পাথরের বুকে ফুল ! সিজেন 2 !! Part- 29
—-“ আপনার বাবা মা কিভাবে খুন হয়েছে তা কি আপনি জানেন??”ওয়াসেনাতের ভারী গলা।
অরিত্রান চোখ পাকিয়ে তাকালো।বললো,
—-“ সেটা জানা তোমার বিষয় না।তোমার জানা প্রয়োজন আমাকে নিয়ে।আর আমার সম্পর্কে জানলেই হবে।”
ওয়াসেনাত একুট ভীতু।লোকটার দয়ামায়া কেমন ধাঁচের এটা তার জানা হয়েগেছে।কিন্তু অদ্ভুত ভাবে তার মনে হচ্ছে উনি তার রিছুই করবে না।মনে হচ্ছে সত্যি ভালোবাসা আছে।কিন্তু মনে একটাই প্রশ্ন এতো ভয়ংকর ব্যক্তির মনে ভালোবাসা তাও তার জন্য?এটা কেমেন যেনো ইম্পসিবল টাইপের।ওয়াসেনাত কৌতুহলি হয়ে বললো,
—-“ আমার বাবা কিভাবে চিনে আপনার বাবা মাকে??”
অরিত্রান দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
—-“ তোমার বাবা না তোমার মা চিনতো।আর সব ভিডিও তিনি করেছে।কিন্তু তার সম্পর্কে আমার খোঁজ খবর তেমন নেওয়া হয়নি।শুনেছি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।তারপর …”
ওয়াসেনাত কান্নায় আটকে আসা গলায় বললো,
—-“ আমার মা বেঁচে নেই।”
অরিত্রান চমকে তাকালো।সে এতোটা ভাবেনি।তেমন খোঁজ নেয় নি কারন সে জানতে পেরেছিলো ভিডিও তৌফিকের কাছে।তাই তাকেই প্রয়োজন।ওয়াসেনাতের কাছে ফোনটা এতো দামি কেনো ছিলো এখন বুঝতে পেরেছে সে।
—-“ আম্মু কিভাবে পরিচিত ছিলো বলবেন প্লিজজ?আর আমার বাবাকে কিছু করবেন না প্লিজ।”
অরিত্রান হাসলো।বললো,
—-“ তা আর করবো না।”
ওয়াসেনাত খুশি হয়েছে।সে হাসছে।অরিত্রান আড়চোখে তাকিয়ে সে হাসি দেখছে।অরিত্রান খুব কৌশলে বললো,
—-“ তোমার মা কি অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে??”
—-“ জানি না।কিন্তু বাবাকে বলতে শুনেছি তাকে না কি খুন করা হয়েছে।আমি কিছুই জানিনা।”
ওয়াসেনাতের গলা ভার।চোখে পানি টলটল করছে।অরিত্রান দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সামনে তাকালো।তারপর ঠান্ডা শীতল কন্ঠে বললো,
—-“ বাবা মায়ের লাভ ম্যারেজ ছিলো।লাভ ম্যারেজের বড় সমস্যা হচ্ছে পরিবার।পরিবার মেনে নিতে চায় না।তাদেরও মেনে নেয় নি।আমার দাদার বিশাল সম্পত্তি।তবে অহংকারী খুব।সে বাবাকে একদম মেনে নেয়নি।অরহাম খান আমার দাদা।অমিতা মায়ের নাম।আর বাবা আশিক খান।বাবা খুবই আত্ননির্ভরশীল ছিলো।নিজের বাবার কি আছে এতে তার তেমন ইন্টারেস্ট ছিলো না।মায়ের সাথে তার পথ চলা খুবই কঠিন ছিলো।টাকা নেই।খাবার নেই।সম্পদ নেই।আছে ভালোবাসা।”
অরিত্রান থামলো।তারপর হাসতে শুরু করলো।ওয়াসেনাত ভ্রু কুঁচকে বললো,
—-“ থামলেন কেনো??ওয়াও আপনার বাবা সেই রোমিও ছিলো।একদম পরিবারের বিরোধীতা করে বিয়ে করে নিলো।কি কিউট!!”
