একঝাঁক জোনাকির আলো

একঝাঁক জোনাকির আলো !! Part 39

৩৯.
_____________________
লোকমা বলে যে একটা শব্দ হয় এটাই যে ছেলে যানতো না সে নিজের হাতে লোকমা ধরে কারোর মুখে বিরিয়ানি তুলে দিচ্ছে ব্যাপারটা আসলেই মুগ্ধ কর মনে হচ্ছে ইফতেখারের।ছাদের এক কোনে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখে কিছুসময় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি।তারপর মনে এক ঝাঁক ভালো লাগা নিয়ে আবার সিঁড়ি বেয়ে যেভাবে এসেছিলেন সে ভাবেই নিচে নেমে গেলেন।
সাফার দু’হাতে মেহেদী। সবার পড়ে মেহেদী লাগিয়েছে তাই খেতে পারছিলো না।নিভ্র সাফাকে এই মধ্যরাতে ছাদে এনে নিজের হাতে খাইয়ে দিচ্ছে। সাফা বেশ আয়েশের সাথেই খাচ্ছে।নিভ্র নিজেও কখনো নিজের হাতে খায়নি।ছোট থেকে হোস্টেলে থাকতে হয়েছে।আর তাদের হোস্টেলে আধুনিকাতা বেশি ছিলো তাই ছোট থেকে চামুচ দিয়েই খায় সে।এই প্রথম তার জীবনে সে চামুচ ছাড়া হাত লাগিয়ে খাইয়ে দিচ্ছে সাফাকে।যেখানে হাতে ঝোল লাগলেও তার রাগ বিরক্তির শেষ ছিলো না সেখানে বিরিয়ানির প্লেটে হাত দিয়ে খাইয়ে দিচ্ছে। আহ কি দৃশ্য। ভালোবাসার হাতে পাগল করার মত জাদু আছে সাথে মাতাল করার মত শক্তি।নিভ্র শুধু পাগল, মাতাল হয়েই সারেনি আরো অনেক কিছুই হয়েছে।সাফা খাওয়ার মাঝেই দুষ্টামি করে নিভ্রর আঙ্গুলে কামড় বসিয়ে দেয়।নিভ্রর কোনো হেল দুল নেই।একটা দেয়, দুটো দেয়,তিনটে আরো জোড়ে দেয়।এভাবে কামড়ের মাত্রা বাড়ে।কিন্তু নিভ্রর হেল দুল কিছুই নেই।ছাদে বাতাস হচ্ছে মৃদূ। আকাশে থালার মত চাঁদ।চাঁদের কিরনের সাথে মিশে লাইটের আলো এক হয়েছে।সাফাকে এই আলোতে দেখে নিভ্রর অদ্ভুত লাগছে।তার হঠাৎ হঠাৎই মনে হয় সাফা সুন্দর, খুবই সুন্দর তার ধারনার চাইতেও সুন্দর কিন্তু এতে কি?? কত সুন্দর মেয়েই তার চারপাশে মৌমাছির মত ঘুড়ে।তাদের প্রতি তো এত মায়া এত ভালোবাসা এত কেয়ারি ভাব আসে না।সব এই মেয়ের জন্যই বরাদ্দ।পরেই হেঁসে মনে মনে বলে রূপ দেখে নয় হাজার লক্ষ কোটির ভেড়েও প্রকৃত হৃদয়েকে সে পেয়েছে।তাই তাকে ভালোবাসে তার রূপে নয়।সাফা এবার জোড়েই কামড় বসিয়ে দিলো।নিভ্র হাত ঝাঁড়ি দিয়ে দেখে লাল টকটকে আঙ্গুল মনে হয় কেঁটেও গেছে। সাফা নিভ্রর মুখ দেখেই খিলখিল করে হেঁসে উঠে।নিভ্র সাফার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলে,
—” আঙ্গুল কামড়ে কি মজা পেলে শুনি??”
সাফা হাসতে হাসতেই বললো,
—” অনেক মজা বুঝবেন না।বাই দ্যা ওয়ে আপনার আঙ্গুল এত নরম কেনো তুলতুলে!!”
—” তা আমি কিভাবে যানবো যে বানিয়েছে তিনিই যানতে পারে।”
—“ছেলেদের হাত পা সব শক্ত শক্ত হয় শুনেছি কিন্তু আপনার বেলায় উল্টো কেনো??”
—” এমন কিছুই না।তোমার দাঁত শক্ত তাই এটা মনে হয়েছে।দেখো লাল করে দিয়েছ!”
