পরিণয়ে পরিণতি

পরিণয়ে পরিণতি !! Part- 12

সারার_গল্পকথা (কাজী সারা)
মুনতাহার শাশুড়ী মুনতাহাকে রুমে এনে দরজা লক করে দিলেন। রাগান্বিত স্বরে,,
— তুমি কি চাও?? অবন্তিকা সব জেনে যাক?? ওর সাথে এত কথা কিসের!!
–মা আমি যদি চাইতাম অবন্তিকা এতক্ষণে সব জেনে যেতো। কিন্তু আমি সেটা করব না। যা করার আমার আল্লাহ করবে।
— আমার সংসারে আগুন লাগানোর জন্য বসে আছ তাইনা। অনেক হয়েছে এবার সময় এসেছে এখান থেকে চলে যাওয়ার।
— আমি দু এক দিনের মধ্যে চলে যাব। আল্লাহর দুনিয়া অনেক বড় কোথাও না কোথাও আমার ঠাই ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু আপনি সংসার টা শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারবেন তো।
মুনতাহার শাশুড়ী চিৎকার করে বলছে,,
— মুখ পুড়ি!! একদম চুপ অনেক বলেছিস। নিজে তো অলক্ষী সারাক্ষণ অলুক্ষনে কথা মুখে রাখস। তোর সংসার টা রক্ষা হলো না বলে হিংসা করছিস।
— আস্তে মা আস্তে। অবন্তিকা বাসায় আছে সব শুনে গেলে সামাল দিতে পারবেন তো!
তাছাড়া এ বয়সে এত চিৎকার চেচামেচি শরীরের জন্য এক্কেবারে ভালো না। বিছানায় পড়লে সেবা করবে কে!!
মুনতাহার শাশুড়ী রাগে কেঁপে কেঁপে উঠছেন।
— কি পারব না পারব সেটা তোরে ভাবতে হবে না। আসলে ছোটলোকের সাথে সম্মন্ধ করাই ভুল। ছোটলোক সারাজীবন ছোটলোক থাকে।
— এবার বড় লোকের সাথে আত্মীয়তা করেছেন ঠেলা বুঝবেন। অবন্তিকা ভালো তবে আপনাদের মা মেয়ের জন্য বারুদ হবে এটা আমি নিশ্চিত !!
নাচিয়ে ছাড়বে আপনাদের।
পয়সার এক পিঠ দেখেছেন এবার ২ পিঠ দেখবেন।
মুনতাহা তাচ্ছিল্যের হাসি দিচ্ছে।। আজ আমার হাসার দিন…
মা যে সম্পর্কের ভিত্তি টাই নড়বড়ে সেটা নিয়ে এত বাহাদুরি কিসের। মিথ্যা যে সম্পর্কের বুনিয়াদ হয় সে সম্পর্ক কয়দিন টিকবে সেটা নিয়ে আমার শংকা আছে!! উইপোকা যেমন ধীরে ধীরে কাঠ খেয়ে ফেলে তেমনি মিথ্যা আপনার সংসার খেয়ে ফেলবে।
মুনতাহা আমার ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে দিও না। আমার ভুল হয়েছে তোমাকে এখানে রাখা। মান সম্মান থাকতে থাকতে বিদায় হও আমার সংসার থেকে।
.
.
মুনতাহা রুমে এসে কান্না শুরু করে দিলো। আজ কান্না টা ঠিক কিসের জানে না।
মুনতাহার খুব খারাপ লাগছে যে শাশুড়ীর চোখের দিকে তাকিয়ে কোনদিন কথা বলেনি আজ তাকে কত্তো কথা শুনিয়ে দিলো।
অবশ্য একদিকে বলতে পেরে নিজেকে খুব হালকা লাগছে বুকের ভিতর জমানো কষ্ট টা কিছুটা হলেও কমেছে। আর কতদিন সহ্য করে থাকবে। সহ্য করার ও একটা সীমা আছে।
মুনতাহা কিছু না করেও সবার চোখের কাল হয়ে গেছে।
যা প্রাপ্য তার চাইতে এ পরিবারে জন্য বেশি করেছে
সারাদিন এ মানুষ গুলোর জন্য খেটেছে কাউকে কিচ্ছু করতে দি নাই। তার প্রতিদান এভাবে দিচ্ছে।
এরা কখনো মুনতাহার মূল্য বুঝেনি। মাঝেমধ্যে নিজের মূল্য বুঝানোর জন্য দূরত্ব বজায় রাখা দরকার।
.
.
অনেক হয়েছে আর না। এখান থেকে মায়ের বাসায় ভাবীর কথা শুনে থাকা অনেক সম্মানের। মা কে কল দিতে হবে।
মুনতাহা মা কে কল দিয়েছে। ২ বার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ করেছে,,
— মা কেমন আছ?
— আমি ভালো আছি। তোর কথা মনে করে ঘুম আসে না। কিভাবে আছিস অই জাহান্নামে।
— মা আমি তোমার কাছে চলে আসব।
— আয় না। চলে আয় ওখানে।
— আমি জানি তুমি ভাবীর কথা চিন্তা করছ। মা ভেব না। আমি বেশি দিন থাকব না। ঠিক একটা ব্যবস্থা করে ফেলব।
— কিচ্ছু হবে না তুই চলে আয়।
মুনতাহা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজকে সন্ধ্যার মধ্যে এ বাসা ছেড়ে সাইমুন কে ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে যাবে। মুনতাহা জানে ফেলে যাওয়া স্মৃতি ওকে পীড়া দিবে। কিন্তু আজ যদি মন কে শক্ত না করে তাহলে সারাজীবন সবার অবহেলার শিকার হতে হবে। হয়ত এসব কাটিয়ে উঠতে কষ্ট হবে, হয়ত সব ঝেড়ে ফেলে দিতে পারবে না তারপরেও সীমানা ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতে হবে।

মুনতাহার সাথে ওদের আচরণ দেখে অবন্তিকা ভালো করে বুঝতে পারছে। রাহি আর ওর শাশুড়ী অতটা সুবিধার না।
অবন্তিকা কয়েকবার মুনতাহা কে ডেকেছে কিন্তু মুনতাহা কথা বলেতে চাচ্ছে না। কিছু না করেও বার বার কেন দোষের ভাগ নিবে। মুনতাহার তো এ পরিবারের প্রতি আর কোন দায় নেই।।
মুনতাহা অবন্তিকা কে বলেছে,,
অবন্তিকা বোন তুমি আমার সাথে কথা বলিও না, পরে বলবে আমি তোমর কান বিষিয়ে তুলেছি।
— কি বলছ মুনতাহা আপু। খারাপ রা খারাপ কথাই বলবে তুমি এসব নিয়ে মন খারাপ কর না।
রাহি পাশ থেকে দাঁড়িয়ে মা কে বলছে,,
— দেখছ মা কি জাদু জানে। এত অল্প সময়ে বশ করে ফেলছে।
— বাদ দে বলছে দু এক দিনের মধ্যে বিদায় হবে।
এখন গেলে আমি বাঁচি।
…..
সাইমুন অফিসে কাজে মন বসাতে পারছে না। মুনতাহার কথা খুব মনে পড়ছে।
আচ্ছা মুনতাহা কি ভাবছে অবন্তিকার সাথে আমি হ্যাপি। আজকাল ওর মন বুঝা যায় না। কখনো আকাশে মেঘের আনাগোনা কখনো ধবধবে পরিস্কার। কখনো মনে হয় আমাকে ছাড়া নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় আবার কখনো মাঝেমধ্যে আমাকে আসেপাশে সহ্য করতে পারে না৷ কোন দোটানায় পড়লাম আমি!। অবন্তিকার ও কোন দোষ নেই। আমার জন্য মেয়েটাও ভুক্তভোগী। আমার কি ওকে সত্যি টা বলা দেয়া উচিত!!
..
.
অবন্তিকা ছাদ থেকে নেমে রুমে ঢুকতেই দেখছে রাহি অবন্তিকার মেক আপ বক্স খুলে মনের খুশিতে সাজছে। অবন্তিকার রাহি কে দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।
না বলে ওর জিনিস ধরেছে,,
— কি ব্যাপার রাহি কি করছ তুমি??
— ভাবী আমি সাজছি।
— কাউকে না বলে তার জিনিসে হাত দেয়া কি ঠিক। লজ্জা করে না আমার জিনিস দিয়ে সাজছ নাকি জীবনেও এত দামী প্রডাক্ট দেখনি।
— ভাবী তোমার জিনিস কি আমি ধরতে পারব না।
— না। আমার পছন্দ না। রুম থেকে বের হয়ে যাও।
অবন্তিকার কথা শুনে রাহির চোখ ছলছল করছে। কান্না করে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। অবন্তিকা জানে এভাবে ব্যাবহার করা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু অবন্তিকাও পরিস্থিতির কাছে বাঁধা পড়েছে। তারউপর ওরা মুনতাহার সাথে যেভাবে কথা বলে ওদের ও বুঝা দরকার খারাপ কথা শুনতে ঠক কতখানি কষ্ট হয়। সবার মনের দাম আছে। আশ্রিতা হলে যে মন থাকবে না এমন টা না।
.
.
মুনতাহা সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগে ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। সাইমুনের পরিবার মুনতাহা কে যা দিয়েছে মুনতাহা সাথে করে কিছুই নিচ্ছে না। এমনকি সাইমুনের দেয়া কোন জিনিস মুনতাহা নিচ্ছে না। নিলে মুনতাহা নিজের কাছে নিজে ছোট হয়ে যাবে। যারা ভালোবাসা নিতে পারেনি তার জিনিস নিয়ে কি হবে। বরং সেই জিনিস গুলো মুনতাহা কে দূর্বল করে দবে।
শেষ বারের মত বাসা টা নতুন করে দেখে নিচ্ছে। কত স্বপ্ন স্মৃতি এ বাসার সাথে জড়িয়ে আছে। নিজের হাতে স্বপ্নের বাগান সাজিয়েছে। মেয়েদের নিজের বলতে কিছুই হয় না। যতক্ষণ দিতে পারে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের প্রয়োজন।
মুনতাহা দেয়ালে হাত বুলাতে বুলাতে,,
সাইমুন তুমি আমার ভালো থাকার মুহুর্ত গুলো কেড়ে নিয়েছ কিন্তু আমার ভিতরের জমানো লুকিয়ে রাখা ভালোবাসা কেড়ে নিতে পারনি। কখনো পারবে না!! ।সেই ভালোবাসার সুন্দর মুহুর্ত গুলো দিয়ে আমি সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারব।
পাশে থেকে হয়ত সবাই ভালোবাসি কথাটা বলতে পারে কিন্তু ভালোবাসার স্মৃতি আগলে রেখে সারাজীবন কি সবাই বাঁচতে পারে। যারা পারে তারাই তো সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষ।।
আমি খুব করে চাই জীবনের একটাসময় আমার কথা মনে করে তোমার বুকটা হাহাকার করে উঠুক। সেদিন টা বেশি দূরে নেই।। ভালো থেকো আমার ভালোবাসা অন্য কোন নীড়ে…
মুনতাহা কাউকে না বলে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। যাওয়ার সময় মুনতাহার দীর্ঘশ্বাস, কান্না মিলেমিশে একাকার। বের হবার পর পিছন ফিরে বাড়িটা দেখছে। যখন বউ হয়ে এ বাড়িতে এসেছিলো তখন কি ভেবেছিলো মাঝপথে শূন্য হাতে অপবাদ অসম্মান নিয়ে বের হতে হবে।
মুনতাহার বাবার বাসা খুব বেশি দূরে নয় আবার কাছে ও না। যেতে ১ ঘন্টার বেশি সময় লাগবে।
.
.
দরজা বন্ধ দেখে অবন্তিকা মুনতাহা কে ডিস্টার্ব করেনি। রাহি রাগ করে নিজের রুমে বসে আছে। অনেক রাত হয়ে গেলো সাইমুন বাসায় আসেনি। অবন্তিকা ইচ্ছা করে টিভির সাউন্ড বাড়িয়ে দিয়ে মুভি দেখছে।
রাহিকে ওর মা বুঝানোর চেষ্টা করছে,,
–অবন্তিকার বয়স কম একটু সময় দে ঠিক হই যাবে। তুই রাগ করে থাকিস না মা।
— মা তুমি দেখছ না কিভাবে কথা বলে।
— একটা বাচ্চা আসলে দেখবি এত তেজ থাকবে না।
— না থাকলে ভালো।
— খাইতে আয়।
— আমি খাব না। আমার কাজ আছে তুমি যাও।
রাহি দরজা বন্ধ করে মোবাইলে কথা বলতে বিজি হয়ে গেলো। রাহির সাথে ২ বছর ধরে তারেক এর সম্পর্ক। খুব অল্প সময়ে দুজন দুজনের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছে। ৬ মাস আগে দুজন কাজী অফিসে গিয়ে লুকিয়ে বিয়ে করে ফেলছে। তারেক চেয়েছিলো রাহি কে আপন করে পেতে আবার দুজনের ফ্যামিলিতে এখন বিয়ের কথা বলা যাবে না তাই দুজন সিদ্ধান্ত নিয়ে বিয়ে করেছে। তারেক বলেছে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে পারিবারিক ভাবে সব ঠিক করে নিবে।
রাহি সারাদিনে কি কি হয়েছে সব তারেক কে বলছে।
যখন কাউকে ভালোবাসে তখন সে মানুষ টি হয় দুনিয়ায় সবার চেয়ে আপন। যাকে মনের সব কথা প্রাণ খুলে বলা যায়। আসলে কি সব কথা বলা ঠিক!!
কিছু কথা গোপন থাকা ভালো। আজ যে মানুষ খুব কাছের কাল সে পর হতে কতক্ষণ। চোখের আড়াল হলে সবাই দূর্বলতা নিয়ে টানাটানি করে। নিজের হাজারো দূর্বলতা থাক তাতে কি অন্যের সমলোচনা করতে আমরা বড্ড ভালোবাসি।
তাই রাহি মুনতাহার সব কথা তারেক কে বলছে। তারেক ও রাহির সাথে তাল মিলাচ্ছে। অই যে ভালোবাসার মানুষের কথা ভুল জানার পরে সঠিক করতে আমরা সবাই ব্যাস্ত।
— জানো কলিজা মুনতাহা ভাবী বিষের মত আমাদের পরিবার টা কে নিঃশেষ করে দিচ্ছে।
— কি বল তাই নাকি!!
— আর কি বলব তোমায়। নতুন ভাবি কে আসতে না আসতে মাথায় আমাদের নামে যাতা ঢুকিয়ে দিছে।
— আহারে আমার বউ টা কত ঝামেলাতে আছে।
— হুম তাই তোমারে বলছি আমাকে তাড়াতাড়ি বউ পরিচয়ে নিয়ে যাও।
— নিব সোনা একটু অপেক্ষা কর।
— উম্মাহ
..
মুনতাহা চলে গেছে বাসার কেউ জানতে ও পারলো না। অবন্তিকা খেয়ে সাইমুন আসার আগে শুয়ে পড়লো। আহানাফ কে খুব মিস করছে।। আহানাফ সারাদিনে কয়েকবার মেসেজ করেছে। এখন ও কল দিচ্ছে। অবন্তিকা ভাবছে ধরবে কিনা। চিন্তা করতে করতে রিসিভ করলো,,
— কি ব্যাপার আহানাফ এত বার কল দিচ্ছ কেন??
— খুব সুখে আছ তাই না!!
— আমি শুশুর বাড়ি তোমাকে বুঝতে হবে। কেউ দেখলে ঝামেলা হয়ে যাবে।
— হুম সেটাই। আমি কিভাবে আছি, আমার রাত কিভাবে কাটছে একবার ভেবেছ??
— শুধু এটাই বলব আমি তোমার ছিলাম তোমার আছি তোমারি থাকব।।
— ও কি তোমার কাছে আসার চেষ্টা করে??
সাইমুন রুমে আসছে দেখে অবন্তিকা তাড়াতাড়ি মোবাইল রেখে শুয়ে পড়লো…
….চলবে…..