শালুক ফুলের লাজ নাই !! Part- 29
দেখতে দেখতে ২ মাস কেটে গেলো। শীতের তীব্রতা বাড়তে লাগলো। এরই মধ্যে ধ্রুবর ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলো। বন্ধুদের থেকে বেশ কিছু টাকা পয়সা ধার করতে হলো ধ্রুবকে যেই সময় শালুকের টাইফয়েড হলো।
ধ্রুবর তখন দিশেহারা অবস্থা। শালুক একা বাসায় থাকে,এদিকে নিজের পরীক্ষা, চাকরি,টিউশন।
কি করবে ধ্রুব ভেবে উঠতে পারলো না।
শেষে ঠিক করলো শালুকের সুস্থ হওয়া পর্যন্ত একজন মহিলা রাখবে বাসায়।ধ্রুবর অনুপস্থিতিতে সে যাতে শালুককে দেখে রাখতে পারে।
কিন্তু বললেই তো হয়ে যায় না কোনো কাজ।কাকে রাখবে,যাকে রাখবে সে কতোটুকু বিশ্বস্ত তা ও তো জানতে হবে।
শেষে ধ্রুব বাড়িওয়ালার কাছে গেলো। তাকে নিজের সমস্যা খুলে বলতেই তিনি তার বাসায় কাজ করে এরকম একজন মহিলাকে পাঠালেন।
তার কাজ হচ্ছে শালুককে সময়মতো ঔষধ খাওয়ানো, খাবার খাওয়ানো। শালুকের কিছু লাগলে এগিয়ে দেওয়া।এটুকুই কাজ তার।
প্রায় ১২ দিনের জ্বরে শালুকের চেহারা মলিন হয়ে গেছে, মাথার চুল সব ঝরে পড়ছে, ভীষণ শুকিয়ে গেছে শালুক।
ধ্রুবর ভীষণ কষ্ট হয় শালুকের দিকে তাকালে।
এক দিকে হাতে টাকা পয়সার টানাটানি, আবার অন্যদিকে শালুকের চিকিৎসা, বাসায় একজন মহিলা রাখায় তার মাসিক ৭ হাজার টাকা বেতন।
ধ্রুব তবুও নিজেকে সামলে নিলো। কিছুতেই ভেঙে পড়বে না বলে বারবার নিজেকে নিজে বুঝাতে লাগলো।
বিপদ যিনি দেয়,তিনিই আবার বিপদ মুক্ত করেন।
রোজ বাসায় যাবার সময় ধ্রুব ফল নিয়ে যায়,নিজের হাতে কেটে শালুককে খাওয়ায়।দিনে নিজে থাকতে পারে না যখন ঘন্টায় ঘন্টায় কল দিয়ে জিজ্ঞেস করে শালুক কি খেলো না খেলো।
অভাব অনটন, প্রেম ভালোবাসা সব কিছু নিয়ে দুজনের দিন কেটে যাচ্ছিলো।
কিন্তু এরই মধ্যে সমস্যা দেখা দিলো অন্য জায়গায়। বাড়িওয়ালা বাসা ভাড়া আরো দুই হাজার টাকা বাড়িয়ে দিলো।
সেই মুহুর্তে ধ্রুবর মনে হলো পায়ের নিচের মাটি সরে গেছে তার।
এমনতেই প্রায় ২২-২৩ হাজার টাকার মতো ধার করতে হয়েছে। কিন্তু বাড়ি ভাড়া আরো বাড়ানোর জন্য সংসার খরচ চার হাজার থেকে নামিয়ে দুই হাজারে আনতে হলো।
শালুকের এই মুহূর্তে পুষ্টিকর খাবার দরকার একদিকে।
ধ্রুব টিউশনি শেষ করে রাস্তার পাশে বসে রইলো।
এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে তার চাইতে অসহায় এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই।
নিজের ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার পরেও তাকে ভালো রাখতে পারছে না সে।
হতাশায় নিমজ্জিত হলো ধ্রুব।বাসায় যাওয়ার মতো অবশিষ্ট শক্তি ও যেনো তার দেহে নেই।
অনেকক্ষণ পথে বসে থাকার পর ক্লান্ত দেহটাকে টেনে নিয়ে গেলো কোনোমতে।
শালুক জেগেই ছিলো ধ্রুবর অপেক্ষায়। শালুকের শরীর এখন আগের চাইতে অনেকটা ভালো।ধ্রুবর আসতে দেরি হচ্ছে দেখে আজ নিজেই রান্না করেছে শালুক। বেশি কিছু রান্না করতে পারে নি, ভাত,ডাল,বেগুন দিয়ে শুঁটকি আর বেগুন ভর্তা বানিয়েছে।
ধ্রুবর হঠাৎ করে মনে হলো, এখন তো রান্না করতে হবে। এতো দেরিতে রান্না করলে শালুক কখন খাবে।
নিজের উপর ভীষণ রাগ উঠলো ধ্রুবর।এতোটা বেখেয়ালি হলো কিভাবে সে এটাই ভেবে পেলো না। কেনো এতোক্ষণ বাহিরে সময় নষ্ট করলো!
পরমুহূর্তে ঠিক করলো শালুকের জন্য হোটেল থেকে খাবার নিয়ে আসবে।নয়তো শালুকের খাওয়ার খুব দেরি হবে।
ধ্রুব কে আবারও বের হতে দেখে শালুক আটকালো।সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় যাচ্ছেন এখন আবার? এমনিতেই তো দেরি করে বাসায় ফিরেছেন।”
ধ্রুব মাথা চুলকে বললো, “একটু বাহিরে যাচ্ছি। রান্না করতে তো দেরি হয়ে যাবে,তোমার ও খেতে দেরি হবে তখন।তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসি গিয়ে। ”
শালুক হাত চেপে ধরে বললো, “কোনো দরকার নেই।আমি রান্না করেছি আজ।আসুন খাবার খাবো।”
ধ্রুব তাকিয়ে রইলো শালুকের দিকে। তারপর বললো, “তোমার রান্না করার কি দরকার ছিলো? তোমার শরীর এখনো ঠিক হয় নি শালুক। ডিম সিদ্ধ করেছো?”
শালুক মাথা নাড়িয়ে জানালো, করে নি।
ধ্রুব কথা না বাড়িয়ে চুলায় ডিম সিদ্ধ দিলো।তারপর ঢাকনা সরিয়ে দেখলো শুঁটকি রান্না করেছে শালুক। হতভম্ব হয়ে গেলো ধ্রুব।বাহিরে এসে জিজ্ঞেস করলো, “সত্যি তুমি রান্না করেছো শালুক? ”
শালুক বললো, “এতো অবাক হওয়ার কি আছে?আমি কি রান্না করতে পারি না না কি?খুব ভালো না হলেও তো,কিছুটা পারি।খাওয়া যায় আমার রান্না।আপনার মতো হয়তো সেরা রাঁধুনি না আমি। ”
ধ্রুব হতবাক হয়ে আবারও জিজ্ঞেস করলো, “সত্যি তুমি রান্না করেছো?”
শালুক বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,”সমস্যা কি?”
ধ্রুব মুচকি হেসে বললো, “তুমি শুঁটকি রান্না করেছ শালুক! এটাই তো আমার জন্য আশ্চর্যের ব্যাপার। ”
শালুক মাথা নিচু করে বললো, “আপনার তো অনেক প্রিয় একটা খাবার। তাই ভাবলাম একটু চেষ্টা করে দেখি।হালাল খাবারই তো এটা তাহলে কেনো এতো নাক সিঁটকাই।সেই জন্য রান্না করেছি।”
ধ্রুব হাসলো। তারপর বললো, “আমি জানি শালুক তুমি কেনো আজ শুঁটকি রান্না করতে চেষ্টা করেছ।ফ্রিজে মাছ মাংস কিছুই নেই।”
শালুক ধরা পড়ে গিয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। তারপর বললো, “আমার আর খেতে ইচ্ছে করে না এসব।প্রতিদিন কিভাবে মানুষ মাছ মাংস খেতে পারে আপনি বলুন?আপনি নিজেও তো পারেন না।প্রতিদিন আমাকে খাওয়ান,নিজে খান না ”
ধ্রুব চুপ হয়ে গেলো। শালুক আস্তে করে বললো, “ভাড়া বাড়িয়েছে বলেছে আপনাকে?”
