সে কি জানে

সে কি জানে Season 2 ! Part– 35

৪৩.
পরেরদিন রাহুল আহমেদের বিজনেস ডিলের জন্য অন্য দেশে যাওয়ার কথা হলেও সেটা আপাতত স্থগিত হয়ে যায়। আরও ১মাস পরে যেতে হবে তার। এ সুযোগে তিনি রেয়ানের বিয়ে দিয়ে দিতে চান। ১মাস সময় তো আছেই! তাহলে এত দেড়ি করে লাভ কি? বিয়ে দেওয়াই বরং উচিত হবে। তাছাড়া তার ছেলে যে উতলা হয়ে আছে, তার কথা না বললেই নয়। রোজ দিনে কয়েক’শ বার বিয়ের ব্যাপারে নীলা রাহমানের সাথে কথা বলে রেয়ান। যা শুনতে শুনতে এখন নীলা রাহমানও ত্যক্ত! তাই রাহুল আহমেদ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কাল মীরার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবেন। তবে এ সম্পর্কে এখনও কেউ অজ্ঞাত নয়। রাতে নীলা রাহমানকে বলবেন উনি। একেবারে শেষে তার বেহায়া ছেলেকে জানাবেন।ছেলেটাকে খুবই বিরক্ত লাগে তার। সব বিষয়ে রেয়ানের অত্যাধিক জেদ আর রাগ। যা মোটেও পচ্ছন নয় রাহুল আহমেদের। যদি পারতেন তাহলে রেয়ানকে ছাড়াই তিনি মীরার বিয়ে দিয়ে দিতেন। কিন্তু আফসোস! বর ছাড়া তো আর বিয়ে হয় না। তাই তার এ ইচ্ছাও যে পূরণ হবে না সেটা তিনি খুব ভালো করেই জানেন।
________________
ঘুম ভাঙ্গে সকাল ৭টা নাগাত। আড়মোড়া ভেঙ্গেই নিজের নিত্যদিনের কাজ রেয়ানকে মেসেজ দিয়ে “শুভ সকাল” জানিয়ে দিলাম আমি। মাথা চুলকাতে চুলকাতে ঘড়ির দিকে তাকালাম একবার। চোখ বন্ধ করে ফেললাম ততক্ষনাত। ঘুম ভেঙ্গে গেলেও ঘুমের রেশ এখনও কাটেনি আমার। ঘুমাতে ইচ্ছে করছে আবার। হঠাৎ মনে পরে গেল আবদ্ধের কথা! আজ বিকেলে একটা মিটিং আছে আমাদের। সে বিষয়ে কিছু ফাইল ঠিক করতে দিয়েছিল আবদ্ধ আমাকে। কালকে অর্ধেক করেছিলাম আমি। আর অর্ধেক বাকি আছি। চট জলদি দাঁড়িয়ে গেলাম বিছানা থেকে। দীঘিকে ভর্তি করিয়ে ভার্সিটি যাবে আবদ্ধ। সেখান থেকেই বিকেলে একেবারে মিটিং-এ পোঁছাবে। তাই আমাকে সকাল নাগাত ফাইলগুলো রেডি করে দিয়ে দিতে বলেছিল সে। অথচ আমি এখনও কাজ শেষ করি নি। নিজের ওপর এখন নিজেরই রাগ লাগছে। এতটা কেয়ার লেস কেন আমি? সবকিছু গুলিয়ে ফেলি সবসময়! ফ্রেশ না হয়েই তাড়াতাড়ি লেগে গেলাম কাজে। বেশি সময় নেই আমার কাছে। ৯টার ভেতরে আবদ্ধকে জমা দিতে হবে এগুলো।
৪৪.
নিজের রুমে রেডি হচ্ছে আবদ্ধ। ঠিক সে রেডি হচ্ছে বললে ভুল হবে, কাউকে জোড় করে রেডি করিয়ে দিতে হচ্ছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আবদ্ধ। আর ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে দীঘি। হাতে টাই তার! আবদ্ধের আদেশ তাকে টাই পড়িয়ে দিবে দীঘি। দীঘি তাই-ই করছে। সে আবদ্ধকে টাই পড়াতে নিলেই আবদ্ধ কোমড় জড়িয়ে ধরে তার। দীঘি একটু চমকালেও পরক্ষনে নিজেকে সামলে নেয় সে। টাই পড়িয়ে দিতে শুরু করে আবদ্ধকে। আর আবদ্ধ! সে পর্যবেক্ষণ করছে তার পিচ্চি বউকে। ইদানিং বেশিই বউ বউ লাগে দীঘিকে। দীঘির শাসণ, বকা, অভিমান আর ভালোবাসা সব যেন একটা নতুন দীঘিকে আবিষ্কার করে আবদ্ধর সামনে।
টাই পড়ানো শেষে আবদ্ধ থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালো দীঘি। আবদ্ধ ভ্রুঁ কুঁচকায়। সাথে সাথে দীঘি বলে উঠে…
— “সব কাজ তো শেষ। এখন আমি যাই?মামনিকে কাজে সাহায্য করতে হবে তো!”
আবদ্ধের ভ্রুঁ কুঁচকানো যেন আরও প্রকট আকার ধারণ করল। দীঘিকে টেনে হাতে চিরুনি ধরিয়ে বলে উঠল সে…
— “মাথা কে আঁচড়িয়ে দিবে? তোর কাজের বুয়া?”
মুখ মলিন করে ফেলল দীঘি। মন খারাপ করে বলে উঠল…
— “এভাবে বলেন কেন?”
— “তাহলে কিভাবে বলব?”
আবদ্ধ একটু থামলো। পরক্ষনেই আবার বলে উঠল…
—” মহারাণী কাজ এখনও শেষ হয়নি। একটু কি আমার মাথা আঁচড়িয়ে দিবেন প্লিইইজ!”
কথাটা অনেকটাই বেঙ্গ করে বলল আবদ্ধ। দীঘি মুখ ভেঙ্গচালো। চুল আঁচড়িয়ে দিলো আলতো ভাবে। সরে জেতে নিলে তাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল আবদ্ধ। ঘাড়ে নাক ঘষতে ঘষতে বলে উঠল…
— “আজকে অনেক কাজ বুঝলি পিচ্চি। কালকে তোর স্কুলের হেড মাস্টারের সাথে কথা বলেছি। উনি বলেছেন, তোকে এখনও ১০ম শ্রেণীতে ভর্তি করানো যাবে। একটা সীট খালি আছে এখনও। তাই আর দেড়ি করছি না বুঝলি। এখন স্কুলে যাবো তোর। তোকে ভর্তি করাতে! তাছাড়া তোকে পড়ালেখা করিয়ে বড় করতে হবে তো। তা না হলে যে আমাদের কিউট কিউট বেবি হবে না।”
দীঘি ভ্রুঁ কুঁচকালো। বলল…
— “পড়ালেখার সাথে বেবির কি সম্পর্ক?”
— “পড়ালেখা না করলে তো তুই বড় হবি না।”
তাও যেন আবদ্ধের কথা বুঝলো না দীঘি। বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল মাত্র। আবদ্ধ মুচকি এসে সরে এলো। দীঘির নাক টেনে বলল….
— “বাসায় আসতে কিন্তু আমার দেড়ি হবে পিচ্চি। প্রথমে তোকে ভর্তি করাবো। তারপর নিজের ভার্সিটি যাবো। সেখান থেকে আবার বিজনেজ মিটিং। এরপর সবশেষে আমার পিচ্চি বউটার জন্য আইস্ক্রিম নিয়ে বাসায় ফিরবো। কেমন?”
দীঘির মুখে হাসি ফুটে উঠল নিমিষেই। অতিরিক্ত আনন্দে একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল সে। আবদ্ধের গালে “টুপ” করে একটা চুমু এঁকে দিলো সে। আবদ্ধ স্তব্ধ! কি হয়েছে বুঝতে পারছে না। তার হাত একটু আলগা হয়ে আসতে দীঘি দৌঁড়ে বেড়িয়ে যায় রুম থেকে। ইসস! কি কাজটাই না করল সে। আবদ্ধের সামনে এখন কিভাবে যাবে সে?