অরিত্রান আবার হাসলো।তবে একটু শব্দ করে।ওয়াসেনাত বিরক্ত হয়ে বললো,
—-“ এমন বাজে ভাবে হাসছেন কেনো??একটা কিউট লাভ স্টোরি শুনাচ্ছেন তো সুন্দর করে হাসেন!তা না!!”
—-“ আমার বাবা রোমিও না।তারা সব বাঁধা পেরিয়ে ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে ছিলো।রোমিও তো গরু।প্রেম করে ,ভালোবেসে মৃত্যুকে বেছে নিয়েছে।তাই বাবাকে রোমিও বলাটা আমার পছন্দ হচ্ছে না।”
ওয়াসেনাত হেসে বললো,
—-“ আচ্ছা বললাম না।এবার বলেন হাসছেন কেনো??”
অরিত্রান গম্ভীর গলায় বললো,
—-“ আমি সব সময় ভাবতাম বাবা ভালবেসেছে তো কি হয়েছে।এতো অর্থ সম্পদ,টাকা রেখে তিনি কেনো শুধু ভালবাসার পিছনে ঘুরে কষ্টের জীবন বেছে নিয়েছে।কেনো বিশাল অট্টালিকা ছেড়ে দু’কামড়ার ড্রেনের পাশে একটা ছোট ঘরে থেকেছে।কেনো দামি মার্সেডিজ বেঞ্চ মেব্যাক গাড়িতে না ঘুরে ভালোবাসার মত অর্থ বিহিন জিনিসের চক্করে পরে রাস্তায় রাস্তায় ঘামে ভিজে জুতো ক্ষয় করে চাকরি করেছে?কেনো টাকার বিছানায় না ঘুমিয়ে দশটাকা বাঁচাতে রিক্সায় উঠেনি?কেনো ভালোবাসার পিছনে ঘুরে জীবনটা কষ্টের করেছে??এতো কেনোর ,কেনো জন্মদিয়েছে??সব উত্তর হঠাৎ করেই মাথায় এসেছে।উত্তর একটাই এই অর্থ বিহিন ভালোবাসা মনেই ভালো থাকা।আমার দাদাজানকে আমি পছন্দ করিনা।কিন্তু তার একটা উক্তি আমার পছন্দ হয়েছে, —” হৃদয়ে যখন ভালোবাসা উপচে উপচে পড়ে।বিবেক তখন লোপ পায়।সবদিকে ভালোবাসা আর ভালোবাসাই চোখে পরে।বাকি সব বৃথা মনে হয়।”
বাবার অবস্থাও হয়তো তেমন হয়েছে।সে ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে থাকতে চেয়েছে।এবং সফল ও হয়েছে।তাদের একমাত্র ছেলের জন্মের পরে তিনি নিজের অফিসের কলিগের সাথে তার উপরে প্রিয় বন্ধুর সাথে ব্যবসা শুরু করে।সফল হয়।সেও টাকার মালিক হতে শুরু করে।গাড়ি করে বাড়ি কিনে।দাদাজান বলে আমি নাকি বাবার কার্বনকপি।হয় তো।তাই তো বাবার মত বিজনেস ম্যান হয়েছি।মায়ের বাড়ি তুর্কি!”
ওয়াসেনাত চমকে বললো,
—-“ আপনার মা তুর্কি??”
—-“ হুম!!”
ওয়াসেনাত উৎসাহের সাথে বললো,
—-“ তাহলে তো আপনি তুরস্কের ও নাগরিক।ওয়াও।আমার খুব পছন্দের দেশ তুরস্ক।”
অরিত্রান ভ্রু কুঁচকে বললো,
—-“ কেনো??ওই দেশের ছেলেরা সুন্দর তাই??”
ওয়াসেনাত মুখ ভেঙ্গচি দিয়ে বললো,
—-“ মোটেও না।তবে ওদের ইতিহাস,ঐতিহ্য সব সুন্দর।তাই ভালো লাগে।সুযোগ পেলে যাব ইনশাআল্লাহ্।এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো??আরে আপনি সেদেশের নাগরিক হয়েছেন তো কি হয়েছে।আমি কি আপনার পরিচয় দিয়ে যাবো না কি??এতো অহংকারীর মত তাকাচ্ছেন কেনো??”
