গল্প ¦ অঙ্ক টিচার— পর্বঃ- ৯ (শেষ)
শারমিন আক্তার
__তনয়াঃ (গালে হাত দিয়ে) আবার চড় মারলেন? কোন অধিকারে বার বার আপনি আমায় চড় মারেন? আর তাছাড়া ইউ আর টু লেট।
আর——
কথাটা বলার আগেই আয়াত তনয়াকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে বলে—–
আয়াতঃ অধিকার কি অধিকার তাই না? তোমার উপর যদি আমার অধিকার না থাকে তাহলে কারো নাই,
তনয়াঃ এত রাগ দেখানোর কোন প্রয়োজন নাই। কিসের জোড়ে আপনি আমার উপর অধিকার খাটাচ্ছেন? এই বলে তনয়া চলে যেতে চাইলে
আয়াত তনয়াকে আরো শক্ত করে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে আয়াত তনয়ার একদম কাছে চলে যায়। এতটা যে একে অপরের নিঃশ্বাসের অনুভুতি পাচ্ছিলো। আয়াত তনয়ার কাছে গিয়ে বললো আমার ভালোবাসার জোড়ে আমি তোমার উপর অধিকার খাটাচ্ছি।
তনয়াঃ ধাক্কা দিয়ে আয়াতকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলে একদিন পর যে অন্য একজনকে নিজের স্ত্রী হিসাবে স্বীকার করবে তার মুখে ভালোবাসা, অধিকার নামক কথা শোভনীয় লাগে না?
আয়াত তনয়ার হাতটা শক্ত করে ধরে বলে চলো আজ এখন সবার সামনে আমি তোমাকে বিয়ে করবো। দেখি কে কি করে? আমি কারো পরোয়া করি না।
তনয়াঃ( অবাক হয়ে) প্লিজ স্যার রাগের মাথায় কোন কাজ করবেন না। রাগ মানুষের গুছানো কাজকেও নষ্ট করে দেয়। প্লিজ বোঝার চেষ্টা করুন স্যার!
আয়াতঃ জাস্ট সেটাপ।
আয়াত তনয়াকে ওর বাবার কাছে নিয়ে যাবে এর মধ্যে লিমা এসে বললো আয়ান ভাইয়া এসেছে তার বৌ নিয়ে।
আয়াতঃ কি? আর বাবা?
আয়াত, তনয়া, লিমা তাড়াতাড়ি আয়াতের বাবার কাছে যায়। গিয়ে দেখে আয়াতের বাবা আয়ান ভাইয়ার সাথে কথা বলছেন
আয়াতের বাবাঃ আজ আয়াতের জন্য তোমাকে মাফ করে দিলাম। দেখো আজ আয়াত আমাকে কত বড় খুশি দিচ্ছে। দেখো আয়াত আমাকে দেয়া কথা রেখেছে। তাই এই খুশির কারনে আমি তোমাকেও মাফ করে দিলাম।
আয়াতের বাবার এই খুশি দেখে আয়াত আর কিছু বলতে পারলো না। তনয়া আয়াতেকে সাইডে এনে বলে****
তনয়াঃ দেখুন স্যার আজ আপনার বাবা কত খুশি। আপনি কি চান তার এই খুশিটা নষ্ট হয়ে যাক? দেখুন স্যার আমার আপনার উপর কোন রাগ বা ক্ষোপ নেই কেন জানেন? কারন আপনি নিজের খুশির কথা না ভেবে আপনার বাবার খুশির কথা ভেবেছেন। আর এই জন্যই আমি আপনাকে না পাওয়ায় জন্য মনে কোন রাগ রাখি নাই। হ্যা আপনাকে না পাওয়ার দুঃখ কষ্ট আফসুস তো আছে আর সারা জীবন থাকবে। কিন্তু আমি এটা ভেবে নিজেকে সামলে নিবো যে আপনার বাবা মা আর আপনি সুখে আছেন। স্যার বাবা মায়ের মত কেউ হয়না।