সাফা নিভ্রর আঙ্গুল টেনে মুখে নিয়ে একটা চুমু দেয়।নিভ্র চমকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। যেনো তার শরীরের রোম রোম কেঁপে উঠেছে।সাফার স্পর্শ গুলো তার কলিজার ধাঁজে কম্পোনের জন্ম দেয়।এ যেনো অদ্ভুত একটা ভালো লাগার অনুভুতি।সাফা হাত সরিয়ে বলে,
—” যান আপনার ব্যাথা ভালো হয়ে যাবে।”
নিভ্রর হুশ হয়।হাঁসে খানিকসময় নিয়ে।তারপর বলে,
—” কামড় দিতে তো কম দেওনি তাহলে আদর দিতে এত কিপটামু করছ কেনো??”
সাফা এবার লজ্জা পায়।মাথা নামিয়ে নিচের দিকে তাকায়।ভাজঁ করা পায়ের বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে ফ্লোর খোঁচায়।নিভ্র হাঁসে। আবার হাত এগিয়ে মুখের সামনে ধরে বলে,
—” তুমি এত ছোট সিম্পল ডিজাইন দিয়েছ কেনো??হাত ভড়িয়ে দিলে আরো ভালো লাগতো।”
সাফা মাথা তুলে তাকায়।ডিজাইন দেখে বলে,
—” সিম্পলই সুন্দর। তবে এখানে একটা ইন্টেরেস্টিং জিনিস আছে।খুঁজে দেখবেন??”
—” কেনো নয়।এদিকে দেখাও।”
সাফা দুখানা হাত মেলে দিলো।নিভ্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে।তারপর বলে,
—” পেয়ে তো গেছি কিন্তু বলবো না।”
—” পাইলে তো বলবেন।হিহি আমি অনেক টেকনিক এপ্লাই করেছি তাই খুঁজে পাওয়া মুশকিলই নেহি না মুনকিন হে।”
নিভ্র হাসলো।সাফা বিরক্তির সাথে বলে,
—” হাসছেন কেনো??”
—” এমনেই।”
—” এমনে কেউ হাঁসে না পাগল ছাড়া।আপনি কি পাগল??”
—” হুম সাফারানীর পাগল ডাক্তার।এবার খাও।অনেক রাত হয়েছে।ঘুমতে হবে।রেস্ট নিতে হবে।কাল বিয়ে মনে নেই।”
—” আছে আগে সিক্রেট বের করেন তারপর।”
নিভ্র প্লেট থেকে মনোযোগ সরিয়ে একটু বিরক্তি নিয়েই বলে,
—” এত নাছোড়বান্দা কেনো তুমি সাফারানী??তুমি টায়ার্ড না??এত নাচানাচি করলা।এখন না ঘুমালে কাল উঠতে পারবে না।আর উঠলেও খুব মাথা ব্যাথা করবে।তাই খাও প্লিজজ।তারপর ঘুম।”
—” না না না আগে বলেন!!”
নিভ্র ছোট কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
—” সাফার ডাক্তার সাহেব লিখেছ।”
সাফা চমকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। যেনো বিশ্বাসই হচ্ছে না নিভ্র পেরেছে।বিস্মের সাথে সে বললো,
—” কিভাবে পেলেন??আমি তো দুই হাত মিলিয়ে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় লিখেছি।”
নিভ্র জবাবে হাসলো কিছু বললো না।সাফার মুখে খাবার পুরে দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুসময়। মনে মনে ভবে এই মেয়েটা যাতে তারই হয়।একে ছাড়া বাঁচা দায় হয়ে যাবে তা না হলে।সাফার খাওয়া শেষ।নিভ্র সাফার এলোমেলো সামনে থাকা ছোট চুল সরিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে একটা চুমু খায় কপালে।সাফার মনে মুহূর্তেই এক অদ্ভুত অনুভুতি সাথে ভয় হতে থাকে।এত ভালোবাসে কেনো লোকটা।অতিরিক্ত ভালোবাসা কি ঠিক??অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না।তার বাবা বলে।অতি হাসাও ভালো না অতি কান্নাও ভালো না।তবে কি অতি ভালোবাসাও ভালো না??সাফা তাকিয়ে থাকে নিভ্রর দিকে এই লোক যে এতটা যত্নবান এটা সে বাস্তবে উপলব্ধি না করলে যানতে পারতো না।নিভ্র সাফার হাত ধরে টেনে দাড় করায়।তারপর বলে,
—” নিচে গিয়ে ঘুমিয়ে যাবে।”
সাফার হঠাৎ কি হলো নিভ্রকে হুট করেই জড়িয়ে ধরে।অনেক অনেক শক্ত তার হাতের বাঁধন। নিভ্র চমকায়।চরম ভাবে অবাক হয়।সাফার হঠাৎ কি হলো??নিভ্ররও কেমন ভয় ভয় করে।ভয় একটা ছোঁয়াছে রোগের মত।কাছের জন পেলে নিজের মাঝেও টান্সপার হয়।নিভ্র এক হাতে সাফার পিঠ জড়িয়ে ধরে।মজার ছলে সাফাকে বললো,
—” কি হয়েছে সাফারানীর??আজ মনে হচ্ছে বেশিই ভালোবাসা আসছে!!!অতি প্রেম প্রেম পাচ্ছে নাকি??”
সাফা আরো শক্ত করে ধরে নিভ্রকে।নিভ্রর মনে ভয় জাগে।মনে হয় ছেড়ে দিলেই খারাপ কিছু হয়ে যাবে।শুধু কিছু না বহু কিছু।সাফার ভয়ে কলিজায় হাতুড়ি পিটা হয় নিভ্রর।সাফার মাথায় হাত বুলায় নিভ্র।নিভ্রর মনে হচ্ছে তার কালো টি শার্ট ভিঁজে যাচ্ছে। সাফার মত চঞ্চল মেয়ের মাঝে কান্নাটা একটা বড় কারনেই আসে।নিভ্রর উত্তেজনা বাড়ে।উদ্বেগের সাথে সে বললো,
—” কি হয়েছে কাঁদছ কেনো??
—“এই বলবে??নাকি আমার বুক ভাসাতে ভালো লাগছে??সাফারানী??”
সাফা নিশ্চুপ। নিভ্র আবার বললো,
—” এই তুমি না বলে ছিলে ছাদে রাতে খাবার খেলে ভূতে ধরতে পারে আমার মনে হচ্ছে তোমাকে কান্না রানীর ভূত আক্রমণ করেছে।তাই এমন করছ।সাফা এবার বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু!!
সাফার কান্নার বেগ বাড়ে।ফুঁপানোর শব্দ কানে আসে নিভ্রর।নিভ্র এবার প্রচন্ড টেনশনে পরে।হৃৎপিন্ড দ্রুত চলে।নিভ্র সাফাকে এবার ধমকের সুরে বলে,
—–” ভালো কথা ভালো লাগে না?? আর একবার কান্নার শব্দ এলে ছাদ থেকে নিচে ফেলে দিব!চুপ!চুপ করতে বলেছি না??”
সাফা এবার কান্না আঁটকে সরে আসে।নিভ্র অবাক হয়ে সাফার চোখমুখ দেখে,কি অদ্ভুত কয়েক মিনিটের কান্নায় মুখ ফুলিয়ে নিয়েছে??নিভ্র প্লেট নিচে রাখে।সাফার গাল নিজের হাতে নিয়ে মুছে দেয়।তারপর শান্ত সুরে বললো,
——” এবার বলো কি হয়েছে??”
সাফা ফুঁপাতে ফুঁপাতেই বলে,
——-” আপনি আমাকে খুব মানে অতিরিক্ত ভালোবাসেন তাই না??”
নিভ্র চমকপ্রদ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুসময় তারপর নিজেকে সামলে বললো,
——-” অবশ্যই। তোমার কি ডাউট আছে নাকি??দেখো সব মানবো কিন্তু আমার ভালোবাসা নিয়ে ডাউট মানবো না।”
—–” আমি তো সেটা বলতে চাচ্ছি না!!”
—” তো কি বলতে চাচ্ছ সাফারানী??”
সাফা নিভ্রর দিকে তাকায়।আবার চোখ নামিয়ে নেয়।নিভ্র এক হাতে জড়িয়ে নেয় সাফাকে।সাফা টি শার্ট খাঁমছে মাথা রাখে নিভ্রর বুকে।তারপর কাঁপা গলায় বললো,
—” অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না ডাক্তার সাহেব।”
—” কি সব বলছ??”
