচ্ছে না কিন্তু আরিয়ানের মনে হচ্ছে ভেতরে ভেতরে উচ্ছ্বাস প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হচ্ছে কিন্তু প্রকাশ করছে না
তাও ভালো তার মধ্যে কার্টেসি আছে মিনিমাম ।
নতুন অভিনেতাদের আবার বেশি রাগ থাকতে নেই , ক্যারিয়ারের শুরুতেই তেজ দেখালে তো সব শেষ ।
দেড় ঘন্টা পর রাইদের গাড়ি আসতে দেখা গেলো ।
গাড়ি থেকে নেমে পুলওভার টা খুলে রফিকের হাতে দিয়ে মুখে হাসি ঝুলিয়ে আরিয়ানের পাশে এসে বসলো রাইদ ।
আরিয়ান মাথা নেড়ে বললো_
— তুমি এত্ত লেইট করো রাইদ । এতক্ষণে কতটা কাজ কমপ্লিট হতো!
— আমাদের কাজ তো সূর্যের নিচে । সাত সকালে এসে বসে থেকে কাজ আছে নাকি!
— আমার মাঝেমধ্যে মনে হয় ডিরেক্টর আমি না বরং তুমি ।
— আমি অল স্কয়ার ।

রাইদের বাঁকা হাসি দেখে আরিয়ানের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলে সে একজন কর্মচারী কে আদেশ করলো উচ্ছ্বাস কে ডেকে নিয়ে আসতে । ও ঐ যে ভ্যানে গেছে আসার নাম নেই ।
প্রতিদিন সকালবেলা করে ড্রাগস নেয়ার অভ্যাস উচ্ছ্বাসের । আজ সকালে এসেছে বলে সুযোগ পায়নি তবে পকেটে আছে ।
ভ্যানে এসেছে সেই ড্রাগস নিতেই ,
ওর ধারণা রাইদের আরো লেইট হবে তাই এখন নিজেকে শান্ত করার কথা ভাবছে ।
টেবিলের ওপর সবটা রেডি করেছে এমন সময় আসলো ফোন বাংলাদেশ থেকে । বন্ধু আলভীর হঠাৎ কল পেয়ে ভ্রু কুঁচকে গেলো উচ্ছ্বাসের ।
রিসিভ করে বিরক্ত হয়ে বললো_ “হ্যাঁ বল”
— দোস্ত হেব্বি ঝামেলা হয়ে গেছে ।
— কি হইছে আবার?
— তানভীর তো ধরা খাইছে কাল হোটেলে । পরে ওর বোন আর হবু দুলাভাই এসে ছাড়ায় নিয়া গেছে । ওর বোন আমারে থ্রেড দিছে দেইখা নিবে ।
— বলস কি?
— হ্যাঁ । আমাদের কথা যদি বইলা দেয় তানভীর তখন কি হবে?
— আমার ক্যারিয়ার শেষ । ধুরর বাল ঐজন্য ওইটারে ঝামেলায় জড়াইতে চাইনাই । এখন এইসব ক্যাচাল মিটাইতে ক তোর সৌভিক ভাই রে ও ই তো আগ বাড়ায় নিতে গেছিলো এই হাফ লেডিস রে ।
— আরে দোস্ত ক্ষেইপ্পা লাভ আছে? যা করার একসাথে মিলেই করা লাগবে ।
ভ্যানের দরজায় নক করার শব্দ পেলো উচ্ছ্বাস ।
— আচ্ছা শোন আমার শ্যুটিং শুরু হবে রাতের দিকে ফোন দিচ্ছি তোকে ।
— আচ্ছা ভাই । আমার তো ঘুম ই উইড়া গেছে রে ।
— থাক টেনশন নেয়ার কারণ নাই আমি দেখছি ।
— ওকে চল বাই ।
— বাই ।
ফোনটা সুইচড অফ করে ড্রাগস গুলো ড্রয়ারে রেখে বেরুলো উচ্ছ্বাস আর মনে মনে রাইদ কে জঘন্য একটা গালি দিলো হুট করে চলে আসার জন্য ।
____
বসার ঘরে মাথা নিচু করে বসে আছে তানভীর তার অপর দিকে মিথিলা আর শব্দ ।
নেশা কেটে যাওয়ার পর এখন সবটা বুঝতে পারছে তানভীর কিন্তু তার বলবার কোনো ভাষা নেই ।
মিথিলা গম্ভীরমুখে প্রশ্ন করে_
— তোর এই অভ্যাস কবে থেকে হলো? আগে কত জনের সাথে এভাবে ডেটে গিয়েছিস?
