পরিণয়ে পরিণতি !! Part- 14
মুনতাহা থাকা কালীন কখনো রান্নাঘরে এত সকালে যেতে হয়নি। মেয়েটা ভালোই বদ অভ্যাস করেছে। বয়স তো আর থেমে নেই এখন আর আগের মত মুনতাহার শাশুড়ী কাজ করতে পারে না।
অবন্তিকা মুনতাহার মত না। রান্না ঘরের ধারে কাছে আসে না। ওর স্কিন নাকি পুড়ে যাবে। রাহিও পড়াশোনা আর নিজেকে নিয়ে ব্যাস্ত থাকে। মুনতাহা ছিলো বলে বুয়ার প্রয়োজন পড়েনি । মুনতাহা যে সারাদিন কত কাজ করত এখন টের পাবে।
পরাটা ভাজতে গিয়ে মুনতাহার শাশুড়ীর ঘাম টপ টপ করে পড়ছে। গরম কালে রান্নাঘরে আগুনের মত উত্তাপ থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে শরীর ঘেমে একাকার হয়ে যায়।
পরাটা বানিয়ে ডিম ভাজি করতে করতে অবন্তিকা উঠে গেছে। অবন্তিকা ডাইনিং এ এসে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। সূর্য কোন দিকে উঠেছে।
অবন্তিকা আসার পর থেকে দেখছিলো মুনতাহা কে হুকুম দিয়ে সবাই কাজ করায়। আজ হঠাৎ করে কি এমন হলো নিজে কাজে লেগে গেছে।
কিছুটা মায়া হচ্ছে।কিন্তু তাকে নরম হলে চলবে না। এখানে সংসার করতে আসেনি। সংসারের মায়া বড্ড খারাপ জিনিস। একবার মায়ার বাঁধনে আটকা পড়লে ছাড়া যায় না।
অবন্তিকা ডাইনিং টেবিলে বসে একটু ভাব নিয়ে বলছে,,
— নাস্তা কি আজ পাব?? নাকি বাইর থেকে এনে খেতে হবে। এ বয়সে,কাজ না পারলে বুয়া রাখুন এত কাঁপাকাঁপির কি দরকার! আপনার ছেলের তো টাকা কম নেই।
— বউ মা তুমি রুমে যাও আমি নি আসছি।
— তাড়াতাড়ি নি আসুন আমার খুব খুধা লাগছে। কয়টা বেজেছে দেখেছেন। নাস্তা করতে করতে না জানি দুপুরের খাবারের সময় চলে আসে।
— সাইমুন কোথায় উঠেনি এখনো?
— আপনি গিয়ে দেখে আসুন আপনার ছেলে কোথায়।
— সারাক্ষণ এভাবে কথা বলো কেন?? আমরা তোমার সাথে কি কোন অন্যায় করেছি?? আসার পর থেকে তোমার খেজমত করছি।
সেখানে তো আমার প্রশ্ন!! এত খারাপ আচরণ করার পরেও এদের টনক নড়ছে না। ঠিক আমাকে সহ্য করে যাচ্ছে।
— আমার সাথে না করলেও মুনতাহা আপুর সাথে তো করেছেন।
অবন্তিকার কথা শুনে শাশুড়ী মায়ের অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
অবন্তিকা মুনতাহা কে নিয়ে সব জেনে গেলো নাতো। ভেবেছিলাম ভালো হবে এখন দেখছি এ মেয়ে আমার জন্য বিষ পোড়া হয়ে দাঁড়াবে। মুনতাহার কথা সত্যি হয়ে যাবে নাতো!! না না এ আমি কিছুতেই হতে দিতে পারি না।
অবন্তিকা কে কিচ্ছু বুঝতে দেয়া যাবে না।
— কি..ই…ই.. অন্যায় করেছি। আন্তাজে কি বলছ!!
— আমার সামনে কি কম অপমান করেছেন। আসলে আপনাদের মধ্যে কাহিনী টা কি।
— তোমার এত কিছু জানতে হবে না বউ মা। তুমি আমার ছেলেটার সাথে সময় কাটাও।
— আপনার ছেলের চলাফেরা ঠিক নাই। আপনার ছেলের মনে অন্য কেউ আছে।
— তোমাকে বলছে??