—–” ঠিক কথাই।অতিরিক্ত হাঁসা বা কান্না করা যেমন ভালো না তেমনি অতিরিক্ত ভালোবাসাও ভালো না।এতে বিরহের কষ্ট মৃত্যু যন্ত্রনার মত লাগে।”
নিভ্রর বুক ধাড়াঁস করে উঠে।বুকের ধুকপুকানি বাড়ে।দু হাতে সাফাকে জড়িয়ে বলে,
—-” সাফা প্লিজজজ এভাবে বলবে না!আমি নিতে পারিনা এই কথা গুলো!এমনেই এসব ভাবলে দম বন্ধ লাগে।উম্মাদ উম্মাদ লাগে!এখন আবার তুমি হাজিবাজি কথা বলছ!এগুলোর মানে হয়!”
—-” যানি না।হঠাৎ মনে হচ্ছে আপনি বদহয় আমাকে বেশিই ভালোবাসেন।আমি আপনার ভালোবাসায় দিন দিন আকৃষ্ট হয়ে যাচ্ছি।তাই ভয় করছে খুব।”
নিভ্রর নিজেরও কেমন গাঁ ছম ছম করছে।তাই ঝাঁড়ি দিয়ে বলে,
—” ধ্যুৎ এসব ভয় লাগানো ডায়লগ কে শিখিয়েছে তোমাকে।আমি মডেল হয়েও শিখতে পাড়লাম না।এসব ছাড়।তুমি যদি আমার পাঁজরের হাওয়া হও কারো ক্ষমতা নেই তোমাকে আলাদা কারার!বোকা মেয়ে!নিচে চলো।”
সাফা মাথা তুলে তাকায়।তারপর বলে,
—-” যদি আপনার পাঁজরের ভাঙা হাওয়া না হই??”
নিভ্রর চোখেমুখে ভয় ফুটে উঠে মুহূর্তেই।আরো শক্ত করে দুহাতে জড়িয়ে ধরে।সাফার কানে নিভ্রর ভয়ের ধুকপুকানির শব্দ আসে।নিভ্র বলে,
—” ফালতু কথা রাখো।এবার চলো আমার সাথে নিচে।তুমি আমারই হাওয়া।আর কারো না।মানে কারো না।দরকার হলে ভিলেন লাভারের মত জোড় করে নিজের কাছে রাখবো আর তা না হলে রোমিওর মত মারা যাবো তবুও তুমি আমার মানে আমার।তোমাকে ছাড়া নিঃশ্বাস নিতেও বড্ড কষ্ট হয়।তাহলে তোমাকে ছাড়া আমি,আমি শেষ।এবার গুলো ছাড়।খুশির মাঝে এসব চিন্তা আসে কিভাবে তোমার মাথায়??”
সাফা নিভ্রর বুকে নাক মুখ ঘঁষে।নিভ্র হাঁসে। সাফা মাথা তুলে বায়নার সুরে বললো,
—” সিঁড়ি পর্যন্ত কোলে করে নিবেন??”
নিভ্র দুষ্টু হাসি দিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
—–” কোলে উঠতে ভালো লাগে বুঝি??”
সাফা নাক ফুলায়।তারপর বলে,
——” যান লাগবে না আমি নিজেই যেতে পারবো।”
—” রাগ দেখাতে হবে না।নাকও ফুলাবে না।প্লেট হাতে নেও।তোমাকে সারা জীবন কোলে নিয়ে হাঁটে পারবো।তোমার ডাক্তার সাহেব বলে কথা।”
সাফা প্রথমে নাছোড়বন্দার মত উঠতে চায় না।নিভ্র জোড় করেই কোলে নেয়।সাফা মিটমিটিয়ে হাঁসে নিভ্রর বুক ঘেঁষে মাথা রেখে। নিভ্র তাকিয়ে সেই বুক ঘেঁষে হাসি দেখে।তারপর বলে,
—” ভালোবাসি।”
সাফা মুখ গুঁজে দেয় বুকে। নিভ্র হেঁসে সামনে হাঁটে।
______________
বিয়ে বাড়ির রমরমে পরিবেশ। সব জায়গায় কোনায় কোনায় মানুষের আনাগোনা। অভ্র নিভ্র ভাইয়ের দায়িত্ব ঠিক ভাবে পালন করছে।এদিক সেদিক তদারকি করছে।তবে ভোগান্তি বেশি নিভ্রর।সাফার আশেপাশে ছেলে দেখলেই তার শরীর বেয়ে রাগ যেনো রিরি করে বাড়ে।ছেলে কেনো তার তো হিরনকে দেখার পড়ে কোনো মেয়েকে সাফার গাঁ ঘেঁষে কথা বলতে দেখলেও বিরক্ত লাগছে।নিভ্র অভ্র মেইন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।নিভ্রর চোখ এদিকে কম সাফার দিকে বেশি।তার সাফার উপড় রাগ হচ্ছে। কি দরকার ছিলো বাদামি রং এর জামা পড়ার।গায়ের রং এর সাথে মিশ খেয়ে কেমন পরী পরী লাগছে।আর ছেলেরা মৌমাছির ঝাঁকের মত চারপাশে বিচরন করছে।অভ্র চোখ বাঁকিয়ে একবার তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিভ্রকে বলে,
—-” ওদিকে এত কি দেখস??মানুষ এদিকে ভাই।”
—” তো কি হইছে।”
—” কি হইছে মানে??কোথায় এদের সাথে কথা বলে ওয়েলকাম করবি তা না ওই দিকে তাকাই আছস।”
—” ভাই আমার সব তো ওই দিকে এদিকে দেখে কি হবে।প্রচন্ড রাগ লাগছে। ”
অভ্র হাঁসে। নিভ্রর মত ব্যক্তির মুখে এই কথা গুলো তাদের খুব হাসায়।নিভ্র অভ্রর দিকে তাকিয়েই বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে বললো,
—-” হাঁসার কি হলো??”
