অনাকাঙ্ক্ষিত সে

অনাকাঙ্ক্ষিত সে !! Part- 07

আলভী গাড়িতে পানির বোতল আনতে যায়। মিশ্মির মাথা ঘুরাচ্ছে। চারপাশের সবকিছু ঘুরছে। ঝাপসা লাগছে সবকিছু। মিশ্মি মাথা ঘুরে রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।
আলভী দ্রুত এসে মিশ্মির চোখেমুখে পানি দেয়। এতটুকু সময়তেই রাস্তায় মানুষ জড়ো হয়ে গিয়েছে। এটা অবশ্য অস্বাভাবিক না। মানবজাতিই বড় কৌতুহলি। ছোট বিষয়টাকেও এত বড় করে দেখে যেটা মুখে বলেও সমাপ্তি উদ্ধার করা যাবেনা। মিশ্মির জ্ঞান ফিরেছে ঠিকই কিন্তু শরীর খুব ক্লান্ত। আলভী মিশ্মির কাঁধে ধরে ধরে গাড়িতে নিয়ে বসায়। অপরপাশে আলভী বসে। সীটের উপর মাথা রেখে বসে আছে মিশ্মি। দুজনের মধ্যে দূরত্ব ভালোই। ক্লান্ত থাকায় মিশ্মি বারবার হেলে পড়ে যাচ্ছে। আলভী হাত বাড়িয়েও হাত সরিয়ে নিচ্ছে। কেন যেন একটা অজানা সংকোচ কাজ করছে। যখন দেখলো মিশ্মি নিজের ওপর কন্ট্রোল হারাচ্ছে তখন আলভী বাধ্য হয়েই মিশ্মিকে ধরে বসলো। মিশ্মির তখন আলভীর কাঁধে মাথা এলিয়ে দিলো।
বাসায় পৌঁছিয়ে কলিংবেল বাজাতেই আলভীর মা আয়েশা বেগম দরজা খুলে দেন। মিশ্মি তখনো আলভীর কাঁধে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে আছে। আর আলভী দু’হাত দিয়ে মিশ্মিকে ধরে রেখেছে। আয়েশা বেগম ভ্রু কুঁচকিয়ে বললেন,
“এই মেয়ে কে?”
“বলছি। আগে ভেতরে যেতে দাও।”
আয়েশা বেগম দরজা থেকে সরে গেলেন। আলভীর সাথে তিনিও মিশ্মিকে ভেতরে নিতে সাহায্য করলেন। মিশ্মিকে আলভীর রুমে শুইয়ে দিলেন। আলভী আয়েশা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওকে কিছু খাবার খাইয়ে দাও। তারপর গরম দুধ খাইয়ে একটা ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়ো। ওর এখন ঘুম প্রয়োজন। আর আমি এসে তোমাকে সব বলছি। হসপিটালে যেতে হবে আমার এখন।”
“কিছু তো বলে যা কে এই মেয়ে?”
“সেই মেয়ে। যাকে আমি কিসমিস বলে ডাকতাম। যে আমাকে মসজিদের সামনে বিয়ে করার কথা বলেছিল।”
আয়েশা বেগমের চোখগুলো চকচক করে উঠলো। তিনি কিছু বলার আগেই আলভী বলল,
“এখন আর কিছু জিজ্ঞেস করো না প্লিজ। আমি আসছি।”
আলভী বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো। আয়েশা বেগম ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে গরম করলেন। মিশ্মি খেতে চাইছিলো না বলে জোর করে খাইয়ে দিয়েছে। এরপর আলভীর কথামত এক গ্লাস গরম দুধ খাইয়ে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে। বালিশ ঠিক করতে করতে আয়েশা বেগম বলেন,
“এখন চুপ করে ঘুমাও তো। তোমার ঘুম ভাঙ্গলে সব শুনবো।”
নতুন জায়গা, নতুন মানুষ। কাউকেই চিনেনা। কিচ্ছু চিনেনা। শুধু জানে এটা আলভীর মা। মিশ্মি কথা বলল না। ঘুমের ওষুধ কাজ করতে লাগলো। মিশ্মির চোখের পাতায় ঘুম জড়িয়ে আসে।
.
