অজানা কারণ

অজানা কারণ !! Part- 03

মিনহাজের ঘর থেকে রক্তের বেসামাল বন্যা লিভিং রুমে ছড়িয়ে পড়েছে। রক্তের টাটকা গন্ধে আর ভেজা আর্দ্রতায় পুরো ঘর ঝুপঝুপ করছে।
আমি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে এক পা দুপা করে পিছে হটতে থাকলাম। কিছুদুর যাওয়ার পর টেবিলের সাথে ধাক্কা লেগে আমি থেমে গেলাম।

এই মুহূর্তে আমার বুকের ভেতরটা ধুক ধুক ধুক ধুক করছে। হার্টবিটে যে এত বিকট শব্দ হতে পারে এর আগে কখনও শোনা হয়নি।

হঠাৎ একটা বিকট শব্দ করে মিনহাজ দরজাটা খুলে দিল। মিনহাজ দরজাটা খুলেতেই আমি আরো বেশি চমকে উঠলাম! ধারালো ছুরি হাতে মিনহাজ দরজার সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ছুরি থেকে এখনো টুপটুপ করে রক্ত পড়ছে।

আমি ধিরে ধিরে সাহস করে মিনহাজের ঘরের কিছুটা কাছে এগিয়ে গেলাম। ঘরের নিকটবর্তী হওয়া মাত্রই আমার ভিতরটা আঁতকে উঠলো। মিনহাজের ঠিক ডান পা ঘেঁষেই পড়ে আছে জয়ার লাশ। গলায় ছুরি দিয়ে কাটার চিহ্ন। গলা থেকে এখনো অনবরত রক্ত পড়েই যাচ্ছে।

আমি সাহস করে এবার মিনহাজের মুখের দিকে তাকালাম। মিনহাজ খুব শান্ত আর গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।একটা মেয়েকে খুন করা নিয়ে উনার মাঝে সামান্য একটু ও ভাবান্তর নেই।
মিনহাজের সাদা শার্ট রক্তের ছিটে ফোঁটায় হালকা ছোপ ছোপ লাল হয়ে গিয়েছে। মুখেও কিছুটা রক্তের ছিটেফোঁটা রয়েছে।

আমি কিছু বলতে যাবো। তার আগেই মিনহাজ আমার কাছে এসে মুখ চেপে ধরে বলল,
_খবরদার !
আমার কাজ নিয়ে তুই কোন প্রশ্ন করবি না। আমি ওকে খুন করতে চাইনি। কিন্তু ও বাধ্য করেছে আমাকে ওকে খুন করতে।

আমি কাঁপাকাঁপা গলায় বললাম,
_আপনি কেন এসব করছেন? মেয়েদের সাথে আপনার কিসের এত শত্রুতা? এই নিরীহ একটা মেয়েকে আপনি কেন মারলেন? ও নিজেকে আপনার স্ত্রী বলে দাবি করেছিল। তারমানে ও অবশ্যই আপনার স্ত্রী।নিজের স্ত্রী কে কেউ এত নৃশংস ভাবে হত্যা করে?

এবার মিনহাজ হুংকার দিয়ে বলল,
_এই সাবধান! তুই আমাকে একদম জ্ঞান দিবি না।
তুই আমাকে জ্ঞান দেওয়ার কে রে? আমি বলেছি না আমি হত্যা করতে চাইনি। কিন্তু হত্যা করে ফেলেছি।
যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমি তোকে স্ত্রী হিসেবে স্বীকার করি আর নাই বা করি। তুইতো আমাকে স্বামী হিসেবে স্বীকার করিস নাকি?

আমি মুখে হাজারটা জড়তা নিয়ে বললাম,
_হ্যাঁ আমি আপনাকে স্বামী হিসেবে মানি। ১০০ ভাগ বিশ্বাসের সাথে স্বীকারো করি। কিন্তু স্বামী হিসেবে মানা বা না মানার সাথে এই খুনের কি সম্পর্ক? আমাকে দয়া করে পরিষ্কার ভাবে বলুন!
আপনার এই হেঁয়ালি মার্কা কথা আমি সত্যিই বুঝতে পারিনা।

মিনহাজ আমাকে জোরে ধমক দিয়ে বলল,
_একদম বাড়তি কোনো কথা বলবি না। আমি তোকে যতোটুকু জিজ্ঞাসা করব ।
ঠিক ততটুকুই উত্তর দিবি। এখন আমার হাতে বাড়তি কথা বলার মতো কোনো সময় নেই।
তোর যত প্রশ্ন আছে সব প্রশ্নের উত্তর একদিন পেয়ে যাবে। এখন মূল কথায় আসি।
আমাকে যদি পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। আর এই হত্যার দায়ে আমার ফাঁসি কিংবা যাবজ্জীবনের জন্য কারাদণ্ড হয়।
তাহলে কি তুই মেনে নিতে পারবি?