—” তুই প্রেমে পড়ে বোকা বোকা হয়ে গেলি মনে হয়।তোকে ডাক্তার ডাক্তার কম প্রেমিক প্রেমিক বেশি লাগে।”
নিভ্র হাসলো।তারপর বললো,
—” তোরে টিচার টিচার থাকতে বলে কে??প্রেমিক হ!”
অভ্র উদাসীন চাহনি চারদিকে বিচরন করে বলে,
—” পারলে আমিও হতাম।”
—” আঁটকে রাখছে কে??”
অভ্র মনে মনে হেঁসে বলে “তুই” তারপর ভারী ইনোসেন্ট গলায় বলে,
—” প্রেমের লাগি প্রেমিকা লাগে ভাই।কিন্তু কই পামু প্রেমিকা ক??”
—” হেই তোর ভাষার একি ছিঁড়ি। কবে থেকে পামু,লাগি এগুলো ইউজ করা শুরু করলি??”
—” চুপ যা তুই।আবার প্রেমিক থেকে ডাক্তার হয়ে গেলি কেন??সাফারে ডাকমু??”
নিভ্র চোখ কটমট করে অভ্রর দিকে তাকায়।অভ্র পাত্তা না দিয়ে শার্টের কলার ঠিক করে।
রাফার বিদায় বেলায় কান্নার ঢেউ যেনো সাফারই বেশি।রাফা অনেক আদর করত তাকে।কেউ থামাতে পারেনা এই কান্না।সাফার বাবা তাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরেছে।রাফা তার ভাইয়েদের জড়িয়ে অনেক সময় নিয়ে কাদেঁ।অভ্র ঝাঁড়ি দিয়ে বলে,
—” তুই গাড়িতে উঠবি নাকি তোর জামাইরে ঘর জামাই রেখে দিবো??”
নিভ্র বলে,
—” আইডিয়া খারাপ না ভাই।শুন নিশান তোর বাবার কোটি টাকার ব্যবসা, তোর চাকরি এগুলো রেখে চলে আয় আমাদের বাড়ি কোনো সমস্যা নাই।আমাদের বোনও আমাদের কাছে থাকলো তুইও ফ্রি!”
আকাশ কিটমিটিয়ে বলে উঠে,
—” ভাই আমারে রাখলে কি হয়। এরে রেখে লাভ নাই নিভ্র।আমি কাজের ও অকাইম্মা”
সবাই হেঁসে উঠে কথোপকথন শুনে।রাফা অভিমানি সুরে বলে,
—” আমি চলে যাচ্ছি ভাইয়া আর তোমরা মজা নিচ্ছ??”
