#প্রেমাতাল পর্ব ৪০
লেখা- মৌরি মরিয়ম
মুগ্ধ বাসায় ফিরতেই দেখলো পিউরা মাত্রই এসেছে, যাক বেশি দেরী হয়নি তাহলে। সবার সাথে গল্পগুজব, হইচই, খাওয়াদাওয়ার পর রাত ১২ টার দিকে পিউরা চলে গেল। মুগ্ধ নিজের ঘরে গিয়ে শুয়েছে কেবল। এমনসময় মা এসে দরজায় নক করলো,
-“ঘুমিয়ে পড়েছিস বাবা?”
-“না, মা.. খুলছি দাঁড়াও।”
দরজা খুলতেই মা বলল,
-“ঢুকবো না, একটা কথা বলতে এসেছি। ভুলে গিয়েছিলাম।”
-“হ্যা বলো।”
-“মুগ্ধ, তোর একটা পার্সেল এসেছে।”
-“কোত্থেকে এসেছে? কে পাঠইয়েছে?”
-“মতিঝিল থেকে পাঠিয়েছে কিন্তু কে পাঠিয়েছে তা তো লেখা নেই। হয়তো তোর বার্থডের জন্য কেউ গিফট পাঠিয়েছে।”
-“কে আবার গিফট পাঠাবে! যাই হোক, কোথায় সেটা?”
-“তোর আলমারিতে ডান পাশের লকারে রেখেছি।”
-“আচ্ছা, ঠিকাছে।”
মা চলে যেতেই আলমারি খুলে জিনিসটা বের করলো মুগ্ধ।
বেশ বড় একটা বক্স র্যাপিং করা। কে পাঠালো! তিতিরের অফিস মতিঝিলে কিন্তু তিতিরের সাথে তো দেখাই হলো! ও দিলে তো হাতে হাতেই দিতে পারতো। তমালের বাসা মতিঝিল, মানে আরামবাগ আর কি! ও কি পাঠালো? যাই হোক খুললেই বোঝা যাবে। র্যাপিং খুলতেই একটা বড় কাগজের বক্স দেখতে পেল মুগ্ধ। বক্সটা খুলতেই দেখলো একটা হালকা আকাশী রঙের ফরমাল শার্ট, একটা নেভি ব্লু টাই, মুগ্ধর প্রিয় ব্র্যান্ডের একটা পারফিউম, একটা সানগ্লাস আর একটা কালো ডায়েরি। এ কাজ তিতির ছাড়া আর কারো নয়। সবার আগে ডায়েরিটা হাতে নিল। ডায়েরি হাতে নিতেই একটা চারভাজ করা কাগজ পড়লো নিচে। কাগজের উপরে লেখা “Open me first” তিতিরের হাতের লেখা। নিজের অজান্তেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো ওর। ডায়েরিটা রেখে কাগজটা খুলল। ইয়া বড় একটা কাগজে মাত্র দু’লাইন লেখা,
“পন্ডিতি করে আবার ডায়েরির শেষের পাতাগুলো আগে পড়োনা প্লিজ। প্রথম পাতা থেকে পড়া শুরু করো, সিরিয়ালি পড়বে।”
মুগ্ধ গিফটগুলোকে বিছানার একপাশে রেখে ডায়েরিটা নিয়ে শুয়ে পড়লো। আরাম করে পড়বে। ডায়েরিটা খুলতেই প্রথম পাতায় দেখলো একদম পুরোনো দিনের মত স্টাইল করে লেখা চিঠি। পড়তে শুরু করলো মুগ্ধ,
এই,
তোমাকে কোনদিনও নাম ধরে ডাকিনি। কখনো তোমাকে নাম ধরে ডাকার ইচ্ছেও করেনি, চেষ্টাও করিনি। তাই চিঠিতেও নাম সম্বোধন করলাম না।
এটা পেয়ে কি ভাবছো রঙঢঙ করে চিঠি লিখছি কেন? কেন জানি ইচ্ছে হলো লিখতে।
তুমি এমন একটা সময়ে আমার জীবনে এসেছিলে যখন আমি প্রেম বুঝতাম কিন্তু জানতাম না ভালবাসা কি? তুমি এসে ভালবাসার সাথে পরিচয় করালে। এমনভাবে, বোঝালে দেখালে ভাল কত রকম ভাবে বাসা যায়। আমি নিজের অবচেতন মনেই সবকিছু তোমার মত করে ভাবতে শুরু করি। তোমার আইডিওলজি গুলো ফলো করতে শুরু করি। আমার মনে হয় তুমি যেটা করো সেটাই ঠিক, মনে হয় একটা আদর্শ পুরুষ হতে হলে তোমার মত হতে হবে। সুহাস খুব ভাল ছেলে কিন্তু তোমার মত নয়। ও খুব ভদ্র, কখনো দুষ্ট কথা বলে না। কিন্তু আমার মনে হয় পুরুষ মানুষদের দুষ্টুই হওয়া উচিৎ।
ও আমার সাথে লাঞ্চ করতে আসে প্রায়ই, বলে আসেনা সারপ্রাইজ দিতে চায়। কিন্তু যদি আমি অলরেডি লাঞ্চ করে ফেলি ও মন খারাপ করে আর খায়না। তুমি হলে বলতে,”খেয়েছো ভাল করেছো। এখন আমার সাথে আবার খাবে।” পুরুষ মানুষদের তো এমনই হওয়া উচিৎ তাইনা বলো?
