অচেনা আমি ! পর্বঃ- ২
লেখাঃ শারমিন আক্তার
আস্ফিঃ কি হয়েছে ভাবি? তুমি এভাবে বসে পরলা কেন? ভিতরে কি দেখলে?
তনয়া আস্ফির কথার কোন উত্তর না দিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। তা দেখে আস্ফি ভিতরে তাকালো যা দেখলো তাতে আস্ফিরও চোখ বড় বড় হয়ে গেলো।
আয়াত হসপিটালের বেডে শোয়া আয়াতের মুখে অক্সিজেন মাস্ক দেয়া, আয়াত চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে আছে। ভিতর থেকে ডাঃ ইমন (তাকে তনয়া আস্ফি দুজনেই চিনে এবং তিনিও তাদের আয়াতের মাধ্যমে মোটামুটি চেনেন) বের হতেই আস্ফি বললো ডাঃ আমি ডাক্তার আয়াতের বোন। ভাইয়া কেমন আছেন? কি অবস্থা তার? কি কারনে এমন হয়েছে?
ডাক্তার ইমনঃ আসলে মিটিং রুমে কিভাবে যেনো শর্টসার্কিট হয়ে আগুন লেগে যায় সেখানে বেশ কিছু ডাক্তার আলোচনায় ছিলো। তাদের সবাই বেশ অসুস্থ, তবে ভয় পাবার কিছু নাই সবাই বিপদ মুক্ত। আজ রাত অবজারবেশনে রেখে কাল সকালে বেডে দিবো এবং দু এক দিনে সবাইকে রিলিজ করে দিবো। তবে সবাইকে বেশ কিছুদিন বিশ্রামে থাকতে হবে।
তনয়াঃ আর আয়াত! ওর কি খবর? (অনেকটা চিন্তিত হয়ে)
ডাক্তার ইমনঃ তিনিও আল্লাহর রহমতে ঠিক আছে। কাল সকালে তাকেও বেডে দেয়া হবে। কদিন বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে।
আস্ফিঃ কিন্তু ডাঃ এরকম কিভাবে হলো?
ডাক্তার ইমনঃ সেটা আমরাও বুঝতে পারছি না। হাতপালের সব ইলিট্রিকাল সংযোগ গুলো রোজ চেক করা হয়। এমন হবার কথা না, এখন এটা একসিডেন্ট নাকি পরিকল্পিত কোন বিষয় তা বোঝা যাচ্ছে না, পুলিশ খবর দেয়া হয়েছে, দেখি তারা কি করে! হাসপাতালে ছয়জন ডাক্তারের সাথে এমন ঘটনা ঘটায়, চারদিকে হৈচৈ পড়ে গেছে। ওনাদের পুরোপুরি সুস্থ হতে কজনের প্রায় পনোরো দিন এবং বাকি দুজনের এক মাস লাগবে। ততদিন তাদের এত রোগী কি করে সামলাবো সেটা ভেবে হাসপাতাল অথরেটির মাথা পুরো খারাপ হয়ে আছে। কি করবে ঠিক ভেবে পাচ্ছে না! এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি বসানো হবে যতদূর শুনেছি। আপনাদের আর কিছু জানার থাকলে পরে বলুন আমার কিছু কাজ আছে।
তনয়াঃ ডাঃ একটা কথা? আমি কি আয়াতের সাথে দেখা করতে পারি?
ডাক্তার ইমনঃ ঠিক আছে কিন্তু কোন কথা বলবেন না। আর আপনি একা যান।
তনয়া ভিতরে ডুকে পরলো। এই ফাঁকে আস্ফি বাসায় ফোন করে সবাইকে বিষয়টা জানিয়ে দিলো। সাথে তনয়ার বাড়ি ফোন করেও বলে দিলো। তারা খবরটা শুনে ভিষন চিন্তায় পরে গেলো। তারা শিগ্রই হাসপাতালে উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
তনয়া আয়াতের বেডের কাছে গিয়ে আয়াতের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বব্দে কাঁদছে। তারপর আয়াতের মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। আয়াতের এখনো জ্ঞান ফিরেনি। তনয়ার চোখের জলে মুখ বাঁধা নেকাবটা ভিজে একাকার। কিছুক্ষন আয়াতের দিকে তাকিয়ে থেকে যেই আসাতে নিলো আয়াত তনয়ার হাতটা ধরে বসলো! হাতের ইশারায় তনয়াকে পাশে বসতে বললো। তনয়া পাশে বসে এক হাত দিয়ে আয়াতের মাথায় হাত বুলাতে লাগলো অন্য হাতটা আয়াত ধরে রেখেছে। কিছুক্ষন পর ডাক্তার আসায় তনয়াকে বাইরে চলে যেতে হলো। বাইরে গিয়ে দেখে বাড়ির সবাই আই সি ইউ এর বাইরে দাড়িয়ে আছে। রাতে তনয়া হাসপাতালে থাকতে চাইলেও আয়াতের বাবা বলে কাল থেকে থাকবে আজতো এমনিতেও কাউকে ভিতরে ডুকতে দিবে না। আমি বরং এখানে থাকি, তারপর তনয়া, আস্ফি আর আনিকা বাড়ি চলে আসলো।
