অনাকাঙ্ক্ষিত সে

অনাকাঙ্ক্ষিত সে !! Part- 08

মোহনাকে নিয়ে আলভীর দিকে এগিয়ে যায় মিশ্মি। আলভী হাত তালি দিতে দিতে বলে,
“আমার প্রতিবাদী কিসমিস।”
মিশ্মি আলভীর প্রতিউত্তরে হেসে দেয়। আলভী বলে,
“তাহলে যাই এবার?”
“না। বাবার সাথে কথা বলতে পারিনি তখন। আগে একটু কথা বলে আসি?”
“আচ্ছা যাও।”
মিশ্মি মোহনাকে নিয়ে হাসপাতালে যায়। বাবার সাথে টুকটাক কথা বলার সময় রেহেনুমা বেগমের দিকে তাকান। তার দৃষ্টি নিচের দিকে স্থির। মিশ্মির দিকে তাকাচ্ছেনা। কথা বলা শেষ করে বাহিরে বেড়িয়ে আসে। মিশ্মি আসতেই গাড়ি স্টার্ট দেয় আলভী। গন্তব্য এখন নুয়াজকে খোঁজা। মিশ্মির মনে অজানা অনুভূতিগুলো দানা বেঁধে আছে। ভয়, আনন্দ সবকিছুর সংমিশ্রণ একসাথেই হচ্ছে। মিশ্মির বলা ঠিকানাতেই আলভী গাড়ি থামায়। বাংলো বাড়িতে এসে মিশ্মি আগে গাড়ি থেকে নামে। গেটে দাঁড়ানো দাঁড়োয়ানের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“চাচা নুয়াজ আছে?”
দাঁড়োয়ান চাচা একটু বিরক্ত নিয়ে তাকালো মিশ্মির দিকে। এর আগে দু’রাত যে নুয়াজের সাথে এই বাংলো বাড়িতে ছিল সেটা সে দেখেছে। হয়তো অন্যান্য মেয়েদের মত মিশ্মিকেও সে খারাপ মেয়ে ভাবছে। মুখে বিরক্তিকর ভাব ফুঁটিয়েই উত্তর দিলেন,
“আছে। কিন্তু ভেতরে যাওয়া যাবেনা।”
“কেন?”
“তুমি যখন ছোট সাহেবের সাথে ছিলে তখন কারো ভেতরে যাওয়ার পারমিশন ছিল না। এখন ছোট সাহেবের সাথে অন্য মেয়ে আছে। কারো ভেতরে যাওয়ার পারমিশন নাই।”
নুয়াজের সাথে অন্য কোনো মেয়ে আছে শুনে বুকে মোচর দিয়ে উঠলো মিশ্মির। মিশ্মি আগে থেকেই জানে নুয়াজ কেমন। আগে কখনোই খারাপ লাগেনি এসব ভেবে বা জেনে। কিন্তু আজ লাগছে। শুধু খারাপই লাগছেনা বরং খুব বেশি কষ্টও হচ্ছে। কারণ বুঝতে কষ্ট হয়না মিশ্মির। আগে নুয়াজের প্রতি ওর কোনো ভালোবাসা ছিল না কিন্তু এখন আছে। হয়তো এজন্যই কষ্ট হচ্ছে এত। মানুষ খারাপ পথে খুব সহজেই যেতে পারে। কিন্তু সেই পথ থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। কিন্তু মিশ্মিকে চেষ্টা করতে হবে। নিজের সবটা দিয়ে চেষ্টা করতে হবে নুয়াজকে এই পথ থেকে ফিরিয়ে আনার।
আলভী আরো আগেই মিশ্মির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মিশ্মিকে চুপ থাকতে দেখে আলভী বললো,
“আমি উনার কথা কিছুই বুঝলাম না মিশ্মি।”
আলভীর কথার উত্তর দিলো না মিশ্মি। দাঁড়োয়ান চাচাকে বললো,
“আপনি নুয়াজকে আমার কথা বলেন। আমার কথা শুনলে ও আমাকে ভেতরে যাওয়ার পারমিশন দিবে।”
“ছোট সাহেবকে এখন ডাকলে সে রাগ করবে। এমনিই তার অনেক রাগ। পরে আমার চাকরী নিয়ে টানাটানি হবে।”
মিশ্মি এবার কড়া গলায় বলে,
“আমি ভেতরে যাবোই।”
“ছোট সাহেব যখন বের হবে তখন দেখা কইরো।”
মিশ্মি রীতিমত তার সাথে চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। আলভী মিশ্মিকে শান্ত করে বললো,
“আমরা বরং অপেক্ষা করি?”