স্যার আপনি তাদের কথা মেনে নিন। বাবা মাকে কষ্ট দিয়ে কেউ জীবনেও খুশি হতে পারেনা। আর বাবা মাকে সুখি করার জন্য যদি নিজে কষ্ট পায় তাহলে আল্লাহ সে কষ্টের প্রতিদান একদিন না একদিন ঠিকই দিবে। চলি স্যার ভালো থাকবেন। আমি আজকেও আসতাম না কিন্তু আজ শেষ বারের মত আপনাকে একবার দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। ভালো থাকবেন।
এটা বলে তনয়া ওখান থেকে চলে গেলো। আর আয়াত হা হয়ে ওর যাবার পানে তাকিয়ে আছে। তনয়া একবারের জন্যও পিছু তাকায়নি হয়তো নিজের চোখের জলটা আয়াতকে দেখাতে চায়নি তাই।
আজ আয়াতের বিয়ে। কিছুক্ষনের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেলো। আয়াতের ঘোরের মত লাগছে। একটা ঘোরের মধ্যেই বিয়েটা হয়ে গেলো। আয়াত মুখ থেকে যখন কবুল বলছিলো তখন ওর কলিজাটা যেনো ছিড়ে যাচ্ছিলো। বিয়ে হবার কিছুক্ষন পর আয়াত তনয়ার কাছে ফোন করলো। ফোনটা নেহা ধরলো।
নেহাঃ হ্যা স্যার বলেন?
নেহার গলা শুনে আয়াতের বুকটা অজানা ভয়ে ধক করে উঠলো।
আয়াতঃ তনয়া কোথায়?
নেহাঃ বেঁচে আছে ভয় নাই আপনার! আমার পাশেই আছে। কিন্তু আমি আপনাকে ওর সাথে কথা বলতে দিবো না। আপনি আপনার নতুন বৌ এর কাছে যান।
এই বলে নেহা ফোনটা কেটে দিলো।
আয়াতও আর কথা বাড়ালো না। রাত অনেক হলো কিন্তু আয়াত নিজের রুমের দিকে যাবার নামও করছে না। ওর ভাবি ওকে জোড় করে রুমের ভিতর ডুকিয়ে দিলো। আয়াত রুমে ডুকে কিছুক্ষন নীরব থাকলো। তারপর ধীরে ধীরে বিছনার কাছে গিয়ে বলেলো—–
আয়াতঃ স্যরি অবনী আমি আসলে তোমাকে বিয়ে করতে চাইনি। আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি। তোমাকে স্ত্রী হিসাবে মেনে নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। পারলে আমাকে মাফ করে দিও।
এই বলে আয়াত যাওয়া ধরলেই মেয়েটা আয়াতের হাতটা টান দিয়ে বিছানায় ফেলে দিয়ে আয়াতের পাঞ্জাবির কলার ধরে বললো ঐ আমাকে কি রবি সিমের মত ফ্রি পাইছেন?
যে যখন খুশি চড় মারবেন? যখন খুশি ভালোবেসে জড়িয়ে ধরবেন? যখন খুশি বলবেন বিয়ে করবেন না? আবার বিয়ে করে বলবেন স্ত্রী হিসেবে মেনে নিবেন না? কি সমস্যা কি আপনার?
আয়াত কথা গুলো শুনে অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে তার থেকে একশগুন বেশি শক খেলো!
কারন মেয়েটি আর কেউ নয় তনয়া। আয়াত যেনো কিছুক্ষনের জন্য নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। মনে হচ্ছে স্বপ্ন আর বাস্তব দুনিয়ার মাঝে একটা আলাদা দুনিয়া তৈরী হয়ে গেছে আর আয়াত সে দুনিয়ায় হারিয়ে গেছে।
তনয়া জোড়ে আয়াতের হাতে একটা চিমটি কাটলো। আয়াত নিজের চেতনা ফিরে পেলো। হচকিয়ে বললো
আয়াতঃ তনয়া তুমি?