সারা রাত তনয়া বিছানায় ছটফট করলো। রাতের বেশির ভাগ সময়ই তনয়া নামাজ পড়ে আর আল্লাহর সাথে কান্না করে কাটিয়েছে। বিয়ের তিন বছরে আয়াতকে ছাড়া বা আয়াতের সাথে কথা না বলে একটি রাতও কাটেনি। যখন আয়াত কোন কাজে শহরের বাইরে থাকতো বা রাতে ফিরতে পারতো না তখন ফোনে তনয়ার সাথে বারবার কথা বলতো। দুজনে ফোনে কথা বলেই রাত পার করে দিতো। কিন্তু আজ প্রথমবার নাতো আয়াত আছে না আয়াতের সাথে কথা বলতে পারছে। রুমের প্রতিটা জিনিস যেনো তনয়াকে চেপে বসেছে কারন রুমের প্রতিটা কোনায় ছড়িয়ে আছে ওদের ভালোবাসার স্মৃতি। তনয়া বাড়ি এসে বেশ কয়েকবার আয়াতের বাবাকে ফোন দিয়ে আয়াতের বিষয়ে জিগেস করেছে।
ফজরের নামাজ পড়ে তনয়া আর দেরি করলো না। সামান্য কিছু নাস্তা আর নরম খাবার বানিয়ে আস্ফিকে বলে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। হাসপাতালে গিয়ে দেখে আয়াতের বাবা ডাক্তারের সাথে কথা বলছেন। তনয়া বুকটা কেঁপে উঠলো। তারাতারি তার কাছে গিয়ে জিগেস করলো
তনয়াঃ বাবা কি জিগেস করলেন ডাক্তারকে? ওনি ঠিক আছে তো?
আয়াতের বাবাঃ হ্যারে মা চিন্ত করিস না। আয়াত ঠিক আছে কিছুক্ষন পর বেডে দিবে।
প্রায় ঘন্টা খানিক সময় পর আয়াত সহ বাকি সবাইকে যার বেড বা কেবিনে দেয়া হলো। আয়াত এখন অল্প অল্প কথা বলতে পারে। আয়াতকে বেডে দেবার কিছুক্ষন পর তনয়া আয়াতের বাবাকে এবং তনয়ার বাড়ি থেকে আসা তনয়ার বাবা মা আর ছোট বোনকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। বললো কিছু লাগলে তাদের ফোনে জানবে। আয়াত ঘুমিয়ে আছে আর তনয়া আয়াতের পাশে বসে ওর একটা হাত শক্ত করে ধরে আরেক হাত দিয়ে আয়াতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর আয়াতের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে। আয়াতের ডান হাতটা বেশ খানিকটা পুড়ে গেছে, কপালে বেশ আঘাত পেয়েছে, ডাক্তার তনয়াকে বলছে পিঠের এবং কোমরে নাকি বেশ খানিকটা জায়গা পুড়ে গেছে। তবে ভয় পাবার মত কিছু হয়নি মাস খানিকের মধ্যে ঘা শুকিয়ে যাবে। তনয়া আয়াতের বা হাতটা এত শক্ত করে চেপে ধরে রাখছে যে, মনে হয় হাতটা ছেড়ে দিলে কেউ আয়াতকে তনয়ার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যাবে। তনয়া আয়াতের হাতটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। তনয়ার চোখের পানি টুপ করে আয়াতের হাতে পরলো। আয়াত এতক্ষন চুপ থাকলেও এখন তনয়ার চোখের জল এরানোর মত শক্তি আয়াতের নাই। আয়াত তনয়ার হাতটা শক্ত করে ধরে বললো।
আয়াতঃ তনয়া আমি ঠিক আছি। প্লিজ কান্না করো না। তুমি তো জানো তোমার কান্না দেখলে আমার কতটা কষ্ট হয়!
তনয়া আয়াতের বুকে মাথা রেখে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো তোমাকে এভাবে দেখে আমার বুঝি কষ্ট হচ্ছে না । তুমি জানো কাল থেকে আমার অবস্থা ঠিক কেমন হয়ে আছে। মনে হয় কেউ ভিতর থেকে হৃদয়টা কেটে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে। তোমার শরীরে কত জায়গা পুড়ে গেছে, ভিষন কষ্ট হচ্ছে তোমার তাই না?
আয়াতঃ দূর বোকা অল্প পুড়েছে। এতে এমন কিছু হবে না। খুব শিগ্রই ঠিক হয়ে যাবো দেখো। আর তাছাড়া তুমিতো আছো! তুমি থাকলে আমার আর কি চাই বলো?