ধ্রুব চমকে জিজ্ঞেস করলো, “তোমাকে এই কথা কে বলেছে?”
শালুক মুচকি হেসে বললো, “বাড়িওয়ালা আন্টি এসেছে বিকেলে।উনি বলেছেন।”
ধ্রুব খাবার সাজাতে সাজাতে বললো, “তোমার এসব নিয়ে ভাবতে হবে না।আমি আছি তো।”
শালুক খেতে খেতে বললো, “আপনার তো একটা টিউশন ছেড়ে দিতে হয়েছে। আমি আজকে বসে বসে হিসেব করেছি।আর আজকেই জীবনের বড় হিসেব মেলাতে পেরেছি।আপনার চিন্তার কারণ বের করতে পেরেছি। ”
ধ্রুব খাওয়া বন্ধ করে বললো, “কি বলছো তুমি? ”
শালুক হাসলো। জ্বরে কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখের নিচে কালি জমেছে শালুকের। চোখ বড় বড় লাগছে আগের চাইতে এখন।ধ্রুবর মনে হলো এই বুঝি বনলতা সেনের সেই পাখির বাসার মতো বড় বড় চোখ!
হেসে শালুক বললো, “আপনি আবারও নিশাকে পড়ানো শুরু করেন।”
ধ্রুব চোখ মুখ শক্ত করে বললো, “বাজে কথা বলবে না শালুক। ”
শালুক বললো, “আপনার মেইন চিন্তা তো এটাই,উপার্জন কমে গেছে,তার উপর সামনের মাস থেকে ভাড়া দিতে হবে ১৭ হাজার টাকা। আমি বুঝতে পারছি আপনার মানসিক পেরেশানি কতোটা এই মুহূর্তে। তার মধ্যে আমার ও এরকম জ্বর হলো। নিশ্চয় আপনাকে অনেক ধারদেনা করতে হয়েছে। এই সময়ে এতো খরচের মধ্যে আমার জন্য একজন বাড়তি মানুষ রাখতে হয়েছে। আমি খুব ছোট নই যে এসব বুঝবো না।”
ধ্রুব খাওয়া শেষ করে বললো, “এতটা বড় ও হয়ে যাও নি যে এতো চিন্তা তোমার করতে হবে এই সময়। আমি আছি তো।আমাকে ভাবতে দাও।”
খাওয়ার পর শালুকের ঔষধ এনে খাইয়ে দিলো ধ্রুব।বিছানায় শুয়ে তারপর বললো, “আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি শালুক। তোমাকে কোনো লেডিস হোস্টেলে উঠিয়ে দিই,আমি আমার হলে চলে যাবো।”
শালুক হতবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বললো, “আপনার কাছ থেকে এক চুল দূরে ও আমি যাবো না।এসব চিন্তা বাদ দিন আপনি। ”
ধ্রুব হাসলো। কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে বললো, “কাছে ও তো আসো না আমার। ”
শালুক তাকিয়ে রইলো ধ্রুবর দিকে। তারপর ধ্রুবর বুকে মাথা রেখে বললো, “এই যে কাছে আছি। ”
ধ্রুব শালুকের হাত চেপে ধরে বললো, “আরো কাছে আসা যায় না?যতো কাছে আসলে দুজন মিশে একাকার হয়ে যেতে পারবো? ”
শালুক লজ্জা পেয়ে মাথা লুকালো ধ্রুবর বুকে।ফিসফিস করে বললো, “ভীষণ ঠান্ডা পড়ছে।”
ধ্রুব ও শালুকের মতো ফিসফিস করে বললো, “তাহলে আরো ঠান্ডা লাগুক তোমার শালুক। ভীষণ ভীষণ ঠান্ডা লাগুক, যাতে আমি হই তোমার উষ্ণতার চাদর।”
প্রথমবারের মতো দুজনের মধ্যে ভীষণ ভালোবাসার লেনাদেনা হলো,প্রবল শীতের রাতে দুজনে একে অন্যকে উষ্ণ করে তুলতে লাগলো। সেই রাতে তৃপ্ত হলো দুজনের চাতক মন।