“কিন্তু! কতক্ষণ এভাবে অপেক্ষা করবো? আমি নুয়াজের কাছে যাবো।”
মিশ্মি প্রায় কান্নাই করে দিচ্ছিলো। দাঁড়োয়ান চাচার হয়তো মায়া লাগলো। তিনি বললেন,
“দাঁড়াও আমি ফোন করে দেখি পারমিশন দেয় নাকি।”
আলভী বললো,
“হ্যাঁ প্লিজ একটু চেষ্টা করে দেখুন।”
কিছুক্ষণ পর দাঁড়োয়ান চাচা ফিরে এসে বলেন,
“যাও। পারমিশন দিয়েছে।”
মিশ্মি খুশিতে ধন্যবাদ দিয়ে ভেতরে যায়।দরজায় বেশ কয়েকবার নক করার পর দরজা খুলে দেয় একটি মেয়ে। দরজা থেকে দাঁড়িয়েই মিশ্মি দেখতে পায় নুয়াজ বিছানায় বসে বসে সিগারেট খাচ্ছে। নুয়াজ বিছানা ছেড়ে উঠে আসে। মেয়েটি সামনে থেকে সরে যায়। মিশ্মির চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে। নুয়াজ সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে বলে,
“ওহ! তুমি? তা হঠাৎ কি মনে করে?”
“এসব কি? আপনি অন্য মেয়ের সাথে?”
“হ্যাঁ তো? তোমার প্রয়োজন শেষ তুমি চলে গিয়েছো। এখন আমি কিভাবে আমার লাইফ লিড করবো সেটা আমার বিষয়। তুমি হঠাৎ এখানে কেন সেটা বলো? আবার কোন প্রয়োজনে এসেছো?”
শেষ কথাগুলো একটু ব্যাঙ্গ করেই বললো নুয়াজ।
“আমি আপনার কাছে প্রয়োজনে আসি?”
“তাছাড়া আর কি? মানুষের তো একটু কৃতজ্ঞতা বোধ থাকে। তোমার তো সেটাও নেই। উধাও হওয়ার আগে একটু জানাতে তো পারতে।”
“আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন।”
“ছলনাময়ীদের চেনা মুশকিল।”
“আমি আপনার সাথে কোনো ছলনা করিনি।”
“অযথাই তর্ক করতে ভালো লাগছেনা। কত টাকা লাগবে এখন সেটা বলো?”
“আমি আপনার কাছে কোনো টাকার জন্য আসিনি। যেজন্য এসেছিলাম সেটা না জানিয়ে বেশ ভালোই হয়েছে। মেয়েদের নিয়ে রাত কাটানো, টাকা উড়ানো এগুলোই আপনার জীবন। ভালোবাসা বলতে না আপনি কিছু জানেন আর না কিছু বোঝেন।”
কথাগুলো বলেই মিশ্মি বাড়ি থেকে বের হয়। আলভী দাঁড়োয়ান চাচার সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। মিশ্মির বুকটা ভারী হয়েছিল। যেকোনো মুহুর্তে চোখের মেঘগুলো বৃষ্টি হয়ে নামবে। মিশ্মিকে এভাবে বেড়িয়ে আসতে দেখে আলভী বলে,
“কি হয়েছে মিশ্মি?”