দু’ভাই চেঁচিয়ে বলে,
—” মোটেও না।
সাফা বিরক্ত ভাইগুলোর প্রতি কোথায় বোন চলে যাচ্ছে কান্না কাটি করবে তা না শুধু হেঁসেই চলেছে।মনে হচ্ছে গেলেই বাঁচে।তার এই বিরক্তি হঠাৎ অবাকতায় রূপ নেয়।গাড়ি গেট পার হতেই নিভ্র ঝাঁপিয়ে অভ্রকে জড়িয়ে ধরে।কাঁদছে না তবুও মনে হচ্ছে আর্তনাদ বেড়িয়ে আসছে।সাফার অবাক লাগে এদের ভালোবাসা দেখে।বিশেষ করে নিভ্র অভ্রর।নিভ্রকে এই দুনিয়ার একজন ব্যক্তিই ভালো ভাবে সামলাতে পারে।আর কেউ না।সে হল অভ্র।অভ্র ছাড়া নিভ্রর ভয়ংকর রাগ সাফাও কমাতে পারবে না।এটাই সাফার মনে হয়।এত সুন্দর পরিবার সে আগে কখনোই দেখেনি।কত ভালোবাসা এদের মাঝে।প্রকাশ না করেও হাজারো ভালোবাসা।সাফা নিজের শীতল দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকে সবার দিকে।
__________________
রাত ১২টা ছুঁই ছুঁই। ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছে পরিবারের সবাই।সাফা সাফার বাবা এক পাশে, নিভ্র অভ্রর পাশে, তার বাবারা,মারা, দাদা, একপাশে, আর মাহির বাবা মা এক পাশে।গোল মিটিং এর মতই সব আয়োজন হচ্ছে মনে হয়।সারিক আগেই কথা শুরু করে বললেন,
—” সাখাওত তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
সাখাওত একটু ভ্রু কুঁচকালো।কারন মাহির আব্বু সবাইকে এই গোল মিটিংয়ে আমন্ত্রণ করেছে তাহলে তার আগে সারিক কি বলতে চায়??এটা ভেবেই তার ভ্রু কুঁচকে এসেছে।নিজেকে ঠিক করে তিনি বলেন,
—” বল!!কথা বলতে অনুমতি লাগে নাকি??”
—” না তেমন কিছু না।আসলে সাফার হল পাওয়া গেছে।তাই এখন আর তোদের বাসায় থাকতে হবে না ওকে।অনেক দিন যত্নে রেখেছিস ধন্যবাদ। তোর মত বন্ধু পাওয়া আর তোদের পরিবারের মত পরিবার পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।অসংখ্য ধন্যবাদ আমার একমাত্র কলিজারে এত ভালো ভাবে রাখার জন্য।”
নিভ্র অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে ফ্লোরে চোখ রাখে।তার সত্যিই আজ নিজেরে বাংলা সিনেমার নায়ক নায়ক লাগছে আর সারিককে হিটলার শ্বশুর। যদি শ্বশুর আব্বাই তার লাভ স্টরির ভিলেন হয় তখন কি হবে??এই আশংকা নিয়ে নিভ্রর ভয় হচ্ছে। সাখাওত কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,
—” তোর ধন্যবাদ তোর কাছে রাখ।কচুর বন্ধু মনে করস।বন্ধু হলে ধন্যবাদের গোডাউন নিয়ে বসতি না।আর ও আমারও মেয়ে।তাই হলের সিট ক্যান্সেল কর।আমার বাসাই থাকবে।”
সাফার বুক কাঁপছে।ভয়ও হচ্ছে খুব কিন্তু কেনো??হলে যাবে বলে তার মন খারাপ হলেও ভয় হচ্ছে না।ভয় অন্যকারনে হচ্ছে। সাফার বাবা কিছু বলার আগেই মাহির বাবা বলে,
—” আরে হলে থাকলে তো ওরই লাভ।পড়ালেখা ভালো হবে।আর তাছাড়া তোদের বাসায় দুইটা ছেলে আছে।মেয়ে মাত্র দুজন এভাবে তো একটা মেয়ে কারো বাসায় থাকতে পারেনা।নেহাত তখন বিপদে পড়েছে মানে বিশ্বস্ত কেউ ছিলো না তাই তোদের বাসায় রাখে কিন্তু এখন তো সব ঠিক আর থেকে কি হবে।”
সারিক বলে উঠে,
—” হুম সেটাই বলতে চাচ্ছি। ”
নিভ্রর রাগ বাড়ছে।অভ্র হাত চেঁপে বসে আছে।মাহি যেনো আজ মহা খুশি।শুধু হেঁসেই চলেছে।সাখাওত গলার স্বর কঠিন করে বলে,
—” এগুলো কোনো কথাই না।আগেও এখানে ছিলো এখনো থাকবে বেসস।”
মাহির বাবা বলে,
—” আরে মেয়েকি তোর নাকি?? যার মাথা তারই ব্যাথা, বাদদে তো।এভাবে একজনের বাসায় কতদিন থাকা যায়।হল যখন পেয়েই গেছে এত কথা বাড়াস কেনো??”