অরিত্রান শুধু তাকিয়ে আছে কিছু বলছে না।মেয়েটা বড্ড বেশি বোকা।ওয়াসেনাতের তাড়া।সে বললো,
—-“ বলেন!আর আপনার বাবা মায়ের প্রেম কিভাবে হয়েছে??”
ওয়াসেনাতের উৎসুক চোখ দেখে অরিত্রান বিরক্ত হলো।এটা কেমন প্রশ্ন বাবা মায়ের প্রেম কাহিনী ছেলের কাছে শুনতে চাচ্ছে।আশ্চর্য!!অরিত্রান বললো,
—-“ আমি কিভাবে যানবো এটা?তখন কি আমার জন্ম হয়েছে না কি??তবে শুনেছি বাবা তুর্কি ঘুরতে যাওয়ার পরে তাদের দেখা হয়েছে।তারপরেই প্রেম মনে হয়।”
—-“ মনে হয় কেমন কথা??হয় হ্যা নয় না।”
ওয়াসেনাতের রাগি চোখ।অরিত্রান হেসে বললো,
—-“ ওকে হ্যা।”
—-“ তারপর??”
—-“ মায়ের পরিবার এটা মেনে নিতে চায়নি।তারা বাংলাদেশের ছেলের সাথে বিয়ে দিবে না।তাই মা পালিয়ে চলে এসেছে বাবার কাছে।বাবাও বিয়ে করে নিয়েছে তাকে।বাবার বাবারও মানলো না।তারা নিজেদের মত সংসার গুছিঁয়ে নিয়েছিলো।মজার কথা হচ্ছে আমার ,অরিত্রানের দাদা এবং নানা কোটিপতি ছিলো তবুও তাকে রাস্তার পাশে ফুটপাতে ঘুমাতে হয়েছে।খাবারের ভিক্ষা খুঁজতে হয়েছে।রাস্তায় রাস্তায় ছিঁড়া জামা পরে ঘুরতে হয়েছে।”
ওয়াসেনাত আতঁকে উঠে।তার চোখ ছানা বড় হয়ে আছে।এতো কঠিন পাথরের মতো মানুষটার জীবনে এতো কষ্ট??যার এখন কোটিকোটি টাকা আছে তার জীবন এমন কেনো ছিলো??”ওয়াসেনাত আতঙ্কিত হয়ে বললো,
—-“ গুঁছিয়ে বলুন প্লিজজ??”
অরিত্রানের মেজাজ তিক্ত হয়ে উঠেছে সে বললো,
—-“ আর বলবো না।”
ওয়াসেনাত চেঁচিয়ে বললো,
—-“ হোয়াট??এটা কেমন কথা??”
—-“ কানে শুনতে পাওনা ,না কি??”
ওয়াসেনাত রেগে গেলো।অরিত্রানের পাঞ্জাবীর কলার খপ করে ধরে বসলো।অরিত্রান আবাক।ওয়াসেনাতের মেজাজ গরম।সে চেচিঁয়ে বললো,
—-“ বলবেন না মানে কি??পাগল আপনি আমাকেও সাথে করতে চান??বলেন??”
অরিত্রান নিজের কলার ছাড়ালো না।বললো,
—-“ কুল!মজা করছিলাম।বলবো।তুমি বসে পরো।”
ওয়াসেনাতের সব রাগ ফুঁস হয়ে উড়ে গেছে।সে বসে পরে পাশে।অরিত্রান পকেট থেকে সিগারেট বের করে।সে যখন খুব হতাশ থাকে তখনই সিগারেট খায়।তা না হলে সে তেমন সিগারেট খোর না।ওয়াসেনাত কপাল কুঁচকায়।মাথা একটু কাত করে সে দেখছে অরিত্রান কি করছে।অরিত্রান ঠোঁটের মাঝে সিগারেট রাখে।লাইটার দিয়ে জ্বালিয়েও নেয়।একটা টান দিয়ে ফুঁ দিতেই ধোঁয়া গুলো গোল হয়ে রিং এর মতো হয়ে গেছে।ওয়াসেনাত যেন এতেই মুগ্ধ সে চোখ বড় করে দু’হাত মুঠো বন্ধি করে বললো,
—-“ ও মাই আল্লাহ্ আপনি এটা করতে পারেন??
অরিত্রান সিগারেট ফুঁকাতে ফুঁকাতে বললো,
—-“ এটা এমন কি হলো যে এতো চেঁচাচ্ছ??”
ওয়াসেনাত হতাশ গলায় বললো,
—-“ অনেক কিছু।আপনি বুঝবেন না।আপনি বরং আমাকে আপনার সিগারেট টা একটু দেন।”
ওয়াসেনাতের চোখ মুখ চকচক করছে।অরিত্রান ভিমড়ি খেল।বিস্ময়ে তার চোখ গোলগোল হয়েগেছে।ওয়াসেনাত তাড়া দিয়ে বললো,
—-“ আরে দেন না পরে দেখা যাবে আপনার খাওয়া শেষ।”
অরিত্রান খকঁ খকঁ করে কেশে উঠে।তার কাশি দেখে ওয়াসেনাত উত্তেজিত হয়ে পানির বোতল এগিয়ে গিলো।গার্ডসরা কাশির বিকট শব্দে দৌড়ে এগিয়ে আসলো।কারো হাতে পানির বোতল তো কারো হাতে জুস।তারা মাথা নিচু করে আছে।ওয়াসেনাতের দিকে তাকানো তাদের নিষেধ।অরিত্রান খেপে গেলো।কাশতে কাশতে সে বললো,
—-“ ডাফার সব!!তোমাদের কে আসতে বলেছে??গেট লস্ট।”
সবাই আবার স্যরি বলে কেটে পড়েছে।ওয়াসেনাত অরিত্রানের ধমকে ভয় পেয়েছে।সে একটু সরে বসেছে।অরিত্রান চোখ লাল করে বললো,
—-“ তুমি সিগারেট খাও??”
ওয়াসেনাত ভয়ে ভয়ে বললো,
—-“ না।”
—-“ তাহলে আমার থেকে চাইলে কেনো??”
ওয়াসেনাত ভীতু হয়ে চুপ করে আছে।অরিত্রান বুঝতে পেরে কোমল গলায় বললো,
—-“ এই ধরনের মজা আমার পছন্দ না।তাই আর করবে না কখনো।”
ওয়াসেনাত ধপ করে জ্বলে উঠে বললো,
—-“ কে বললো মজা করলাম??আমি সত্যি খাবো।অনেক দিনের স্বপ্ন আমি সিগারেট খাবো প্লিজজ দেন না!!”
অরিত্রান শ্বাসরূদ্ধকর কন্ঠে বললো,
—-“ হোয়াট?এটাও কারো স্বপ্ন হয়?”
ওয়াসেনাত দু’হাত এক করে শান্তভঙ্গিতে বললো,
—-“ জী হ্যা হয়।”
—-“ পরীজা এসব হেয়ালি টাইপের কথা বার্তা আমার মোটেও পছন্দ না।”
কথাটা বলেই সিগারেট ছুঁড়ে দিতে হাত উচুঁ করে।ওয়াসেনাত দ্রুত হাত এগিয়ে খপ করে সিগারেট হাতে নেয়।অরিত্রান চোখ গরম করে তাকায়।মৃদু চিৎকার করে সে বললো,
—-“ পরীজা ভালো হবে না কিন্তু!ওটা ফেলে দেও!”
ওয়াসেনাত ফেলা তো দূর সে নিজের ঠোঁটের মাঝে সিগারেট বসিয়ে ফুঁ ফুঁ করছে।অরিত্রান এবার শান্ত ভঙিতে বসে হাসছে।ওয়াসেনাত সিগারেট টানতেই পারছেনা।কেমন যেন বাজে গন্ধ।সে বললো,
—-“ ছি কেমন একটা গন্ধ!!
অরিত্রান চোখ সরু করে বললো,
—-“ সবাইকে দিয়ে সব হয় না।”
ওয়াসেনাত অনেক চেষ্টা করেও টানতে পারলো না।কারন সে শুধু ফুঁ ফুঁ করছে টানছে না।আসলে সে জানেই না সিগারেট কিভাবে টানে।ব্যর্থ হয়ে সিগারেট ছুঁড়ে ঠোঁট উল্টে সে বললো,
—-“ আমার মনে হয় সিগারেট খারাপ হয়েগেছে।হতে পারে ধোঁয়া শেষ।আপনি আমাকে আর একটা দিন তো।”
অরিত্রান পুরো পেকেট সামনে পানিতে ফেলে গিয়ে বললো,
—-“ আজ থেকে আমি সিগারেট খাবো না।আর তুমি এটা টেস্টের বা স্বপ্নের চিন্তু মাথায় ও আনবে না।গট ইট??”
ওয়াসেনাত মুখ গোমড়া করে বললো,
—-“ দেখা যাক।এবার আপনি কাহিনী বলা শুরু করুন।প্লিজজজজজজজজজ!!”
অরিত্রানের একদম বলতে ইচ্ছে করছে না।সে ঝুম মেরে বসে আছে।পৃথিবীটা বিচিত্র।এতে বাস করা মানুষ আরো বিচিত্র।এই মানুষ গুলোর মাঝেও থাকে বিচিত্র সব অনুভুতি।থাকে কষ্টে ঘেরা অতিত।তা জানাতে চায় না অনেকেই।অরিত্রান তাদের মাঝে একজন।কিছু কথা সে নিজের মাঝে রাখতে চায়।তার মতো অর্থবান মানুষের জীবনেও কষ্ট আছে??ওয়াসেনাতের বড্ড অদ্ভুত লাগছে ব্যাপারটা।
_______________________
আজ তিনদিন পরে সেন্স ফিরেছে মাদৌলির।মাদৌলির বাবা প্রচন্ড অবাক।তিনি এখনো জানে না তার আদরের মেয়ের এমন ভাঙাচুরা অবস্থা কে করেছে।কিন্তু তিনি হাইপার হয়ে আছে।যে এই কাজ করেছে তাকে তিনি ছাড়বে না।ইহানের চাচার মেয়ে মাদৌলি।চাচাত বোনের এমন করুন অবস্থা কে করেছে তাকে খুঁজতে সে লোক লাগিয়ে দিয়েছে।সামনের বিছানায় মাদৌলি বসে আছে।সে এখনো কিছুই বলেনি।চুপ মেরে বসে আছে সে।ইহান রাগে ফুসছে।তার পাশে বসে আছে তার চাচা মাদৌলির বাবা।আর অপর পাশে দাড়িঁয়ে আছে শৈকত।এদের সবার মাঝে শুধু দুজনেই যানে এই কাজ কার।এক শৈকত দুই মাদৌলি।শৈকত এটা যানেনা কেনো মারা হয়েছে মেয়েটাকে।মাদৌলির দু’হাত ভাঙা।মাথা ফাঁটা।সব ব্যান্ডেজ করা।ইহান চোয়াল শক্ত করে বললো,
—-“ এই ফুলোনি!মুখটা এভাবে ফুলিয়ে না রেখে বলতো কিভাবে এসব হয়েছে??কে করেছে??ভাইরে বল মেরে পুঁতে দিবো এই মুহূর্তে।”
মাদৌলি নিশ্চুপ।তার বাবা এবার বললো,
—-“ বলনা মামুনি কিভাবে এইসব হয়েছে??”
মাদৌলি চোখ লাল করে বাবার দিকে তাকায়।তারপর উঠে হাতের কনুই দিয়ে ঠেলে ঠেলে সব ভাঙ্গচুর করা শুরু করে।সবাই স্তব্ধ।তাকে কেউ থামাতে চাচ্ছে না।এগিয়েও যাচ্ছে না।ডাক্তার নার্স মনে মনে খুব গালি দিচ্ছে এদের।ক্ষতি করে,কিন্তু ক্ষতিপুরোন করবে না এরা।কিছু বলতেও পারবে না।এক একজন মাফিয়া ডন।শৈকত মনে মনে দৌড়ানের চিন্তা করছে।মেয়েটা পাগল মনে হচ্ছে তার কাছে।মাদৌলি এবার চিৎকার করছে।ভাঙা হাত বাড়িয়ে সে সব ছুঁড়ে দিচ্ছে।সবাই মনে মনে ভয় পাচ্ছে।মাদৌলি হাতে ব্যথা পাওয়া শুরু করেছে।তাই ধপ করে বিছানায় বসে পরে।ডাক্তার নার্স মনে মনে খুশি হয়েছে।হাতের কারনে তেমন কিছু ভাঙতে পারেনি।এটাই অনেক তাদের জন্য।মাদৌলি চেঁচিয়ে বললো,
—-“ আমার হাত ব্যথা করছে।”
ইহান ক্ষেপা সুরে বললো,
—-“ ওই ডাক্তার চিকিৎসা কর ।”
ডাক্তার জানের ভয়ে দৌড়ে আসে।মনে মনে সে কিছু বাজে বিশ্রী গালি দিলো এদের ভাইবোনকে।ইহান টুলটেনে মাদৌলির পাশে বসে বললো,
—-“ এবার বল কে করেছে এগুলো??”
—-“ শুনে কি করবে??মাদৌলির ঠান্ডা কন্ঠ।
ইহান চেতে বললো,
—-“ কি করবো মানে কি??তুই কি তোর ভাইয়ের পাওয়ার সম্পর্কে অবগত নস??”
মাদৌলি হেসে বললো,
—-“ তার সম্পর্কে তুমি নিজেও অবগত নও।”
ইহানের আত্নসম্মানে লাগলো।সে তেজি গলায় বললো,
—-“ কি বলতে চাস আমি তুচ্ছ!!”
—-“ না তবে নামটা শুনেই তুমি কাঁপবে,কপাল ঘামে চুপচুপ হবে,হাত কাঁপবে,হাঁটু কাঁপবে।”
—-“ শেট আপ!!এমন কেউ এই দুনিয়ায় আছে না কি ইহানকে কাঁপাতে পারে??”
—-“ আছে আছে।দেখা হওয়ার আগে আমিও এমনই ভাবতাম কিন্তু দেখে যা বুঝলাম তা হলো কি জানো??”
মাদৌলি ইহানের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
—-“ সে হচ্ছে সিংহ।”
ইহান পুরা আগুন হয়ে আছে।সিংহ তার সবচেয়ে প্রিয় প্রানী।নিজেকেই সে সিংহের জায়গায় বসায় আর কাউকে সহ্য করতে পরেনা।কাউকে না।মাদৌলি হাসলো।সে চায় ইহান রাগুক।সেটাই হচ্ছে।ইহান ঝাঝাঁলো গলায় বললো,
—-“ কে সে???”
মাদৌলি শিস বাজিয়ে উঠলো।ইহান মনে মনে ভাবে তার বোন পাগল হয়ে গেলো না তো??এমন তো সে কখনো করে না।মাদৌলি হঠাৎ শিস বাজানো বন্ধ করে বললো,
—-“ সে অরিত্রান।”
ইহানের কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠে।এই নাম তার জীবনের সবচাইতে ভয়ংকর একটা নাম।সত্যি ইহান কাঁপছে।
_________________________
—-“ বাবা সফল হয়েছে।সফল বিজনেস ম্যানের তালিকায় নাম ও লিখিয়ে ছিলো।আমাদের হলো সুখি পরিবার।মাম্মাম আমি আর বাবা।ছোট একটা পরিবার।আমিও ছিলাম সব মানুষের মত স্বপ্ন বিলাসী।আমার মাও বাঙালি মায়েদের মতো স্বপ্ন দেখতো তার ছেলে ডাক্তার হবে।বাবা চাই তো বিজনেস ম্যান হবে আমার ছেলে।সে দেশ বিদেশ কাঁপাবে।ছোট অরিত্রানের অতো স্বপ্ন ছিলো না।সে তো আশ্রয় চাই তো বাবা মায়ের কোলে।আমাদের বাড়ি হলো গাড়ি হলো।অনেকে এখন বলে টাকা হলে ভালোবাসা কমে যায়।তাদের বেলায় সেটা হলো না।সুখ মুঠো ভর্তি করে ধরা দিলো।স্বপ্ন গুলো আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছিলো।কিন্তু সব স্বপ্ন চোখে দেখা হয় না।কিছু স্বপ্ন থাকে অসম্পূর্ন।আমি মায়ের স্বপ্ন পুরোন করতে পরিনি।বাবারটা পেরেছি।অরিত্রান নাম করা বিজনেস টাইকুন হয়েছে ।বহুবার পুরুষ্কার জিতেছে।১১বছরের সেই দুর্বল অরিত্রান এখন আর নেই।স্কুল থেকে এসে বাবা মায়ের মৃত দেহ দেখে সেন্সলেস হওয়া অরিত্রান এখন খুব সহজে মানুষ কাঁটে।”
অরিত্রান হাসছে।কিছুক্ষন পরে সে হাসি আরো বাড়লো।ওয়াসেনাতের গাঁ কাঁপছে।কি ভয়ংকর সে হাসি!অরিত্রান শীতল গলায় বললো,
—-“ ১১বছরের অরিত্রান সাদা পাঞ্জাবী গায়ে ঈদের দিন বন্ধুর বাসা থেকে এসে নিজের বাবা মাকে মৃত্যু যন্ত্রনায় কাতরাতে দেখেছে।আমি সেই অরিত্রান যে নিজের মায়ের ব….”