তনয়াঃ কি স্যার সারপ্রাইজটা কেমন লাগলো?
আয়াত যেনো এখনো নিজের ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারছে না। তারপরও বললো
আয়াতঃ অবনী কোথায়?
তনয়াঃ ইসসস অবনীর খুব চিন্তা হচ্ছে না? আমি অবনীকে মেরে ফেলেছি। বলে জোড়ে হাসেছে তনয়া!
আয়াত যেনো কিছুই বুঝতে পারছে না। এর মধ্যে কে যেনো দড়জায় টোকা দিলো?
আয়াত দড়জা খুলে দেখে অবনী দাড়িয়ে হাসছে—
অবনীঃ হাই দুলাভাই! হোয়াট’স আপ? এখনো বাসর শুরু করেন নি? কেন আমার জন্য ওয়েট করছিলেন বুঝি?
আয়াত আবার একটা ধাক্কা খেলো।
এদিকে তনয়া আর অবনী মিলে হাসতেছে। এর মধ্যে বাড়ির সব লোক যেমন আয়াতের বাবা মা, ভাইয়া ভাবি, লিমা আর নেহা সেখানে উপস্থিত হলো। এবং সবাই হাসছে। আয়াত যেনো বোকা হয়ে গেছে। কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা তা যেনো একটা ভ্রমের মত লাগছে ওর কাছে!
আয়াতঃ বাবা এসব কি হচ্ছে?
আয়াতের বাবাঃ আমি জানতাম না যে আমার ছেলে তার বাবা মায়ের জন্য নিজের ভালোবাসার মানুষকেও ছাড়তে পারে!
আয়াতঃ মানে?
আয়াতের বাবাঃ তোমার বিয়ে কখনোই অবনীর সাথে ঠিক হয়নি। তোমার বিয়ে অনেক আগে থেকেই তনয়ার সাথে ঠিক হয়ে আছে।
আয়াত চোখ বড় বড় করে কি? তাহলে অবনী?
আয়াতের বাবাঃ অবনী তনয়ার কাজিন। তনয়া যখন আমাদের বাসায় পড়তে আসতো তখন থেকেই আমি বুঝেছিলাম যে তুমি তনয়াকে ভালোবাসো। কিন্তু আমি দেখতে চেয়েছিলাম তুমি তোমার বাবাকে কতটা ভালোবাসো? তাই তোমার বিয়ে তনয়ার সাথেই ঠিক করেছিলাম কিন্তু ছবি দেখালাম অবনীর মানে তনয়ার কাজিনের। কিন্তু আমি শেষ পর্যন্ত দেখতে চাইছিলাম যে তুমি তনয়ার ভালোবাসায় মোহীত হয়ে নিজের বাবা মাকে ছেড়ে যাও কিনা?
কিন্তু তুমি তা করোনি। তুমি তোমার বাবা মায়ের চাওয়াটাকেই প্রধান্য দিয়েছো। তোমাকে নিয়ে আজ আমার সত্যিই গর্ব হচ্ছে।
আয়াতঃ তারমানে তনয়া সব জানতো?
আয়াতের বাবাঃ নাহ। তনয়া জানে মাত্র তিন মাস ধরে। কারন তনয়ার জন্ম দিনে তনয়াকে আমি উপহার স্বরূপ তার অঙ্ক টিচারকে গিফ্ট করেছি। কারন তনয়াই আমাকে ভালোবাসার আসল মানে শিখিয়েছে! তোমার ভাইয়া আর ভাবিকেও সে ফিরিয়ে এনেছে।
তনয়াঃ স্যরি স্যার। আমার জন্মদিনের দিন যখন বাবা সব খুলে বললো তখন আমি খুশিতে ঠিক কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। আপনার সামনে দুঃখি হবার এ্যাটিং করতে আমার ভিষন খারাপ লেগেছে। কিন্তু আমি আপনার বাবাকে ওয়াদা করেছিলাম আপনাকে কিছু বলবো না। তাই।
তারপর লিমা আর নেহা একসাথে বলে উঠলো আমরাও স্যরি! আসলে কিছু দিন আগে থেকে আমরাও সবটা জানি!
আয়াত রাগে দুঃখে কোন কথা বলতে পারছে না। রাগের চোটে ওখান থেকে সোজা ছাদে চলে গেলো।
তনয়াঃ বাবা ওনি তো রাগ করলেন এখন আমি কি করবো?
আয়াতের বাবা মাঃ আমাদের মত বুড়োবুড়িদের এর মধ্যে না টানাই ভালো! আয়ানের মা চলো অনেক রাত হয়েছে। এই বলে তারা চলে গেলেন।
লিমাঃ আমি এর মধ্যে নাই আমার বাচ্চা কাঁদছে যাই।
ভাইয়া ভাবিঃ আমাদের অনেক কাজ আছে। চলো চলো
নেহাঃ দেখ তনয়া স্বামীটাতো তোর তাই রাগটাও তুই ভাঙা। আমি যাই নয়নের সাথে একটু ফোনে প্রেম টেম করি। বাই ডিয়ার।
তনয়া বোকার মত সবার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। তারপর মনে মনে বললো সব গুলো এক একটা বজ্জাতের হাড্ডি। পরে আমিও দেখে নিবো?
তনয়া ধিমি পায়ে ছাদে উঠে দেখে ছাদের এক কোনায় আয়াত দাড়িয়ে আছে।
তনয়া কি করবে ঠিক ভেবে পাচ্ছে না। তাই আস্তে আস্তে গিয়ে আয়াতকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
তারপর আয়াতকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো স্যরি স্যার।
আয়াত কোন কথা না বলে তনয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ওঠে। আয়াতের কান্না দেখে তনয়াও কেঁদে ফেলে। তারপর বলে—-
তনয়াঃ বললামতো স্যরি!
আয়াতঃ স্যরি বললেই সব ঠিক হয়ে গেলো বুঝি? জানো এই কয় মাস কি রকম মানুষিক চাপের মধ্যে দিয়ে গেছি?
তনয়াঃ ইসসসসস! মাত্র কয় মাস আর আমাকে যে সারে চার বছর ধরে রেখেছেন? তার বেলায়? ইট’স রিভেন্স! এখন শোধ বোধ!
তনয়ার কথা শুনে আয়াত মুচকি হেসে বললো তাহলেও তো তুমি কম, কারন আমি তোমাকে কবে থেকে ভালোবাসি জানো?
তনয়াঃ জানি! লিমাআপু বলেছে! স্যার যা হয়েছে সব ভুলে যাননা প্লিজ! চলুননা নতুন করে শুরু করি!
আয়াতঃ কি করে শুরু করি বলো তো?
তনয়াঃ কেন আবার কি হয়েছে?
আয়াতঃ তুমিতো এখনো সেই স্যারের আটকে রয়েছো? আমি এখন তোমার বর! বুঝলা?
তনয়াঃ লজ্জা পেয়ে হুমম।
আয়াত তনয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা ভালোবাসার পরশ একে দেয়।
তনয়াঃ দ্যাট’স নট ফেয়ার স্যার?
আয়াতঃ হোয়াই?
তনয়াঃ চড় মারলেন গালে আর ভালোবাসা কপালে ?
আয়াতঃ শুধু গালে কেন সব জায়গায় ভালোবাসা দিয়ে দেই! দুষ্টমি করে
তনয়াঃ এই একদম না!
আয়াতঃ তা বললে তো হবে না ম্যাডাম পাঁচ বছর ধরে ওয়েট করছি আর পারবো না।
অতপরঃ———-
তনয়া এখন অঙ্কের উপর অনার্স করছে আর মজার বিষয় কি জানেন? আয়াতও সেই কলেজেই প্রফেসর গিরি শুরু করেছে। তনয়াকে দুবেলা অঙ্কে সাথে সাথে ভালোবাসার পাঠটাও শিখায়।
ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।
গল্পটা কেমন লাগলো তা জানাবেন।