সারিকের গায়ে লাগে কথা গুলো।সে কখনোই তার মেয়েকে কারো বাসায় রাখতে চায়নি।হলও মিলেনি আর ঢাকায় আত্নিয়ও কেউ নেই।সাখাওতের পরিবারকে অনেক আগে থেকে চিনে এবং সম্পর্ক গভীর হওয়াই মেয়েকে রেখে গেছে। এর বেশি কিছু না।মাহবুব শুধু শুনেই চলেছে তেমন কিছু বলে না।নিভ্র ফোঁস ফোঁস করছে রাগে।তার ইচ্ছে করছে মাহির বাবাকে এখনই মেরে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে।কিন্তু চুপ করে আছে।রাজিব বলে,
—” এসব কেমন কথা ভাই??মেয়ের মত আমাদের ও।আর ও এ বাড়িতেই থাকবে।”
মাহির বাবা এবার সোজা হয়ে বসে বলে,
—” পরের মেয়ে নিয়ে এত ভাবার কি আছে??আর এই মেয়েরে জিজ্ঞেস করলেই হয় ও কোথায় থাকতে পছন্দ করবে।এতো কথার মানে হয়??এই মেয়ে??তুমি কোথায় থাকতে চাও বলো??”
ইফতেখার ভয়ে শেষ।তার ছেলের প্রান এই মেয়ের মাঝে এটা এই কিছুদিনেই বুঝেছেন।সাফা চলে গেলে নিভ্র কি করবে সেটাই ভাবছে সে।নিভ্র দাঁতে দাঁত চেঁপে গম্ভীর গলায় বলে,
—” সাফা নাম ওর।এই মেয়ে বলার মানে কি ?? আপনি কি নাম জানেন না??তাহলে ডাকার প্রয়োজন নেই।”
মাহির বাবা দমে।নিভ্রকে তারও ভয় লাগে অনেক।ছোট থেকে এই দুই ভাইয়ের উপর কেউ কথা বলে না।তাই তিনিও ভয় পান এদের।মাহির বাবা সুর লাগিয়ে বলে,
—” স্যরি বাবা।তো সাফা তুমি কোথায় থাকতে চাও??”
সাফা বাবার দিকে একবার তাকায়, নিভ্রর দিকে একবার তাকায়।নিভ্র মাথা নিচু করে আড়চোখে তাকিয়ে আছে।সে মনে প্রানে দোয়া করছে সাফা যাতে থাকতে চায়।সাফাকে ছাড়া তার সকালের সূর্য যেমন ভালো লাগে না, রাতের আকাশও ভালো লাগে না।দিনটাই খারাপ লাগে তার।সব দম বন্ধ লাগে।সেখানে সাফা হলে গেলে সে তো যখন তখন সাফাকে দেখতে পাবে না।এটা ভেবেই নিভ্রর বুক কাপঁছে। সাফা বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
—“হলই ভালো হবে।”
সাফা মাথা নিচু করে।নিভ্র চমকে তাকায়।সে ভেবেছে সাফা থাকতে চাইবে।সাফার উপড় রাগ হচ্ছে নিভ্রর। খুব রাগ।সাফা এটা কিভাবে বলে দিলো??যেখানে ও জানে তাকে না দেখে নিভ্রর সকাল হয় না, বিকেল যায় না, রাত আসে না।কথাটা ভেবেই রাগে নিভ্র ফ্লোরের দিকে তাকায়।সাফারো খুব মন খারাপ।কিন্তু বাবাকে সে ছোট করতে চায় না।তার তো নিভ্রর চাইতে তার পরিবারটা বেশি প্রিয়।কত ভালোবাসে সবাই তাকে।এদের ছেড়ে তারও যেতে ইচ্ছে করছেনা।সবার মুখ কালো হয়ে গেছে।মাহির খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে। মনে মনে বলে অনেক হইছে এবার তোর যাওয়ার পালা।অভ্র নিভ্রর হাত মুঠোয় নিয়ে রেখেছে।প্রলয় যেকোনো সময় আসতে পারে।মাহির বাবা বলে,
—” এই তো সব ঠিক হয়েগেছে শুধু শুধু এমন রিয়েকশনের আর তর্কের প্রয়োজন ছিলো না।
নিভ্র চোখ তুলে সাফার দিকে একবার তাকায়।সাফা নিভ্রর লাল হওয়া সবুজ চোখ দেখেই ভয়ে চোখ নামিয়ে নেয়।সারিক বলে,
—” কালই তাহলে আমরা চলে যাবো।আমি কিছুদিনের ছুটি নিয়েছি।তাই।ভাই সাখাওত তোরে অনেক ধন্যবাদ।
—” ধন্যবাদের কি আছে ও তো আমারও মেয়ে।”
নিভ্র উঠে দাঁড়ায়। সাফার সাথে বুঝাপড়া করবে সে।এভাবে তার দম বন্ধ করে তো সাফাকে যেতে দেওয়া যাবে না!!”