নুয়াজ ফোনের ওপর ফোন দিয়ে যাচ্ছে মিশ্মিকে। কিন্তু প্রতিবারই ফোন সুইচড অফ। নুয়াজের মেজাজ চরমে পৌঁছে যায়। রাগে গজগজ করতে করতে নিজেই বলে,
“মেয়েটা এত্ত ইররেসপন্সিবল কেন! ফোন বন্ধ রাখে কোন সাহসে।”
গাড়ি নিয়ে সোজা মিশ্মিদের বাসায় চলে যায়। কিন্তু সেখানে গিয়েও হতাশ হয় নুয়াজ। বাড়ির গেটে তালা লাগানো। আশেপাশে কারো থেকে জিজ্ঞেস করেই কোনো সন্ধান মিললো না। তখনই আবার হাসপাতালে গেলো। হয়তো বাবার কাছে আছে। কিন্তু সেখানেও মিশ্মিকে পেলো না। নুয়াজের রাগ ক্রমে ক্রমে বেড়েই যাচ্ছে। এখন মিশ্মিকে কাছে পেলে শিওর চিবিয়ে খেতো।
.
দুপুরের দিকে আলভী বাড়িতে আসে। আয়েশা বেগম তখন রান্না করছিলেন। আলভীর রুমের দরজা চাপানো ছিল। একবার রুমের দিকে এগিয়েও আবার পিছিয়ে যায়। কারণ রুমে এখন মিশ্মি আছে। কিভাবে না কিভাবে আছে তার তো কোনো ঠিক নেই। এভাবে হুট করে রুমে যাওয়া ঠিক হবেনা। তাই আলভী রান্নাঘরে মায়ের কাছে যায়। আলভীকে দেখে আয়েশা বেগম বলেন,
“কখন আসলি?”
“এইতো এখনই। খাইয়েছিলে ওকে?”
“হুম। ওকে কোথায় পেলি তুই?”
“হাসপাতালের সামনে। রুমে গিয়ে দেখো তো কি করছে।”
আয়েশা বেগম চুলার আঁচ কমিয়ে আলভীর রুমের দিকে যায়। পেছন পেছন আলভীও যায়। আয়েশা বেগম আগে রুমে ঢুকেন।
“রুম তো ফাঁকা আলভী।”
আলভী এবার রুমে ঢুকে। ব্যালকোনিতে মিশ্মির উপস্থিত টের পায় আলভী।
“মা তুমি রান্না শেষ করে আসো। মিশ্মি ব্যালকোনিতে আছে।”
“আচ্ছা।”
আয়েশা বেগম চলে যেতেই আলভী ব্যালকোনিতে যায়। মিশ্মি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দার রেলিং ধরে। কি থেকে কি হয়ে গেল মিশ্মি এখনো বুঝে উঠতে পারছেনা। আলভী এসে ডাক দেয়।
“কিসমিস।”
মিশ্মি পিছনে তাকিয়ে মৃদু হেসে আবার আকাশের দিকে তাকায়।
“তোমার কি মন খারাপ?”
“উঁহু।”
“কি হয়েছিল বলবে? প্রথমদিন থেকেই দেখছি তোমার পরিবারের লোকজন তোমায় দেখতে পারেনা। কেন?”
মিশ্মি কিছু বলেনা। চুপ করে থাকে।
“প্লিজ মিশ্মি চুপ করে থেকো না।”
আয়েশা বেগম ততক্ষণে রান্না শেষ করে আলভীর রুমে আসে। মিশ্মির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“বলো না মা কি হয়েছে?”
