সে কি জানে

সে কি জানে Season 2 ! Part- 26

দুপুর গড়িয়ে আকাশে রাত নেমে এলো কিন্তু এখনও দীঘির জ্ঞান ফিরল না। রেয়ানের মতে কাল সকালের আগে জ্ঞান ফিরবে না তার। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো মামী আর দীঘির মা শারমিন আজকের রাতটা হাসপাতালে থাকবেন। আমি, রেয়ান আর আবদ্ধ চলে যাবো বাসায়! তবে এটা মানতে আবদ্ধ নারাজ। সে যাবে না তার পিচ্চিকে রেখে। কোনো কিছুতেই যখন আবদ্ধ বাসায় আসতে চাইছিল না, তখন এক প্রকার টেনে চিঁচড়েই আবদ্ধকে বাসায় নিয়ে আসলাম আমি আর রেয়ান।
__________
বাসায় ফিরতেই দরজা খুলে দিলো রহিমা। আমাদের ভেতরে না ঢুকতে দিয়ে দরজার সদরে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল সে…
— “তোমাগো আইতে এত দেড়ি হইলো ক্যা? আমি তো এতহন চিন্তায় মরি যাইতে ছিলাম। কোনো বিপদ টিপদ হইছে নি আবার।”
চরম বিরক্তি নিয়ে রহিমার দিকে তাকালাম আমরা তিন’জন। হঠাৎ রেয়ান রসিকতা করে রহিমাকে বলে উঠেন…
— “কেন গো রহিমা? এত চিন্তা কেন আমাদের জন্য? প্রেম করতে ইচ্ছে হচ্ছিল বুঝি?”
কথা শেষে রহিমাকে চোখ টিপ মারলেন রেয়ান। ভ্রুঁ কুঁচকে মাথা কাত করে রেয়ানের দিকে তাকিয়ে আছি আমি আর আবদ্ধ। যেন অবিশ্বাস্য একটা ঘটনার শিকার হয়েছি আমরা। এদিকে রহিমা চেঁচিয়ে উঠল…
— “আস্তাগফুরুল্লা! নাউজুবিল্লা! কি কন এগিন ভাইজান।”
— “ঠিকই তো বলছি রহিমা। আয় আজকে আমরা দুইজন মিলে প্রেম করব।”
বলেই রেয়ান রহিমাকে ধরতে যাবেন তার আগেই সে দৌঁড়ে পালালো তার রুমের দিকে। যাওয়ার আগে রেয়ানের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল…
— “আই আর আন্নের সামনে আইতাম না ভাইজান। আন্নের চরিত্র ভালা না।”
কথাটা শুনে তিন’জনই “হো হো” করে হেসে দিলাম। এতে যেন রহিমার রাগ আরও শীর্ষে পৌঁছে গেল। মুখ ভেংচি দিয়ে সে চলে গেল রুমে।

রহিমা যেতেই আবদ্ধ আর রেয়ানকে ফ্রেশ হতে পাঠিয়ে দিলাম আমি। নিজেও তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে চলে গেলাম রান্নাঘরে। খাবার গরম করতে হবে। পেটের ইঁদুর গুলো ইতোমধ্যে নাচানাচি করা শুরু করে দিয়েছে। কাজ করার মাঝেই মনে হলো কেউ একজন গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মাথা উঠিয়ে তাকিয়ে দেখলাম রেয়ান। দরজায় হেলান দিয়ে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছেন উনি। আমি তাকাতেই দাঁত কেলিয়ে হাসলেন একবার৷ বললেন…
— “তোমাকে বউ বউ লাগছে মরুভূমি। ইচ্ছে করছে এখনই বিয়ে করে ফেলতে। প্রথমে তোমাকে বিয়ে করব তারপর রহিমাকে। জোস না ব্যপারটা?”
মুচকি হাসলাম আমি। বললাম…
— “আবদ্ধ কোথায়? ফ্রেশ হচ্ছে এখনও?”
— “হ্যাঁ।”
— “আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? টেবিলে গিয়ে বসুন। আমার আর একটু আছে।”
— “যাবো না এখান থেকে। দেখবো!”
— “কি দেখবেন?”
— “তোমাকে।”
— “আমাকে দেখার মতো কিছু নেই। টেবিলে গিয়ে বসুন। যান!”
— “আছে অনেক কিছু আছে। বর্ণনা শুনবে?”
— “না।”
— “উহু! শুনতে হবে।”
চোখ বন্ধ করে একটা লম্বা নিশ্বাস নিলেন রেয়ান। শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আবেগী কণ্ঠে বলে উঠলেন…
— “সে কি জানে তার ডাগর ডাগর আঁখি জোড়ায় গভীর থেকে গভীর ভাবে হারিয়ে যাচ্ছি আমি। যতটা গভীরে গেলে একটা মানুষ অপর মানুষের মাঝে মিশে যায় ঠিক ততটাই গভীরে। সে কি জানে? তার সরু নাকে লেপ্টে থাকা সাদা পাথরের নাকফুল কতটা আকর্ষণ করে আমায়। তাকে বলো, তার রাগে লাল হয়ে যাওয়া গালে চুমু খেতে আমার ভালো লাগে। তার চোখের ঘন পাঁপড়ি ছুঁড়ে দিতে মন চায় বারংবার। তার ঠোঁট’দুটো মনে হয় যেন সদ্য ফুটে ওঠা লাল গোলাপ। তাকে বলো, তার রুপে আমি আকর্ষিত, তার আচরণে আমি এক প্রেমিক পুরুষ। ভালোবাসার চেয়েও বেশি অভ্যেস সে আমার। তবুও বলব, ভালোবাসি প্রেয়সী।”
অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। তাকে খুব বলতে ইচ্ছে করছে “আপনি খুব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারেন রেয়ান।” তবে তা আর বলা হলো না। এর আগেই আবদ্ধ এসে হাজির। আমাকে আর রেয়ানকে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হেসে হেসে বলল…
— “চোখে চোখে রোমেন্স। হাউ সুইট!”
চোখ পাকিয়ে আবদ্ধের দিকে তাকালাম আমি। ধমক দিয়ে বললাম…
— “ফাজিল কোথাকার! যা টেবিলে গিয়ে বয়। আমি আসছি। আর আপনিও যান। দু জনের মধ্যে একজনও আর একটা বাজে কথা বলবেন না। সোজা ডাইনিংরুমে যাবেন।”
আবদ্ধ আর রেয়ান দু’জনেই দাঁত কেলিয়ে হাসলো। ডান হাতের একটা আঙ্গুল ঠোঁটে চেপে ধরে চুপ করার মতো ভঙ্গিমা করে চলে গেল দু’জন।

খাবার শেষে রেয়ান আর আবদ্ধ চলে গেলেন আবদ্ধের রুমে। আর আমি চলে আসলাম আমার রুমে। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই চোখে ঘুম নেমে আসলো আমার। সারাদিনের এত ধকলের পর চোখ আর চাইছে না মেলে থাকতে। এখন ঘুমাতে হবে আমার। এসময় হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। বিরক্ত হলেও কে ফোন দিয়েছে সেটা না দেখেই ফোন রিসিভ করলাম আমি। সাথে সাথে অপাশ থেকে ভেসে উঠল রেয়ানের কণ্ঠ। অবাক হলাম অনেকটা। এ মাত্র না তাকে বিদায় দিয়ে রুমে ঢুকলাম, এখনই আবার ফোন কেন করলেন? আমার ভাবনার মাঝেই উনি আবার বলে উঠলেন…
— “কি হলো কিছু বলছ না যে? ছাদে যাবে?”
— “উহু! ঘুমাবো।”
— “বেশি ঘুম এসেছে?”
— “হু। আপনিও ঘুমিয়ে যান। কাল তো আপনার ফ্রেন্ডরা আসবেন।”
— “ঠিকাছে। এখন তুমি ঘুমাও আমি ফোন রাখছি।”
ইতোমধ্যে ঘুমের সাগরে ভাসছি আমি। কোনোমতে- “হু” শব্দ মুখ থেকে বের করতেই পর মুহুর্তে ঘুমের দেশে পারি দিলাম আমি। ফোনটা কান থেকে সরিয়ে রাখতেও যেন আমার অলসতা!