— একজনের সাথে ।
— সেই মেয়ে কে?
— বড় মামার মেয়ে রাফনিদ ।
তুতলিয়ে কথাটা বললো তানভীর ।
বজ্রাহত চোখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে মিথিলা বললো_
— কিইহ্? রাফনিদ?
— হ্যাঁ ।
— ছিঃ ছিঃ ছিঃ । তোর এত অধঃপতন । মা কিংবা মামা এসব জানতে পারলে কি হবে আইডিয়া আছে তোর?
উঠে এসে তানভীরের গালে সশব্দে কয়েকটা থাপ্পড় মেরে কাঁদতে কাঁদতে বললো মিথিলা ।
তানভীরও কেঁদে ফেললো । মিথিলার পা জড়িয়ে ধরে বললো_
— আপু আমার ভুল হয়ে গেছে । কি করে যে এই অন্ধকার জগতে চলে গেছি বুঝতেই পারিনি । কেউ আমাকে এখান থেকে ফিরিয়ে আনারও চেষ্টা করেনি । আমি কি করতাম বল? আমি নিজেও চাই এসব থেকে মুক্তি পেতে কিন্তু কি করে তা জানিনা । প্লিজ আপু তুই আমাকে সাহায্য কর আমাকে মুক্তি দে এসব থেকে আপু প্লিজ ।
এতক্ষণ চুপচাপ সব দেখলেও এবার কথা বললো শব্দ ।
— তুমি কি সত্যিই চাও এসব থেকে মুক্তি পেতে?
তানভীর মাথা নেড়ে সায় দিলো ।

— তা’হলে চলো আমার সাথে । আজ থেকে তুমি আমার দায়িত্বে আমার বাসায় থাকবে । যতদিন না এই অন্ধকার দিকটা তোমার মন থেকে মুছে যাচ্ছে ততদিন তুমি আমার সাথে থাকবে । রাজি?
— আমি শুধু এসব থেকে মুক্তি চাই ভাইয়া । প্লিজ ।
— কেঁদো না কেঁদে লাভ নেই । যা হওয়ার হয়ে গেছে নাও এখন গোছগাছ করে নাও আজ থেকেই তুমি আমার সাথে থাকবে ।
আর মিথি তুমি খালাম্মা কে এ ব্যাপারে কিছুই বলবে না উনি যদি কিছু জিজ্ঞেস করেন তানভীর কোথায় গেছে তা’হলে বলবে একটা আ্যাসাইনমেন্টের জন্য ওকে ঢাকার বাইরে যেতে হয়েছে কিছুদিনের মধ্যেই ফিরবে ।
— সব ঠিক হয়ে যাবে তো?
— অবশ্যই । আমি আছি তো ।
কাঁধে হাত রেখে আশ্বস্ত করলো ওদের৷ মিথির চোখ থেকে টুপটুপ করে পানি গড়িয়ে পড়লো ।
হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে তা মুছে বললো_
— তানভীর যা প্যাকিং করে নে আর রাফনিদের ফোন নাম্বার আমাকে দিয়ে যা । ওর সাথে কথা বলা খুব জরুরি ।
তানভীর মাথা নেড়ে ভেতরের ঘরে চলে গেলো ।
শব্দ মিথির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো _
— একটু বসো তুমি কয়েকটা কথা বলি । শোনো তুমি আজকের পর থেকে এসব বিষয় নিয়ে মন খারাপ কিংবা কান্নাকাটি করবে না । স্যারের চলে যাওয়ার পর এমনিতেই খালাম্মা ভেঙে পড়েছেন । এতদিন বাদে যখন একটু স্বাভাবিক হলেন তখন আর এসব ব্যাপারে তাকে জড়ানোর দরকার নেই কেমন? তানভীর আবার আগের মত হয়ে যাবে চিন্তা নেই ।
— আমাদের ঝামেলায় অযথা আপনার কষ্ট হচ্ছে স্যরি ।
— এবার বলেছো ঠিক আছে কিন্তু নেক্সট টাইম আর বলবে না । কিছুদিন পর আমিও এই পরিবারের সদস্য হয়ে যাচ্ছি সুবিধা অসুবিধা দেখা আমার দায়িত্ব ।
— আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ।
— শুকনো কথায় মুড়ি ভিজবে না । আমার জবাব জলদি দিয়ে দাও তাহলে ই হ্যাপি হবো ।
উত্তরে হাসলো মিথি ।
— আচ্ছা আমার তো একটা ইম্পর্টেন্ট মিটিং আছে লেইটে পৌঁছুলে খুব ঝামেলা হয়ে যাবে। তানভীর কে একটু তাড়াতাড়ি নিতে বলো ।
— এখন তো সন্ধ্যা আপনার না মিটিং বিকেলে ছিলো?