মিশ্মি এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে দেয়। কাঁদতে কাঁদতেই ঘটে যাওয়া সব কথা বলে ওদের। সব শুনে আলভী ও আয়েশা বেগম স্তব্ধ হয়ে যায়। আলভীর চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে। আয়েশা বেগম রাগে গর্জে উঠে বলে,
“এত খারাপ মানুষ কি করে হয়? আল্লাহ্-এর গজব পড়বে ঐ রাক্ষসীর ওপর।”
মিশ্মি তখনো কাঁদছে। আয়েশা বেগম মিশ্মিকে শান্ত করে বলে,
“তুমি কেঁদো না মা। আমি আছি এখন তোমার পাশে।”
আলভীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
“আমি টেবিলে খাবার বাড়ছি তুই ওকে নিয়ে আয়।”
আলভী ছোট করে বলে,
“হুম।”
আয়েশা বেগম চলে যাওয়ার পর আলভী ফ্রেশ হতে যায়। মিশ্মির কেন জানি খুব খারাপ লাগছে। কাউকে দেখার জন্য মনটা অস্থির হয়ে আছে। কিন্তু সেই ‘কেউ’ টা কে। বাবা? নাকি নুয়াজ!

আলভী ফ্রেশ হয়ে এসে মিশ্মিকে খাওয়ার টেবিলে নিয়ে যায়। মিশ্মির গলা দিয়ে খাবার নামছে না। মোহনার কথা খুব মনে পড়ছে। কে জানে ওরা মোহনাকে কিছু বলেছে কি না! মিশ্মি খাচ্ছে না দেখে আয়েশা বেগম বলেন,
“খাবার ভালো হয়নি?”
মিশ্মি মৃদু হেসে বলে,
“খুব ভালো হয়েছে।”
“তাহলে খাচ্ছো না কেন?”
“খাচ্ছি তো।”
“পাশেই তো তোমার খালার বাড়ি। তোমার খালাকে খবর দেবো?”
মিশ্মি উত্তর দেওয়ার আগে আলভী বলে,
“না মা। এখন ওর খোঁজ কাউকেই দেওয়া ঠিক হবেনা। এসব যদি ওর খালা জানতে পারে তাহলে ওকে তার বাসায় নিয়ে যেতে চাইবে। ওর খালার শ্বশুরবাড়ির লোকজন সেটা ভালো চোখে দেখবে না। তাই দরকার নেই এখন জানানোর।”
“এটা ঠিক বলেছিস আলভী।”
খাওয়ার ছলে বিভিন্ন আড্ডা দিলো ওরা। কথা যা বলার আলভী আর আয়েশা বেগমই বলেছে। মিশ্মি শুধু চুপচাপ শুনেছে।

মিশ্মিকে স্বাভাবিক করার জন্য আলভী দুষ্টুমি করে বলল,
“এই মিশ্মি কিসমিস খাবে? দিবো দুইটা? রান্নাঘরে আছে বোধ হয়।”
“না।”
“তুমি বড় হলে কেন বলো তো? ছোট থাকতেই কত ভালো ছিলে। শুধু শুধু বড় হয়েছো। দুষ্টুমি করা কি ভুলে গেছো?”
“আমার ভালো লাগছেনা।”
“রাজা-রাণীর গল্প শুনবে?”
“না।”
“তাহলে ভূতের?”
“না। আপনার বউয়ের গল্প শুনবো।”
“আমি তো বিয়েই করিনি।”
“তাহলে যে বলেছিলেন আপনার বউ আছে।”
“দুষ্টুমি করে বলেছিলাম। এরপর তো তুমি আর সামনেই আসলেনা।”
কিছুক্ষণ থেমে আলভী আবার বললো,
“তবে একজন ছিল যে আমায় অনেক ভালোবাসতো। আমার খালাতো বোন ছিল নিপা। ব্রেন ক্যান্সারে মারা যায়।”
“ওহ।”
“বাদ দাও ওরা কথা। তুমি কাউকে ভালোবাসো না?”
“জানিনা।”
“তার মানে মনে মনে কেউ আছে তাই না?”
মিশ্মি কিছু বললো না। আলভী বললো,
“শোনো তোমায় কিছু কথা বলি। তার আগে বলো তুমি রুটি বানাতে পারো?”