— না বললে কি হবে বুঝা যায়।
— এত না বুইঝা আমার ছেলেটারে সুখ দাও। বউয়ের মত থাকো সব ব্যাপারে উড়নচণ্ডী ভালো না।
— ধীরে বলুন। এত জোরে কথা বলা পছন্দ না আমার। আমি মুনতাহা না বুঝছেন?? আর মুনাতাহা আপু কোথায়?? উনাকে দেখছিনা যে।
— এইতো… আ..ছে কোথাও।
অবন্তিকা গিয়ে দেখে মুনতাহার রুম বন্ধ ভেবেছে এখনো ঘুমাচ্ছে তাই আর বিরক্ত করেনি।
সাইমুন উঠার পর থেকে একবার ও মুনতাহা কে দেখেনি। মনের মধ্যে খটকা লাগছে মুনতাহা কে না দেখে। দ্রুত গিয়ে মুনতাহার রুমের দরজা নক করছে। খুলছেনা দেখে জোরে ধাক্কা দেয়াতে খুলে গেলো। মুনতাহা রুমে নেই। ছাদে যায় নিতো। মন খারাপ থাকলে মুনতাহা প্রায় সময় ছাদে চলে যায়।
সাইমুন ছাদে গিয়ে দেখছে সেখানেও মুনতাহা নেই। সাইমুন বুকের বাপাশে চিনচিন ব্যাথা অনুভব করছে। চোখের পাপড়ি ভিজে দুঃসময়ের জানান দিচ্ছে। ছেলেরা চাইলেও কাঁদতে পারে না। ছেলেদের নাকি কান্নায় মানায় না।
মা কে আড়ালে নিয়ে জিজ্ঞেস করছে,,
— মা মুনতাহা কোথায়??
ভাবছে কি উত্তর দিবে। কি বা দিবে সত্যি কি কোন উত্তর জানা আছে। কালকের কোন ঘটনা সাইমুন কে বলা যাবে না। সব শুনলে রেগে যাবে। পরে হিতে বিপরীত হবে।
— কেন কি হইছে?? কি দরকার আমাকে বল!! তোর কি খুঁজে পাচ্ছিস না আমি খুঁজে দিব।
— তুমি আগে বলো মুনতাহা বাসায় নেই কেন?? কোথায় গেছে বলে গেছে??
— ও চলে গেছে বাসা ছেড়ে??
— কিইইইই….. হঠাৎ কি হয়েছে?? আমি তো কিছু জানিনা।
— হয়ত এখানে থাকতে অসস্থি হচ্ছে ও বুঝছে এ সংসারে ওর দরকার শেষ তাই চলে গেছে। তুই অবন্তিকা কে নিয়ে ভাব।
— যাওয়ার সময় তোমাকে বলে গেছে??
— না। বাদ দে তো। তুই অবন্তিকা কে নিয়ে ঘুরে আয়। মেয়েটা বোধয় তুই ঠিকমতো কথা বলিস না বলে খিটখিটে মেজাজের হয়ে আছে। কোথাও থেকে ঘুরে আসলে ভালো লাগবে।
— মা এখন এসব কথা ভালো লাগছে না প্লিজ।
মুনতাহার শাশুড়ীর মনের অজানা গহীনে খারাপ লাগা কাজ করছে৷ কিন্তু সেটা স্বীকার করতে চাইছে না। কিছু মানুষ ভুল করে বুঝার পরেও মাঝেমধ্যে জোর করে নিজেকে সেই ভুলের উপর টিকিয়ে রাখতে চায়। যতক্ষণ না সব কিছু শেষ হচ্ছে হার মানতে রাজি না।
মুনতাহার শাশুড়ীর মনটা কেমন জানি করছে। সুখের জন্য এত কিছু করেও কোথাও সুখের ছিটেফোঁটা নেই।
যত যাইহোক একসময় মুনতাহার সাথে কত ভালো সময় কাটিয়েছে একি ছাদের নিচে।
.
.
সাইমুন বিশ্বাস করতে পারছেনা মুনতাহা চলে গেছে।
মুনতাহা একবার ও আমাকে বলার প্রয়োজন মনে করেনি। এতটাই পর করে দিলো আমায়!!
সাইমুন মুনতাহার নাম্বারে বার বার কল করে দেখছে মুনতাহার মোবাইল অফ। মুনতাহার মায়ের নাম্বারে কল দেয়ার সাহস হয়নি। কোনমুখে কল দিবে। বিয়ের সময় কত বড়মুখ করে বলেছিলো উনার মেয়েকে সুখে রাখবে কোন কষ্ট ছুঁতে দিবে না।
কথা দেয়া সহজ হলেও কথা রাখা অনেক কঠিন।
সাইমুনের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে….