সুহাস ঠিক তোমার মত করেই আমার দিকে তাকিয়ে থাকে মাঝে মাঝে। সেটা বুঝতে পেরে যদি আমি ওর দিকে তাকাই ও চোখ ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু তুমি তো তাকিয়ে থাকতে, তোমার ওই দৃষ্টি দিয়ে মেরে ফেলতে আমাকে। আর কেউ পারবে না আমাকে তোমার মত করে মারতে। এ মরণ সুখের মরণ। আমি আর কোনদিনও এভাবে মরতে পারবো না। তবু আমি সুহাসকেই বিয়ে করতে চলেছি। আমি জানি আমাকে ছাড়া থাকতে তোমার কতটা কষ্ট হয়। কত স্বপ্ন দেখেছিলে তুমি আমাকে নিয়ে। আর আমি? তোমার স্বপ্নগুলোকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়ে চলে আসি। আমার আর কোন উপায় নেই। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার অসহায় লাগে। জানো, বাবা সারাদিন বাসায় থাকে। সামনের মসজিদে নামাজ পড়তে যায় শুধু। নামাজ পড়ে এসেই হাপাতে থাকে। তিনবেলা মুঠো ভরতি করে ওষুধ খায়। আমি এই দৃশ্য সহ্য করতে পারি না। আমার বাবা আর কোনদিনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে না এটা আমি মানতেই পারিনা। আবার তোমাকে ছাড়া সারাটা জীবন অন্য একজনের সাথে সংসার করতে হবে এটাও ভাবতে পারি না। যাই হোক, পারলে আমাকে ক্ষমা করো, তোমার ভালবাসার মান রাখতে পারিনি আমি। অথচ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সব মুহূর্তগুলো তোমার দেয়া। কি জানো? নীলগিরিতে পাহাড় দেখানো, পথে ডাকাতদের হাত থেকে বুকে আগলে আমাকে বাঁচানো, থানচিতে আমার কানে কাজলের কালি লাগিয়ে দেয়া, কথায় কথায় আমাকে গান শোনানো, রেমাক্রি ফলসে আমার পাগলামিগুলো হাসিমুখে সহ্য করা, রেমাক্রিতে আমাকে মেঘ ছোঁয়ানো, নফাখুমের পথে হুট করে সবার মধ্যে থেকে আমাকে কোলে তুলে নেয়া, নাফাখুম জলপ্রপাতের পানিতে আমাকে নিয়ে ভাসা, তোমার সাথে চিটাগাং যাওয়া, বান্দরবানের সেই রাত! তোমার আমার প্রথম চুমু, একসাথে মহুয়া খাওয়া, টিওবির প্রত্যেকটা ট্যুরে দুজনের একসাথে যাওয়া পাগলামি করা, আমার প্রত্যেকটা জন্মদিনকে স্পেশাল করা, বিছনাকান্দির পানিতে তোমার বুকের উপর আমার ভেসে বেড়ানো! এই সবকিছু! স্পেশালি সিলেটের সেই রাত। আমার সারাটা শরীর মন সেদিন চাইছিল তোমাকে, আমি লজ্জায় বলতে পারিনি। যতটুকু পেয়েছি তাও অবশ্য কম না। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত। বাই দ্যা ওয়ে, তুমি কিন্তু খুব সুন্দর করে আদর করো। আরো কতরকম পাগলামি ভরা আদর তুমি করতে পারো জানার ইচ্ছে ছিল। ভাগ্যে হলো না। এসব নিয়ে সরাসরি কখনো আলোচনা করোনা প্লিজ, খুব লজ্জা পাব।
ভাল থেকো।
-তোমার রসগোল্লা তিতিরপাখি।
চিঠি শেষ। পৃষ্ঠা ওলটালো মুগ্ধ। ওদের বান্দরবান যাওয়ার টিকেট, সিলেট আর বান্দরবানের হোটেলের ভাউচার স্কচটেপ দিয়ে ডায়েরিতে আটকানো। এখন বুঝতে পারলো তিতির কেন ওগুলো নিয়ে যেত। আরো কয়েকটা পৃষ্ঠা ওলটাতেই ডায়েরিতে একটা খাম আটকানো দেখলো। খামের উপর লেখা “Miss me? open it” খামটা খুলতেই টিস্যুতে পেঁচানো একটা শক্ত, মোটা কাগজ পেল। টিস্যু সরাতেই দেখলো কাগজে অসংখ্য ঠোঁটের ছাপ। এ ঠোঁট মুগ্ধর চিরচেনা। তিতির ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে কাগজে ছাপ দিয়েছে। মুগ্ধ ঠোঁটের ছাপগুলোর উপর হাত বুলিয়ে নিল। তারপর কাগজটাতে চুমু দিল। ওর চোখ ভরে উঠেছে জলে।
চার মাস পর বেলা ১১ টার দিকে মুগ্ধর ফোন এল তিতিরের কাছে। তিতির একটু অবাক হলো মুগ্ধ ফোন করলে রাতে করে, অফিসে থাকতে কখনোই ফোন করে না। কোন অঘটন কি ঘটলো? তিতিরের বুক ধড়ফড় করতে লাগলো। ফোন ধরে বলল,
-“হ্যালো..”
-“তিতির?”
-“হ্যা।”
-“কেমন আছো?”
মুগ্ধর কন্ঠটা একটু অন্যরকম লাগলো। কি হয়েছে কে জানে! বলল,
-“ভাল, তুমি কেমন আছো?”
-“অনেক ভাল, আরো ভাল থাকার ব্যবস্থা করছি।”
-“কি?”
-“আমি বিয়ে করছি, ইকরাকে।”
তিতিরের মনে হলো ওর বুকের মধ্যে কেউ ১০০ ছুরির কোপ বসিয়েছে। মুগ্ধ ইকরাকে বিয়ে করছে কেন? দুনিয়াতে কি মেয়ের অভাব? স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
-“ও, কংগ্রাচুলেশনস! কবে বিয়ে?”
-“এই শুক্রবার।”
-“তাহলে তো আর ৪ দিন পরই।”
-“হ্যা।”
-“এত তাড়াতাড়ি সব এরেঞ্জমেন্ট কি করে করবে?”
-“কোন এরেঞ্জমেন্ট নেই। আমরা ইকরাদের বাসায় যাব, কাজী আসবে বিয়ে পড়াবে শেষ। ইকরাকে নিয়ে চলে আসব। কোন অনুষ্ঠান হবে না, কেউ ইনভাইটেড থাকবে না, শুধু ফুপীরা আর আমরা।”
-“ওহ, এটাও ভাল।”
-“ঠিকাছে তিতির রাখছি, আমি অফিসে তো।”
-“আচ্ছা।”
মুগ্ধ ফোনটা রেখে দিল। তিতিরের নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছিল, কি এমন হয়েছে যে এত তাড়াহুড়ো করে বিয়ে হচ্ছে মুগ্ধর? আর যে ইকরাকে ও সহ্যই করতে পারেনা সেই ইকরাকেই বিয়ে করছে! ভাবতে থাকলো তিতির, কিন্তু কোন কূলকিনারা পেল না।
ফোনটা এল দুপুরবেলা। মুগ্ধর মায়ের নাম্বার দেখে তিতিরের বুক কেঁপে উঠলো। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে এল,
-“হ্যালো তিতির?”
-“জ্বী আন্টি। আসসালামু ওয়ালাইকুম।”
-“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো মা?”
-“ভাল, আন্টি আপনি ভাল আছেন?”
-“আছি বাবা, ভালই আছি। তোমার সাথে একটু কথা ছিল।”
-“হ্যা আন্টি বলুন।”
-“মুগ্ধ তোমাকে আজ ফোন করেছিল?”
-“হ্যা করেছিল।”
-“তাহলে তো জানোই বোধহয় বিয়ের ব্যাপারটা।”
নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে তিতির বলল,
-“ও বলেছে আমাকে।”
-“এই শুক্রবারই ওদের বিয়েটা ঠিক করেছি। মাগো তোমার কাছে আমার একটা রিকোয়েস্ট.. যেহেতু তুমি মুগ্ধকে বিয়ে করতে পারবে না, তুমি ওর জীবন থেকে পার্মানেন্টলি সরে যাও।”
-“আন্টি ওর সাথে এখন আর আমার সম্পর্ক নেই।”
-“জানি মা, কিন্তু এর মধ্যে ও হয়তো তোমার সাথে দেখা করতে চাইতে পারে। তুমি দেখা করোনা মা। অনেক কষ্টে, অনেক কিছুর পর আমি ওকে এই বিয়েতে রাজী করাতে পেরেছি। প্লিজ এখন তুমি এমন কিছু করোনা বা এমন কিছু বলোনা যাতে আবার মুগ্ধ ডিসিশন চেঞ্জ করে ফেলে। এভাবে তো চলতে পারেনা, তাইনা? আমি আজ আছি কাল নেই। আমি মরার পর কে দেখবে ওকে? এভাবে একা একা সারাজীবন কাটাবে এটা আমি মা হয়ে কিভাবে সহ্য করি বলো? ইকরা ওকে পাগলের মত ভালবাসে, সেই ছোটবেলা থেকে। তুমি মুগ্ধর সাথে থাকলে আমি যতটা নিশ্চিন্ত থাকতাম, ইকরা ওর সাথে থাকলেও আমি ঠিক ততটাই নিশ্চিন্ত থাকব।”
-“আমি ওদের বিয়েতে বাধা দেবনা আন্টি। আমিও চাই মুগ্ধর একাকিত্ব ঘুচুক।”
-“লক্ষী মা আমার। নিশ্চিন্ত করলে আমাকে। ঠিকাছে রাখছি।”
ফোন রেখে তিতির কান্নায় ভেঙে পড়লো।
To be continued…