৪৫.
৯টা বাজার কিছুক্ষন আগেই ফাইলগুলো দেখা শেষ হয়ে যায় আমার। এখন একটু শান্তি শান্তি লাগছে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে ফাইলগুলো হাতে নিয়ে চলে গেলাম নিচে। সবাই নাস্তা খাওয়া শুরু করেছে মাত্র। তবে আবদ্ধ আগেই নাস্তা খাওয়া শেষ করে রেডি হয়ে বসে আছে সোফায়। তার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। ফাইলগুলো তার হাতে দিয়ে সোফায় বসতে বসতে বলে উঠলাম…
— “দেখ তো ফাইলগুলো ঠিক আছে নাকি? তাড়াহুড়োয় দেখেছি সব!”
আবদ্ধ হাসলো। বলল…
— “তোমার কাজে ফল্ট ধরা আমার পক্ষে সম্ভব না মীরাপু।”
— “তাও একটু দেখেনিস।”
— “আচ্ছা। এখন তাহলে আসি আপু। রাতে দেখা হবে।”
— “সাবধানে থাকিস।”
চলে গেল আবদ্ধ। যাওয়ার আগে দীঘির দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ মারলো সে। যা চোখ এড়ালো না আমার। আমি হাসলাম মাত্র। নাস্তা খেয়ে চলে গেলাম রুমে। রেডি হতে হবে। অনেকদিন ভার্সিটি যাওয়া হয় না। যেতে হবে।
রেডি হয়ে নিলাম তাড়াতাড়ি। সবাইকে বিদায় জানিয়ে বেড়িয়ে গেলাম বাসা থেকে। বাসার একটু সামনে এগুতেই আমি অবাক! রেয়ান দাঁড়িয়ে আছেন। প্যান্টের পকেটে হাত রেখে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন উনি। চোখে তার সানগ্লাস। আমাকে দেখেই মিষ্টি হাসলেন রেয়ান। বললেন…
— “শুভ সকাল মরুভূমি!”
বিনিময়ে আমিও হাসলাম। বললাম…
— “হাসপাতালে যাবেন না আজকে?”
— “যাবো। তোমাকে ভার্সিটি দিয়ে আসি।”
ভ্রুঁ কুঁচকে এলো আমার। উনি কিভাবে জানলেন আমি ভার্সিটি যাবো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম আমি। উনি হয়তো বুঝে গেলেন আমার মনে কি চলছে। ভাব নিয়ে বললেন…

— “আমি কিন্তু আমার মরুভূমির এক একটা স্টেপ সম্পর্কে খবরাখবর রাখি। তাই আজকে যে তুমি ভার্সিটি যাবে সেটা কিন্তু আমার জানারই কথা।”
বলেই বাঁকা হাসলেন উনি। আমিও ভাব নিয়ে বললাম…
— “সব মিথ্যা কথা। আপনি এমনি এমনি আমার বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হয়তো সারপ্রাইজ দিতে! বাট যখন দেখলেন আমি ভার্সিটি যাবো, তখনই আমাকে ভার্সিটি পৌঁছে দিতে চাইছেন।”
রেয়ান এবার চোখ-মুখ কুঁচকিয়ে বললেন…
— “ডোন্ট টেল লায় মরুভূমি। তুমি জানো সত্যটা কি! যাই হোক, এখন বলো দিহানের সাথে কথা বলেছ?”
— “কোন ব্যাপারে?”
— “আজকে বিকালে ওর সাথে দেখা করার কথা আমাদের। ভুলে গেছ?”
আসলেই তো! ভুলে গিয়েছিলাম আমি। রেয়ান না বললে হয়তো মনেই থাকতো না আমার। ক্ষাণিকটা বিরক্ত হলাম নিজের ওপর। রেয়ান আবারও বলে উঠলেন…
— “বিকালে হাসপাতালের কাজ শেষ করে আমি তোমাকে নিতে আসবো। তুমি দিহানকে সাথে নিয়ে এসো। কিন্তু কোথায় যাবে? রেস্টুরেন্টে?”
— “না, কথা বলার জন্য দিহানের সবসময়ই শান্ত পরিবেশ পছন্দ। দীঘির স্কুলের পাশে একটা নদী আছে রেয়ান। ওখানে গেলে কেমন হবে?”
— “ভালো হবে।”
এতটুকু বলেই রেয়ান চুপ হয়ে গেলেন৷ ক্ষাণিকটা মন খারাপ করে বলে উঠলেন…
— “তুমি সবার ব্যাপারেই কম-বেশি জানো মরুভূমি। কিন্তু আমার ব্যাপারে মোটেও তেমন কিছু জানো না।”
কথাটা বলার সময় রেয়ান মুখটা কেমন যেন বাচ্চা বাচ্চা করে ফেললেন। যা দেখে হাসলাম আমি। তার গাল টেনে বললাম…
— “আপমাকে আমি সবচেয়ে বেশি জানি রেয়ান। আমার সব আপন জন থেকেও বেশি। কেন বলুন তো?”
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন রেয়ান। আমি আবারও হেসে বললাম…
— “কারন আপনি আমার অভিমান, আমার প্রিয়জন, আমার ভালবাসা।”
রেয়ানের মলিন মুখে এক চিলতি হাসি ফুটে উঠল। যা ক্রমশই তীব্র হচ্ছে। এ প্রথম তার মরুভূমি তাকে বলেছে, সে তাকে ভালোবাসে। খুশিতে কেমন যেন উত্তেজিত হয়ে গেলেন রেয়ান। আমার দিকে একটু ঝুঁকে কপালে আলতো করে ঠোঁটের স্পর্শ এঁকে দিলেন। কানের কাছের চুলগুলো আরেকটু ভালোভাবে গুঁজে দিলেন কানে। মিষ্টি করে হেসে বললেন…
— “চলো তোমাকে ভার্সিটি দিয়ে আসি।”

________________
ভার্সিটি যেতেই দিহানের সাথে দেখা হয়ে গেল আমার।মিষ্টি হেসে আমার দিকে এগিয়ে এলো সে। ভাঙ্গা গলায় বলে উঠল…
— “কেমন আছো মীরু?”
— “আলহামদুল্লাহ। তুমি?”
বিনিময়ে দিহান হাসলো মাত্র। আমি আবারও বললাম…
— “ভার্সিটি ছুটির পর আমার সাথে একটা জায়গায় যেতে পারবে দিহান? জরুরি কথা ছিল।”
দিহান তাচ্ছিলের সঙ্গে বলে উঠল…
— “তোমার রেয়ান কিছু বলবে না?”
আমি মৃদু সরে বললাম…
— “রেয়ানও যাচ্ছেন আমাদের সাথে দিহান।”
দিহানের হাসি উবে গেল মুহুর্তেই। চোখে পানির কণা জমা হতে শুরু করল তার। আমার দিকে এক’পা এগিয়ে আসতেই আমি দু’পা পিছিয়ে গেলাম। কষ্ট পেল সে। একটা লম্বা শ্বাস টেনে বলল…
— “তুমি কি আমার সাথে বোঝাপড়া করতে চাইছো মীরু? নাকি কঠিন কোনো সত্যের সম্মুখীন করাতে চাইছো?”
— “যদি বলি দুটোই!”