“আমি বাড়ি যাবো।”
“নুয়াজ কোথায়?”
“আমি বাড়ি যাবো। আপনি নিয়ে যাবেন কি’না?”
“কি হয়েছে সেটা তো বলবে?”
“ধ্যাত!”
মিশ্মি কান্না করতে করতেই হাঁটা শুরু করে। আলভী কি করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা। দাঁড়োয়ান চাচাকে বললো,
“চাচা প্লিজ নুয়াজের নাম্বারটা দিবেন?”
“আচ্ছা তুলো।”
আলভী নুয়াজের নাম্বার নিয়েই গাড়িতে উঠে মিশ্মির পেছন পেছন যায়। মিশ্মির কাছে গিয়ে বলে,
“গাড়িতে উঠো।”
মিশ্মি কিছু না বলে গাড়িতে উঠে বসে। নিরবে চোখের পানি ফেলে। মিশ্মিকে এখন কিছু জিজ্ঞেস করলেই আরো বেশি কাঁদবে। তার চেয়ে বরং শান্ত হোক তারপর জিজ্ঞেস করা যাবে।
মিশ্মি রুমে গিয়ে দরজা চাপিয়ে দেয়। আলভী ওর মাকে বলে ওর কাছে এখন না যেতে। আলভী নিজেও বেড়িয়ে যায় বাড়ি থেকে। নুয়াজের নাম্বারে বেশ কয়েকবার ফোন দেয়। নুয়াজ কল রিসিভ করে বলে,
“হ্যালো।”
“নুয়াজ?”
“হ্যাঁ। আপনি কে?”
“আমি আলভী। আপনি আমাকে চিনবেন না। আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই। যদি একটু সময় দিতেন?”
“কি দরকার?”
“দেখা হলেই বলবো।”
“ঠিক আছে।”
.
নুয়াজ আর আলভী মুখোমুখি বসে আছে। নুয়াজ দেখতে মাশআল্লাহ্। যেকোনো মেয়ের নজর কাড়ার জন্য নুয়াজের মত ছেলে যথেষ্ট। আলভী যে নুয়াজের থেকে কম সুদর্শন সেটাও কিন্তু নয়। কিন্তু নিজের সৌন্দর্য নিজে খুঁজে বের করা মুশকিল। নুয়াজ টেবিলের ওপর হাত রেখে বলে,
“তারপর বলুন মিস্টার আলভী। কিজন্য দেখা করতে চাইলেন?”
“আসলে আমি মিশ্মির ব্যাপারে কথা বলার জন্য আপনাকে ডেকেছি।”
“আপনি মিশ্মির কে?”
প্রশ্নটাকে অনেক কঠিন মনে হলো আলভীর। সত্যিই তো মিশ্মি আলভীর কি হয়? এমন কোনো সম্পর্কই তো ওদের মধ্যে নেই। এমন কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে তাও আবার নুয়াজের সামনে সেটা ভাবেনি আলভী। আলভী উত্তরে বলে,
“আমি ওর শুভাকাঙ্ক্ষী। আচ্ছা আপনার সাথে মিশ্মির আজ কি হয়েছে?”
“কি হবে? কিছুই না।”
“দেখুন আপনাদের মধ্যে সম্পর্ক কি বা আজ কি হয়েছে সেটা আমি জানিনা। তবে আমার মনে হচ্ছে কোনো ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে।”
“ওর কথা আমার শুনতে ইচ্ছে করছেনা। স্বার্থবাদী একটা মেয়ে।”
“আপনি ভুল। আপনি একটু ঠান্ডা মাথায় আমার কথা শুনুন।”
এরপর মিশ্মির সাথে ঘটে যাওয়া সব কথা নুয়াজকে বলে আলভী। এটাও বলে যে, মিশ্মি নুয়াজকে কতটা ভালোবাসে।সব শুনে নুয়াজের নিজের প্রতিই নিজের রাগ হচ্ছে। কি করে পারলো এভাবে মিশ্মিকে কষ্ট দিতে। নুয়াজ বিনয়ী স্বরে বললো,
“মিশ্মি এখন কোথায় আপনি জানেন?”
“আমার বাসায়।”
“আমি ওর কাছে যেতে চাই।”
“শিওর। চলুন আমার সাথে।”
.
.
সন্ধ্যাঃ ৭টা
পুরো রুম অন্ধকার করে ফ্লোরে বসে হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদছে মিশ্মি। আয়েশা বেগম বেশ কয়েকবার এসে জিজ্ঞেস করেও মিশ্মির কাছ থেকে কিছুই জানতে পারেনি।
আলভীর সাথে আলভীর বাসায় এসেছে নুয়াজ। আলভীর রুমে গিয়ে মিশ্মির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে । আলভী রুমের লাইট অন করে দেয়। মিশ্মি মুখ তুলে তখনও তাকায়নি আর নুয়াজকেও দেখেনি। নুয়াজ যখন মিশ্মির মাথা উঁচু করে তখন নুয়াজকে দেখতে পায়। এখানে নুয়াজকে দেখে বেশ অবাক হয় মিশ্মি। কিন্তু অভিমানের পাহাড়ে চাপা পড়ে যায় বিষ্ময়। নুয়াজের হাত ছিটকে ফেলে দেয় মিশ্মি। যতবার নুয়াজ ধরতে যায় মিশ্মি ততবারই সরিয়ে দেয়। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“একদম আমাকে ছুঁবেন না। ধরবেন না আমায়।”
নুয়াজ এবার জোর করে টেনে মিশ্মিকে বুকে নেয়। নুয়াজের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য হাত-পা ছুঁড়োছুঁড়ি করছে।
“ছাড়েন আমায় ছাড়েন। আপনার জন্য কত মেয়ে আছে। আমি তো স্বার্থপর। নিজের স্বার্থের জন্য আপনাকে ব্যবহার করেছি। সরে যান আমার থেকে।”
“আমি স্যরি তো জান। এবারের মত মাফ করে দাও। আর কখনো এমন ভুল হবেনা।”
“আমি সেই সুযোগই দিবো না। আপনি আমাকে ছাড়েন।”
“স্যরি প্লিজ। আর কাঁদে না।”
মিশ্মির কপালে, গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় নুয়াজ। চোখের পানি মুছে দিয়ে আবার বুকে জড়িয়ে নেয়।
“একটাবার সুযোগ দাও জান। এমন কখনোই আর হবেনা। প্রয়োজনে এখন যতখুশি আমাকে মারো, বকো।”
মিশ্মি এবার আর নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছেনা। নিরবে চোখের পানি ফেলছে। মিশ্মির একহাত নুয়াজের পিঠে রেখে আলতো করে মিশ্মিও জড়িয়ে ধরে।
“সবাই শুধু আমাকে কষ্ট দেয়। আপনিও আমাকে কষ্ট দেন।”
“আর দিবো না তো। সত্যি বলছি আর কষ্ট দিবো না।”
মিশ্মি জোরে শব্দ করে কেঁদে দেয়। কান্নারত অস্পষ্ট স্বরে বলে,
“ভালোবাসি নুয়াজ ভালোবাসি।”
“আমিও ভালোবাসি পাগলীটা।”

মিশ্মি চোখ বন্ধ করতেই চোখ থেকে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়লো। যখন চোখ খুললো নজর গেলো দরজার দিকে। আলভী দাঁড়িয়ে আছে। আলভীর চোখের ভাষা অস্পষ্ট কিন্তু ঠোঁটের কোণে হাসি। মিশ্মি এই চোখের ভাষা, হাসির কারণ কোনোটাই বুঝতে পারেনা কিন্তু এটা বুঝতে পেরেছে যে, নুয়াজের ভুল আলভীই ভেঙ্গেছে।

চলবে….

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *