সে কি জানে

সে কি জানে Season 2 ! Part- 36

৪৬.
পাত্রপক্ষের সামনে বসে আছি আমি। পাত্রপক্ষ বলতে রেয়ানের পরিবার। দ্বিতীয় বার উনাদের সামনে আসলেও কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে আমার। এদিকে রেয়ান বারবার চোখ টিপ দিয়ে যাচ্ছেন আমায়। যা বিরক্তির শেষ প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। উনি এত বেহায়া কেন? নিজেকে নিজে প্রশ্ন করতেই মনটা হেসে ওঠে একবার। এই বেহায়া মানুষটাকেই যে ভালোবাসি আমি!
রেয়ানের পরিবারের সাথে আজকে একজন নতুন সদস্য এসেছেন আমাকে দেখতে। তিনি হলেন রেয়ানের দাদী। খুবই রসিক একজন মানুষ। বাসায় আসতে না আসতেই নিজের এক অচেনা শাসণ আর ভালোবাসা দিয়ে আমাদের সবাইকে মুগ্ধ করে দিয়েছেন মুহুর্তেই। নানা ধরণের প্রশ্ন করছেন আমাকে। “আমি এখনও পড়ালেখা করছি নাকি, পড়ালেখা শেষ করে কি হতে চাই, তাকে আমার ভালো লেগেছে কিনা” এসব। আমি খুবই নিচু সরে সেগুলোর উত্তর দিচ্ছি। কেন যেন কণ্ঠনালী থেকে সর-ই বের হচ্ছে না আমার। যা দেখে মিটিমিটি হাসছে রেয়ান আর আবদ্ধ। দু’জনেই যেন একই কেটাগেরির অসভ্য! এক কথায় দুই কথায় এবার দাদী আমাকে আর রেয়ানকে আলাদা কথা বলার জন্য ছাদে নিয়ে যেতে বলতেই রেয়ান যেন খুশিতে গদগদ। তবে রাহুল আহমেদের এসব মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। তিনি চান না এই বেহায়া ছেলে তার বউমার আশেপাশেও থাকুক। বিয়ে দিলে কি হয়েছে? বিয়ের পর তিনি মোটেও রেয়ানকে আমার সাথে থাকতে দিবেন না। তার ছেলে তার সাথে যা করেছে তার ফল তিনি হাড়ে হাড়ে বোঝাবেন তার বেহায়া ছেলেকে। এক রকম গর্জে ওঠে রাহুল আহমেদ বলে ওঠেন…
— “ওদের কোনো আলাদা কথা বলতে দেওয়া যাবে না। বিয়ের আগে এসব আমার একদমই পছন্দ না।”

উনার এমন কথা শুনে অবাক হলাম উপস্থিত সবাই। রেয়ানের তো রিতিমতো মুখটা গম্ভীর হয়ে গেছে। সে বেশ বুঝতে পারছে তার বাবা তাকে কোনোভাবেই আলাদা ভাবে কথা বলতে দিবে না। রাহুল আহমেদের তো একটাই লক্ষ্য- “আমার ছেলে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ডাক্তার হয়েছে না? এবার তাকে বিভিন্ন ভাবে শাস্তি দিবো আমি।” যা এখন করছেন উনি। এদিকে রেয়ান কিছু বলতেও পারছেন না। মামী বসে আছেন সামনেই। মামীর সামনে নিজের বাবার সাথে তর্কাতর্কি করা এক ধরণেই বেয়াদবি হবে। যা উনি করতে চাচ্ছেন না। মোটেও না! রাহুল আহমেদের এমন কথায় সবাই অবাক হলেও কিছু বলছি না কেউ। তবে দাদী বেশ চটে গেছেন। রেগে তিনি বলে উঠেন…
— “বিয়ের আগে তুই কয়বার বউমার সাথে দেখা করেছিস বল তো? আমার দাদুভাই দেখা করলেই দোষ? তুই করলে ষোলো আনা আর অন্যজন করলে এক আনাও না। এটা কেমন কথা?”
পরের বাড়িতে মায়ের এমন কথা শুনে ক্ষেপে যান রাহুল আহমেদ। সবার সামনে এমন করে কেউ বলে? এটা তো এক ধরণের অপমান। ঘোড় অপমান! চেহারায় বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠল রাহুল আহমেদের। চরম বিরক্তি নিয়ে নীলা রাহমানের দিকে তাকালেন একবার। পরক্ষনেই নিজের মায়ের দিকে তাকালেন। ফিসফিসিয়ে তার কানে বলে উঠলেন…
— “আমি আর আমার ছেলে কি এক হলাম মা? তোমার আদরের দাদুভাই হলো একটা বান্দর। আমাকে কি তোমার বান্দর মনে হয়?”
দাদী বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলেন…
— “বান্দর থেকেই কিন্তু বান্দরের সৃষ্টি।”
দমে গেলেন রাহুল আহমেদ। নিজের মায়ের সাথে কথায় জীবনে পেরে উঠেন নি তিনি। তাই এবারও যে পারবেন না, সেটা জানা ছিল তার। তবুও পেরে উঠার একটু প্রয়াস করেছিলেন মাত্র! নিজের মার থেকে চোখ সরিয়ে সবাইকে একবার দেখে নিলেন উনি। কেউ কি তাদের কথপোকথন শুনে ফেলেছে নাকি? শুনলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। তবে কাউকে দেখে তো মনে হচ্ছে না কেউ শুনেছে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন রাহুল আহমেদ। মামীকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন…
— “তাহলে বিয়েটা হচ্ছে?”
— “জ্বী…জ্বী অবশ্যই।”

দাদী ভ্রুঁ কুঁচকালেন। সাথেও রেয়ানও। দাদী কিছু বলতে যাবেন তার আগেই রাহুল আহমেদ দাঁড়িয়ে গেলেন। চড়া গলায় বলে উঠলেন…
— “তাহলে এখন আসি। বাসায় গিয়ে বিয়ের ডেট-টা জানিয়ে দিবো আপনাকে।”
বলেই হনহন করে বেড়িয়ে গেলেন রাহুল আহমেদ। যাওয়ার আগে কড়া দৃষ্টিতে রেয়ানের দিকে তাকিয়ে ছিলেন একবার। যার অর্থ- “আর এক মুহুর্তও যদি তুমি এখানে থাকো কিংবা আলাদা কথা বলার চেষ্টা করো তাহলে তোমার বিয়েটাই হতে দিবো না আমি।” রেয়ান রাগলেন ক্ষাণিকটা। পরক্ষনেই শান্ত হয়ে গেলেন আবার। আমার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উঁচু করে চুমু দেওয়ার ভঙ্গিমা করলেন।সাথে সাথে আমি নিচু সরে বলে উঠলাম- “ছিঃ!!” হাসলেন রেয়ান। আবারও একই কাজ করে বেড়িয়ে গেলেন বাসা থেকে।
৪৭.
দিহানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে জেনি। চোখ-মুখ ফুলে এক এলাহি অবস্থা তার। যা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষন করছে দিহান। ক্ষাণিকবাদ গম্ভীর কণ্ঠে জেনিকে বলে উঠে…
— “সমস্যা কি?”
চমকালো জেনি। অবাক হয়ে তাকালো দিহানের দিকে।সে কি আবার কোনো ভুল করেছে? কিন্তু তার তো মনে পরছে না। জেনির ভাবনার মাঝেই দিহান আবারও বলে উঠে…
— “কাল আসো নি কেন ভার্সিটিতে? আমাকে জ্বালাতে ভালো লাগে তোমার?”
— “আমি আপনাকে জ্বালালাম কখন? তাছাড়া আমি ভার্সিটিতে না আসলে তো আপনারই ভালো।”
দিহান ভ্রুঁ কুঁচকায়। ভ্রুঁ নাচিয়ে বলে…
— “কিভাবে?”
— “আপনি তো আমাকে পছন্দ করেন না।”
দিহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার মতে জেনির কথা সঠিক না। দিহান তাকে ভালোবাসে না। তবে পছন্দ করে। সে পছন্দটাকেই ভালোবাসায় পরিণত করতে চাইছে সে। জোড় করে হলেও চাইছে। রেয়ানের কথাটাই সঠিক। এভাবে চলতে থাকলে সে একদিন নিঃশেষ হয়ে যাবে। পুরোপুরি ভাবে নিঃশেষ হয়ে যাবে! তার একজনকে দরকার। নিজের কষ্টগুলো কাউকে বলার প্রয়োজন। তাকে জড়িয়ে ধরে খুব করে কাঁদা প্রয়োজন। সে একজন যদি জেনি হয়, তাহলে ক্ষতি কিসের? তাছাড়া রেয়ানও বলেছে জেনি ভালো মনের মানুষ। এমন একজনই তো চায় দিহান। জেনিকে দেখে তার মনে হয়, মেয়েটা সত্যিই তাকে ভালোবাসে। তার চোখে এক গভীরতা দেখে সে। যা ক্রমশই গভীর হচ্ছে। গভীর থেকে গভীরতর। বুক ভরে শ্বাস নিলো দিহান। জেনির হাত ধরে টেনে হাঁটতে হাঁটতে বলল…
— “চলো লেকে যাবো।”
জেনি থমকায়! অবাক হয়! বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে দিহানের দিকে। সত্যিই কি দিহান লেকে যাওয়ার কথা বলেছে? নাকি সেটা শুধুই তার স্বপ্ন? ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলো জেনি।কি মনে করে হঠাৎ বলে উঠে…
— “ভালোবাসেন আমায় দিহান?”
দাঁড়িয়ে যায় দিহান।উত্তরটা কেমন হওয়া উচিত? হ্যাঁ কি না? দাঁড়িয়ে গেল দিহান। জেনির দিকে তাকালো সে। মায়াময়ী মুখ ভেসে উঠল সামনে। নিজের অজান্তেই বলে উঠল…

— “তোমার মধ্যে অনেক মায়া ফেনি।”
ফেনি? এটা আবার কি? চট্টগ্রামের কাছাকাছি অবস্থিত ফেনি শহর না তো? এমন অবস্থায়ও ভ্রুঁ কুঁচকে এলো জেনির। এখানে ফেনি শহরের কথা আসলো কেন? দিহানের চোখ বরাবর তাকালো জেনি। মুখ থেকে আপনা-আপনিই উচ্চারিত হলো…
— “ফেনি?”
দিহান হাসলো। জেনির কানে চুল গুঁজে দিতে দিতে বলে উঠল…
— “তোমার নাম জেনি,
আদর করে ডাকি ফেনি।।”
________________
রাত এগারোটা। বিছানায় বসে বসে গল্পের বই পড়ছি আমি। এসময় রেয়ানের কল। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ঝাঁঝালো কণ্ঠে রেয়ান বলে উঠেন…
— “তুই এমন কেন? আমাকে জ্বালাতে তোর ভালো লাগে? কেন ঘুমাতে দেস না আমাকে? প্লিজ আমার হয়ে যা তাড়াতাড়ি। তোকে ছাঁড়া শ্বাস নিতে কষ্ট হয় আমার। দম বন্ধ হয়ে আসে। আমি একবার তোকে সামনা সামনি দেখতে চাই প্লিজ! কিন্তু, কিন্তু তোর বজ্জাদ শ্বশুড় বাসায় এসে সাফ সাফ বলে দিয়েছে, বিয়ের আগে কিনা আমি তোর সাথে দেখা করতে পারবো না। এটা কি ধরণের কথা? তোদের দু’জনকে আমার অধিক বিরক্ত লাগে মরুভূমি। এত জ্বালানো কি খুব প্রয়োজন? আমার যে আর সহ্য হচ্ছে না এসব। আমি তোকে সামনাসামনি দেখতে চাই মরু! তোর বজ্জাদ শ্বশুড় যে মানছে না। প্লিজ তাকে মানানোর চেষ্টা কর।”
আমি হতবাক! এগুলো কি বলছেন উনি।
.
.
চলবে…