“থ” মেরে দাঁড়িয়ে রইল দিহান। সে হয়তো কল্পনা করেনি এমন কিছুও হতে পারে। নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করল দিহান। মুখে মেকি হাসির রেখা টেনে বলল…
— “আমি প্রস্তুত মীরু।”
আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না সে। আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আমি ফ্লোরের দিকে শুণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম মাত্র! নিজেকে অনেক সার্থপর মনে। আচ্ছা আমার জন্য সবাই এত কষ্ট পায় কেন? প্রথমে আমার জন্য বাবা-মা মারা গেলেন, আমার জন্য আবদ্ধের পড়ালেখা ছাড়তে হলো, আমার জন্য আবদ্ধ আর মামী কষ্ট পেয়েছিল, এখন দিহান পাচ্ছে, আর মাঝে মাঝে ঠিক আমার জন্যই রেয়ান কষ্ট পান। এতগুলো মানুষের কষ্টের কারন আমি। শুধু মাত্র আমি। মাঝে মাঝে মন চায় দূরে কোথাও চলে যাই। তবে তা কি সম্ভব? মোটেও না। আমি যে তাদের ছাড়া শূণ্য। তাদের ছাড়া বেঁচে থাকা যে অসম্ভব আমার জন্য। ভাবতেই কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো!
________________
ভার্সিটি শেষে আমি, দিহান আর রেয়ান চলে এলাম দীঘির স্কুলের পাশের সেই নদীর পাড়টায়। তিনজনের মাঝেই এক বিশেষ ধরণের নিরবতা বিরাজ করেছে। দিহান বেশ কয়েকবার আমাকে আর রেয়ানকে আড়চোখে দেখছে। পরক্ষনেই মাটির ঘাসগুলোর দিকে তাকিয়ে কেমন করে যেন হাসছে সে। যার মানে বুঝতে পারছেন না রেয়ান। নিরবতা ভেঙ্গে রেয়ান এবার বলে উঠেন…
— “কেমন আছো দিহান?”
প্রতিউত্তরে আগের সেই হাসিটা হাসলো দিহান। রেয়ান আবার বললেন…
— “তুমি মীরাকে ভালোবাসো তাই না?”
চমকালো দিহান। রেয়ানের গলার সর একদম শান্ত। নিজের প্রেমিকাকে একজন ভালোবাসে, আর সে তার সামনে আছে তা জানা সত্ত্বেও তাকে এমন প্রশ্ন রেয়ান এত শান্ত ভাবে কিভাবে করছেন? কিঞ্চিত অবাক হলো দিহান। মৃদু সরে বলল…
— “হুম!”
রেয়ান এবার কিছুটা গম্ভীর হলেন। তবে তার কণ্ঠ আগের নেয়ই শান্ত। উনি দিহানকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন…
— “তুমি হয়তো ভাবছো আমি এখনও এত শান্ত কিভাবে? সত্যি বলতে আমি রেগে আছি। ভেতরে ভেতরে অনেকটাই রেগে আমি। ইচ্ছে করছে তোমার গালে জোড়ে জোড়ে কয়েকটা চড় বসিয়ে দি।”
থামলেন রেয়ান। নিজেকে স্বাভাবিক করলেন আবার। বললেন…
— “তুমি অনেক শান্ত ছেলে দিহান। তোমার জায়গায় আমি হলে অনেক কিছুই করে ফেলতাম। জেদ আর রাগ আমার ভেতর কুড়ে কুড়ে আছে। যার ছিটে ফোটেও তোমার মধ্যে নেই৷ মীরা কিন্তু এমন ছেলেদেরই পছন্দ করে। কিন্তু তাও সে তোমার হলো না। কেন ? কারন মীরা তোমার জন্য তৈরি নয়। আমি বলব না মীরা আমার জন্যই তৈরি। তবে প্রত্যকটা মানুষের জন্যই বিধাতা একজনকে তৈরি করে থাকেন। তোমার জন্যও হয়তো কেউ আছে। তাই বলবো নিজেকে এভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিও না। তুমি দেখতে যতটা স্বাভাবিক ভেতর থেকে কিন্তু তার চেয়েও অস্বাভাবিক। এসব মানুষরা কিন্তু বেশিদিন বেঁচে থাকে না। তোমাকে একজন ভাই হিসেবে বলছি দিহান। স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় ফিরে আসো। নাহলে এক সময় নিঃশেষ হয়ে যাবে। যা তোমার হওয়ার নয় তার পেছনে নিজের সময় নষ্ট করো না। বিধাতার কাছে শুকরিয়া আদায় করো।”
থামলেন রেয়ান। আমার হাতটা শক্ত করে ধরে আবারও বলে উঠেন…
— “তুমি যদি মীরাকে সত্যিই ভালোবাসো তাহলে নিজেকে আবার আগের মতো গড়ে তুলো দিহান। কেননা ভালোবাসার মানুষের জন্য এতটুকু করাই যায়। আর মীরার খুশিও কিন্তু সেখানে। মীরা তোমাকে প্রিয়জন হিসেবে ভালো না বাসলেও একজন বন্ধু হিসেবে অনেক ভালোবাসে। তোমার এ অবস্থার জন্য ও প্রতিনিয়ত নিজেকে দায়ী করে। ওর খুশীর জন্য হলেও তোমাকে স্বাভাবিক হতে হবে দিহান। নিজের জন্য কাউকে খুঁজে নিতে হবে।”
হঠাৎ দিহান বলে উঠল….

— “জেনিকে আপনার কেমন লাগে?”
ভ্রুঁ কুঁচকে এলো রেয়ানের।দিহানের প্রতি এক অজানা সন্দেহ জাগলো মনে। তবে তা প্রকাশ করলেন না উনি। দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলেন…
— “মনের দিক দিয়ে জেনি অনেক ভালো একটা মেয়ে। ছোট বেলায় বাবা-মার সঠিক শাসণ না পেয়ে এমন হয়ে গেছে সে। যখন যা চেয়েছে তা পেয়ে যাওয়ায় এক ধরণের জেদ আছে ওর মধ্যে। তবে আমি মনে করি সঠিক শাসণে আর ভালোবাসায় ওর সব জেদ, রাগ দূর করা যাবে। সত্যি বলতে ও অনেক ভালো মেয়ে। বলতে পারো, বাইরে থেকে খারাপ কিন্তু ভেতর থেকে ভালো।”
কথাটা বলেই আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে গেলেন রেয়ান। মুচকি হেসে বললেন…
— “আসি তাহলে।”
দিহানও মুচকি হাসলো। রেয়ান আমার হাত টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন গাড়ির দিকে। দিহানের দিকে একবার তাকালাম আমি। তার মুখে বেদনা ভরা এক হাসি। তবে চোখে পানি নেই। কেন যেন মনে হচ্ছে সে আমাকে চোখে দিয়ে বলছে- “আমি আবার আগের মতো হওয়ার চেষ্টা করব মীরু” আমার মাঝে এক প্রশান্তি খেলে গেল মুহুর্তেই। দিহান থেকে চোখ সরিয়ে রেয়ানের দিকে এবার তাকালাম আমি। মানুষটা আসলেই অন্যরকম। ভীষণ অন্যরকম! এ মানুষটাকে ভালোবাসি আমি। অনেক অনেক ভালোবাসি। ভাবতেই মুখে হাসি ফুটে উঠল আমার।
_________________
এদিকে দিহান তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। কেমন যেন হালকা হালকা লাগছে নিজেকে। তার মীরু তাকে প্রিয়জন না হলেও বন্ধু হিসেবে ভালোবাসে। এটাই যে তার জন্য অনেক। সে নিজেকে আগের মতো স্বাভাবিক করে ফেলবে। মীরুর জন্য হলেও আগের মতো হয়ে যাবে সে। মনটা একটু হালকা হলেও কোথাও যেন একটা অশান্তি রয়েই গেছে দিহানের। রেয়ানকে সে কেন জেনির কথা জিজ্ঞেস করেছে? তার তো পছন্দ না মেয়েটাকে। তাহলে? আবার জেনি আজকে ভার্সিটি না আসায় কেমন খালি খালি লাগছে তার। এমন কেন হচ্ছে? সে কি সত্যিই জেনিকে পছন্দ করতে শুরু করেছে? হয়তো! মীরার পাশাপাশি একটা আলাদা জায়গা মনে তৈরি হচ্ছে জেনির জন্য তার। দীর্ঘশ্বাস ফেলল দিহান। যা হচ্ছে তা হতে দিবে সে। আটকাবে না। তারও যে একটা বাঁচার মাধ্যম প্রয়োজন!
.
.
চলবে…