তনয়াঃ আচ্ছা আয়াত মিটিং রুমে কি হয়েছিলো?
আয়াতঃ আসলে তনয়া, এর মধ্যে কে যেনো আয়াতের কেবিনের দড়জায় টোকা দিতে থাকে। তনয়া তারাতারি হিজাব পরে মুখ ঢেকে ফেলে। (তনয়ার পরিবার খুব ধার্মিক থাকায়, তনয়া অনেক পর্দাশীল, ওকে বাইরের পরপুরুষ কেউই দেখেনি। এমনকি বিয়ের সময় বাইরের ছেলেরা দেখবে বলে তনয়া আর আয়াতের বিয়ে একদম সাধারন ভাবে ঘরোয়া পরিবেশে হয়েছে। বাইরে কারো সামনে তনয়া হিজাব ছাড়া যায় না) তনয়া দড়জা খুলে দেখে তিন জন পুুলিশ অফিসার।
অফিসারঃ ম্যাডাম আমরা কালকের ঘটনার তদন্ত করতে আসছি। আপনার হ্যাজবেন্ড এর জবানবন্দী নিবো। তার কি জ্ঞান ফিরেছে?
তনয়াঃ (অত্যান্ত নিচু স্বরে) জ্বি।
অফিসারঃ মিঃ আয়াত বলুন গত কাল মিটিং রুমে কি হয়েছিলো?
আয়াতঃ আসলে কাল আসরের নামাজের পর আমরা ছয় জন ডাক্তার মিলে কিছু জরুরি আলোচনার জন্য ওখানে বসি। কিন্তু কিছুক্ষন পর হঠাৎ করে রুমের বেশ কয়েকটি লাইট আপনা আপনিই ব্ল্যাস্ট হয়ে যায়। আমরা বেশ ভয় পেয়ে যাই। রুম থেকে বের হতে গেলে দেখি রুম লক করা! কিভাবে যে, রুম লক হয়ে গেলো বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ ফাইলের সেলফে বৈদ্যুতিক তার থেকে আগুন ধরে গেলো। পুরো রুমে ধোয়ায় ভরে গেলো, আমাদের সবার, চোখ জ্বালা করতে লাগলো আর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। দড়জা খোলার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু পারছিলাম না, তারপর সিলিং এ টানানো বড় কাচের ঝারটা বিকট শব্দ করে নিচে পরে গেলো। তখন আমরা বেশ কজন ছিটকে পরে যাই। আমি গিয়ে সেলফের ওখানে পরায় পিঠে আর কোমরে আগুনের ছ্যাকা লাগে, কপালে কিভাবে যেনো আঘাত পাই। ঘটনাগুলো এত দ্রুত হয়ে যায় যে, আমরা কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারিনি বা কি করা উচিৎ তাও ভেবে পাচ্ছিলাম না । আমি কোনমতে ফোন বের করে ডাক্তার ইমনকে বলি মিটিং রুমে আগুন লাগছে। তারপর কি হয়েছে কিছু মনে নাই।
অফিসারঃ হুমমম বুঝতে পারলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই এতসব হয়ে গেলো আর তাও একসিডেন্টলি? বিষয়টা কেমন যেনো ঘোলাটে লাগছে। পুরো হসপিটালে শুধু তিন তলার দুটো রুমে শর্ট সার্কিট হয়েছে। মিটিং রুমে আর তার পাশের রেস্ট রুমে, তখন রেস্ট রুমে দু তিন জন লোক ছিলো, তাদের ভিতর দুজন ঠিক আছে অপরজন সামান্য আঘাত পেয়েছে। রেস্ট রুমের দড়জা খোলা ছিলো বিধায় তাদের তেমন ক্ষতি হয়নি। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো হঠাৎ করে এমন দূর্ঘটনা কিভাবে ঘটলো?
আয়াতঃ আমারও একই প্রশ্ন অফিসার!
তনয়া একবার ভাবছে মেসেটার কথা বলবে আবার ভাবছে আয়াতের সাথে কথা না বলে বলা ঠিক হবে না। আগে আয়াতকে বলবো তারপর তারপর পুলিশকে।
অফিসারঃ আমরা বিষয়টা তদন্ত করে দেখছি। আপনি বরং বিশ্রাম নিন। যদি আরো কিছু মনে করতে পারেন তাহলে আমাদের জানাবেন। আর আমাদের কিছু জানার থাকলে আবার আপনাকে বিরক্ত করবো কিন্তু!
আয়াতঃ নো প্রবলেম অফিসার। আপনার যে কোন কিছু জানার দরকার হলে আসতে পারেন।
অফিসার কেবিন থেকে বের হতেই তনয়া দড়জা লক করে বলে। আয়াত তোমাকে কিছু বলার আছে। কিন্তু—–
চলবে——–
ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।