আবর্তন !! লেখাঃ তাজরীন খন্দকার
আবর্তন
অরুণ আমার পেটে তোমার বাচ্চা,অথচ তুমি আমার জীবনটা নষ্ট করে আবার বিয়ে করতে চলেছো?
কীভাবে ভুলে গেলে আমাদের তিন বছরের প্রেমের সম্পর্ক এবং এক বছর আগে কোর্টে বিয়ে হওয়ার কথা?
অরুণের বিয়ের আসরে হঠাৎ দৌঁড়ে এসে হাঁফাতে হাঁফাতে কথাগুলো বললো একটা অচেনা মেয়ে। যাকে কিনা এখানে উপস্থিত কেউই চিনেনা।
কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানোর পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি নিয়ে বরের সামনে বসেছিলেন ,ঠিক সেসময় সেখানে এই অচেনা মেয়ের আগমন, যার দাবি হলো এই বর তার স্বামী হয় এবং তাদের একবছর আগে বিয়ে হয়েছে৷ আবর্তন
অপরিচিত সেই মেয়েটা হাতে বিয়ের কাগজপত্র নিয়ে জোরে জোরে চিৎকার করে সামনে যারা আছে সবাইকে দেখাচ্ছে,আর বলছে
___এই বিয়ে যেভাবেই হোক যেন ভেঙে দেন প্লিজ। বুঝার চেষ্টা করুন, এখানে যদি কোনো রকম বিয়ে হয় তাহলে আমার এবং আমার বাচ্চার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। আমার জানা ছিল না অরুণ আমাকে এভাবে ঠকাতে পারে। সে আমাকে বলেছিল তার পরিবারকে ৬ মাসের মধ্যে যেভাবেই হোক রাজী করিয়ে আমাকে তার ঘরে তুলবে,কিন্তু তার আগেই সে আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করার জন্য চলে এসেছে। আমি ভাবতে পারছিনা কিছু!
মেয়েটা রীতিমতো সবার হাতেপায়ে ধরে হাউমাউ করে অনুরোধ করতেছে। অরুণের পরিবারের লোকজন পারছেনা এই মূহুর্তে এই অসম্মান থেকে বাঁচতে মাটির নিচে লুকিয়ে যায়! তাদের ছেলে তাদের না জানিয়ে কি করে এমন একটা জগণ্য কাজ করতে পারে!
ইতোমধ্যে এই ব্যপারটা সারাময় রটে গেলো।
সেটা এই বিয়ের কণেবেশে অন্তপুরে বসে থাকা চন্দ্রার কানে পৌঁছাতেই তার গা হিম হয়ে এলো, কিছুক্ষণের জন্য সে একদম স্থির হয়ে ছিল, আর তার চোখ দুটো মূহুর্তেই লাল হয়ে পানিতে টলমল করছে, মুখে কোনো শব্দ বেরুচ্ছেনা, হাত একটা আরেকটার হালকা উপর নড়ছে । হঠাৎই সে লাল বেনারসি শাড়ী আর ঘোমটা টেনে এক দৌঁড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো ।
একদম বাইরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো, আর দেখলো এক জায়গায় সবাই জড়ো হয়ে আছে এবং সেখান থেকে তর্কাতর্কির খুব জোরে জোরে শব্দ আসছে, চন্দ্রা বুঝতে পারলো সেই মেয়েটার সাথেই হয়তো কথা বলছে সবাই। চন্দ্রা সামনে এগুনোর জন্য যে-ই পা বাড়াবে তখনি তাকে পেছন থেকে কেউ আটকে ফেললো। পেছনে তাকানোর আগেই সামনে একজনের চোখে আর চোখবিদ্ধ হলো, সবার ভীড় থেকে যে চোখজোড়া তার দিকে অসহায় হয়ে তাকিয়ে আছে। চন্দ্রা পেছনে আটকানো হাতটাকে ছিটকে সরিয়ে দরজার একদম বাইরে চলে আসলো। ততক্ষণে সেখানের সবার দৃষ্টি এসে পড়লো চন্দ্রার দিকে। আবর্তন
স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে অরুণের চোখ ভিজে আছে কিন্তু সেখানে এই মূহুর্তে এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মতো কোনো শক্তি তার নেই।
চন্দ্রা ডান হাতের আঙুলটা উপরে সামনে ধরে ঠিক অরুণের দিকে লক্ষ্য করে কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে, ভাঙা স্বরে জোরে জোরে বলতে লাগলো,,
___ একটা মানুষ এতো নিচ কীভাবে হয়? কীভাবে পারে এতো নিখুঁতভাবে প্রতারণা করতে?
এই এই! আপনিই না সেদিন বলেছিলেন, চন্দ্রা তোমার আর আমার নামের মধ্যে একটা দারুণ মিল আছে, অরুণ নামের অর্থ সূর্য, আর আমার নামের অর্থ চাঁদ! চাঁদ যেমন সূর্যের আলোয় নিজেকে আধারে আলোকিত করে, তেমনি আপনার ভালোবাসায় আমাকেও সারাজীবন আলোকিত করে রাখবেন! বলেছিলেন না? কেন বলেছিলেন এগুলো, কেন ? কেন আমার এতো স্বপ্ন আশাকে ভেঙে চুরমার করে দিলেন! কি দোষ ছিল আমার?
বিয়ের আসর থেকে বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পরে একটা মেয়ের জীবনে কেমন ধ্বস নেমে আসতে পারে, আপনার ধারণা আছে? আমি আপনাকে কখনোই ক্ষমা করবোনা,কখনোই না।
চন্দ্রার কথা শুনে এখানে সবাই মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে রইলো, কেউ কেউ চোখ মুছতেছে,
শুধু অরুণ নির্বাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে শুনে যাচ্ছে। চন্দ্রা এখান থেকে ভেতরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েও আবার অরুণের দিকে তাকালো,
অরুণ হাত নাড়িয়ে বলতে চাচ্ছে এসবের কিছুই সে জানেনা,কিন্তু চন্দ্রা তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চেঁচিয়ে বললো,
___আপনার এই পাপী মুখ আমাকে দেখাবেন না। আমি আপনাকে আর কখনোই দেখতে চাইনা। ঘৃণা করি আপনাকে!
বলেই এক দৌঁড়ে চন্দ্রা ভেতরে চলে গেলো। বিয়েটা ভেঙে গেলো, অরুণ কোনো একটা মুখের কথাও বলতে পারলোনা। চারপাশ থেকে মানুষজন ছি ছি করতে লাগলো। তার পরিবারের লোকজন তাকে যাচ্ছেতাই বকে যাচ্ছে। কোনো রকম সেখান থেকে মাফ চেয়ে বরপক্ষ কণেবিহীন গাড়ী নিয়ে খালি হাতে ফেরত যাচ্ছে। অরুণের তখনি মরে যেতে ইচ্ছে করছিলো, কাউকে বিশ্বাস করাতে পারছেনা সত্যিই সে নির্দোষ! এমন গন্ডগোলের ভীড়ে অরুণ সেই মেয়েটাকেও আর খুঁজে পেলোনা আর।
কারো চোখের দিকে তাকাতে পারছেনা, খুব ক্ষেপে আছে সবাই। আবর্তন
গাড়ীতে বসে অরুণ উপরে তাকিয়ে নিজেকে শক্ত করলো। চন্দ্রার সাথে বিয়ের তারিখ হওয়ার পরে মাত্র তিনবার ফোনে কথা হয়েছে, এর আগে অসংখ্য পাত্রী দেখেছে অরুণ কিন্তু কাউকেই তার জীবনসঙ্গী হিসেবে যোগ্য মনে করতে পারেনি। কিন্তু চন্দ্রাকে দেখার পর পরই তার মনে হয়েছিল তারা একে অপরের জন্য সৃষ্টি হয়েছে। তবে আজ কাঙ্খিত সেই চাওয়াকে পাওয়ার শুরুতেই হারানোর ভয়াবহ ব্যথার পাথর বেঁধে ফিরতে হচ্ছে। সে জানেনা এটা কেমন চক্রান্ত ছিল! সত্যিই কি চন্দ্রাকে সে হারাবে এটা ভাবতেই অরুণের বুক কেঁপে ওঠছে।
কিন্তু নাহ তাকে হেরে গেলে চলবেনা,সেতো জানে সে সত্যিই কিছু করেনি। তাকে এখানে ফাঁসানো হয়েছে। আর এটা তাকে যেভাবেই হোক প্রমাণ করতে হবে।
কিন্তু কে এমন করতে পারে? যে মেয়েটা আসছিল তাকেও তো অরুণ চিনেনা, আবার সে যে কাবিনপত্র নিয়ে আসলো সেখানেও অরুণের সাক্ষর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। অরুণের জানামতে তার কোনো শত্রু থাকতে পারেনা, আবার এমনো নয় যে তার কোনো প্রাক্তন প্রেমিকা ছিল। সে কখনো প্রেম করার সুযোগই পায়নি। বছরের পর বছর একগাদা বই নিয়ে তার জীবনের এতগুলো সময় নির্বাহিত হয়েছে। আর সেই জন্যই আজ তার ভালো একটা চাকরি আছে,সম্মান আছে। তবে আজকের কান্ডে তার সারাজীবনের সঞ্চিত সম্মানটা পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। সে জানেনা কি থেকে এখন কি শুরু করবে, আর সবার ভুল ভাঙাবে! তবে সে হাল ছাড়বেনা। মনে মনে শপথ করেছে যে করেই সত্যটা সবার সামনে আনবে এবং সে চন্দ্রাকেই বিয়ে করবে। আবর্তন
অন্যদিকে চন্দ্রা নিজের ঘরে সেই দুপুর থেকে দরজা লাগিয়ে বসে আছে। তাকে এভাবে ঘরে দরজা লাগিয়ে রাখতে দেখে সবাই চিন্তায় পড়ে গেলো। শুধুমাত্র তার ভাবী ছাড়া সবাই-ই কেমন জানি ছুটাছুটি করছে, চন্দ্রার মা তো পুরো পাগল প্রায় অবস্থা। এভাবে মেয়েটার বিয়ে ভেঙে গেলো, কে জানে তার মেয়ের ভবিষ্যৎে কি অপেক্ষা করছে!
কিন্তু চন্দ্রার সেই ভাবীটা উনাকে বুঝানোর চেষ্টা করছে কিছুই হবেনা। যা হয়েছে হয়তো মঙ্গলের জন্যই হয়েছে। নাহলে এমন একটা ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে বিষয়টা জানলে কতোই না দেরি হয়ে যেতো।
চন্দ্রার মা বিষয়টা বুঝতে পেরে কিছুটা আশ্বস্ত হলেন। আবর্তন
এদিকে সবাইকে বুঝাতে বুঝাতে চন্দ্রার ভাবী প্রায় হাঁফিয়ে উঠেছে।
এতকিছু হয়ে যাওয়ার পরে কেউ চন্দ্রার সাথে কথা বলতে যায়নি। কারণ সেটার সুযোগই পায়নি কেউ। অবশেষে ভাবী গিয়ে চন্দ্রার দরজার উপর কড়া নাড়লেন।
পুরো তিন মিনিট পর চন্দ্রা একটা গম্ভীর ভাব নিয়ে দরজা খোলে সামনে নিজের ভাবীকে দেখে জোরে হেসে উঠে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বললো,
___ভাবী তুমি? আমি তো ভাবছি অন্য কেউ!
চন্দ্রার ভাবী মুখ বাঁকিয়ে বললো, আবর্তন
___কেন আমি না হলে কি শুরু করে দিতে অভিনয়?
তুমিও পারো বোন। আচ্ছা মানলাম এসব সংলাপ দেওয়া সহজ কিন্তু চোখে পানি আসে কীভাবে বুঝাবে?
চন্দ্রা তার ভাবীর মুখ চেপে ধরে বললো,
___ আস্তে ভাবী আস্তে, কেউ শুনে ফেলবে তো!
চলবে…….