যদি তুমি জানতে !! Part- 07
আমার যা মনেহয় কেউ এখনো তোর উপর নজর রাখছে। আজ রাতে তুই একা ঘুমাবি না। ফিমাকে নিয়ে ঘুমা যা।
-ঠিক আছে।
রাতে আর কেউ আসেনি। আপু আমার সাথে শোয়ার পরও দরজা খোলা রেখেছি। বলা যায় না কখন কী হয়। সকাল বেলা ঘুম ভাঙলো সাঈদ ভাইয়ের চিল্লাচিল্লিতে। আপু ভার্সিটি চলে গিয়েছে। সাঈদ ভাই রুম থেকে- “নাবিলা নাবিলা” বলে ডেকেই যাচ্ছে।একাধারে ডাকছে তো ডাকছেই। থামছেনা।আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে সে যত শান্তি পায়!!
আজকে হাত পায়ের ব্যাথা অনেকটা কম।কোনোকিছু ধরে ধরে যেতে হয়নি। উঠে সোজা সাঈদ ভাইয়ের রুমে গেলাম। আমাকে দেখেই ভাইয়া একদম চুপ। এতক্ষন যে চিল্লাচিল্লি করল, উনার অবস্থা দেখে কেউ সেটা বলবে না। সাঈদ ভাই আমাকে কাছে আসতে বললেন। আর বললেন-
– নবাবজাদি ! তোর এখন ঘুম ভাঙে! সেই কখন থেকে গলা ফাটিয়ে চিল্লাচ্ছি!
– তোমাকে গরুর মতো ভ্যা ভ্যা করতে কে বলছে,শুনি!
-আবার মুখে মুখে কথা বলছিস! গদর্ভ মাথামোটা কথোকার! ঠিকমতো কথা বলতে না জানলে চুপ থাকিস! নাহলে গালে আরেক দফা পড়লে আমার দোষ দিতে আসবি না!
-ভাইয়া, এখন যদি খালামনিকে বলে দেই।।
-আম্মু বাসায় থাকলে তো।
-মানে?
-আম্মু মেজো খালামনির বাসায় গেছে। দিপের জন্য মেয়ে দেখতে গেছে। তুই এখন এইদিকে আয় আর আমাকে ওয়াশরুমে নিয়ে যা।
-ভাই কালকে যদি একা একা দোলনায় বসতে পারো, তাহলে একা একা ওয়াশরুমে যেতেও পারবে।যাও
-নাবিলা তর্ক করবি না। আমি এসব পছন্দ করি না। আসতে বলছি। আয়।
ধ্যাত্! কী আর করার!! সাঈদ ভাইয়ের কথা মতো উনাকে ওয়াশরুমে নিয়ে দাতঁ ব্রাশ করিয়ে মুখ ধুয়িয়ে দিলাম। রুমে আনলাম। সকালের খাবার প্লেটে নিয়ে তাকে খাওয়ালাম। নিজেও খেলাম।খেতে গিয়েও ইচ্ছেমতো জালিয়েছে। হয় আঙ্গুলে কামড় বসিয়েছে নাহয় ইচ্ছে করে মুখ থেকে খাবার ফেলে দিয়েছে। বিছানায় বসতেই আরেক দফা হুকুম-
-কাগজ পেন্সিল নিয়ে আয়। বড় দেখে কাগজ আনবি। ওখানে দেখ, টেবিলের বা দিকে রাখা আছে।
-আচ্ছা ভাই।
আদেশ মোতাবেক সব সরন্জামাদি এনে উনার পাশে বসলাম। আর বললাম-
-ভাইয়া নাও।
-তুই না দেখে ছবি আকঁতে পারবি?জাস্ট বিবরনটা মুখে বলব আর তুই আকবি।
-হ্যাঁ ভাই পারব।
-তোর চোখে যদি কাপড় বেধে দেই, তাহলেও পারবি?
-মানে বলতে চাইছো, তুমি বিবরন দিবে আর আমি না দেখে কাগজে আকব?
-ইয়েস। দ্যাটস ইট। পারবি তো?
-হ্যাঁ পারব। কিন্তু আমার একটা কন্ডিশন আছে।
-উল্টা পাল্টা কিছু চাইলে ধরে একটা আছাড় মারব!
-বর্তমানে তুমি ল্যাংড়া চাইলেও কিছু করতে পারবে না। হাহাহা
-এমন ডাইনির মতো হাসিস না! দাত খুলে হাতে ধরালে তোর জামাই ভয়ে পালাবে।এখন কন্ডিশন বল!
-ভাইয়া আমাকে দুবক্স ভর্তি চকলেট লাগবে।
-এহ্ ! মামার বাড়ির আবদার !
-মামা নেই এজন্যই খালাবাড়ির আবদার করছি।
-আগে কাজ তারপর চিন্তা করব ওই ব্যাপারে।
-তোমার কাছে চাওয়া আর খালি বদনা হাতে নিয়ে বাথরুমে বসে থাকা, একি কথা।
-ছি! কীসব থার্ড ক্লাস কথা বলছিস!সেন্স কি পানি দিয়ে গিলে খেলি নাকি। তুই কাজ করবি, নাকি করবি না খালি এটা বল।
-না না করছি। করছি আমি। করছি। ভাই।
.
.
সাঈদ ভাই মুখে মুখে বলছেন আর আমি চোখে পট্টি বেধে কাগজে একেঁ যাচ্ছি। আল্লাহই জানে আমাকে দিয়ে কী আকাচ্ছেন। কিন্তু একটা জিনিস খেয়াল করলাম। ছবি আকার বিবরনী তে ভাইয়া খুব সুন্দর করে বর্ননা করছেন। যেন মনের মধ্যে সেটার ছবি গেথে রেখেছেন খুব যত্নে।
চোখ বন্ধ। ভাইয়ার কন্ঠ শুনছি শুধু। কেমন জানি ঘোর লেগে যাচ্ছে তার মিষ্টি কন্ঠে। একটা মেয়েকে পাগল করার জন্য তার কন্ঠই যথেষ্ঠ। ভাইয়াকে না দেখে যে কেউ বলে দিবে ছেলেটা দেখতে সেইরকম সুন্দর। উনার কন্ঠে একটা, সৌন্দর্যের ঘোর লাগানো ক্ষমতা আছে। একবার শুনলে তা শুনার সাধ মিটবে না। কখনোই না!!
প্রায় আড়াই ঘন্টা ধরে সাঈদ ভাইয়ের বর্ননা অনুসারে ছবিটা আকলাম। কিন্তু কী আকলাম নিজেও জানি না!! চোখের পট্টি সরিয়ে দেখার চেষ্টা করছি কিন্তু ফলাফল শূন্য। ভাইয়া বাধা দিচ্ছেন। শেষে চোখের পট্টি পুরো খুলে দেখতে নিলে তার আগেই সাঈদ ভাই খপ করে কাগজটি নিয়ে গোল করে মুড়িয়ে নিলেন। আর বললেন-
-নাবিলা অনেক সুন্দর একেছিস। ঠিক যেমন চেয়েছি ওরকম। সুস্থ হলে এটা বাধাই করতে দিয়ে আসব। আসলেই !! তুই বাকিসব না পারলেও ছবিটা অনেক অনেক অনেক সুন্দর একেছিস!!
-ভাইয়া আমিও একটু দেখতে চাই। কী আকলাম এতক্ষন!!
-রুমে যখন টাঙ্গাবো তখন দেখিস।
-এখন দেখলে কি হবে?
-তোর ওই গোবর ভর্তি মাথাটা ফেটে মাটিতে গড়াগড়ি খাবে!গদর্ভ!
-ভাইইইইই তুমি!!!
দুপুরে খাইয়ে দেওয়ার পর আমার কোলেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে যায় ভাই। ভাইকে এই উছিলায় এতো কাছ থেকে দেখছি।।উনার গলায় একটা তিল আছে। দেখতে খুব আকর্ষণীয় !! ভাইয়া যে এখনো বিড়ি-সিগারেট ঠোঁটে ছোয়াননি সেটা তার গোলাপী সুন্দর ঠোঁটজোড়া দেখলেই বুঝা যায়।খুবই সুন্দর!! ছেলেদের ঠোঁট কি ওমন গোলাপি রঙের হতে হয় নাকি আজব!! ভাইয়া সব দোষ তোমার। এমন গোলাপী কেন তোমার ঠোঁট!! উফফ, সামলানো বড় দায়!!
এমনেই তুমি সুন্দর তার উপর তুমি আমার কোলে!! তোমাকে এলোমেলো চুলেই বেশি ভালো লাগে ভাই। এইযে দেখো!! তুমি ঘুমিয়ে আছো তবুও তোমার সিল্কি চুলগুলো চোখের উপর কপালে ছেয়ে আছে!!এতো সুন্দর দেখতে কেন তুমি ভাই!!
বিকেলের দিকে সাঈদ ভাইয়া আবদার করে বসলেন ছাদে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি এখন আগের থেকে কিছুটা হলেও সুস্থ। অন্তত একাই ঠিকমতো হেটে যেতে পারি। কিন্তু সাঈদ ভাই বেশি আঘাত পেয়েছেন বিধায় অনেকটা র্দূবল। সিড়ি দিয়ে উনাকে ধরে ধরে নিয়ে গেলাম। যদিও ভাইয়া ধরতে না করেছিলেন। ছাদে যেয়ে ডানদিকে বসার জায়গায় নিয়ে বসি। ভাইয়ার বামহাতের হাত ব্যান্ডেজ খুলে দেয়া হয়েছে। কেননা, ক্ষত জায়গা ভালোভাবে শুকাতে হবে। আর ডান হাতের অবস্থা নাইবা বললাম। কাচের ক্ষত এখনো ব্যান্ডেজ খুলার মতো নাহ্ ।
ভাইয়া আজ চুপ, নিঃশব্দ। কারনটা জানি না। দূর সীমানার নীল আকাশের বিকালটা আজ গভীর ভাবে দেখছেন তিনি। তাকানো অবস্থায় ভাইয়ার চোখদুটো খুব লোভনীয় লাগছে।মুগ্ধ হচ্ছি বারবার!! আমি তাকিয়ে তাকিয়ে আকাশ না দেখলেও সাঈদ ভাইকে অপলকভাবে দেখে যাচ্ছি। আজ তার ফর্সা গায়ের উপর সাদা টিশার্ট ঢেকে আছে। কপালে ব্যান্ডেজ করা, চুলগুলোকে ঠিক করার জন্য হাত পড়েনি। তবুও বাতাসে সিল্কি চুলগুলো কপাল বরাবর লুকোচুরি খেলছে। ভাইয়ার তালগাছ মার্কা ছয় ফিট হাইটটা যেন উনার জন্যই মানানসই। জিম করেননা তবুও এত সুন্দর বডি!! আচ্ছা এই ব্যক্তি কি পাগল করার সব প্রশিক্ষণ নিয়েছেন!!! সবসময় এমন কিছু রুপ দেখে মুগ্ধ হতে হয় যেটা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারিনা!!
হঠাৎ সাঈদ ভাই আকাশে তাকানো অবস্থায় বলে উঠলেন-
-নাবিলা দেখ আজ আকাশটা খুব সুন্দর না?
-আকাশ তো সবসময়ই সুন্দর ভাই।
-জানি। কিন্তু নাবিলা, আজ অন্য এক মার্ধুয্যের আচ্ছন্ন বিরাজ করছে। চোখ ফেরানো যাচ্ছেনা।
-হুম ভাই। ভাই একটা কথা বলি?
-বল।
-তুমি না আমার সাথে কথা বলা শুরু করলে বেশিরভাগ কথায় “নাবিলা” বলে শুরু করো।
-হুম। নামটা সুন্দর তাই। যা নিচে থেকে গিটার টা নিয়ে আয়।
-হঠাৎ গিটার কেন?…ভাইয়া প্লিজ তোমার হাত এখনো ঠিক হয়নি!!
-মুডটা নষ্ট করিস না যা বলছি!
-আনতেছি।
সাঈদ ভাইয়ের রুম থেকে তার গিটার আনতে যাব তখনই দেখি সেই কিউট বিড়ালটা। ভাইয়ার রুমের জানালার ওখানে বসে আছে। আমাকে দেখে বিড়ালটা জানালার ভেতর দিয়ে ঢুকে পূর্বের মতো আমার হাতে গা ঘষতে থাকে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এবারও সে আমার জন্য বড় চিরকুট নিয়ে আসে। রশি খুলে চিরকুট নিতেই সে হুড়মুড় বাইরের দিকে লাফিয়ে চলে যায়। তার চিন্তা বাদ দিয়ে চিরকুট খুলে দেখি তাতে কিছু লিখা। ঠিক এরকম-
“সময় আসছে, আমিও আসবো। তোমার চারপাশ আমিময় হবো”।
.
.
ছাদে যেয়ে গিটার সহ চিরকুট, সাঈদ ভাইয়ের হাতে দিয়ে সব ঘটনা বললাম। সাঈদ ভাই আমাকে বললেন-
-আমি এখনো মরিনাই।যে পযর্ন্ত আমি চারপাশে আছি, তোর কিচ্ছু হতে দিবনা ভয় পাবি না। গিটারটা দে।
-ভাইয়া যদি এই সময় ওই ব্যক্তি টা এখন এসে কিছু করে?
-তোর কাছে যাওয়ার আগে আমার উপর দিয়ে যেতে হবে। গিটারটা দে এখন।
-ডান হাত যে কাটা বাজাবে কীভাবে?
-আমি দুহাতেই সুর তুলতে পারি। তুই শুনলে বস না শুনলে চলে যা।
-না না আমি শুনব। এই প্রথম তোমার গান শুনব !! চান্স কীভাবে মিস করি ভাই!!
-চুপচাপ বস।
সাঈদ ভাই গিটার নিয়ে ধীরে ধীরে সুর তুলছেন। বেগ বাড়িয়ে সুর তুলতে তুলতে গান ধরলেন ভাই। উনার গিটারের প্রতিটা সুর যেন নিঃশব্দে তাল মিলাচ্ছে।ব্যক্ত করছে অনুভবের অনুভূতি!! চোখ বন্ধ করে মিশে যেতে লাগলাম সেই সুরের মোহনায়-
“আমার সকল অভিযোগে তুমি
তোমার মিষ্টি হাসি টাকি আমি,
আমার না বলা কথার ভাজে
তোমার গানের কত সুর ভাসে,
তোমায় নিয়ে আমার লেখা গানে
অযথা কত স্বপ্ন বোনা আছে,
আমার হাতের আঙ্গুলের ভাজে
তোমাকে নিয়ে কত কাব্য রটে…
..ভুলিনি তো আমি তোমার মুখে হাসি
আমার গাওয়া গানে তোমাকে “ভালোবাসি”
আসো আবার কাছে হাতটা ধরে পাশে
তোমায় নিয়ে যাব আমার পৃথিবীতে..
তোমার পথে পা মিলিয়ে চলা
তোমার হাতটি ধরে বসে থাকা
আমার আকাশে তোমার নামটি লেখা
সাদার আকাশে কালো আচ্ছাবনা..
তোমায় নিয়ে আমার লেখা গানে
অযথা কত স্বপ্ন বোনা আছে
আমার হাতের আঙ্গুলের ভাজে
তোমাকে নিয়ে কত কাব্য রটে..
…ভুলিনি তো আমি তোমার মুখে হাসি
আমার গাওয়া গানে তোমাকে “ভালোবাসি”
আসো আবার কাছে হাতটা ধরে পাশে
তোমায় নিয়ে যাব আমার পৃথিবীতে….”
চোখ বন্ধ রেখেই মনেমনে বলতে লাগলাম- ইশশ! ভাই থামলে কেন !!গানটা শুনিয়ে যাও না!! তোমার গানে যে নেশা ধরে যাচ্ছে!! যে নেশা আজ বন্ধ চোখেই অনুভব করছি!!
চোখ খুললাম। দেখি সাঈদ ভাইয়ের হাত থেকে রক্ত পড়ছে। এতক্ষন যে গিটারের তারে, উনার কাটা হাত ডুবিয়ে এত সুন্দর গান শুনালেন এখন সেটার ফল। রাগ উঠছে আমার! গিটারের তারে হাত কাটার জন্য কি ব্যান্ডেজ খুলে দিছিলাম! দরকার কি এমন গান শুনানোর যেটায় নিজের ক্ষতি !!
সাঈদ ভাই বসেই আছেন যেন উনার কিছুই হয়নি। কেমন আজব মানুষ!!আমি দৌড়ে রুম থেকে ফাষ্ট এড বক্স এনে ব্যান্ডেজ করতে নিলে ভাই বললেন-
-কীরে এতো অস্থির হচ্ছিস কেন? মরে যাচ্ছি না।
-চুপপ! একদম চুপ! নির্লজ্জ, বেহায়া কোথাকার! হাত কাটার জন্য কি গিটার এনে দিছিলাম! আবার হাত কেটে চুপ মেরে বসে আছেন!
– নাবিলা তুই রাগ করছিস?
-নাহ্ আমি তো আদর করছি!
-এ আবার কেমন আদর?
-লাল মরিচের মশলা মাখা আদর! বেশশরম! ফালতু লোক কথাকার !
-চলবে