—” আরে নিভ্র বাবা কথা এখনো হয় নি তুমি কোথায় যাচ্ছ?”মাহির বাবা বলে।
নিভ্র একবার তাকায়।ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না কি বলতে চাচ্ছে উনি।তাই বসে পড়ে।সাফার বাবাকে সম্মান দেখাতে গিয়ে সে কিছু বলতেও পাড়ছেনা। কিন্তু বেশি সময় নিয়ে এই সম্মান দেখাতে পারবে বলে মনে হয় না তার।মাহির বাবা এবার সাখাওতের দিকে তাকিয়ে বলে,
—” দেখ তুইও বিজন্যাস ম্যান আমিও।দুজনের পার্টনারশিপ দেশ বিখ্যাত। তাই বলছিলাম কি এর একটা সম্পর্কের নাম দিলে কেমন হয়??”
সাখাওত সহ বাড়ির সবাই বিস্ময়ে তাকায়।কেউই বুঝতে পাড়ছে না কি বলতে চাচ্চে।সাফাও বিস্মিত নয়ে তাকিয়ে থাকে সবার দিকে।সাখাওত বললো,
—” বুঝলাম না ঠিক। আমরা তো সম্পর্কেই আছি।একুই পরিবার।আলাদা কি?? ”
—” আরে আরো কাছের সম্পর্কে যেতে চাই।মেয়ের বাবা হয়ে বুঝি এখন বলতাম??”
সাফা চমকে তাকায়।সাথে সবাই নিভ্র তো আকর্ষীক ঝাটকা খেলো মনে হয়।সাখাওত বলে,
—” তুমি মেয়ের বাবা এটা আমি তুই সবাই জানি তাই এখানে নতুনের কি??আর কি বলবি ক্লিয়ার করে বল?? ”
মাহির বাবা নড়েচড়ে বসে উৎসাহের সাথে বলে,
—” আমার মেয়ে তোর কেমন লাগে মানে মাহিকে??”
সাখাওত বিস্ময়ের সাথেই বললেন,
—” কেমন লাগে মানে কি??ও তো আমার মেয়ের মতো।”
ইফতেখার মনে মনে বিড়বিড় করে বলে,
—–” আইছে আমার মেয়ে জাতির পিতা।হু!এই মাহি নামের বেয়াদপ মেয়ে আমার ভালোই লাগে না।বলে কিনা মেয়ে?? 😒আজ রুমে আসো পরে বুঝামু!!”
মাহির বাবার পরের কথা শুনে সবাই ভয়ংকর ভাবে ঝাটকা খায়।তিনি বলেন,
—” তাহলে আর কি??আমাদেরও নিভ্র বাবাকে অনেক পছন্দ। মাহি তো ছোট থেকেই করে।দুজন দুজনকে চিনে জানে বুঝে।তাই আমি চাই এই সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে।মানে আসল কথা শুধু আমি কেনো তোদেরও মত আছে যেহেতু আমরা চাই ওদের বিয়ে দিতে।মাহি আর নিভ্র দুজনেই হাই সোসাইটির ছেলেমেয়ে।ভালো সম্পর্কও।তাই বিয়েটা তাড়াতাড়ি হলে ভালো হয়।কিরে কি বলছ??”
সারিক আর মাহির পরিবার বাদে সবার মুখের ভঙি পরিবর্তন হয়ে গেছে।সারিক সবাইকে অবাক হয়ে দেখছে এত বিস্ময়ের কি আছে সে বুঝে উঠতে পারলো না।অভ্র তো সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।সাফা আশ্চর্য চোখে নিভ্রর দিকে তাকায়।নিভ্র নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।সাফা চোখ সরিয়ে ফ্লোরে রাখে।বুকের পাশে ব্যাথাটা যেনো হঠাৎ করেই তিব্র থেকে তিব্র হয়।গাল বেয়ে না পড়লেও চোখের পাপড়ি বেয়ে পানি গড়িয়ে নিচে পড়ে।মনে মনে ভাবে তাহলে কি”!!সে নিভ্রর পাঁজরের ভাঙা হাওয়া না!!!”
.
.
#চলবে________________________🍁

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *