তোকে চাই – Season 2 ! Part- 60
শুভ্র বিছানায় বসে ফোন গুতাচ্ছেন। আর আমি তার ঠিক সামনে দাঁত কেলিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। শুভ্র এ পর্যন্ত দু’বার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েছেন কিন্তু তাতে আমার অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় নি বললেই চলে। শুভ্র এবার ফোনটা পাশে রেখে আমার দিকে তাকালেন। ভ্রু নাঁচিয়ে বলে উঠলেন,
— কি? ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন?
উনি কথাটা বলার সাথে সাথেই একরকম লাফিয়ে গিয়ে উনার গা ঘেষে বসে পড়লাম আমি। আমার কাজে উনি চরম অবাক। কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে হালকা কেশে কিছুটা সরে বসলেন উনি। আমি আবারও উনার পাশে গিয়ে বসে পড়লাম। উনি এবার সন্দেহী দৃষ্টিতে তাকালেন। আরেকটু সরে গিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলেন,
— এই তুমি আবার বিয়ার খেয়েছো?
— আজব? বিয়ার খেতে যাবো কেন? আর আপনিই বা এমন বিহেভ করছেন কেন?
— এই প্রশ্নটা আমার করা উচিত। এমন বিহেভ করছো কেন? বিয়ার খাওয়া ছাড়া তো আমার প্রতি তোমার এতো দয়া হওয়া পসিবল না। টেনেও তো পাশে বসানো যায় না আবার ভালোবাসা। তাই আজ যেহেতু এতো ভালোবাসা দেখাচ্ছো নিশ্চয় কাহিনি আছে। যদি বিয়ার খেয়ে থাকো তো আমার থেকে দূরে থাকো। মাতাল হলে তোমার ভালোবাসা একটু বেশিই বেড়ে যায়। নিজেকে তখন অসহায় মোরগ মনে হয়। টোটাল এগ্রেসিব রোদ….প্লিজ দূরে…
কথাটা বলে আরেকটু দূরে সরে বসলেন উনি। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছি। কিছুক্ষণ চুপচাপ উনার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলাম,
— একটু পর চিত্রার বাসর।
উনি অবাক চোখে কিছুক্ষণ আমায় দেখে নিয়ে বলে উঠলেন,
— তো? তুৃমিও বাসর করতে ইচ্ছুক নাকি? হলে বলো….সাজিয়ে দিই রুম। আমার কিন্তু কোনো প্রবলেম নেই। আই এম অলওয়েজ রেডি।
— ধেৎ! অলওয়েজ ফালতু কথা বলবেন না। আমি বাসর করতে চাচ্ছি না। হেল্প চাচ্ছি।
এবার যেনো আরো অবাক হলেন উনি। চোখ কপালে তুলে বলে উঠলেন,
— কিসের হেল্প?
আমি আবারও উনার পাশে গিয়ে বসলাম। ইনোসেন্ট ফেইস নিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে উঠলাম,
— এতো সহজে বাসর হয়ে যাবে? জ্বালাবো না? সেই কতো বছর থেকে প্ল্যানিং করে আসছি চিত্রার বাসরে এভাবে ডিস্টার্ব করবো,ওভাবে ডিস্টার্ব করবো বাট….এখন কিছুই মাথায় আসছে না। ভাল্লাগে না….
— আহারে। তো আমাকে কি করতে বলো? আমি দুলাভাই হয়ে তো শালিকার বাসরে ডিস্টার্ব করতে পারি না রোদপাখি। যা করার তুমিই করো।(ভাব নিয়ে)
— আপনি হেল্প করবেন না?
— উহুম।
— সিউর তো?
— হ্যাঁ।
— ওকে দেন। করতে হবে না আপনাকে হেল্প। আমাকে হেল্প করবেন কেন আপনি? আপনি তো হেল্প করবেন আপনার শ্রেয়া বেপিকে তাই না??আর কে কে যেনো আছে? হেল্প করার মানুষের অভাব নেই তো আপনার। ভার্সিটি স্টুডেন্টরাও তো এখন ইনিয়ে বিনিয়ে প্রোপোজাল দেয়। বাচ্চা বাচ্চা কচি কচি মেয়ে… আহা! তাদের রেখে আমাকে হেল্প করতে যাবেন কেন? কি মনে করেন বুঝি না আমি? সব বুঝি।
কথাটা বলে মুখ ফুলিয়ে ওঠে যেতে নিতেই টেনে কোলে বসিয়ে নিলেন উনি। আমার মুখ তখন অমাবস্যার রাতের মতো কালো। আর উনার মুখে মিষ্টি হাসি। আমার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে বলে উঠলেন উনি,
— আপনি এতো বুঝেন,জানায় ছিলো না আমার। তো? আর কি কি বুঝেন?
আমি কিছু বললাম না। মুখ ভার করে বসে রইলাম। এবার উনি ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। আমার ঠোঁটে হালকা ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে উঠলেন,
— এই ঠোঁটে হাসি ফুটানোর জন্য কি করতে পারি ম্যাডাম?
এবারও চুপ করে রইলাম আমি। মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে বসে রইলাম চুপচাপ। আমাকে চুপ থাকতে দেখে ঘাড়ের চুলগুলো সরিয়ে কাঁধে একটা কামড় দিয়ে বলে উঠলেন,
— আচ্ছা মহারানী, আপনার আদেশই শিরধার্য তবু একটু হেসে এই অধমকে ধন্য করুন।
আমি এবার উনার দিকে তাকালাম। চোখে চোখ পড়তেই মুচকি হেসে লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলাম। উনি শক্ত করে কোমর চেপে ধরে কাঁধে মুখ গুঁজে ফিসফিস করে বলে উঠলেন,
— থেংকিউ মহারানি।
চিত্রার বাসর ঘরটা সাজানো হয়েছে একদম দক্ষিণের ঘরটাতে। সেদিক থেকে দক্ষিণা বাতাস আসবে এই মতবাদেই সাজানো হয়েছে সেই রুম। এই ওয়েডিং হাউজের বেশির ভাগ রুমগুলোর পাশেই ব্যালকনি আছে কিন্তু সমস্যা হলো ব্যালকনি গুলো এক্সট্রা নয় লম্বালম্বি। অর্থাৎ সব রুমের পাশ দিয়ে একই বারান্দায় চলে গিয়েছে লম্বালম্বি ভাবে। আমি বারান্দার এক কোণে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছি। আমার পাশে জানালার উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছেন শুভ্র। রাত প্রায় বারোটা পনেরো। হালকা জোস্ন্যার আলো চারপাশে। আমাদের দুজনের দৃষ্টিই চিত্রাদের রুমের বারান্দায়। ওখানে দাঁড়িয়ে আছে রোহান ভাই, সাব্বির ভাই, সাকিব -রাতুল ভাই সহ সব। এমনকি শিশির স্যারের ভাই মিসির আলী সরি মিশির আহমেদও আছেন। এতোগুলো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে অথচ জায়গাটা একদম নিশ্চুপ। কিছুক্ষণ পর পর কেউ একজন করে খুব জোড়ে কাশি দিয়ে উঠছে। একটানা কয়েক সেকেন্ড কাঁশতে কাঁশতে আবারও নিশ্চুপ হয়ে লুকিয়ে পড়ছে সব। কয়েক মিনিট পর অন্য আরেকজন গিয়ে শুরু করছে সেই বিখ্যাত কাঁশি আর এসব দেখে বাকিগুলো হাসতে হাসতে কাহিল। শিশির স্যার এই পর্যন্ত দু’বার দরজা খুলে চেক করেছেন কেউ আছে কি না। কিন্তু বেচারা! কাউকেই চোখ পড়ে নি তার। সাকিব ভাই আর রাতুল ভাইয়ের উৎসাহই বেশি। কাশতে কাশতে যেন এখনই রক্তবমি করে দিবেন এমন অবস্থা করে লুকিয়ে পড়েন ব্যালকনির বাইরের ভারতি ওই অংশটুকুতে। কি ভয়াবহ অবস্থা। শুভ্রর মাথায় এমন সব প্ল্যান কোথা থেকে আসে কে জানে? আজ বেচারা শিশির-চিত্রা কাশি বিড়ম্বনায় ক্লান্ত হয়ে পড়বে নির্ঘাত। রাত প্রায় একটার দিকে সবাইকে কাছে ডেকে বলে উঠলেন শুভ্র,
— বহুত জ্বালাইছিস। এবার রুমে যা। বাকি সময়টা ওদেরকে নিজের মতো থাকতে দে। বাসর বলে কথা। লাইফের সবচেয়ে মেমোরিবেল ডে। এভাবে সম্পূর্ণটায় নষ্ট করে দেওয়া উচিত নয়।
উনার কথা মেনে নিয়ে যার যার রুমে চলে গেলেন সবাই। তবে যেটুকু জ্বালিয়েছে সেটুকু জীবনে ভুলবে বলে মনে হয় না আমার।
রাত ক’টা বাজে জানি না। হঠাৎই শুভ্রর হাসির শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো আমার। চোখ দুটো পিটপিট করে তাকিয়ে আশেপাশের অবস্থানটা বুঝতে চেষ্টা করে উঠে বসলাম আমি। কম্বলটা ভালো করে পেঁচিয়ে সামনের দিকে তাকিয়েই ল্যাপটপে চোখ পড়লো আমার। শুভ্র ভিডিও কলে কথা বলছিলেন। আমাকে উঠতে দেখে মুচকি হাসলেন উনি। ওপাশ থেকে সাহেল ভাইয়া বলে উঠলেন,
— হেই সানশাইন? কেমন আছো? ওপস্ সরি! ভাবছি এখন থেকে ভাবি ডাকবো। আমার একমাত্র বেস্ট ফ্রেডের একমাত্র বউ বলে কথা। তো ভাবি কেমন আছেন?
আমি হাসলাম। চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে নিয়ে নিয়ে ঘুমুঘুমু কন্ঠে বলে উঠলাম,
— ভালো আছি ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন?
— আমিও ভালো। শুধু একটা প্রবলেম। এদের ঘাস ভুস খেতে খেতে বাঙালী খাবারের টেষ্ট ভুলে যাচ্ছি। দেশে গিয়ে একটা বাঙালী রাধুনী মেয়ে দেখে বিয়ে করবো বুঝলা? কয়েক মাস শুধু বসে বসে খাবো। একটা পাক্কা রাধুনী মেয়ে খুঁজো তো সানশাইন ভাবি।
উনার কথায় আবারও হাসলাম আমি। হাসিমুখে বলে উঠলাম,
— ওখান থেকেই একটা ধলাসুন্দরী বিয়ে করে আনুন ভাইয়া। পরে নাহয় রান্না শিখিয়ে দিবো।
— আরেহ নাহ। বিয়ে তো আমি দেশী মেয়েকেই করবো। তাও আবার শ্যামবতী। আমি নিজেই যে সাদা আরেক সাদাকে বিয়ে করলে আমার বাচ্চাগুলো সব ফার্মের মুরগীর মতো দেখাবে। তারথেকে দেশী মেয়েই ভালো…
আমি কিছু বলার আগেই শুভ্র কিছু একটা বললেন। তার বিপরীত সাহেল ভাইয়াও কিছু একটা বললেন৷ তারপর শুরু হলো দু’জনের হাসাহাসি। শুধু হাসাহাসি নয়… একে বলে চরম রকম হাসাহাসি। আমি আবালের মতো তাকিয়ে আছি। উনাদের কথার আগামাথাও বুঝতে পারছি না আমি। আমি আর চিত্রাও কোড টাইপ কথা বলি কিন্তু এদের মতো…এভাবে? কখনোই নয়…!!
🍁
চিত্রার বিয়ে শেষ করে কালই বাসায় ফিরেছি আমরা। বিয়েতে সারাদিন দৌঁড়া দৌঁড়ি লাফালাফিতে পা ব্যাথা কাকে বলে বুঝতে না পারলেও এখন বেশ বুঝতে পারছি। বিকেল ৩ টা বাজে। সারাদিন ঘুমিয়েই কাটিয়েছি আজ কিন্তু শুভ্র! সে সকাল সকাল উঠে ভার্সিটিতে চলে গেছেন চুপচাপ। ক্লান্তি জিনিসটা উনার মাঝে নেই বললেই চলে। বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে রুমে আসতেই দেখি মুখে গম্ভীর ভাব নিয়ে বসে আছেন শুভ্র। আমি কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে বললাম,
— কখন ফিরলেন?
আমার কথায় সটান দাঁড়িয়ে পড়লেন উনি। আমার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন,
— আজ তোমাদের সেমিষ্টার ফাইনাল রেজাল্ট দিয়েছে জানো?
আমি পাত্তা না দিয়ে বললাম,
— হুম লিমা ফোন দিয়ে বলেছিলো সকালে।
উনি আগের থেকেও গম্ভীর মুখে বলে উঠলেন,
— রেজাল্ট কি?
— ৩.৫৭
— মাত্র! ৪ এর মধ্যে মাত্র ৩ সামথিং? লাইক সিরিয়াসলি? তুমি জানো? প্রত্যেকটা সেমিস্টারে আমার রেজাল্ট ছিলো সিজিপিএ ৪ আর তুমি? অবিশ্বাস্য।
উনার কথায় যেনো আমি আকাশ থেকে পড়লাম। ৩.৫৭ তার কাছে মাত্র? এটা পেয়েই আমি আর চিত্রা যেখানে লুঙ্গি ডান্স করি সেখানে উনি বলছেন মাত্র? আমি থতমত খেয়ে বলে উঠলাম,
— এটা মাত্র?
— তো? মাত্র নয়? ভার্সিটি টিচারের বউ হয়ে এই রেজাল্ট? আমি পলিটিক্স করার পাশাপাশি পড়াশোনা করেও ৪ পেয়ে গেছি আর তুমি তো সারাদিনই বাসায় বসে থাকো। এতো লাফালাফি ঝাঁপাঝাপি না করে একটু পড়াশোনা করলে কি হয় শুনি?
— আমি এতো ভালো রেজাল্ট দিয়ে কি করবো? ৩.৫৭ ই আমার জন্য অনেক। তাছাড়া আপনার মতো বইয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকতে মোটেও ভালো লাগে না আমার।
— আমি সারাদিন বই নিয়ে পড়ে থাকি নি। ফ্রেন্ডদের সাথে ইঞ্জয়, পলিটিক্স সবই করেছি। এক্চুয়েলি মনোযোগ তো থাকতে হবে৷ তোমার মাথায় তো সারাদিন ফাউল ফাউল বুদ্ধি ঘুরে বেড়ায়। মনোযোগ থাকবেটা কিভাবে? তোমার মনোযোগ এক্চুয়েলি কোথায় থাকে সেটাই তো বুঝি না আমি।
সাথে সাথেই দাঁত কেলিয়ে বলে উঠলাম,
— আমার মনোযোগ তো আপনার কাছে থাকে।
কথাটা উনাকে ডিসট্রেক্ট করার জন্য ছিলো কিন্তু হায় নিয়তি! উনি আরো গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন,
— রোদপাখি? লাভ নেই। আমার দুর্বলতায় আঘাত করে লাভ নেই। আপনার এই প্রেমবান আপাতত নিজের কাছে রাখুন। নেক্সট এক্সামে ৪ না এলে খবর খারাপ হবে তোমার। আজ থেকে লাফ ঝাপ বন্ধ। অফিস থেকে এসে যদি দেখি দৌড়া দৌড়ি করছো বা ঘুমিয়ে গেছো তাহলেই চলবে মাইর। আমি ফ্রেশ হতে যাচ্ছি টেবিলে খাবার দিতে বলো। যাওয়ার আগে পড়া দেখিয়ে দিয়ে যাবো। চুপচাপ কমপ্লিট করবা সব৷ গো….
কথাটা বলেই ওয়াশরুমে ঢুকে গেলেন উনি। আমি থম মেরে দাঁড়িয়ে আছি। টিচার বিয়ে করার সাইড ইফেক্টটা মাথায়ই ছিলো না আমার। এবার বুঝো ঠেলা। এর থেকে তো আম্মুই ভালো ছিলো। ধেৎ বিয়ে করে লাভটা কি হলো??কথাটা ভেবেই মুখটা কালো হয়ে গেলো আমার। যদিও কালো ভাবটা বেশিক্ষণ থাকলো না যখন মনে হলো চিত্রার বরও টিচার। আহা! কি শান্তি। নিজে একা বাঁশ খেলে যতটা দুঃখ দুঃখ ফিলিংস হয়, বেস্ট ফ্রেন্ডকে নিয়ে বাঁশ খেলে তার থেকেও বেশি সুখ সুখ ফিলিংস হয়। যে সুখটা এখন আমার লাগছে। চিত্রার বিয়েটা শিশির স্যারের সাথে হয়েছে বলে আল্লাহ কে কয়েক লক্ষবার থেংকিউ জানিয়ে, আনন্দে নাঁচতে নাঁচতে নিচে নেমে গেলাম আমি। আর মনের মাঝে কনটিনিউয়াসলি চলছে ,” চিত্রা বেবি! ইউ আর গন।”
#চলবে….🍁