মিনহাজের কথা শুনে আমি পুরোদমে ঘাবড়ে গেলাম। কথাটা কোনোভাবেই সহ্য করতে না পেরে দুই হাত দিয়ে শক্ত করে কান চেপে ধরে বললাম,

_আপনি এসব কি বলছেন? আমাদের বিয়ে হয়েছে কেবল একদিন হলো। বিয়ের আগে থেকেই আপনার সাথে আমার সব খারাপ কিছু ঘটে যাচ্ছে। আর বিয়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত একটাও ভালো কিছু ঘটেনি। আমি কি করবো আমাকে বলে দিন। আমার মাথায় কিছু আসছে না।

মিনহাজ হাসতে হাসতে সোফায় বসে পরলো। তারপর রক্তমাখা ছুরিটা ওর ডান পাশে রেখে বলল,

_এই তো এতক্ষণে তুই সোজা রাস্তায় এসেছিস। তোকে কি করতে হবে এটা তুই এখনো বুঝতে পারছিস না?
জয়াকে পুলিশ অনুসন্ধান করার আগেই এই লাশটা আমাকে আর তোকে দুজনকে মিলে গায়েব করতে হবে। কি আমাকে তুই সাহায্য করবি না?

আমার শরীর প্রচন্ড রকমের কাঁপছে।এটা কি ভয়ে নাকি অন্যায়ের সাথে অংশীদার হওয়ার অনুতাপে। সেটা আপাতত বুঝতে পারছিনা।
আমি মিনহাজ কে কিছু একটা বলতে যাবো। তার আগেই আমার ফোনে রিং বেজে উঠল।
শাশুড়ি মা কল করেছেন।

কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে,
_কি ব্যাপার মামনি? তোমাকে কতবার করে বললাম ওয়ালেট আর সেলফোনটা রেডি করে রাখো! মিনহাজের হাতে একদম সময় নেই। অফিসের প্রচুর তাড়া। আর তুমি এখনও এই দুইটা জিনিস রেডিই করতে পারো নি। ড্রাইভার সেই কখন থেকে তোমাকে কল করে যাচ্ছে ।তুমি কোন রেসপন্সই করছ না।

আমি আকুতি-মিনতি ভরা কন্ঠে বললাম,
_সরি মা! আসলে আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। কখন যে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নিজেও জানিনা। তাই হয়তো খেয়াল করিনি ড্রাইভার কখন কল করেছিল। কোন ব্যাপার না মা আমি এক্ষুনি সবকিছু দিয়ে দিচ্ছি।

শাশুড়ি মা আরো একটা কিছু বলতে যাবেন।তার আগেই মিনহাজ আমার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে লাইন কেটে দিল।
আমি মিনহাজ কে বিস্ময়ের সুরে বললাম,
_আপনি ফোন কেটে দিলেন কেন? ওপাশে তো মা
ছিলেন। আচ্ছা মা কি জানেন না আপনি এখানে?

মিনহাজ আমাকে চুপ করতে ইশারা করে বললো,
_ড্রাইভার কে জিনিস গুলো দিয়ে তাড়াতাড়ি আয়। আমার হাতে সময় বেশি নেই।তুই কি বুঝতে পারছিস না জয়াকে পুলিশ খুঁজলে আমি ফেঁসে যাবো?
নাকি তুই এটাই চাইছিস?

আমি মিনহাজের আর কোন কথার উত্তর দিলাম না। সোজা নিজের ঘরে এসে সেলফোন আর ওয়ালেট টা নিয়ে বাহিরে চলে গেলাম। ড্রাইভার গাড়ির ভিতরেই বসে আছে। আমাকে দেখা মাত্রই গাড়ি থেকে নেমে কিছুটা সম্মানের ভঙ্গিতে বলল,

_ম্যাডাম আপনি কষ্ট করে আসতে গেলেন কেন?
আমাকে বললেই তো হতো আমি গিয়ে নিয়ে আসতাম। আসলে আমি আপনাকে অনেক বার কল করেছিলাম। কিন্তু আপনি আমার কোন কল রিসিভ করেননি।

আমি অনেকটা জোরের উপর হেসে বললাম,
_না ঠিক আছে। কোন ব্যাপার না। আসলে আপনি যে কল করেছেন আমি শুনতে পাইনি। আচ্ছা একটা কথা বলুন তো ‌। আপনার স্যার কি আপনাদের সাথেই ছিলেন?