অরিত্রান আর বলতে পারলো না।গলাটা কেমন যেনো করছে।মাথাটা ঝিম ঝিম করছে।ওয়াসেনাত নিশ্চুপ।অরিত্রান থেমে থেমে বললো,
—-“ আমার মাথা ধরেছে খুব!”
ওয়াসেনাত চুপ করে আছে।কি বলবে সে জানে না।আসলে সে ভাবছে।সব মিলিয়ে দেখছে।অরিত্রান বললো,
—-“ আমি গুঁছিয়ে কথা বলতে পারিনা পরীজা।মিলিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে না??”
ওয়াসেনাত এবারও কিছু বললো না।শুধু চোখ তুলে অরিত্রানের দিকে তাকিয়ে আছে সে।অরিত্রানের চোখ লাল টকটকে হয়ে আছে।ওয়াসেনাত বিড়বিড় করে বলে,”এতো লাল!!”তারপরেই ভাবে শেষের কথাটা কি ছিলো??কি??অরিত্রানের নিঃশ্বাস দ্রুত চলে।সে বললো,
—-“ পরীজা পা গুলো উপরে তুলবে একটু??গুটিঁয়ে বসবে কিন্তু।”
ওয়াসেনাতের মনে প্রশ্ন জাগে তবুও সে করে না।পা তুলে বসে পরে।অরিত্রান থামে।ওয়াসেনাতের মুখের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলে,
—-“ ভালোবাসা হচ্ছে অর্থ বিহিন শব্দ।এই কয়েক দিনে আমি কি বুঝেছি জানো??পৃথিবীতে দৃষ্টিকর্তা ভালোবাসা তো দৃষ্টি করেছে কিন্তু এর বর্ণনা করার জন্য ভাষা দেয় নি।ভালোবাসা তো মানুষের মনে সৃষ্টি করে দেয় কিন্তু এটা বর্ণনার কলমটা নিজের কাছে রেখে দিয়েছে।তবুও আমার মতে ভালোবাসা হচ্ছে নিঃশ্বাসের মতো।নিঃশ্বাস যেমন দেখা যায় না।এটাও দেখানো যায় না যা দেখানো হয় তা হচ্ছে যত্ন।এটাকে বোকা মানুষজাতি ভালোবাসার নামে চালিয়ে দেয়।তবে আমি তা করতে চাই না।নিঃশ্বাস এবং ভালোবাসা দু’টোই অদেখা অনুভুতি।আশ্চর্যের বিষয় দু’টি ছাড়া দম বন্ধকর অনুভুতি হয়।ভালোবাসা অদ্ভুত অনুভুতি।এটি এতো গুরুত্বপূর্ন কেনো জানো??কারন এর নামে শরীরে একটা আলাদা যন্ত্র আছে।তাই তো ভালোবাসার জন্য মানুষ মরিয়া।আর সেই যন্ত্র হচ্ছে হৃৎপিন্ড।আমার মনে হয়ে দৃষ্টিকর্তা নিজেই এই ভালোবাসাকে খুব দাম দেয় বুঝলে পরীজা।তাই তো হৃৎপিন্ড দিয়েছে মানুষের মাঝে।বিচিত্র মানুষের মাঝে সবচেয়ে মিল ভালোবাসা জায়গাটায়।তবে সব মানুষের ভালোবাসা ,মানুষের মতোই ভিন্ন।কারো ভালোবাসাকে কিন্তু কারো সাথে মিলাতে পারবে না।আমি চাইলেও বাবার মতো প্রেমিক হতে পারবো না।আর অন্য কেউ চাইলেও আমার মতো প্রেমিক হতে পারবে না পরীজা।
অরিত্রান থামে।তারপর আবার বললো,
—-“ তোমার কোলে একটু মাথা রাখি??”
ওয়াসেনাত ঘোরের মাঝে আছে।তার কেনো যেনো অরিত্রানের প্রতি খুব মায়া হচ্ছে।অরিত্রানের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে ওয়াসেনাত বললো,
—-“ রাখেন।”
ওয়াসেনাত নিজের দুহাত সরিয়ে দিলো।অরিত্রান এই সুযোগ কিছুতেই হাত ছাড়া করলো না।দ্রুত ওয়াসেনাতের কোলে মাথা রেখে দু”হাতে ওয়াসেনাতের কোমড় জড়িয়ে ধরে।কোলে নাক ডুবিয়ে চোখ বন্ধ করে।ওয়াসেনাত চমকায়।সে ভাবেনি এভাবে অরিত্রান তাকে জড়িয়ে নিবে।সে তো কোলে জায়গা দিয়েছে এতো পুরো কোলজুড়ে কব্জা করে নিয়েছে।ওয়াসেনাত শিউরে উঠে।কপালে জমে ঘাম।অরিত্রানের শরীর হালকা কাপঁছে।ছোট হয়ে পা গুটিঁয়ে আছে সে।সন্ধ্যা নেমেছে।মাঝে জমেছে মেঘ আর বাতাস।বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ হচ্ছে।সেই বাতাসের সাথে কাঁপছে আশেপাশের গাছের পাতা।তাদের সাথে তাল মিলিয়ে ওয়াসেনাতের শরীর কাঁপছে।অরিত্রানের নিঃশ্বাস বারি খাচ্ছে ওয়াসেনাতের জামা ভেদ করে পেটে।উষ্ণ নিঃশ্বাসের তাপে ওয়াসেনাতের হাত পা থরথর করে কাঁপছে।গলা শুকিয়ে আসছে।চোখ বড় বড় করে সে তাকিয়ে আছে অরিত্রানের মাথা ভর্তি চুলের দিকে।অরিত্রান মাথা তুলে এবার ওয়াসেনাতের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে বললো,
—-“ মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিবে পরীজা??”
ওয়াসেনাত হাত বাড়াতে পারছে না।তার শরীর শিরশির করে কাঁপছে।অরিত্রান নিজেই হাতটা টেনে নিলো।নিজের মাথায় রেখে আবার সে চোখ বুঝলো।ওয়াসেনাত ঘামছে।প্রচুর কম্পিত হচ্ছে তার শরীর।অরিত্রানের ভালো লাগছে না।আরো অস্থির লাগছে।তবুও সে শুয়ে আছে।এবার মাথা কাত করে নিয়েছে হালকা।ওয়াসেনাতের কাঁপুনি কমেছে একটু।সে আস্তে আস্তে অরিত্রানের মাথায় বিলি কেটে দেয়।অরিত্রানের মাথা আরো ভার হয়।বুকটা কাঁপে ধড়াস ধড়াস করে।সেই শব্দ ওয়াসেনাতের কানেও আসে।ওয়াসেনাত অবাক হয়ে হাত সরিয়ে অরিত্রানের বুকের পাশটায় রাখে হিসহিস করে বলে,
—-“ আল্লাহ্!আপনার কি বুক ব্যথা করছে??”
অরিত্রান চোখ খুললো না।আগের মতো থেকে সে হেসে বললো,
—-“ হুম !করছে তো!অনেক ব্যথা।তবে সেরে যাবে ঔষুধের কোলে শুয়েছি বলে কথা।”
ওয়াসেনাত ভারী অবাক হলো।বললো,
—-“ আমি ঔষুধ??”
অরিত্রান হেসে বললো,
—-“ হুম।তবে সবার না শুধু আমার!”
ওয়াসেনাত তাকিয়ে আছে।”আমার” কথাটায় ভারী একটা অনুভুতি ছিলো।যা তাকে ক্রমশো কাঁপিয়ে তুলছে ভিতর থেকে।
#চলবে_________