শালুক সকালে ধ্রুবকে বকতে লাগলো। ধ্রুব হাসতে লাগলো। এক অজানা সুখে ধ্রুবর দেহ মন তৃপ্ত হয়ে আছে।সোয়েটারের উপর শালুক চাদর জড়িয়ে নিলো।তবুও যেনো শীত কমছে না তার।
ধ্রুবকে সে কথা বলতেই ধ্রুব হেসে বললো, “আসো তাহলে, আবারও উষ্ণ করে দিই তোমাকে। ”
শালুক লজ্জায় লাল হয়ে বললো, “দূর,আপনি ভীষণ খারাপ। এর চাইতে ভালো আমাকে লেডিস হোস্টেলে উঠিয়ে দিন।”
ধ্রুব শালুকের পাশে বসে হেসে বললো, “এখন যে আমি কিছুতেই তোমাকে ছাড়বো না বোকা ফুল,ফুলটাকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিলে রাতে তার শীত করলে আমি তো তার শীত দূর করতে পারবো না। এখন যে তোমাকে আরো শক্ত করে বেঁধে ফেলতে ইচ্ছে করছে নিজের সাথে। ”
শালুক বললো, “একটা কথা বলি,রাগ করবেন না বলুন।”
ধ্রুব বললো, “আচ্ছা, বলো।”
শালুক বললো, “আমরা এই বাসাটা ছেড়ে দিই।এতো বড় বাসার তো আমাদের কোনো দরকার নেই তাই না?আমরা দুজন মানুষ। একটা রুম হলেও আমাদের চলে যাবে।অযথা ১৭ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে থাকার কি দরকার তাহলে? ছোট একটা বাসা নিন আপনি, এক রুমের হলে আরো ভালো হয়।এতে করে আমাদের সব দিক থেকেই সুবিধা হবে।”
ধ্রুব অপলক তাকিয়ে থেকে বললো, “অনেক বড় হয়ে গেছিস তুই শালুক। তোর মনে আছে, ছোট বেলায় এই তুই ভীষণ জেদ করতি আমার ছাদে একটা রুম আছে তোর নেই কেনো এটা নিয়ে। তুই বলতি তোর ভীষণ বড় রুম লাগবে।জোর করে ছাদের একটা ঘর দখল করেছিস তুই।আর আজ সেই তুই কি সুন্দর করে বলছিস একটা ছোট রুম হলেই চলবে।
সময় কেমন করে খেলে মানুষকে নিয়ে, তাই না শালুক?
ছিলি কোথায় রাজ বাড়িতে, আমার জন্য তোকে এখন থাকতে হচ্ছে গাছতলায়। ”
শালুক ধ্রুবর কাঁধে মাথা রেখে বললো, “সেখানে আমি রাজকন্যা ছিলাম,অতিথি ছিলাম।সেই রাজমহল আমার আজীবনের জন্য ছিলো না। এখন আমার যা আছে তা একান্তই আমার। এখানে আমি রানী,সর্বাধিকারী এই রাজ্যের। এটাই যে আমার জন্য চিরস্থায়ী ঠিকানা। আপনি সাথে থাকলে আমি সব জায়গায়, সব পরিবেশে থাকতে পারবো। আপনি ও তো ছিলেন সেই রাজ্যের যুবরাজ। আপনার যদি মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা থাকে আমার কেনো থাকবে না।”
ধ্রুব একটা চুমু খেয়ে বললো, “কথা দিচ্ছি শালুক,একদিন একটা রাজবাড়ী করে দিবো তোমায়।”
সেদিন আর ধ্রুব শো রুমে গেলো না,বহুদিন পর দুজন বের হলো বাহিরে।একই সাথে কিছুটা ঘুরাঘুরি ও হবে,বাসা দেখা ও হবে।
এবার আর রেষ্টুরেন্ট যাওয়া হলো না,টং দোকানের চা রুটি, ফুচকা,চটপটি খেয়ে আনন্দ চিত্তে দুজন বাসা খুঁজে বের করলো।
চলবে……
রাজিয়া রহমান