স্যার আমাকে জীবনটা ভিক্ষা দেন: সিনহা
সিনহা
সেনাবাহিনীর (অব.) মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান (৩৬)। কক্সবাজারের টেকনাফে পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনি। এ ঘটনায় মাঠে নেমেছে তদন্ত দল। এদিকে ৯ পুলিশ সদস্যকে আসামি করে মামলা দায়ের হয়েছে।
সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা নিহতের ঘটনায় একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৩ জুলাই ‘জাস্ট গো’ নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে ট্রাভেল শো ডকুমেন্টারির শুটিংয়ের জন্য স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের আরো তিনজনসহ কক্সবাজারের নীলিমা রিসোর্টে ওঠেন মেজর সিনহা।
৩১ জুলাই দুজনকে হোটেলে রেখে সঙ্গী সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে নিয়ে বিকাল ৪টার দিকে হোটেল থেকে টেকনাফের শামলাপুর পাহাড়ি এলাকায় গিয়েছিলেন মেজর সিনহা। বাহারছড়া ইউনিয়নের মাথাভাঙ্গা থেকে শহিদুল নামের এক কিশোরকে নিয়ে পাহাড়ে উঠেন। কিশোরটি তাদের পথ দেখিয়ে ফিরে আসলে তারা লাইটের আলো জ্বালিয়ে কাজ করেন। এতে স্থানীয় অনেকেই অপরিচিত লোকজন দেখে কৌতূহল ও নানা রকম ধারণা করতে থাকেন।
রাত সাড়ে ৮টায় তারা দুজন পাহাড় থেকে নামেন এবং সিনহা নিজস্ব প্রাইভেট কারে মেরিন ড্রাইভ করে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা দেন। শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে আসার আগে বিজিবি চেকপোস্টে সিনহার গাড়ি তল্লাশির জন্য থামানো হয়। তবে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। রাত ৯টায় শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে আসার আগেই এসআই লিয়াকত ডাকাত সন্দেহে অবহিত হয়ে সঙ্গীয় ফোর্সসহ মেজর সিনহার গাড়ি থামান। মেজর সিনহা গাড়ি থামিয়ে নিজের পরিচয় দিলে প্রথমে যাওয়ার অনুমতি দিলেও একটু পরই অকস্মাৎ এসআই লিয়াকত তাদের পুনরায় থামার সংকেত দেন। পিস্তল তাক করে তাদের দিকে এগিয়ে আসেন।
মেজর সিনহার সঙ্গী সিফাতের দেওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মেজর সিনহা পুলিশের নির্দেশনা পাওয়ার পরপরই পিস্তল গাড়িতে রেখে হাত উঁচু করে বের হন। এসআই লিয়াকত কোনো কথা না বলেই গাড়ি থেকে নামার পরপরই সিনহাকে লক্ষ্য করে ৩ রাউন্ড গুলি করেন। সঙ্গে থাকা সঙ্গীয় সিফাতকে আটক করে তদন্ত কেন্দ্রে নেয়া হয়।
তবে পুলিশের দাবি দুর্ধর্ষ রোহিঙ্গা ডাকাত বাহিনীর সদস্য পাহাড় থেকে নেমে আসার খবর পেয়েই বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বরত পরিদর্শক লিয়াকতের নেতৃত্বে একদল পুলিশ মেরিন ড্রাইভে অবস্থান নিয়েছিল। লোকজনের দেয়া খবর অনুযায়ী টেকনাফ থেকে কক্সবাজারমুখী একটি প্রাইভেটকারের আরোহীর সঙ্গে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে বাহারছড়া ফাঁড়ির দায়িত্বরত পুলিশ ইন্সপেক্টর লিয়াকত গুলি চালায়।
পুলিশের দাবি, ওই সেনা কর্মকর্তা নিজের পিস্তল বের করেছিলেন পুলিশের প্রতি। ঘটনার পর পরই কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসকরা গুলিবিদ্ধ আরোহী মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে তল্লাশি চালিয়ে ৫০ পিস ইয়াবা ও গাঁজা পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে টেকনাফ থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এদিকে চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর শনিবার বিকেলে মেরিন ড্রাইভ রোডের বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ি এলাকার ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনীর একটি তদন্ত দল ঘটনা তদন্তে যায়। এসময় এলাকার লোকজন সেনাবাহিনীর তদন্ত দলটিকে দেখে এগিয়ে আসেন।
তদন্তের সময় উপস্থিত একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, স্থানীয় একটি হেফজখানার মুয়াজ্জিন মো. আমিনসহ বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাদের কাছে বলেছেন, শনিবার রাতে প্রাইভেটকারের ওই আরোহী (মেজর সিনহা) ফাঁড়ির পুলিশ ইন্সপেক্টর লিয়াকতের নির্দেশ মতে উপরে দুই হাত তুলে বলেন, ‘বাবা আপনারা অহেতুক আমাকে নিয়ে উত্তেজিত হবেন না। আপনারা আমাকে নিয়ে একটু খোঁজ নিন।’ মেজর সিনহা এমন কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই কুত্তার বাচ্চা বলেই তাঁর (মেজর সিনহা) বুকে গুলি চালায় পুলিশ ইন্সপেক্টর লিয়াকত হোসেন। তখনই মেজর বলেছিলেন, ‘স্যার আমাকে জীবনটা ভিক্ষা দেন।’ পর পর আরো দুটো গুলি করলে তৎক্ষণাৎ তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
তদন্তের পর থেকে বায়তুন নুর জামে মসজিদের মেয়াজ্জিনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে মসজিদের একাধিক মুসল্লি ও পরিচালকরা জানান। পাশাপাপাশি ভয়ে অনেকেই এলাকা ছেড়ে গা ঢাকা দিয়েছে। কেউ কেউ মুখ বন্ধ করে রেখেছে। হুমকি প্রদান করায় ভয়ে এখন কেউ মুখ খুলছে না।
প্রত্যক্ষদর্শী শামসুল ইসলাম বলেন, মাথাভাঙ্গার প্রধান সড়কের একটি সরু গলির পশ্চিম দিকে কিছুদূর যাওয়ার শামসুল ইসলামের কিশোর নাতি শহিদুল ইসলামকে সঙ্গে করে নেন মেজর ও তার সঙ্গে থাকা সিফাত। পাহাড়ি পথ দেখিয়ে দিয়ে ফিরে আসে বলে জানান শামসুল ইসলাম।
তিনি আরো জানান, পাহাড়ে উঠে বেশ কিছুক্ষণ কাজ করেছিল। রাত হলে নেমে আসেন তারা। তবে এর মধ্যে মারিশবিনয়া এলাকার লোকজন হট্টগোল করেছিল বলেন শুনেছি। এর বেশি বিস্তারিত তিনি জানাতে পারেননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একজন বলেন, আমি বাড়ি যাবার সময় দেখলাম, বাহারছড়া কেন্দ্রের ইনচার্জ একটি কারকে থামান। গাড়িতে থাকা একজন বলেন, কেউ ইনফরমেশন দিলে গাড়ি চেক করেন। এতে লিয়াকত হোসেন তাদের দিকে পিস্তল তাক করে বলেন, ‘শালা ভুয়া কোথাকার নাম।’ কারের আসনে থাকা মেজর সিনহা হাত দুটো ওপরে তুলে গাড়ি থেকে নেমে পড়েন। কিছু বলার আগে গুলি করেন। তারপরেও মেজর বলেন, ‘স্যার আমাকে জীবনটা ভিক্ষা দেন।’ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ নির্মমভাবে পর পর আরও দুটি গুলি করেন। কিছুক্ষণ পরে টেকনাফ থানার ওসি ঘটনাস্থলে আসেন।
মো. ফরিদ স্থানীয় মেম্বার জানান, বিকেলে দুইজন লোক মেরিনড্রাইভে কারটি রেখে ভেতরে আসেন। গ্রামের এক কিশোরকে নিয়ে পাহাড়ে উঠে যান। পাহাড়ে তারা আলো জালিয়ে কাজ করায় গ্রামের লোকজন ডাকাত মনে করে হট্টগোল করেন। খবরটি তারা (মেজর সিনহা ও সিফাত) পেয়ে দ্রুত নেমেই ফের কার যোগে ফিরে যান। কিছুক্ষণ পরে শুনতে পাই, ওখানে গুলিতে নিহত হন।
এদিকে টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলী ও টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ৯ পুলিশ সদস্যকে আসামি করে বুধবার (৫ আগস্ট) মামলা করেছেন মেজর সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস।
বুধবার আদালতের বিচারক তামান্না ফারাহ ফৌজদারি দরখাস্তটি আমলে নিয়ে টেকনাফ থানায় নিয়মিত মামলা হিসাবে রেকর্ড করতে নির্দেশ প্রদান করেন। সেই সাথে বিচারক হত্যা মামলাটি তদন্তের জন্য র্যাব-১৫ কে দায়িত্ব দিয়ে আগামী ৭ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছেন।
দুপুরে টেকনাফের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগ আনেন বাদী নিহত মেজর সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস। বাদী এজাহারে অভিযোগ করেছেন, টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাসের নির্দেশে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে গুলি করেছেন পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলী।
বাদী এজাহারে উল্লেখ করেন, ঘটনার কিছুক্ষণ পর ওসি প্রদীপ কুমার দাস ঘটনাস্থলে আসেন। তিনি এসেই তখনও জীবিত থাকা মেজর সিনহাকে উদ্দেশ্য করে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন এবং তার শরীরে লাথি মারেন। মৃত্যু নিশ্চিত হলে একটি ‘ছারপোকা গাড়ি’তে তুলে মেজর সিনহাকে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়।
মামলার অন্যান্য আসামিরা হলেন- বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, সহকারি উপপরিদর্শক (এএসআই) লিটন মিয়া, সহকারি উপপরিদর্শক (এএসআই) টুটুল ও কনস্টেবল মোহাম্মদ মোস্তফা।
মামলার আবেদনে আরও বলা হয়, সিনহার মৃত্যুর ঘটনাটি ধাপাচাপা দেয়ার জন্য ইয়াবা, গাজা ও সরকারি কাজে বাঁধা দেয়ার অভিযোগ এনে টেকনাফ থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়।
মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস আদালত থেকে বেরিয়ে বলেন, ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নির্দেশনা মতে পরিদর্শক লিয়াকত ঠান্ডা মাথায় গুলি করে আমার ভাইকে হত্যা করেছে।
তিনি আরো বলেন, পরে আমার ভাইয়ের শরীরে ও মুখে বিভিন্ন জায়গায় পা দিয়ে লাথি মেরে তার মুখ বিকৃত করার চেষ্টা করে। এসময় অন্যান্য আসামিরা তাদের সহযোগিতা করে। তাই তিনি আইনের আশ্রয় নিচ্ছেন বলে জানান।
বিষয়টি নিয়ে শুধু বাহারছড়া ইউনিয়ন নয়, পুরো দেশ ক্ষুব্দ। সব পেশাজীবী শ্রেণি সুষ্ঠু তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টামূলক শাস্তির দাবি জানান।