মুনতাহা কে যে আমি কোনদিন সুখ দিতে পারিনি। মেয়েটা শুধু দিয়ে গেলো বিনিময়ে শূন্য হাতে চলে গেলো। খুব ভালো করেছ” এই অসুন্দর ভুবনে তুমি বড্ড বেমানান। এই ঘর পরিবার কিছুই তোমার যোগ্য না।
জীবন হল জলের নৌকা !! কখনো সুখের পাল তুলে ,, কখনো দুখের স্রোতে ভাসে .. কখনো অজানা অভিমানে থেমে যায়।
মুনতাহা আজ নেই বলে সাইমুনের কত কষ্ট । না পারছে নতুন কে বরণ করতে না পাচ্ছে মানসিক শান্তি। যুক্তি আর স্বার্থ দিয়ে নিজেকে বুঝ দেয়া গেলেও সত্যিকার অর্থে সুখ পাওয়া যায় না৷
মানুষ বড়ই আজব প্রাণী। যা পাশে থাকে, একান্ত নিজের থাকে সে জিনিসের কদর থাকে না। যে দূরে চলে যায় মুহুর্তের মধ্যে কদর বেড়ে যায়।
…
..
মুনতাহা ভাবছে এখানে খুব বেশিদিন থাকা যাবে না। উঠতে বসতে, খেতে ঘুমাতে মুনতাহার ভাবী খোঁচা দিয়ে কথা বলবে।
যা খাবে তা বিষের মত মনে হবে।
যে মানুষ গুলো খোঁচা মেরে কথা বলতে মজা পায় তারা কখনো বুঝবে না কথা গুলো ঠিক কোথায় গিয়ে লাগে। আসলে এসব মানুষরা অন্য কে ছোট করে কথা বলার মাঝে একধরনের পৈশাচিক আনন্দ পায় ।
কিছু একটা করতে হবে আমাকে। কুকুরের মত বেঁচে থাকার চেয়ে নিজের মত করে একবেলা না খেয়ে থাকাও ভালো। আমার যে ভাই ভাবীর কথায় উঠে বসে। ভালো মন্দ বুঝার ক্ষমতা নাই। তার কাছে বউয়ের সব কথাই ঠিক অন্য সবার কথা ভুল।। দুনিয়া কত রকমের মানুষ। কেউ বউয়ের ভালোবাসার মূল্য বুঝে না কেউ বউয়ের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে বিবেকহীন মানুষ হয়ে যায়।
আল্লাহর দেয়া অনেক বড় রহমত সুন্দর বিবেক। যদি সবার সুন্দর বিবেক থাকতো তাহলে কেউ কারো সাথে কখনো অন্যায় করতে পারতো না।
হঠাৎ করে মুনতাহার রাশেদের কথা মনে পড়ে গেলো। একি ভার্সিটি থেকে মাস্টার্স শেষ করেছিলো দুজন। রাশেদ ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিলো। অনেক বড় কোম্পানীতে জব করে। বিয়ের পর মাঝে একবার দেখা হয়েছিলো মুনতাহার সাথে। তখন ভিজিটিং কার্ড দিয়েছিলো বলেছিলো দরকার হলে কল দিতে৷
তখন কি জানতো কখনো দরকার হবে। চাকুরী করার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু সাইমুন চায় নি চাকুরী করুক। সাইমুনের ইনকাম পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত ছিলো। আর মুনতাহাও চেয়েছিলো পরিবার কে বেশি সময় দিতে।
মোবাইল বের করে রাশেদের নাম্বার খুঁজে কল দিলো। ভাগ্যিস নাম্বার টা ছিলো। ওপাশ থেকে পুরুষ কন্ঠ ভেসে আসলো। মুনতাহার লজ্জা লাগছে কিভাবে বলবে,,
— হ্যালো কে কথা বলছেন না কেন??
— আমি মুনতাহা! চিনতে পারছ?
— মুনতাহা!! কেমনে মনে পড়লো এ অভাগা বন্ধুরে। কেমন আছ??
— ভালো। তুমি কেমন আছ??
— এইতো চলছে জীবন। তোমার ভয়েস এমন কেন শুনাচ্ছে কিছু হইছে?? তুমি ঠিক আছো তো??
— বুঝতে পারছিনা কিভাবে বলব।
— আরে বলে ফেলো। বন্ধুর কাছে বলতে লজ্জা কিসের। আমাকে আপন ভাবো না!
— আমার সাথে একটু দেখা করতে পারবে??
— আচ্ছা কখন করতে হবে বলো। তুমি ডাকবে আর আমি আসব না তা কি করে হয়।
….চলবে…