২৪.
সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমি চরম অবাক। ফোনের লাইন এখনও কাটা হয়নি। তবে কি রেয়ান কল কাটতে ভুলে গিয়েছিলেন? আগপাঁচ ভাবতে ভাবতে ফোনটা কানে দিয়ে “হ্যালো” বলতেই অপর পাশ থেকে রেয়ান ঘুমু ঘুমু কণ্ঠে বলে উঠেন….
— “এতক্ষনে ঘুম ভেঙেছে মহারাণীর?”
— “আপনি রাতে ফোন কাটেন নি কেন? নাকি সারারাত আমার সাথে কথা বলেছেন আর আমি ঘুমিয়েছি?কোনটা?”
— “আমি কথা বলিনি তো।”
— “তাহলে?”
— “সারারাত ভরে তোমার নিশ্বাসের শব্দ শুনেছিল মাত্র।”
কয়েক মুহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম। পরক্ষনেই বললাম…
— “আপনি একটা পাগল।”
— “কি করব বলো? একটা পাগল মেয়েকে ঠিক করতে গিয়ে নিজেই পাগল হয়ে গেছি তার প্রেমে।”
— “পাগলাগারদে যান। আপনাকে ওরা সাদরে গ্রহণ করবে।”
— “বাচ্চা মেয়ে, ইহা এক বড় ধরণের অসুখ। তুমিহীনা সুস্থ হতে পারবো না আমি।”
__________
হাসপাতালে আমরা যেতেই মামী আর শারমিন চলে যান বাসায়। আবদ্ধ চলে যায় দীঘির কাছে কেবিনে আর রেয়ান হাসপাতালের কিছু ফর্মেলিটির কাজ করতে। আমি বসে আছি কেবিনের সামনের বেঞ্চগুলোতে। ওইদিনের মতো এখনও একা একা লাগছে খুব! কেন যেন রেয়ান আমাকে একা রেখে কোথাও গেলেই মনটা খারাপ হয়ে যায় আমার। এমনটা কেন হয়? উত্তর অজানা আমার!
দেওয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছি আমি। হঠাৎ পাশে কারও উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ খুললাম। রেয়ান হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি তাকাতেই মিষ্টি সরে বলে উঠেন….
— “আমার ফ্রেন্ডরা এসে গেছে মরুভূমি। নিচে ওয়েট করছে আমাদের জন্য।যাবে আমার সাথে? চলো!”
বলেই হাতটা টেনে ধরে নিয়ে যেতে লাগলেন উনি। শুধু শুধু যাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করেন রেয়ান। আমার প্রতিউত্তর শোনার আগেই তো উনি আমাকে নিয়ে চলে যান। তাহলে শুধু শুধু জিজ্ঞেস করার দরকার কি? না জিজ্ঞেস করলেই তো হয়।
.
প্রায় ১০ মিনিট হতে চলেছে কিন্তু দীঘি সেই কখন থেকে চুপ করে আছে তো আছেই। আবদ্ধ ভাবছে, হয়তো সে রাতে তাকে একা রেখে বাসায় গিয়েছে দেখে দীঘি রাগ করেছে। করুন দৃষ্টিতে দীঘির দিকে তাকালো আবদ্ধ। বলল…
— “আমি রাতে চলে গেছি বলে তুই রাগ করেছিস? সরি রে পিচ্চি আর কখনও তোকে রেখে যাবো না প্রমিস।”
— “আমার তো টেস্ট পরীক্ষা চলছে আবদ্ধ। পরীক্ষা না দিয়ে এখানে কেন রেখেছেন আমাকে?”
চমকালো আবদ্ধ। ঘাবড়ে গেল অনেকটা। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে বলে উঠল….
— “তুই তো অসুস্থ। তাই টেস্ট পরীক্ষা দেওয়াচ্ছি না। তাছাড়া টেস্ট পরীক্ষা না দিলে কিছু হবে না। একেবারে এস.এস.সি. পরীক্ষা দিবি।”
— “এমন কি অসুখ হয়েছে যে আপনি আমাকে পরীক্ষাই দেওয়াচ্ছেন না। আপনি তো এমন না আবদ্ধ। যত যাই হোক আপনি আমাকে পরীক্ষা দেওয়াতেন তো দেওয়াতেনই। তাহলে এখন কেন এমন বলছেন। নিশ্চয়ই কিছু লুকাচ্ছেন আমার কাছে।”
— “চুপ থাক দীঘি। এমন কিছু হয় নি।”
— “মিথ্যা কেন বলছেন আবদ্ধ।”
ধমকে উঠল আবদ্ধ। বলল….
— “তোকে চুপ থাকতে বলেছি না? চুপ থাক।”
চুপ হয়ে গেল দীঘি। তার চোখ থেকে পানি পড়ছে অনবরত। আবদ্ধ নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। দীঘিকে কাঁদতে দেখে কষ্টগুলো যেন তার মনকে আরও খুবলে খাচ্ছে। দীঘিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সে। যথা সম্ভব শক্ত থাকার চেষ্টা করে বলল….
— “সময় আসলে সব বলল দীঘু। এখন এসব বিষয়ে কথা বলিস না। সইতে পারি না আমি!”

হাসপাতালের নিচে আসতেই দেখলাম ৩টা মেয়ে আর ৫টা ছেলের দল দাঁড়িয়ে আছে। আমাদেরকে দেখেই তারা জোড়ে জোড়ে চিল্লিয়ে ওঠে….
— “হ্যালো ভাবি!”
এত জোড়ে চিল্লানোতে রেগে যান রেয়ান। ধমকের সুরে বলে উঠেন…
— “এভাবে চিল্লানোর মানে কি? এটা হাসপাতাল যে ভুলে গেছিস?”
চুপ হয়ে গেল ওরা। সবাই একত্রে “সরি” বলল। তাদের মধ্যে একটা ছেলে বলে ওঠে….
— “তা ভাবি কেমন আছেন? আমার নাম তীর্থ। আপনার দেবর হই।”
সাথে সাথে অন্য একজন ছেলে বলে উঠে…
— “তুই কি একা দেবর নাকি? আমরাও আছি।”
— “শালা তুই হইলি সেকেন্ড হ্যান্ড। আর আমি ফাস্ট হ্যান্ড।”
— “হ্যাঁ জানি কেমন ফাস্ট হ্যান্ড। হেংলা এক নাম্বার।”
— “তুই খবিশ। না, না, লুলা!”
মাঝখান দিয়ে রেয়ান বলে উঠলেন….
— “তোরা কি এখানে হ্যাংলা লুলা খেলতে আসছোস? নাকি এখন একটু পেসেন্ট এ-র সাথেও দেখা করবি।”
— “থাম শালা। ভাবির কাছে আগে পরিচিত হই আমরা।”
একে একে সবাই পরিচয় হতে লাগলো আমার সাথে। পরিচয় আলাপ শেষে সবাইকে নিয়ে দীঘির কেবিনের দিকে এগুতে লাগলেন রেয়ান।
__________
দীঘির সাথে কথা বলছিল আবদ্ধ। এ-র মাঝে অনেকগুলো ছেলেমেয়ে ঢুকে গেল কেবিনে। আবাক হলো আবদ্ধ। পরক্ষনে আমাকে আর রেয়ানকে দেখে বুঝতে পারলো এরা কারা। কেবিনে ঢুকতেই তীর্থ ভাইয়া বেশ রসিকতা নিয়ে বলে উঠলেন….
— “তা পিচ্চি ভাবি কেমন আছেন? বিয়ে করছেন কবে ভাবি? আপনার সে তো দিনরাত অপেক্ষা করছে আপনার জন্য।”
প্রচুর লজ্জা পেল দীঘি। এ একটা জিনিসই বড়দের চেয়েও বেশি আছে তার। এমন কথায় তো তার ইচ্ছে হচ্ছে মাটি ফাঁক হয়ে যাক আর সে সেখানে মিশে যাক! তবে তা কি আর হওয়ার। লজ্জায় গাল দু’টো লাল হয়ে যাচ্ছে তার। মনে মনে বলছে- “এভাবে কেও বলে?”
.
.
#চলবে🍁