“হুম।”
“ঐ আটা যখন ছানাও তখন নরম হয় তাই না?”
“হুম।”
“আচ্ছা। আটা যদি শক্ত শক্ত থাকে তাহলে কি রুটি বানাতে সুবিধা হয় নাকি নরম থাকলে?”
“নরম থাকলে।”
“ওকে। একপাশে কাঁদামাটি আর অন্যপাশে শক্ত মাটি। এখন তোমাকে বলা হলো উঁচু কোনো জায়গা থেকে লাফ দিতে। তাহলে তুমি কোথায় লাফ দিবে? কাঁদামাটিতে নাকি শক্তমাটিতে?”
“অবশ্যই কাঁদামাটিতে।”
“কেন?”
“কারণ শক্ত মাটিতে পড়লে আমি যতটা ব্যথা পাবো, কাঁদা মাটিতে পড়লে ততটা পাবোনা।”
“ইক্সেক্টলি। আমরা মানুষগুলো স্বভাবসুলভই এমন। নরম আটা বা কাঁদামাটির মত কাউকে পেলে তাকে দুমড়ে মুঁচরে হাতের মুঠোয় রাখি। কারণ ঐযে নরম। আর শক্ত জিনিস থেকে দূরে থাকি। কারণ শক্ত কিছুর ওপর বল প্রয়োগ করা মুশকিল। এই কথাগুলো আমি তোমাকে এজন্যই বললাম, কারণ তুমিও ঐ নরম আটা বা কাঁদামাটির মত। যে কারণে তোমার পরিবারের লোকজন তোমার ওপর এত অত্যাচার করতে পারে। কিন্তু তুমি যদি শক্ত হও, অত্যাচার সহ্য না করে প্রতিবাদ করো তাহলে দেখবে তারা তোমার সামনে এসে দাঁড়াতেও দশবার ভাববে। তুমি কি বাহিরের জগৎ দেখো না মিশ্মি? এই পৃথিবীটা ভীতুদের জন্য নয়। বাঁচতে হলে লড়াই করতে হবে। তুমি যদি এভাবে নিজের মধ্যে ভয়ে গুমড়ে থাকো তাহলে একদিন মুক্তির জন্য আত্মহত্যার পথকে বেছে নিবে। কিন্তু আত্মহত্যা কি কখনো কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে? কখনোই পারেনা। বরং পৃথিবীর সাথে সাথে হারিয়ে ফেলে জান্নাতকেও। পৃথিবীতে যে শাস্তি ভোগ করছো তার চেয়েও হাজার হাজার গুণ বেশি শাস্তি পরকালে ভোগ করতে হবে। তাই সময় থাকতে ঘুরে দাঁড়াও মিশ্মি।”
খুব মনোযোগ সহকারে আলভীর প্রতিটা কথা শুনলো মিশ্মি। আলভীর মধ্যে নুয়াজকে খুঁজে পেলো। সেদিন নুয়াজও ঠিক একইভাবে বুঝিয়েছিল। নুয়াজের কথা এত কেন ভাবছে মিশ্মি? তবে কি ভালোবাসার অধ্যায়ে নুয়াজের নাম লিখে ফেলেছে মিশ্মি?
.
তিনদিন পার হয়ে গিয়েছে বাবাকে দেখেনা মিশ্মি। সেই সাথে নুয়াজকেও। বারবার বুকের বাঁ পাশটায় ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। কাউকে না দেখার কষ্টটা খুব। কাউকে ভালোবাসার অনুভূতি বুঝি দূরে থাকলেই বুঝা যায়। সেদিনের পর থেকে নুয়াজের প্রতি ভালোলাগাটা এখন যে ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে এটা বুঝতে বাকি নেই আর মিশ্মির। মিশ্মি জানে নুয়াজের স্বভাব কেমন। নুয়াজ হয়তো মিশ্মিকে ইউজ করেনি ঠিকই কিন্তু অন্যান্য মেয়েদের সাথে ফিজিক্যালের কথাটা অজানা নয় মিশ্মির। তবে নুয়াজকে এই পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। জানাতে হবে মিশ্মির ভালোবাসার কথা।
“আসতে পারি?”