ড্রাইভার হাসতে হাসতে বলল,
_ছিলেন কি আবার ম্যাডাম? আমিতো স্যারকে উনার পরিবারের সাথে ছেড়ে দিয়েই,,,,,,,।

ড্রাইভার কথাটা শেষ করার আগেই আমার ফোনে রিং বেজে উঠল। অপরিচিত নাম্বার। আমি ওর সাথে আর কোন কথা না বলে ।ওকে বিদায় জানিয়ে চলে আসলাম। আসতেই দেখি মিনহাজ আমার উপর প্রচন্ড রকম ক্ষেপে আছে।

আমি বহু কষ্টে মিনহাজকে শান্ত করলাম। দুজনে মিলে ধরাধরি করে জয়ার লাশটা বাড়ির পেছনের ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে ভিতরে ফেলে দিলাম।
মিনহাজের হাতে তখনও রক্তাক্ত ছুরি টা ছিল।
আমি মিনহাজ কে উদ্দেশ্য করে কিছু একটা বলতে যাবো। তার আগে মিনহাজ বলে উঠলো,

_দেখ আমি যে জয়া কে খুন করেছি। এ কথা যদি কেউ জানতে পারে । তাহলে তোকেও আমি জয়ার মত এভাবে,,,,,, মিনহাজ আমার পেটের বরাবর ছুরি তাঁক করার সাথে সাথে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।

কিছু সময় পর আমার জ্ঞান ফিরলো। আমি শোয়া থেকে উঠে বসলাম। নিজেকে বিছানায় দেখে আমি খুব অবাক হলাম!তাহলে একটু আগে আমি যা যা দেখেছি সব স্বপ্ন ছিল।
বিছানা থেকে নেমে ব্যালকনির কাছে গিয়ে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম! আকাশে রাতের অন্ধকার দেখা যাচ্ছে।
_ওমা ঘড়িতে প্রায় বারোটা বাজতে চলেছে। তারমানে আমি দুপুর বারোটায় ঘুমিয়ে রাত বারোটায় ঘুম থেকে উঠেছি। এটাও কি সম্ভব?

ফোন হাতে নিয়ে আমি আর ও কিছু টা অবাক হয়ে গেলাম। মা অনেকগুলো কল করেছেন। মিনিমাম ৫ মিনিট আগেও।
আমি কল ব্যাক করলাম।অদ্ভুত ব্যাপার হলো একবার রিং বাজার সাথে সাথেই মা রিসিভ করে ফেললেন।
আমি ভিতরে কিছুটা ইতস্তত বোধ রেখে বললাম,

_মা আপনি কল করেছিলেন। আমি ঘুমে ছিলাম তাই ধরতে পারিনি। আপনারা ঠিকমত পৌঁছেছেন?

মা হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে বললেন,
_হ্যাঁ মা আমরা ঠিক মতই পৌঁছেছি। তুমিতো জানোই কুষ্টিয়া পৌঁছাতে আট থেকে নয় ঘণ্টা লাগে। তাই একটু কষ্ট হয়েছে। শোনো! মামনি তোমাকে যেটা বলার জন্য কল করেছিলাম।
আমাদের বাড়িতে একটু সমস্যা হয়েছে। তাই মিনহাজকে আমাদের সাথে নিয়ে এসেছি। তুমি কষ্ট করে একটু দুইটা দিন একা থাকো। দুদিন বাদেই মিনহাজ ফিরে যাবে। এ কথা বলার জন্য তোমাকে অনেক বার কল করেছিলাম। কিন্তু তুমি কল রিসিভ করোনি।

আমি খানিকটা লাজুক ভঙ্গিতে বললাম,
_না ঠিক আছে মা। উনি আস্তে ধীরেই আসুন। আমি এখানে সব সামলে নেব। শাশুড়ি মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে আমি ফোন রেখে দিলাম। প্রচন্ড রকমের ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে।
আর ক্ষুধা সহ্য করা যাচ্ছে না। ফ্রীজে যা আছে আপাতত তাই খেয়ে নেওয়ার চিন্তাভাবনা করে আমি লিভিং রুমের দিকে এগোতে থাকলাম।

লিভিং রুমে গিয়েই আমি দুপা পিছিয়ে গেলাম। পুরো লিভিং রুম রক্তে ভেসে যাচ্ছে।আমি রক্ত অনুসরণ করতে করতে সেই রুমটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। যেই রুমের সামনে আমি মিনহাজকে দাঁড়াতে দেখেছিলাম।

রুমের কাছে যাওয়া মাত্রই আমি ধপ করে সোফায় বসে পড়লাম। এটা কিভাবে সম্ভব?
জয়ার বিধ্বস্ত লাশ পড়ে আছে ঘরের মাঝ বরাবর। ঠিক ওই দিকটাতে। যে দিকটাতে মিনহাজ দাঁড়িয়েছিল। আর আমার ঠিক ডান পাশেই পড়ে আছে রক্তাক্ত ছুরিটা। সেখান থেকে এখনো টুপ টুপ করে রক্ত পড়ছে মেঝেতে।

আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম!
মিনহাজ যদি আট থেকে দশ ঘন্টার রাস্তা পেরিয়ে কুষ্টিয়া পৌঁছে থাকে। তাহলে জয়ার খুন কে করেছে?

(চলুক,,,,,,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *