শালুক ফুলের লাজ নাই !! Part- 24
ধ্রুবর মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে।একটু আগে শাপলা কল দিয়েছে শালুকের ফোন থেকে।আদনান যা যা করেছে সব বলেছে শাপলা ধ্রুবকে।
তারপর থেকে ধ্রুবর মন মেজাজ বিগড়ে আছে।রাগ উঠেছে সপ্তমে।অযথাই মাথা গরম হচ্ছে।
এই শীতের দিনেও ধ্রুবর শরীর থেকে ঘাম বের হচ্ছে। যা নিয়ে ধ্রুব চিন্তায় ছিলো তাই হচ্ছে।
নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো ধ্রুব।এরকম অযথাই রাগে ফোঁসফোঁস করার স্বভাব ধ্রুবর নেই।ধ্রুব মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করার মানুষ।
এই মুহুর্তের অতিরিক্ত রাগ ধ্রুবকে ভাবিয়ে তুলছে।সে কি নিজেকে কন্ট্রোল করতে ব্যর্থ হচ্ছে!
ধ্রুবর দাদী বলতেন, অতিরিক্ত রাগ হলে যাতে মাটির দিকে থাকে তাহলে রাগ মাটি হয়ে যাবে।আর নয়তো পানির দিকে তাকিয়ে থাকতে তাতে রাগ পানি হয়ে যাবে।
এই বিশাল শপিং মলের দুই তলার এই শো-রুমের চৌহদ্দিতে কোনো মাটি নেই আর না আছে ওভাবে দেখার মতো কোনো পানি।বোতলের পানির দিকে তাকিয়ে রাগ কমানোর কোনো উপায় পেলো না।
ফ্লোরে শুয়ে ধ্রুব ১০০ থেকে উল্টো দিকে কাউন্ট করতে শুরু করলো। ২৩ এ এসে ধ্রুব অনুভব করতে পারলো তার রাগ কমেছে। তবুও খানিকটা মনোকষ্ট রয়ে গেলো।
শালুক কেনো তার কাছে এই ব্যাপারটা লুকিয়ে গেছে এই ভেবে।
বুঝতে পারলো না ধ্রুব শালুকের এই ব্যাপারটা।
শো-রুম থেকে বের হয়ে ধ্রুব টিউশনিতে গেলো। দুইটা টিউশনি শেষ করে শেষ টিউশনিতে যাবার সময় ধ্রুবর কেমন ইতঃস্তত বোধ হলো। এই টিউশনিটা ধ্রুবর কাছে কেমন যেনো লাগে।ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়া একটা মেয়েকে পড়ায় ধ্রুব।ফিন্যান্স আর একাউন্টিং। দুই সাবজেক্ট। সপ্তাহে ৩ দিন ফিন্যান্স তিন দিন একাউন্টিং।মাসে ১০ হাজার টাকা বেতন। কিন্তু ছাত্রীর আচার ব্যবহার কিছুদিন ধরে ধ্রুবর কাছে সুবিধাজনক লাগছে না।
ধ্রুব বাসার বাহিরে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিলো।তারপর মুখে অতিরিক্ত গাম্ভীর্য এনে বাসায় প্রবেশ করলো।
তার ছাত্রী চেয়ারেই বসে ছিলো। যেনো ধ্রুবর প্রতীক্ষা করছে বসে বসে।
ধ্রুব বসতে বসতে আড়চোখে তাকালো।
মোটা করে চোখে কাজল দিয়েছে মেয়েটা,ঠোঁটে গাঢ় খয়েরী রঙের লিপস্টিক। কানে নীল দুল পরেছে নীল জামার সাথে ম্যাচিং করে।
ধ্রুব একটা হতাশার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই মেয়েটার হাবভাব সুবিধাজনক লাগছে না বলে ধ্রুব প্রথমেই বলে দিয়েছিল সে বিবাহিত। কিন্তু মেয়েটার মধ্যে তার জন্য ভ্রুক্ষেপ নেই।
ধ্রুব গম্ভীরমুখে বললো, “গতকাল যে আর্থিক অবস্থার বিবরণী করতে দিয়েছিলাম আগে ওটা দেখাও।”
ধ্রুবর ছাত্রীর নাম নিশা।নিশা খাতা বের করে বললো, “স্যার, আমার দিকে তাকান।”
ধ্রুব খাতার দিকে তাকিয়ে বললো, “তোমার দিকে তাকানোর কি আছে?তোমার দিকে তাকিয়ে থাকার জন্য তো আমাকে মাস শেষে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয় না।টাকা দেওয়া হয় তোমার লেখাপড়ার দিকে তাকানোর জন্য।তাই,নিজের সাজগোজ বন্ধ করে মন দিয়ে নিজের মেধাকে সাজাও।পড়ালেখায় মন দাও।”
নিশা ফিসফিস করে বললো, “মন তো স্যার আমার কাছে থাকে না।আপনার কাছে থাকে।”
ধ্রুব শুনতে পেলো কথাটা। কিন্তু জবাব দিলো না। না শোনার ভান করে রইলো। নিশা আবারও বললো,”আমার দিকে তাকালে আজকে আপনি একটা মজার জিনিস দেখতে পাবেন।আজকে আমাকে অন্যরকম লাগছে সেটা দেখতে পাবেন।”
ধ্রুব না তাকিয়ে বললো, “কেনো,তোমার কি আজকে মাথায় শিং গজিয়েছে নাকি?বাজে কথা বন্ধ করো।তোমার অংক মিলে নি।কোনটা কোথায় বসবে তুমি সেটাই এখনো বুঝতে পারছো না।আয়,ব্যয় সব গুলিয়ে ফেলেছ।”
নিশা করুণ সুরে বললো, “আমার মাথাটাই তো গুলিয়ে গেছে স্যার।অংক মিলবে কিভাবে?”
ধ্রুব আবারও খাতায় আর্থিক অবস্থার বিবরণীর ঘর আকলো।তারপর নিশার দিকে খাতা এগিয়ে দিয়ে বললো, “শুরু করো আবার। যেই এন্ট্রি বুঝবে না আমাকে জিজ্ঞেস করবে।”
নিশা ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে বললো, “আগে এটা বুঝান কিভাবে কারো মনে এন্ট্রি নেওয়া যায়?”
ধ্রুব ভীষণ রাগ হলো। ধমকে বললো, “ফাজলামি করতে বসেছ তুমি?আমাকে জোকার মনে হয় তোমার? নাকি তামাশা করতে ভালো লাগছে?নেক্সট টাইম যদি তোমার এরকম ব্যবহার দেখি তবে আমি তোমার আম্মুকে বলে যাবো আমার পক্ষে তোমাকে পড়ানো সম্ভব না। অন্য টিচার রাখতে।বেয়াদব স্টুডেন্ট আমার চাই না।”
নিশার কলিজায়ভাবে লাগলো ধ্রুবর এই কথাগুলো। ধ্রুব কেনো বুঝতে পারছে না নিশা তাকে ভালোবাসে!শুধুমাত্র ধ্রুবর জন্যই তো নিশা পড়ানোর টাইম হবার আগেই টেবিলে এসে বসে থাকে।নিজেকে সাজিয়ে গুজিয়ে রাখে।আর ধ্রুব কি-না নিশার থেকে নিস্তার পেতে নিজেকে বিবাহিত বলে দাবি করছে?
নিশা ভেবে পায় না সে দেখতে কি এতোই খারাপ!
নিশাকে অংক করতে দিয়ে ধ্রুব শালুককে কল দিলো। শালুক তখন বাংলা দ্বিতীয় পত্র বই নিয়ে বসেছে।ধ্রুবর কল পেয়ে অবাক হলো। এই সময়ে ধ্রুব তো কখনো কল দেয় না।আজ কি হলো হঠাৎ!
তড়িঘড়ি করে শালুক কল রিসিভ করলো। ধ্রুব যথাসম্ভব মধুর স্বরে বললো, “কি করছো?খেয়েছ তুমি? ”
শালুক জবাব দিলো পড়া শেষ করে খাবে তারপর জিজ্ঞেস করলো, “এই সময় তো কল দেন না।আজকে হঠাৎ কি হলো?”
ধ্রুব নিশাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো, “এই সময় তো আমার বউটা আমার কাছে থাকতো বাসায়।তাই কল দিতাম না।কারণ বাসায় গেলে তোমাকে দেখবো।আজকে তো তুমি নেই,তাই খুব মিস করছিলাম।এজন্য কল দিয়েছি।আজ তো বাসায় গেলে দেখবো বাসা ফাঁকা।”
শালুকের কেমন যেনো ভালো লাগলো ধ্রুবর এই কথাগুলো। কেমন হৃদয় প্রশান্ত করে দিচ্ছিলো। ধ্রুব কল রেখে দিলো।নিশা কান পেতে শুনলো সবটা।তবুও ওর বিশ্বাস হলো না। নিশার মনে হলো এই সব ধ্রুবর প্ল্যান।কাউকে আগেই বলে রেখেছিলো হয়তো। তাই নিশাকে সরানোর জন্য এরকম করছে ধ্রুব।
চুপচাপ নিশা অংক করে গেলো। ধ্রুবকে একটা এন্ট্রি ও জিজ্ঞেস করলো না।
অংক দেখতে গিয়ে ধ্রুব টের পেলো নিশা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আর মজার ব্যাপার হলো, অংক এবার ঠিকঠাক মিলে গেছে।
ধ্রুব ভেবে পেলো না নিশার এই কান্নার কারণ কি।তবে এটুকু বুঝতে পারলো এই টিউশনি ছেড়ে দতে হবে খুব শীঘ্রই। এসব কেলেংকারীতে ধ্রুব কিছুতেই জড়াতে চায় না।আর এই ষোড়শীকে বুঝানোর সাধ্য তার নেই।
নিজের বউয়ের চিন্তা করবে না কি অন্য মেয়েকে নিয়ে ভাববে সে।
বাকি সময়ে ধ্রুব আরো দুটো অংক করালো।নিশা একটা কথা ও বললো না ধ্রুবর সাথে। নিশা ভেবেছিলো ধ্রুব একটা বার হলেও জিজ্ঞেস করবে নিশাকে কেনো চুপ করে আছে।
কিন্তু নিশার ভাবনা ভুল করে দিয়ে ধ্রুব ও প্রশ্ন করে নি।সময় শেষ হতেই ধ্রুব উঠে চলে গেলো।
পড়ার টেবিলেই নিশা কান্নায় ভেঙে পড়লো। নাকের জল,চোখের জল একাকার হয়ে গেলো নিশার।
বাবা মায়ের একমাত্র আদরের মেয়ে নিশা।যা চেয়েছে তাই পেয়েছে।এজন্য সব কিছুতে জিতে যাওয়ার একটা মানসিকতা নিশার মধ্যে প্রবল। সব সময় আত্মীয় স্বজন, কাজিনদের মধ্যে ফার্স্ট প্রায়োরিটি নিশার।কেননা নিশার বাবা অনেক টাকার মালিক।তার একমাত্র উত্তরাধীকারি নিশা।
তার উপর নিশা বেশ সুন্দরী। সবদিক মিলিয়ে সবখানে নিশা দেখেছে সবাই তাকে খুব প্রাধান্য দেয়।
কিন্তু এই একটা জায়গায়, একজন মানুষের কাছে নিশা হেরে যাবে তা নিশার ভাবনাতে ছিলো না কখনো।
ক্লাস সেভেন থেকে বেশ কয়েকজন প্রাইভেট টিচার চেঞ্জ করেছে নিশা।পড়াতে পড়াতে সবাই নিশাকে ভালোবেসে ফেলতো।এর থেকে নিশার মধ্যে এক ধরনের অহংবোধ জন্ম নিলো।
সে ভেবেই নিলো এরকমটাই হতে হবে।কিন্তু ধ্রুব অন্যদের চাইতে অন্যরকম হওয়ায় নিশার মনে জায়গা করে নিয়েছে।
স্বপ্নের পুরুষ হিসেবে নিশা যেমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ, মেধাবী,শ্যামলা,লম্বা ছেলে পছন্দ করে ধ্রুবর মধ্যে তার সবটাই আছে।
নিশা কিছুতেই ধ্রুবর নেশা থেকে নিজেকে বের করে আনতে পারছে না।
উল্টো ধ্রুবর এই কাটখোট্টা ব্যবহারে নিশা আরো প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। অথচ এই মানুষটা কিছুতেই বুঝতে চায় না ওকে।
ধ্রুব বাসায় ফিরে সটান হয়ে শুয়ে পড়লো। আজ আর রান্না করতে ইচ্ছে করে না।একা একা খেতে ইচ্ছে করে না। পুরো বাসা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। একটা মানুষের অনুপস্থিতে এই বাসাটা ও বুঝে গেছে। ধ্রুবর বুকের ভেতর ভীষণ জ্বালাপোড়া অনুভূতি টের পাচ্ছে ধ্রুব।
কেনো এতো অন্তর পুড়ে যাচ্ছে?
কেনো শালুক এভাবে হৃদয়ে আসন গেড়ে বসেছে।আজ যে শালুক কাছে নেই অথচ ধ্রুব এই সামান্য বিরহ সহ্য করতে পারছে না।
শালুক পড়া শেষ করে খেতে গেলো। আদনান অপেক্ষা করে ছিলো কখন শালুক খেতে যাবে।শালুক খেতে বসে দু লোকমা খেয়েছে সেই সময় আদনান গেলো ভাত খেতে। মা’কে ডেকে ভাত দিতে বললো।
শালুক বুঝতে পারলো আদনান ইচ্ছে করে এই সময় এসেছে।ভাতের প্লেট নিয়ে শালুক দাদার রুমে চলে গেলো।
আদনান বুক ভরা ব্যথা নিয়ে তাকিয়ে রইলো। শালুক কেমন করে তাকে ইগনোর করে যাচ্ছে। এতো ভাব কিভসবে হলো শালুকের?
না-কি ধ্রুবর সাথে থাকতে থাকতে শালুক ও এরকম হয়ে গেছে।
খাওয়ার পর দাদীর রুমে বসে সবাই মিকে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করলো।
রাতে শালুক ঠিক করলো আজকে নিজের রুমে ঘুমাবে। ধ্রুব কি কি রেখেছে ব্যাগে এসব দেখবে।
রুমে গিয়ে শালুক ধ্রুবকে কল দিলো। ধ্রুব ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। গতরাত জার্নি শেষ করে বাসায় এসে দু ঘন্টা ও ঘুমাতে পারে নি।বের হয়ে যেতে হয়েছিলো জীবিকার তাগিদে। সারাদিন খাটাখাটুনি শেষে আজ বিছানায় পিঠ দিয়ে শালুককে ভাবতে ভাবতেই ধ্রুব ঘুমিয়ে পড়লো।
শালুক যখন ধ্রুবকে কল দিয়েছে তখন রাত ১২.১৫ মিনিট।
শালুক ফোন রেখে দিয়ে সবেমাত্র ব্যাগ খুলেছে এই সময় দরজায় টোকা পড়লো। শাপলা ভেবে শালুক দরজা খুলতেই দেখলো আদনান দাঁড়িয়ে আছে। শালুককে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আদনান মুখ চেপে ধরে দরজা বন্ধ করে দিলো।
চলবে……