— স্যরি তখন মিথ্যে বলেছিলাম । বিকেলে আমার অন্য একটা কাজ ছিলো মিটিং রাতের দিকে ।
— তা’হলে বসুন আপনাকে চা নাশতা দিতেই ভুলে গেছি ।
— এত ফর্মালিটির দরকার নেই । অন্য একদিন এসে তোমার হাতের রান্না খেয়ে যাবো ।
— না না তা কি করে হয়?
— হবে হবে । প্লিজ একটু দেখো তানভীরের কি অবস্থা আমার সত্যিই লেইট হয়ে যাচ্ছে ।
— হ্যাঁ দেখছি ।

তানভীর নিজের ফোন ল্যাপটপ বোনের কাছে দিয়ে শব্দের সাথে বেরিয়ে গেলো ।
ওদের বিদায় দিয়ে এসে রাফনিদের নাম্বার ট্রাই করলো কিন্তু বন্ধ দেখালো পরে বড় মামা কে কল করে রাফনিদের নতুন নাম্বারটা নিলো ।
বড় মামা কেঁদে কেঁদে বললেন “বুঝতে পারছিনা মামণি আমার মেয়েটার কি হলো। হুট করে রাজশাহী চলে গেলো হলে উঠলো । আমাদের সাথে যোগাযোগ ও করেনা”
খুব খারাপ লাগলো কথাটা শুনে । মিথি আশ্বাস দিলো ও দেখছে ব্যাপারটা সবটা ঠিক করে দেবে ।
মামার সাথে কথা বলা শেষে ক্লাসমের রাইসার একটা মেসেজ আসলো ও যাতে মেইল চেক করে দেখে ।
ল্যাপটপ নিয়ে মেইল চেক করতেই অবাক হয়ে যায় মিথি ।
একজন নাম করা ফ্যাশন ডিজাইনারের আন্ডারে জব করার সুযোগ পেয়েছে ও । এতসব ঝামেলায় এপ্লিকেশন করার কথা ভুলেই গেছিলো । রাইসা যে ওর অজান্তেই এপ্লিকেশন করেছে এটা ভেবে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলো রাইসা কে ।
আল্লাহর কাছে দুআ করলো রাইসার মঙ্গল হোক৷
এক সপ্তাহ পর বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার মারজুক মুফতি ওকে দেখা করতে বলেছে ।
এত এত কষ্টের মধ্যে এই এক টুকরো সুখ মিথির ঠোঁটের কোণে হাসির ঝিলিক এনে দিলো ।

__
শ্যুটিং শেষে রফিক পানির বোতল নিয়ে দৌড়ে আসলো রাইদের দিকে ।
এক চুমুক দিয়ে ও ফোনটা চাইলো ।
রফিক ফোন এগিয়ে দিতেই ওকে বললো গাড়ি বের করতে খুব টায়ার্ড লাগছে হোটেলে ফিরবে ।
রফিক যাওয়ার পর ফোন ঘাটাঘাটি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো রাইদ ।
হোয়াটস আ্যাপে মেসেজ গুলো চেক করার সময় একটা মেসেজে চোখ আটকে গেলো ।
তাতে লেখা , “হেই ব্রো তোমার কথায় তো মেয়েটাকে কাজে নিলাম পারফর্মেন্স ভালো না হলে কিন্তু আমার টাইম কিল করার জন্য দোষারোপ করবো তোমাকেই”
রাইদ রিপ্লাই করলো, “শী ইজ ভেরি ট্যালেন্টেড । তোমাকে নিরাশ করবে না”
বাঁকা হেসে রাইদ আপন মনেই বললো, “মিস শেখ তোমার অজান্তেই তোমার কতগুলো উপকার করে চলেছি । এর রিটার্ন কিন্তু আমার ভালোভাবেই চাই”
চলবে,