আলভীর ডাকে হুশে আসে মিশ্মি। হেসে বলে,
“আসেন।”
“কিছু ভাবছো নাকি?”
“তেমন কিছুনা।”
“আচ্ছা তাহলে কি ভাবছো শুনি?”
“কাউকে ভালোবাসার অনুভূতিটা কেমন?”
“হঠাৎ এই প্রশ্ন? তুমি কি কাউকে ভালোবাসো?”
“ভালোবেসে ফেলেছি।”
“ওয়াও। কে সে?”
“নুয়াজ!”
আলভী যেন একটা ধাক্কা খেলো। কেমন যেন খারাপ লাগা শুরু করলো। এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
“নুয়াজ কে?”
“যাকে আমি ভালোবাসি। নুয়াজই আমার বাবার অপারেশনের টাকা দিয়েছিল।”
“ওহ।”
“কিন্তু আমি নুয়াজের থেকে হারিয়ে গিয়েছি। ওর বাড়ির ঠিকানাও আমি জানিনা। ফোন নাম্বার আমার ফোনে সেভ করা ছিল।”
“ওর কোনো বন্ধুকে চিনো না?”
“না।”
“তাহলে কি করে খুঁজবে?”
“উমম! আমার এক বান্ধবীর সাথে নুয়াজের বন্ধুর রিলেশন আছে। তার থেকেই তো নিতে পারি।”
“তাহলে ফোন করো।”
“শিট! ওর বাড়িও তো আমি চিনিনা।নাম্বারও নেই।”
“সব পথই তো দেখছি বন্ধ। এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে তোমাদের দেখা হতো? বা যেখানে গেলে ওর খবর পাবে?”
“আছে তো। ওদের বাংলোবাড়ি। সেখানে গেলে নিশ্চয়ই ওর খবর পাবো।”
“বেশ তো! তাহলে যাও তাড়াতাড়ি রেডি হও। আমি নিয়ে যাবো তোমাকে।”
“সত্যিই নিয়ে যাবেন?”
“হ্যাঁ।”
“আসার সময় বাবাকে দেখতে চাই। হাসপাতালে নিয়ে যাবেন?”
আলভী হেসে বলে,
“আচ্ছা পাগলী।”
মিশ্মি খুশিতে গদগদ হয়ে আলভীর গাল টেনে দিলো।

গাড়িতে পাশাপাশি বসে আছে আলভী আর মিশ্মি। আলভী ড্রাইভ করছে আর মিশ্মি জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে। মিশ্মির খুশিগুলো আজ পেটের মধ্যে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। আলভী বললো,
“তুমি বাংলো বাড়ির যেই এড্রেস দিলে ঐখানে যাওয়ার আগেই হাসপাতাল পড়ে। আগে তোমার বাবাকে দেখে যাবে নাকি বাংলোতে যাবে?”
“তাহলে বরং বাবাকেই দেখে যাই। অনেকদিন হয়েছে খোঁজখবর নেওয়া হয়না।”
“ঠিক আছে।”
এক ঘন্টার মধ্যেই ওরা হাসপাতালে পৌঁছে যায়। আলভী গাড়ি পার্কিং করতে যায় আর মিশ্মি হাসপাতালে প্রবেশ করে। বাবার কেবিনে গিয়েই মিশ্মি থমকে যায়। এখানে ওর সৎ মা, সৎ খালা, মামা আর মোহনাও রয়েছে। মিশ্মিকে দেখে বড়খালা বলে,
“যাক অবেশেষে তাহলে আসলি। তোর জন্য কবে থেকে অপেক্ষা করছি। আয় আয় বাহিরে আয়।”
তিনি ভালোমতই মিশ্মিকে কেবিন থেকে বের করলো। এরপর টানতে টানতে হাসপাতাল থেকে বাইরে নিয়ে আসলো। পেছন পেছন ছোট খালা আর মামাও আসলো। মিশ্মি বললো,
“আমার হাত ছাড়।”
“এখনো আমাকে তুই তোকারি করছিস?”
“আমি হাত ছাড়তে বলেছি।”
“ছাড়বো তো। বাসায় নিয়ে।”
“আল্লাহ্ তোদের লজ্জা দেয়নি তাইনা? সেদিনের থাপ্পড় কি কম হয়ে গেছিলো?”
এবার মামা এসে মিশ্মির হাত ধরে বলে,
“সেদিন বেঁচে গেছিস বলে আজও বাঁচতে পারবি ভেবেছিস?”
মিশ্মি মুচকি হাসলো। এরপর জোরে জোরে চেঁচিয়ে বললো,
“আমার হাত ছাড় জানোয়ার। রাস্তাঘাটে মেয়েদের সম্মান নিয়ে টানাটানি করছিস?”
মিশ্মির চেঁচামেচিতে মানুষজন জড়ো হয়ে গেছে। কয়েকজন এগিয়ে এসে বলছে,
“কি হয়েছে আপু?”
“দেখেন না ভাই রাস্তাঘাটে কিভাবে সম্মানহানির চেষ্টা করছে।”
পাশ থেকে আরেকজন বললো,
“হ্যাঁ ভাই আমিও চায়ের দোকান থেকে খেয়াল করেছি। লোকগুলো মেয়েটার সাথে জবরদস্তি করছে।”
মামা মিশ্মিকে ধমক দিয়ে বললেন,
“এসব কি বলছিস তুই?”
মিশ্মি সাথে সাথে মামার গালে থাপ্পড় লাগিয়ে দেয়। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,
“একটা মেয়ের সম্মান নিয়ে পাবলিক প্লেসে এভাবে টানাটানি করছে আর আপনারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন?”

ছোটখালা দাঁতমুখ খিঁচে মিশ্মির কাছে আসতে আসতেই পাবলিকরা মামাকে গণপিটুনি দিতে শুরু করে। পাশে থাকা কয়েকজন মহিলা ছোটখালার গালে বেশ কয়েকটা থাপ্পড় দিতে থাকে। বড়খালা কাউকেই থামাতে পারছেনা। উল্টো ধাক্কা খেয়ে পড়ছে। মিশ্মি বড়খালাকে তুলে এলোপাথাড়ি থাপ্পড় দেয়। মাটিতে একটা ভাঙ্গা কাঠের টুকরো পায়। সেটা দিয়েই ইচ্ছামত পিটাতে থাকে। যত রাগ জেদ ছিল সব মিটিয়ে নিচ্ছে আজ। যতক্ষণ মিশ্মির শরীরে কুলালো ততক্ষণ বড়খালাকে পিটালো। শেষে থেমে বললো,
“জনসম্মুখে মেয়ের বয়সী মেয়ের হাতে মার খেয়ে যদি লজ্জা হয়ে থাকে তাহলে অন্যায় করার আগে দশবার ভাববি।”

কাঠের টুকরোটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় মিশ্মি। আলভী এতক্ষণ গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিল। মিশ্মির এত পরিবর্তন দেখে আলভীর চোখ ধাঁধিয়ে গেছে। দূর থেকে মোহনা এসে মিশ্মিকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আপুরে তুই যা করলি আজ! উফ আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। মাকেও দু’ঘা দেওয়া উচিত ছিল।”
“চুপ। মা তো মা’ই। মা ওদের প্ররোচনায় পড়ে এসব করেছে। লজ্জা যদি হয় তাহলে এসব দেখেই হবে।”
মোহনাকে নিয়ে আলভীর দিকে এগিয়ে যায় মিশ্মি। আলভী হাত তালি দিতে দিতে বলে,
“আমার প্রতিবাদী কিসমিস।”

চলবে…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *